হৈমন্তীকা
১৪.
বাবার ডাকে থমকে দাঁড়ালো হৈমন্তী। জবাব নিলো,
— “জি, বাবা।”
আসরাফ সাহেবের মুখ মলিন, গাম্ভীর্যপূর্ণ। হৈমন্তীর দিকে একবারও তাকাচ্ছেন না তিনি। বরং ওভাবেই বললেন,
— “নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সব গুছিয়ে রাখ। নতুন বাসা পেলেই এ ফ্ল্যাট ছেড়ে দেব আমরা।”
— “হঠাৎ… কেন বাবা?”
হৈমন্তীর কপালে ভাঁজ পরলো। বিমূঢ় হয়ে জিজ্ঞেস করলো সে। অথচ আসরাফ সাহেব কোনোরূপ উত্তর দিলেন না। তাকে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে। ঘনঘন শ্বাস নিচ্ছেন তিনি। হৈমন্তীও আর পালটা প্রশ্ন করলো না। নিরবে প্রস্থান করতে নিলেই আসরাফ সাহেব সরব জিজ্ঞেস করে উঠলেন,
— “তোর কি তুষারের সঙ্গে সম্পর্ক আছে হৈমন্তী?”
হৈমন্তী ভড়কে গেল। ভীতু নয়নে তাকালো আসরাফ সাহেবের দিকে। বুঝতে পারছে না, হুট করে তিনি এহেন প্রশ্ন করছেন কেন তাকে? তুষার কি উনাকে কিছু বলে দিয়েছে? কিন্তু তা কিভাবে হয়? তুষার তো এতক্ষণ তার সঙ্গেই ছিল।
সামান্য তোতলিয়ে হৈমন্তী বললো,
— “ন-না বাবা। হঠাৎ এমন অদ্ভুদ প্রশ্ন করছো কেন?”
তিনি একপলক হৈমন্তীর দিকে তাকালেন। নিজের রুমে যেতে যেতে কথাটা সম্পূর্ণ এড়িয়ে গিয়ে বললেন,
— “না, কিছু না।”
হৈমন্তী হতবিহ্বল হয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল। আসরাফ সাহেবকে এমন অস্বাভাবিক আচরণ করতে কখনো দেখেনি সে। এতটা চিন্তিত হতেও কখনো দেখেনি। সকালেও তো ঠিক ছিলেন তিনি। এখন আবার কি হলো? বিষয়টা ঘাটাতে গিয়েও কি ভেবে আর ঘাটালো না হৈমন্তী। সেও আজ বড্ড ক্লান্ত। ক্লান্ত শরীর নিয়ে রুমে গিয়েই প্রথমে ফুল স্প্রিডে বৈদ্যুতিক পাখা চালিয়ে দিলো সে। আরাম করে বিছানায় বসলো। কিছুক্ষণ অতিবাহিত হতেই কোত্থেকে হেমন্ত হন্তদন্ত পায়ে ছুটে এলো তার কাছে। জোড়ে জোড়ে নিশ্বাস ফেলতে লাগলো। অতঃপর উত্তেজিত গলায় জিজ্ঞেস করলো,
— “আপু, আব্বু কিছু বলেছে তোমাকে? বকেছে?”
হৈমন্তী ভ্রু কুঁচকালো,
— “বকবে কেন?”
— “মা তোমাকে কিছু বলে নি?”
— “না।”
হেমন্ত এবার মাথা দুলাতে দুলাতে বললো,
— “আমি পুরোটা জানি না। ওই সময় বাসায় ছিলাম না। তবে আমাদের বিল্ডিংয়ের কার্তিক থেকে জেনেছি, দুপুরে নাকি তুষার ভাইয়ার আব্বু এসেছিল বাসায়। তোমার নামে আব্বুকে আজেবাজে কথা বলে গেছে। সম্ভবত তোমার আর তুষার ভাইয়াকে নিয়ে। ঝগড়াও লেগেছিল বললো। বিল্ডিংয়ের মানুষ জড়ো হয়ে গিয়েছিল আমাদের বাসার সামনে। তখন থেকেই আব্বু এমন রেগে আছে। আমি তো ভেবেছিলাম আব্বু তোমাকে বকবে। একটু আগে আমাকেও বকেছিল।”
শেষের বাক্যটি মন খারাপ করে বললো হেমন্ত। পরক্ষণেই বোনের দিকে তাকালো, সে কিছু বলবে সেই আশায়। অথচ হৈমন্তী কিছুই বলছে না। চুপচাপ, অনুভূতি শূণ্য হয়ে বসে আছে বিছানায়। দৃষ্টি মেঝের দিকে নিবদ্ধ। বাহ্যিকভাবে শান্ত দেখালেও হৈমন্তীর ভেতরটা কেমন তীব্র বিষাদে বিষিয়ে যাচ্ছে। সে আন্দাজও করতে পারেনি এমন কিছু ঘটবে। তার জন্য আসরাফ সাহেবকে অপমানের সম্মুখীন হতে হবে!
বুক চিঁড়ে এক বেদনাদায়ক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। ক্ষীণ আওয়াজে বললো,
— “পানি দেয়, হেমন্ত।”
হেমন্ত এক মুহুর্ত দেড়ি করলো না। বিছানার পাশের ছোট্ট টি-টেবিলের জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে এগিয়ে দিলো হৈমন্তীর দিকে। ধীর স্থির ভাবে গ্লাসের অর্ধেক পানি পান করলো হৈমন্তী। বিষাদে পানিও গলা দিয়ে নামছে না যেন। চোখের সামনে শুধু বাবার চিন্তিত, শুকনো মুখশ্রী ঝাপসা ভাবে ভেসে উঠছে বারংবার। একদিন আসরাফ সাহেব উৎফুল্ল মনে বলেছিলেন, এমন এক মুহুর্ত আসবে, যখন তিনি হৈমন্তীকে নিয়ে গর্ব করবেন। তার মেয়েই তার মুখ উজ্জ্বলের কারণ হবে।
কিন্তু কোথায়? সেই মুহুর্তটা তো আসলো না। বরং নিজের এই মেয়ের জন্যই অন্যের কাছে অপদস্ত হতে হয়েছে উনাকে। ভাবতেই নেত্রকোণে বিন্দু, বিন্দু জল এসে জমা হলো তার। টলমলে হয়ে উঠলো আঁখিজোড়া। বোনের কষ্ট দেখে অদ্ভুদ ভাবে হেমন্তরও কষ্ট হতে লাগলো খুব। পানির গ্লাস নিয়ে সে কাঁদো গলায় আওড়ালো,
— “প্লিজ, কান্না করো না আপু। আমি তুষার ভাইয়ার সাথে আর মেলামেশা করবো না। তুমি শুধু কান্না থামাও।”
_____
নভস্থলের মন আজ বেজায় খারাপ। সেই সকাল থেকেই কেঁদে চলেছে সে। মাঝে মাঝে তার এই বিরতিহীন কান্নায় অসহ্য হয়ে ধমক দিয়ে চমকে উঠছে বিদ্যুৎ। হৈমন্তী উদাস মনে আকাশ পানে চেয়ে রইলো। দু’দিন ধরে ভার্সিটি যাওয়া হয় না তার। সে ইচ্ছে করেই যায় না। ছাদ, বারান্দা সব জায়গা থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে। বাহিরে গেলেই তো তুষারের মুখোমুখি হতে হবে তাকে। যা সে চায় না। একদম চায় না।
হঠাৎ রান্নাঘর থেকে মায়ের হাঁক শুনতে পেল হৈমন্তী। রাবেয়া জোড়ে জোড়ে চেঁচিয়ে বলছেন,
— “ছাদ থেকে ডানদিকের গাঁধা গাছটা নিয়ে আয় হৈমন্তী। গাছটা এমনিতেই নষ্ট হওয়ার পথে। পানিতে হয়তো মরেই যাবে।”
হৈমন্তী দিরুক্তি করল না। হেমন্ত বাসায় নেই। শত মানা করার পরও শেষে দেখা যাবে তাকেই যেতে হয়েছে ছাদে। সে ছোট্ট করে জবাব দিলো, “আনছি।”
অদ্ভুদ হলেও সত্য, ওইদিনের ঘটনা নিয়ে রাবেয়া এখনো একটা প্রশ্নও করেন নি তাকে। তার আচরণ একদম স্বাভাবিক। তবে আসরাফ সাহেব আগের চেয়ে কথা কমিয়ে দিয়েছেন। কথায় কথায় ‘মা’ ডাকটা বড্ড মনে পরেছে এই দুইদিনে হৈমন্তীর।
হৈমন্তী খুব সাবধানে ছাদে পা ফেলল। পানিতে পিচ্ছিল হয়ে গেছে মেঝে। গুটিগুটি পায়ে ছাদের ডানদিকে গিয়ে গাঁধা গাছের টবটা একহাতে নিলো। অন্যহাতে ছাতার হ্যান্ডেলটা ধরে পেছনে ফিরতেই ভীষণ ভাবে চমকে গেল সে। ছাদের সদর দরজায় অস্পষ্ট ভাবে তুষারকে দেখা যাচ্ছে। তার স্থির দৃষ্টি হৈমন্তীর মুখপানে। চেহারায় একরাশ গাম্ভীর্যের ভীড়। হৈমন্তী দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলো। মস্তিষ্কে কোনোরূপ উদ্ভট ভাবনা আসতে না দিয়ে শক্ত মনে পা ফেলতে লাগলো সামনের দিকে। উদ্দেশ্য, তুষারকে পাশ কাটিয়ে চলে যাবে। কিন্তু তার এই কঠোর ভাবটা বেশিক্ষণ টিকলো না। হঠাৎ-ই দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে ছাতার ভেতর ঢুকে পরল তুষার। স্তব্ধ হৈমন্তী তৎক্ষণাৎ থমকে দাঁড়ালো। বড় বড় চোখে তাকালো তুষারের দিকে। তুষার ভ্রুক্ষেপহীন। আলতো হাতে হৈমন্তীর গালে হাত রাখলো সে। লহু স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
— “কেঁদেছেন কেন হৈমন্তীকা?”
তুষার অনেকটা ঝুঁকে আছে হৈমন্তীর দিকে। তার অস্বস্থি হচ্ছে। তুষারকে হালকা ধাক্কা দিলো সে। কাঠকাঠ গলায় বললো,
— “সরে দাঁড়ান তুষার!”
তুষার কথা শুনলো না। অবাধ্যের ন্যায় ওভাবেই রইলো। গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন ছুড়ল,
— “আপনারা বাসা ছেড়ে দিচ্ছেন, হৈমন্তীকা? কেন? কেন এত জ্বালাচ্ছেন আমাকে?”
— “আমি আপনাকে জ্বালাচ্ছি না তুষার। বরং আপনি জ্বালাচ্ছেন আমাকে। আমার কাছ থেকে দূরে থাকুন তুষার। আমি আপনাকে ভালোবাসি না। তবুও কেন পিছু ছাড়ছেন না আমার? কেন নিজের সময় নষ্ট করছেন?”
তুষারের চাহনি গভীর হলো। আরও ঝুঁকে এলো সে। সযত্নে হৈমন্তীর কপালের চুলগুলো কানে গুঁজে দিলো। ক্ষীণ আওয়াজে বললো,
— “আপনি আমাকে ভালোবাসবেন হৈমন্তীকা। একদিন ঠিক ভালোবাসবেন।”
হৈমন্তী আশ্চর্য চোখে তাকালো। কণ্ঠে একরাশ বিস্ময় নিয়ে বললো,
— “এতকিছুর পর আপনি কিভাবে ভাবছেন আমি আপনাকে ভালোবাসব? অন্তত আপনার বাবার ওরকম ব্যবহারের পর তো কক্ষনো না।”
তুষারের কপালে ভাঁজ পরলো। বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলো, “মানে?”
হৈমন্তী হাসলো। তাচ্ছিল্যের হাসি।
— “জানেন না, তাই তো? আপনার বাবাকে জিজ্ঞেস করে নেবেন। আর হ্যাঁ, একটা অনুরোধ করবো, রাখবেন?”
তুষার জবাব দিলো না। শুধু ভ্রু কুঞ্চিত করে নিষ্পলক চেয়ে রইলো। হৈমন্তী নিজ থেকেই আবার বললো,
— “দয়া করে আমার পিছু ছেড়ে দিন।”
____________________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা