#হৃদয়_রেখেছি_জমা
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ২
উজবেকিস্তানের রাজধানী তাসখন্দের একটা বিলাসবহুল পাঁচতারা হোটেলে অবস্থান করছে এন এস আই এর চার সদস্য। তাদের জন্য বুকিং করে রাখা হোটেলে উঠেনি কেউই। প্ল্যান অনুযায়ী অন্য একটা হোটেলে উঠেছে।
বহুতল ভবনবিশিষ্ট এই হোটেলটির লবিতে বসে আছে মাহমুদ, এনা এবং সোহাগ। একটু আগেই ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমেছে তিনজন। সবার আগে এসেছে সোহাগ। তারপর মাহমুদ। তারপর এনা। মেহরিন এখনো নিচে নামে নি। তারজন্য অপেক্ষা করতে করতে আলোচনা শুরু করে দিলো বাকি তিন জন।
ডিনারে কে কি খাবে সেই নিয়ে আলোচনা! প্রায় ঘন্টাখানেক বাদে ফ্রেশ হয়ে নিচে নামলো মেহরিন। তাঁর পরনে হালকা আকাশি রংয়ের একটা ফতুয়া আর ব্ল্যাক জিন্স। ভেজা চুলগুলো এলোমেলো কাধের ওপর ছেড়ে দিয়েছে। বামহাতে দামী রিস্টওয়াচ। বেশ স্নিগ্ধ লাগছে দেখতে। তাঁকে দেখে আলোচনা থামিয়ে দিলো মাহমুদ। বাকি দুজনকে উদ্দেশ্য করে ভাষণ দেওয়ার ভঙ্গিতে বললো,’ঐ যে এনএস আই এর উজ্জ্বল নক্ষত্র মেহরিন শারাফাত সিঁড়ি দিয়ে নামছেন। মাত্র একঘন্টা তিনমিনিটে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়েছেন তিনি।’
তাঁর বলার ঢংয়ে হেসে ফেললো এনা। কৃত্রিম শাসনের ভঙ্গিতে বললো,’ব্যাড ম্যানার্স! জানো না মেয়েদের ফ্রেশ হতে টাইম লাগে।’ সোহাগও হাসলো তবে সেটা মাহমুদকে উদ্দেশ্য করে নয়। মেহরিনকে স্বাগতম জানানোর জন্যে। তাঁর পাশে সিঙ্গেল সোফায় বসলো মেহরিন। জ্বলজ্বল চোখে একবার মাহমুদের দিকে তাকিয়ে ডিনার অর্ডার করলো। তিনটে ভেজিটেবল রাইস, একটা থাইস্যুপ আর গ্রিল্ড চিকেন দিয়ে ডিনার শেষ করলো তাঁরা। ডেজার্ট হিসেবে মাহমুদ এবং এনা আইসক্রিম নিলেও বাকি দুজন সাফ মানা করে দিলো। তারপর শুরু হলো মিশন নিয়ে আলোচনা।
বেশ কিছুদিন আগের ঘটনা, বাংলাদেশে সফর করতে আসা ভিয়েতনামের পররাষ্ট্র মন্ত্রীর ওপর হামলার পরিকল্পনা চালায় বাংলাদেশের কুখ্যাত একটি মাফিসা গ্যাং। যদিও কড়া নিরাপত্তার কারণে তাদের চেষ্টা সফল হয় নি তবে গোপন সূত্রে জানা গেছে, আবারো হামলার পরিকল্পনা করছে দলটি। এবং হামলার সমস্ত পরিকল্পনা তাসখন্দ থেকে আনুমানিক সত্তর কিলোমিটার দূরবর্তী আলমালেক শহরে চলছে। কিন্তু কবে, কখন, কোথায় তাঁরা হামলা করবে সে ব্যপারে এখনো কিছু জানা যায় নি।
★
আলোচনা প্রায় শেষ। সবার বক্তব্য শেষে পুরো প্ল্যানটা আরেকবার ব্রিফ দিচ্ছে মেহরিন। মাহমুদের সেদিকে মন নেই। তাঁর দৃষ্টি সামনের দিকে। বিশাল রিসেপশন এরিয়ে পেরিয়ে একপাশে গান বাজনার পশরা চলছে। অন্যপাশে গ্যাম্বলিংয়ের আসর। ওয়েস্টার্ন ড্রেস পরিহিতা উঠতি বয়সী কিছু তরুনী গানের তালে তালে নৃত্য করছে। আনমনে সেদিকেই তাকিয়েছিলো সে। বস্তুত আগামী কালকের প্ল্যান নিয়ে ইরফান আহমেদের সঙ্গে তাঁর কিছু জরুরি ডিসকাশন আছে । সে ব্যপারেই ভাবছিলো সে। রুমে গিয়ে ইরফান সাহেবকে মেইল পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলো।
এদিকে তাঁর দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনে চাইলো মেহরিন। মুহূর্তেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। এত গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা রেখে মাহমুদ মেয়েদের নাচ দেখছে? নাহ! আর সহ্য করা যাচ্ছে না। হাতের ফোনটা শব্দ করে সেন্টার টেবিলের ওপর রেখে গম্ভীর কন্ঠে বললো,’নজর হটানো গেলে আলোচনাটা ঠিকভাবে করা যেত।’
ধ্যান ভাঙ্গলো মাহমুদের! মুচকি হেসে মেহরিনের দিকে চাইলো সে। আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠে দাঁড়ালো। তাঁর সামনে দিয়েই ট্রে-ভর্তি রেড ওয়াইন নিয়ে যাচ্ছিলো অল্পবয়স্ক এক তরুণ ওয়েটার। তাঁকে ডেকে পরপর দুটো পেগ গলাধঃকরণ করলো মাহমুদ। তিন নাম্বারটা হাতে নিয়েই একেবারে তরুনীদের মাঝখানে চলে গেলো। তাদের সাথে তাল মিলিয়ে ডান্স মুভ দেওয়ার চেষ্টা করলো। প্রথমে যদি খানিকটা অসুবিধে হলো কিন্তু ধীরে ধীরে তাল মিলতে শুরু করলো। মেহরিন তীক্ষ্ণ চোখে সেদিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে চোখ সরিয়ে নিলো। রাগে তাঁর সমস্ত শরীর জ্বলছে।
হাতের ম্যাগাজিনটা রেখে এনাও উঠে দাঁড়ালো। দ্রুত পায়ে মাহমুদের দিকে এগিয়ে গেলো। তাকে দেখে হাসিমুখে হাত বাড়ালো মাহমুদ।
সোহাগ সেদিকে একঝলক তাকিয়ে মেহরিনকে উদ্দেশ্য করে বললো,’বসের ঠিক কি প্ল্যান, তুমি কি কিছু জানো?’
-‘না।’ গম্ভীর গলায় জবাব দিলো মেহরিন। তাঁর প্রচুর রাগ লাগছে। ইরফান সাহেবকে যদি একবার এদের কাণ্ডকারখানাটা দেখাতে পারতো সে! যেন ফুর্তি করতে এসেছে ওরা।
-‘মাহমুদ ভাইকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। উনিও জানেন না।’
-‘কি জানি।’, নিরাসক্ত কন্ঠে জবাব দিলো মেহরিন। সোহাগের এসব উটকো কথাবার্তা ত্যক্ত লাগছে তাঁর।
আলোচনা বিশেষ জমলো না। চুপ করে রইলো সোহাগ। মেহরিন চারপাশে চোখ বুলিয়ে একটা ম্যাগাজিন তুলে নিয়ে পড়তে শুরু করলো। মিনিট দশেক বাদে ফিরে এলো মাহমুদ। পরনের শার্টটা ঘামে ভিজে চুবচুবে। ধপ করে সোফায় বসে পড়ে শার্টের প্রথম দুটো বোতাম খুলে দিলো সে। ঘাড়ের কাছে খানিকটা নামিয়ে দিলো কলারটা। টিস্যু দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বললো,’এদের মিউজিক চয়েস খুব ভালো। নাচের জন্য একদম পার্ফেক্ট!’
চাপা রাগে মুখ ফিরিয়ে নিলো মেহরিন। মাহমুদকে উপেক্ষা করে সমস্ত মনোযোগ ম্যাগাজিনের দিকে দেওয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু না! না চাইতেও দৃষ্টি বারবার মাহমুদের দিকে চলে গেলো। এনা এসে একেবারে তাঁর ঘা ঘেঁষে বসেছে। মিষ্টি হেসে মেহরিনকে উদ্দেশ্য করে বললো,’মাহমুদ বলছিলো আপনি নাকি খুব ভালো ডান্স করতে পারেন। আমাদের সঙ্গে জয়েন করলেন না কেন আপু?’
-‘ইট’স ওকে। আমি ঠিক আছি।’, থমথমে গলায় জবাব দিলো সে।
মাহমুদ সরাসরি তাঁর মুখের দিকে চাইলো। চোখাচোখি হতেই মুখ দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো মেহরিন। হাই তুললো। প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছে তাঁর। সারাদিনের জার্নিতে শরীর ভীষণ ক্লান্ত। উঠে দাঁড়ালো সে। সোহাগকে উদ্দেশ্য করে বললো,’আমি রুমে যাচ্ছি।’
জবাবে সোহাগ কিছু বলার আগেই মাহমুদ তড়িঘড়ি করে বললো,’আমি আর এনা রুম নম্বর থ্রি-সিক্সটি ফাইভে থাকবো। তোমাদের কোন অসুবিধে নেই তো?’
থমকে গেলো মেহরিন। একঘরে থাকবে মানে? লজ্জা শরমের কি মাথা খেয়েছে মাহমুদ? রাগে মুখ লাল হয়ে গেলো তাঁর। একটা মানুষ কি করে এতটা ডেস্পারেট হতে পারে? ক্রুর দৃষ্টিতে মাহমুদের দিকে চাইলো সে। ক্ষ্যাপা কন্ঠে ডাক দিলো,’মি.মাহমুদ?’
-‘ইয়েস, মিস মেহরিন?’, নড়েচড়ে বসলো মাহমুদ। মুখে মিটিমিটি হাসি। রেগে গেলে মেহরিনের প্রফেশনালিজম মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। তখন মাহমুদ হয়ে যায়, মি. মাহমুদ।
-‘আপনি বোধহয় ভুলে যাচ্ছেন আমরা মিশনে এসেছি, হানিমুন পালন করতে নয়!’
-‘আমি মোটেও ভুলি নি মিস মেহরিন। আমার স্মরণ শক্তি একদম ঠিক আছে।,
-‘তাহলে?’
-‘তাহলে আর কি? আপনি বোধহয় বসের নির্দেশের কথা ভুলে গেছেন।’
-‘বেশ আপনিই তবে স্মরণ করিয়ে দিন?’
-‘হোয়াই নট? আমাদের এখানে উঠার একটাই উদ্দেশ্য শত্রুপক্ষের নজর এড়ানো। যতদিন না মুখোমুখি হামলার নির্দেশ দেওয়া হয় ততদিন পুরোপুরি ছদ্মবেশে থাকতে হবে আমাদেরকে। উই হ্যাভ টু বি ইন ডিজগাইস!’
বিব্রত হলো মেহরিন। রাগের চোটে এই কথাটা মাথা থেকে একদম বেরিয়ে গেছিলো তাঁর। ইরফান আহমেদের সঙ্গে পরামর্শ করেই স্বামী স্ত্রীর পরিচয়ে কামরা বুক করেছে তাঁরা। তখন অবশ্য বুঝতে পারে নি রাতেও একঘরে থাকতে হবে সোহাগের সঙ্গে। অস্বস্তি বোধ করলো সে। যদিও প্রফেশনের দিক থেকে ইট’স অল অফ দেয়ার ডিউটি বাট মেয়েলি ইনস্টিংক্ট বলে তো একটা ব্যপার আছে? যতই সহকর্মী হোক, একা এক ঘরে সোহাগের সঙ্গে থাকার ব্যপারটা স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারলো না সে।
মাহমুদ সেটা বুঝতে পেরে বললো,’দুটো কামরাই ডাবল বেডের! দুজন ইজিলি ম্যানেজ করা যাবে!’
চোখ জোড়া জ্বলে উঠলো মেহরিনের। এরমানে ‘আর একটা কথাও বলবে না তুমি।’ সে রেগে আছে বুঝতে পেরে মাহমুদকে ভয়ে আর কিছু বললো না ঠিকই কিন্তু এনাকে বগলদাবা করে উপরে চলে গেলো।
সোহাগ গম্ভীর মুখে বললো,’আমি ভেবেছিলাম এনা অন্তত আপত্তি করবে।’
-‘বাচ্চা মেয়েটার ব্রেইনওয়াশ করে দিয়েছে। দেখছো না কেমন মাহমুদ, মাহমুদ করে মুখে ফেনা তুলছে?’
সোহাগ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,’কি আর করা। আফটার অল, উই আর প্রফেশনাল। আমাদেরকে সব রকম পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবে।’
মেহরিন প্রতিউত্তর করলো না। তাঁর ভেতরটা জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। একটা মানুষ কি করে এত বদলে যেতে পারে? সোহাগ ব্যস্তভাবে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,’তুমি রুমে যাও। আমি একটা ফোন সেরে আসছি।’
★
ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো মেহরিন। ঘুমে তাঁর চোখ ঢুলুঢুলু। সোহাগ এখনো আসে নি। দরজায় নকের আওয়াজ পেয়ে উঠে দাঁড়ালো সে।দরজার বাইরে এনা দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখে হাসিমুখে বললো,’ঘুমিয়ে পড়েছিলেন?’
ভ্রুজোড়া আপনা আপনি কুঁচকে গেলো মেহরিনের। মাহমুদের ওপর রাগ ঝাড়তে না পেরে অলরেডি মেজাজ প্রচুর খারাপ হয়ে আছে তাঁর। তারওপর এনাকে দেখে আরো বেশি বিরক্ত হলো। বিরক্তি চেপে যথাসম্ভব শান্ত কন্ঠে প্রশ্ন করলো,’তুমি?’
প্রতিউত্তরে এনা আবারো মুচকি হেসে বললো,’আমি এখানে ঘুমাবো। মাহমুদ আপনার সঙ্গে দুষ্টুমি করেছে।’
মেহরিন হতভম্ভ! মানে কি? এটা কি মজা করার মতন কোন বিষয়? মাহমুদ শুরু করেছে টা কি?
রাগে তাঁর গা জ্বলে উঠলো! বারবার তাঁকে বিভ্রান্তিতে ফেলে কি প্রমাণ করতে চাইছে মাহমুদ? প্রতিশোধ নিচ্ছে মেহরিনের ওপর? এনার ডাকে ধ্যান ভাঙলো। ভেতরে ঢুকে খাটের ওপর আরাম করে বসেছে সে। মেহরিন চুপ থাকতে দেখে কৈফিয়ত দেওয়ার মতন করে বললো,’আপনি বোধহয় শুয়ে পড়েছিলেন তাই না। আসলে আরো আগেই আসার কথা ছিলো। কিন্তু বস হঠাৎ ভিডিও কল দিয়ে বসলেন তাই দেরী হয়ে গেছে।’
এতক্ষণ যাবত মাহমুদের সঙ্গে বসে থেকে তাঁর এবং ইরফান আহমেদের কথাবার্তাই শুনে এসেছে এনা। পুরোটা অবশ্য শুনতে পারে নি কথার মাঝখানে উঠে বারান্দায় চলে গেছে মাহমুদ। কিন্তু যেটুকু শুনেছে তাতে মনে হলো এখানকার কিছু স্থানীয় এজেন্টও সহযোগীতায় থাকবে তাদের। মেহরিনকে সেটা জানানোর জন্যই প্রসঙ্গটা তুলেছিলো সে। ভেবেছিলো মেহরিন জিজ্ঞেস করবে কি কথা হয়েছে ওদের মধ্যে। কিন্তু মেহরিন কোনরূপ আগ্রহ প্রকাশ করলো না। উলটো হাই তুলে বললো,’তুমি যদি কিছু মনে না করো, তাহলে আমি এখন ঘুমাতে চাই এনা। প্রচুর ঘুম পাচ্ছে আমার। এসব নিয়ে আমরা সকালে আলোচনা করবো।’ এনা মাথা দুলিয়ে সায় জানালো। শুয়ে পড়লো মেহরিন। যদিও তাঁর ঘুম আসছে না। মাথায় অন্য চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। মাহমুদের সঙ্গে আর্জেন্ট কথা বলা দরকার। আজকে সে যা করেছে সেটা সোহাগ এবং মেহরিন দুজনের জন্যই খুবই বিব্রতকর ছিলো। কড়া করে কিছু কথা শুনিয়ে দেওয়া দরকার মাহমুদকে।
অথচ সে জানে না, শুধুমাত্র তাঁর জন্যই ইরফান আহমেদের নির্দেশ অমান্য করে এনাকে এই ঘরে পাঠিয়েছে মাহমুদ। ইরফান আহমেদ বারবার করে বলে দিয়েছিলেন ‘শত্রুপক্ষের গুপ্তচর যে কোন জায়গায় থাকতে পারে। তোমরা সাবধানে থেকো। কেউ যেন বুঝতে না পারে তোমরা টুরিস্ট নও।’
.
.
.
চলবে