হৈমন্তীকা
৭.
বারান্দায় শনশন আওয়াজে বাতাসের আনাগোনা চলছে। কপালের চুলগুলো উড়ে এসে চোখে পরছে হৈমন্তীর। বিরক্ত করছে খুব। হৈমন্তী চোখ পিটপিট করে তাকালো। বিরক্ত সহিত কপালের চুলগুলো কানে গুঁজে নিলো। হেমন্ত তখন ব্যগ্র গলায় প্রশ্ন ছুঁড়লো,
— “আপু? কি বলেছি তোমায়?”
— “কি বলেছিস?” গাছে পানি দিতে দিতে জবাব দিলো হৈমন্তী।
— “তুষার ভাইয়ার জ্বর হয়েছে। দেখতে যাবা না?”
— “না।”
— “কেন যাবা না?”
হৈমন্তী রোষপূর্ণ নয়নে চাইলো। ধমক দিয়ে উঠল,
— “তোর যাওয়ার হলে যা হেমন্ত। আমাকে বিরক্ত করছিস কেন? বলেছি না যাবো না?”
বোনের কর্কশ ব্যবহারে ভীষণ মন খারাপ হলো হেমন্তর। ঠোঁট উলটে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো সে। এরপর চলে যেতেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল হৈমন্তী। কিছু জিনিস চাইলেও করা যায় না। আবার কিছু জিনিসে বেশি লাই দিতে নেই।
_____
তুষার আধশোয়া হয়ে বসে আছে বিছানায়। আড়চোখে একবার ডানদিকের ছোট্ট টি-টেবিলটির দিকে তাকালো সে। প্লেটে ঢাকনা দেওয়া বিরিয়ানি পরে আছে সেখানে। হেনা অনেক চেষ্টা করেও খাওয়াতে পারেন নি তুষারকে। সারাদিনে একটুখানি জ্যুস আর নাপা খেয়েছে সে। জ্বর এখন কিছুটা কমেছে। এক’শত এক ডিগ্রী। ক্ষুধায় পেটে ইঁদুর দৌঁড়াচ্ছে। কিন্তু খেতে ইচ্ছে করছে না কিছু। জ্বরের পাশাপাশি মনটাও বিষিয়ে আছে বড্ড। আজ বিকালে হেমন্তকে দিয়ে তার জ্বরের খবর হৈমন্তীর কাছে পাঠিয়েছিল সে। ভেবেছিল হৈমন্তী ক্ষণিকের জন্য হলেও তাকে দেখতে আসবে। কিন্তু কই? বিকাল পেরিয়ে সন্ধ্যা হলো। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত! প্রিয়তমার দেখা যে এখনো মিললো না!
তুষার উঠে বসলো। টি-টেবিল থেকে গ্লাস নিয়ে দু’ঢোক পানি পান করতেই তিক্ত স্বাদে চোখ মুখ কুঁচকে গেল তার। পানি খাওয়ার ইচ্ছেটাই হারিয়ে গেল তৎক্ষণাৎ। সশব্দে গ্লাসটা টেবিলে রেখে উঠে দাঁড়ালো সে। ধীর পায়ে বারান্দার দিকে এগোলো।
নিস্তব্ধ পরিবেশ। মানুষ তো দূর, চারিদিকে কোনো কাকপক্ষীরও দেখা নেই। শীতল বাতাসে মৃদুভাবে কাঁপছে তুষারের শরীর। শীত করছে ভীষণ। কিন্তু রুমে যেতে ইচ্ছে করছে না তার। হৈমন্তীকে একপলক দেখতে ইচ্ছে করছে। একদম কাছ থেকে। নিবিড় ভাবে। তুষারের চোখ মুদে এলো। অস্পষ্ট কণ্ঠে বিড়বিড় করে ডাকল সে, “হৈ-ম-ন্তী-কা!”
এর পরপরই হৈমন্তীর রিনঝিনে কণ্ঠ কানে এলো তার, “তুষার? আপনি এখানে?”
তুষার খুব করে চমকালো। কণ্ঠের উৎসের দিকে তাকাতেই দেখতে পেল, তার দু,তিন হাত নিচে বারান্দায় দাঁড়ানো হৈমন্তী বিচলিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। তাকে কিছু বলতে না দেখে সে আবার বললো,
— “তুষার? আপনার না জ্বর? না ঘুমিয়ে এই বাতাসে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?”
তুষার বার দুয়েক ঘন পলক ফেলল। অবুঝ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
— “আপনি সত্যিই আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন, হৈমন্তীকা?”
— “মানে?” ভ্রু কুঞ্চিত করে বললো হৈমন্তী।
তুষার ঢোক গিললো। শুষ্ক ঠোঁট জোড়া জিভ দিয়ে ভিঁজিয়ে নিয়ে, হৈমন্তীর দিকে গভীর চাহনি মেলে ধরল। এলোমেলো কণ্ঠে আবার আওড়ালো,
— “আপনি এত সুন্দর কেন হৈমন্তীকা? আমার ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করছে আপনাকে। ছুঁয়ে দেই?”
হৈমন্তী ভড়কালো। আর্তনাদ করে উঠল,
— “কিসব বলছেন তুষার! মাথা ঠিক আছে?”
তুষার বাচ্চাদের মতো মাথা দুলিয়ে বললো,
— “আমার মাথা সত্যিই ঠিক নেই হৈমন্তীকা। পুরো মস্তিষ্ক জুড়ে শুধু আপনিই বিরাজমান। আপনাকে ছাড়া কিছু ভাবতেই পারি না আমি। এমন কেন হয়?”
তুষার একটু থামলো। লম্বা একটা নিশ্বাস নিয়ে উগ্রতার সঙ্গে আবার বলে উঠল,
— “এত দূরত্ব আমার ভালো লাগছে না হৈমন্তীকা। আপনাকে যখন ইচ্ছে ছুঁতে পারছি না আমি। আপনার কোলে মাথা রেখে ঘুমুতে পারছি না। আপনার চুলে হাত বুলিয়ে দিতে পারছি না। সব! সব কিছু অসহ্য লাগছে আমার। আমরা… আমরা কালকেই বিয়ে করে ফেলবো হৈমন্তীকা। আপনি বিয়ে করতে না চাইলে তুলে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করবো।”
হৈমন্তী বিস্ফোরিত নয়নে চেয়ে আছে। তুষারের ফ্যাকাসে মুখশ্রী দেখে তার যেমন মায়া হচ্ছে, তেমনি তুষারের উদ্ভট কথায় আশ্চর্যও হচ্ছে খুব। তার বুঝতে বাকি রইলো না, তুষার জ্বরের ঘোরে এমন করছে।
— “তুষার, আপনি অসুস্থ। রুমে গিয়ে রেস্ট নিন।”
— “না। আমি তোমাকে ছুঁবো।”
একমুহুর্তের জন্য বিমূঢ়তায় বাক হারা হয়ে গেল হৈমন্তী। তুষার এই প্রথম ‘তুমি’ বলে ডেকেছে তাকে। ডাকটা প্রচন্ড মিষ্টি লাগল তার। খানিক জড়তা কিংবা অস্বস্থিতে আড়ষ্ট হয়ে গেল সে। মিইয়ে যাওয়া কণ্ঠকে কঠিন করে বললো,
— “বাজে কথা বাদ দিয়ে রুমে যান তুষার।”
— “যাবো না।” একরোখা উত্তর দিলো তুষার।
হৈমন্তী আরও বেশ কয়েকবার বলার পরও তুষার শুনলো না। হৈমন্তী খেয়াল করল, তুষারের শরীর আগের চেয়েও বেশি কাঁপছে এখন। তিরতির করছে ওষ্ঠ জোড়া। হৈমন্তী ছোট্ট নিশ্বাস ফেলল। অনুরোধের সুরে বললো,
— “আপনি ঠান্ডায় কাঁপছেন তুষার। প্লিজ, রুমে যান। নতুবা আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পরবেন।”
— “একা একা রুমে ভালো লাগছে না আমার হৈমন্তীকা। আপনিও আসুন।”
শুনে হৈমন্তীর নেত্রজোড়া কোটর থেকে বেড়িয়ে আসতে চাইলো যেন। তীব্র ঝংকার তুলে ধমক দিয়ে উঠল সে, “তুষার!”
দূর্বোধ্য হাসলো তুষার। ঠোঁটটা খানিক বাঁকিয়ে। হৈমন্তী রেগে চলে যেতে নিলে দ্রুততার সঙ্গে বলে উঠল,
— “আমি সকাল থেকে কিচ্ছু খাই নি হৈমন্তীকা।”
হৈমন্তী না চাইতেও দাঁড়ালো। একবার নিজের রুমে উঁকি দিয়ে দেখল, বিছানার অর্ধেক জায়গা দখলে নিয়ে ঘুমিয়ে আছে হেমন্ত। একটু পরপরই নাক ডাকছে। সে চোখ ফিরিয়ে নিলো। একটু নরম হয়ে বললো,
— “কেন খান নি?”
— “ভালো লাগে না। তিতা, তিতা লাগে।”
একপলক তুষারের দিকে তাকালো হৈমন্তী। তুষারের মাদক মেশানো চাউনির সঙ্গে চোখাচোখি হতেই নতজানু হয়ে গেল আবার। তুষারের জন্য তার মায়া হচ্ছে নাকি অন্যকিছু হচ্ছে, ঠিক বুঝতে পারলো না। কোনোমতে মিনমিনিয়ে বললো,
— “খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন তুষার। এখানে দাঁড়িয়ে থাকবেন না।”
বলে অনেকটা পালিয়েই চলে গেল সে। আর একবারও ফিরে তাকালো না তুষারের পানে।
_____
বিকালের আগমন ঘটেছে কিছুক্ষণ।
ভার্সিটি শেষে মাত্রই বিল্ডিংয়ের কাছে এসেছে হৈমন্তী। রিকশা থেকে নেমে টাকা দিতে গিয়ে দেখল, তার পার্সে শুধু পাঁচশত টাকার একটা নোট আছে। রিকশা চালকের কাছে ভাংটি নেই। ওদিকে দারোয়ান চাচার কাছেও নেই। বহু খুঁজে ব্যাগের এককোণে শত ভাঁজ পড়া এক পুরোনো বিশ টাকার নোট পেল সে। কিন্তু মাঝখানে একটুখানি ফাঁটা। রিকশা চালক নিবে না সেই টাকা। হৈমন্তী অনুরোধ করে বললো,
— “আমার কাছে আর টাকা নেই মামা। এটাই নিন না প্লিজ।”
রিকশা চালক আগের মতোই নাকচ করে উঠল। তিনি নিবেনই না ছেঁড়া টাকা। সেই মুহুর্তে তুষারের আগমন ঘটলো সেখানে। পরনে তার কুঁচকানো গাঢ় নীল শার্ট। চোখ ঘুমে বুজে আসছে। অদ্ভুদ গম্ভীরতা নিয়ে সে জিজ্ঞেস করল,
— “কি হয়েছে হৈমন্তীকা?”
হৈমন্তী কিছু বলার আগে আগেই দারোয়ান চাচা বলে উঠলেন,
— “হৈমন্তী মামণির কাছে ভাংটি নাই। আমার কাছেও নাই। তোমার কাছে ভাংটি হইবো তুষার বাপজান?”
তুষার কিছু না বলে রিকশা চালকের দিকে তাকালো। আগের গাম্ভীর্য ধরে রেখে প্রশ্ন করলো,
— “কত টাকা?”
রিকশা চালক জবাব দিলো,
— “জিহ্ বিশ।”
তুষার বিনা বাক্য ব্যয়ে পকেট থেকে বিশ টাকা বের করে দিলো। হৈমন্তীর ভালো লাগলো না সেটা। বললো,
— “সমস্যা কি? আপনাকে বলেছি আমার হয়ে টাকা দিতে? দিলেন কেন?”
— “হাঁটতে হাঁটতে কথা বলি হৈমন্তীকা?”
তুষারের ভীষণ শীতল কণ্ঠ। হৈমন্তী কেন যেন মানা করতে পারলো না। তুষারের সঙ্গে হাঁটতে লাগল। তবে মনে মনে ভেবে নিলো, সে এখনই তুষারের টাকা ফেরত দিয়ে দিবে। তার মতে বড় বোন হিসেবে ছোট ভাইয়ের কাছে ঋণী থাকাটা মোটেও শোভনীয় নয়। হাতে থাকা আধছেঁড়া বিশ টাকাটা তুষারের দিকে এগিয়ে দিয়ে সে বললো,
— “এটা আপাতত রাখুন। ভাঙ্গটি পেলে নতুন বিশ টাকা পরে দিয়ে দিবো।”
তুষার আধবোজা চোখে তাকালো,
— “এটা আমাকে দিচ্ছেন কেন?”
— “আমি কারো কাছে ঋণী থাকি না। বিশেষ করে আপনার কাছে তো একদমই না।”
তুষার মুচকি হাসলো। টাকাটা নিতে নিতে বললো,
— “আচ্ছা, দিন। পরবর্তীতে আমাদের বিয়ের সময় এই বিশটাকা দিয়েই আপনার জন্য চুড়ি কিনা যাবে। চুড়ির টাকা বাঁচিয়ে দিলেন আপনি।”
শুনে হৈমন্তী শক্ত চোখে তাকালো। এতে খানিক ঝুঁকে আবারও হাসলো তুষার। নিজের মাথার পেছনের চুলে হাত বুলিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়লো,
— “কালকে রাতে কি আপনার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল হৈমন্তীকা? আমার ঠিক মনে পরছে না।”
হৈমন্তীর দৃষ্টি আরও শক্ত হলো এবার। মনে মনে ভয়ংকর একখানা উপাধি দিয়ে দিলো তুষারকে। ভীষণ ভয়ংকর!
__________________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা