হৈমন্তীকা
১২.
ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পরছে বাহিরে। বাতাসের তীব্র তান্ডবে তীর্যকভাবে বৃষ্টির এক একেকটা ফোঁটা গায়ে লাগছে। নিস্তব্ধ, নির্জন রাস্তার মধ্যিখানে হাঁটছে তুষার। রাত আনুমানিক ন’টা হবে। বাসায় যেতে ইচ্ছে করছে না তার। আবার না যেয়েও উপায় নেই। ধীর স্থির ভাবে হাঁটতে থাকা পায়ের গতি আরও কমিয়ে দিলো সে। আরও ধীরে হাঁটতে লাগলো। শার্টের কাঁধের অংশটা ভিঁজে গেছে ইতিমধ্যে। একটু পরে সে নিজেই কাকভেঁজা হয়ে যাবে। রাস্তার এক লোক সেদিক দিয়ে যাচ্ছিল। তুষারের এহেন উদাসীন ভাব দেখে তাড়া দিয়ে বললো,
— “এত আস্তে হাঁটছেন কেন ভাই? বৃষ্টি আরও বাড়বে। তাড়াতাড়ি পা চালান।”
লোকটির কথায় কোনোরূপ ভাবান্তর ঘটলো না তার। সে আগের ন্যায়ই নিশ্চুপ। একমনে হেঁটে চলছে সামনের পথে।
আরেকটু পথ অতিক্রম করতেই লোকালয়ের কাছাকাছি চলে এলো তুষার। রাস্তার পাশে এক বৃদ্ধা প্রতিদিন চুড়ি বেচাকেনা করেন। আজ বৃষ্টি হওয়ায় চুড়িগুলো একটা থলের ভেতর ঢুকিয়ে রাখছিলেন তিনি। সেদিকে তাকিয়ে আপনা-আপনি থেমে গেল তুষারের পা। রঙ-বেরঙের চুড়িগুলোর দিকে চেয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো সে। কল্পনা করলো, একদিন তার দেওয়া চুড়ি, শাড়ি পড়ে হৈমন্তী তার কাছে আসবে। তাকে দেখেই লজ্জা পেয়ে কপালে পরে থাকা চুলগুলো কানে গুঁজে নিবে। কাঁচের চুড়িগুলো একটার সঙ্গে একটা বারি খেয়ে টুংটাং শব্দ করবে তখন। তুষার মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবে তা।
ভাবতেই ঠোঁটে ক্ষীণ হাসির রেখা ফুটে উঠল তার। পরক্ষণেই কি ভেবে হাসিটা মিলিয়ে গেল। এর বদলে বেরিয়ে এলো কয়েকটি দীর্ঘশ্বাস।
বৃদ্ধার কাছে এগিয়ে গেল তুষার। পায়ের পাতায় ভর দিয়ে হাঁটু ভেঙ্গে বসলো। অতঃপর চুড়ি দেখতে লাগলো। বৃদ্ধা তখন ব্যস্ত হয়ে বললেন,
— “কইনগুলা নিবা বাজান? তাত্তাড়ি কও। বৃষ্টি আইছে। বাসায় যামু।”
তুষার হালকা হাসার চেষ্টা করলো। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বললো,
— “নীল চুড়িগুলো দিন তো দাদী।”
দাদী বলায় বৃদ্ধা খুশি হলেন যেন। মুখ ভরে হাসলেন। ডাজনখানেক চুড়ি একটা পলিথিনে করে তুষারকে দিলেন। এক হাতে চুড়ির থলে নিয়ে অন্যহাতে পকেট হাতড়ে মানিব্যাগ বের করল তুষার। বললো,
— “কত টাকা দাদী?”
— “তিরিশ।”
তুষার ত্রিশ টাকা দিলো না। বরং পঞ্চাশ টাকা ধরিয়ে দিলো বৃদ্ধাকে। বৃদ্ধা প্রথমে নিতে চাইলেন না। জোড় করতেই বললেন,
— “চুড়িগুন কি তোমার বউর লাইগা নিতাছো বাজান?”
তুষার মলিন হাসলো। জবাব দিলো,
— “না, প্রেয়সীর জন্য।”
_____
তুষার বাসায় ফিরলো রাত ১টা ৫৬ মিনিটে। ড্রইংরুমের সোফায় আফতাব সাহেব থমথমে মুখ নিয়ে বসে ছিলেন। সে ভেতরে ঢুকতেই বাজখাঁই গলায় ধমক দিয়ে উঠলেন,
— “কয়টা বাজে তুষার? এখন বাসায় আসার সময় হলো তোমার? কোথায় ছিলে এতক্ষণ?”
তুষার দাঁড়ালো। স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো,
— “বাহিরে ছিলাম।”
— “বাহিরে কোথায়? দিন দিন তুমি কিন্তু মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছ তুষার। এতরাত পর্যন্ত বাহিরে কি কাজ তোমার? আসলে কি জানো, দোষ তোমার না। ওই মেয়েটার। ওই মেয়ে তোমার জীবনে আসার পর থেকেই তুমি এমন পাগলাটে ধরণের হয়ে গেছ। কি করো, না করো, সেটা কি তুমি নিজে জানো? তোমার মাথাটা একেবারে খেয়ে ফেলেছে মেয়েটা।”
তুষার এতক্ষণ শান্ত থাকলেও এবার খানিকটা রেগে গেল যেন। বিরক্ত সহিত বললো,
— “এখানে ওর কথা আসছে কোত্থেকে? যা করছি আমি নিজ ইচ্ছেতেই করছি। সব বিষয়ে ওকে টানবে না বাবা।”
আফতাব সাহেব বড় বড় চোখে তাকালেন। ঝাঁঝালো কণ্ঠে হেনার উদ্দেশ্যে বললেন,
— “দেখেছো তোমার ছেলেকে, হেনা? পরের মেয়ের জন্য কি দরদ উতলে পরছে! নিজের বাবার সঙ্গে এভাবে কথা বলতেও মুখে বাধছে না ওর।”
হেনা করুণ চোখে ছেলের দিকে তাকালেন। এ বিষয়ে কোনোরূপ উত্তর দিলেন না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন স্বামীর পাশে। তুষার একবার নিজ মাকে দেখছে তো একবার বাবাকে। ভীষণ বিরক্তি লাগছে তার। মনে হচ্ছে, আশেপাশে কোনো সিরিয়ালের নাটক চলছে। ঘুম পাচ্ছে বড্ড। আর কোনো জবাব দিলো না তুষার। সবকিছু সূক্ষ্ণ ভাবে অগ্রাহ্য করে চলে গেল নিজের রুমে। আফতাব সাহেব কিন্তু তখনো থামেন নি। উঁচু গলায় অনবরত বকে যাচ্ছেন তাকে।
তুষার ফ্রেশ হয়েই বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। টেবিলে রাখা চুড়িগুলোর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে, কি ভেবে ফোন হাতে নিলো। অতঃপর হৈমন্তীর নম্বরে মেসেজ টাইপ করলো, “কাল শাড়ি পরে আসবেন হৈমন্তীকা?”
পরক্ষণেই হাতের কঠিন চাপে লিখাটা আবারো কেটে দিলো সে।
_____
রবিবার।
আজ রোদের তাপটা একটু বেশিই। সূর্য যেন তার সহস্র ক্রোধ ঢালছে পৃথিবীতে। মানুষসহ কাকপক্ষীরও গরমে আজ বেহাল অবস্থা। বাসে বসে থাকা হৈমন্তী বাম হাতের পিঠে কপালের ঘাম মুছে নিলো। শহরের রিকশা চালকদের আজ কি হয়েছে কে জানে! আধঘণ্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকেও একটা রিকশা পায় নি সে। বাধ্য হয়ে বাসে উঠতে হয়েছে তার। ভেবেছিল, জানালার পাশে বসলে হয়তো একটু হলেও বাতাসের ছোঁয়া গায়ে লাগবে। কিন্তু কই? গরমে যেন শরীর থেকেই তাপ বের হচ্ছে!
হৈমন্তী ক্লান্ত নিশ্বাস ফেলল। বাস থেমেছে। কনডাক্টর যাত্রী নিচ্ছে। সেদিকে চেয়ে হৈমন্তী আবারো জানালা গলিয়ে বাহিরে তাকাতেই হঠাৎ কোত্থেকে তুষার এসে বসে পরল তার পাশে। কোনো কিছু না বলেই হৈমন্তীর ওড়না দিয়ে নিজের ঘর্মাক্ত ললাট মুছতে মুছতে আওড়ালো,
— “কি ভীষণ গরম পরেছে, তাই না হৈমন্তীকা?”
হৈমন্তী চমকালো, ভড়কালো, তাজ্জব বনে গেল। বিস্ফোরিত নয়নে চেয়ে আশ্চর্য কণ্ঠে বললো,
— “আপনি এখানে?”
তুষার বিস্তর হাসলো। প্রশ্নের জবাব না দিয়ে উলটো জিজ্ঞেস করলো,
— “পানি হবে আপনার কাছে?”
হৈমন্তীর হাতেই পানির বোতল ছিল। সেটা তুষারকে দিতেই সে আগের মতোই মুখ লাগিয়ে পান করলো তা। এরপর পানির বোতল ফেরত দিয়ে অনুমতি চেয়ে বললো,
— “আপনার হাতটা একটু দিন তো হৈমন্তীকা।”
তুষার কি অনুমতি চাইলো তার কাছে? নাকি আদেশ করলো? ঠিক আন্দাজ করতে পারলো না হৈমন্তী। জোড়ালো গলায় প্রশ্ন ছুড়লো, “কেন?”
তুষার এবারো প্রশ্নের জবাব দিলো না। নিজেই টেনে নিলো হৈমন্তীর হাতজোড়া। কোলে রাখা পেকেট থেকে একটা একটা করে চুড়ি বের করে পরিয়ে দিতে লাগলো তার দু’হাতে। হৈমন্তী কেন যেন বাঁধা দিতে পারলো না। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলো ক্ষীণ লাজুক নয়নে।
চুড়ি পড়ানো শেষ হতেই হৈমন্তীর হাত টেনে উঠে দাঁড়ালো তুষার। হৈমন্তী জিজ্ঞাসু চোখে তাকালো। ঠোঁটের কোণে দূর্বোধ্য হাসি ফুটিয়ে তুষার আওড়ালো,
— “চলুন হৈমন্তীকা। বাইকে করে আজ সারা শহর ঘুড়বো।”
__________________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা