১৮+ সতর্কতা
চিঠি দিও
২০
_____
বিদ্যুতের খুঁটির ওপর বসে থাকা একটা কাক দীর্ঘক্ষণ যাবৎ করুণ সুরে ডেকে যাচ্ছে। কাকে যে ডাকছে এত বিষণ্নভাবে, এত মায়া দিয়ে! বুঝতে পারছে না আশিন। বোঝার কথাও নয়। বিশেষ কোনো ক্ষমতা ছাড়া ই’তর প্রাণীর ভাব বোঝা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। আচ্ছা ইতর প্রাণীটা এমন মায়া মিশিয়ে তার সঙ্গিকে ডাকছে কি?
লোকে বলে এমন করুণ সুরে কাক ডাকা অশুভ, অলক্ষুণে৷ যে বাড়ির ওপর এসে ডাকে অল্পদিনের মধ্যে সে বাড়িতে একটা বিপদাপদের ঘটনা ঘটে। কিছু জীবজন্তু আছে তারা অশনি সংকেত টের পায়। সতর্ক করার জন্য সেই বাড়িগুলোতে বার্তাও নিয়ে যায়। ওদের মধ্যে কাক একটি। আশিন অবশ্য এতে বিপদের কিছু খুঁজে পাচ্ছে না। তার চোখে কেবল একটা সঙ্গীহীন ইতর প্রাণীর সঙ্গী হারানোর ব্যথা ভেসে বেড়াচ্ছে। ঐ বিষাদগ্রস্ত, অসহায় প্রাণীটার মতো সেও তো নিঃসঙ্গ। ব্যথাবিদীর্ণ হৃদয়টাতে ওর মতোই হাহাকার ভেসে বেড়ায়।
নিঃসঙ্গতার কারণ হিসেবে কাউকে দায়ী করাটা অনুচিত। পছন্দ-অপছন্দ মানুষের স্বতন্ত্র বিষয়। এর ওপর কবজা জমানোর অধিকার কারোর নেই। যদি থাকতো তাহলে পৃথিবীতে বিচ্ছেদ নামক শব্দটার সৃষ্টি হতো না।
বয়স তখন কমই বলা চলে। কৈশোর পেরিয়ে দুর্বার তারুণ্যে পা রাখল আশিন। কলেজের চৌহদ্দি পেরিয়ে ভার্সিটির চৌকাঠ মাড়ানো শুরু হয়েছে। কল্লোলিত ঢেউয়ের মতো উথাল-পাথাল একটা বয়স। দাপুটে হাওয়ার সাথে কখন কোন দিকে ভেসে যেতে ইচ্ছে করে ঠিক-ঠিকানা নেই। সেই পাগলাটে বয়সে হুট করে ওর সাহিত্যের প্রতি প্রবল আগ্রহের জন্ম নিলো। সহপাঠীরা নিত্য যে পথ মাড়ায় সে পথে তার পা বাড়াতে ইচ্ছে করল না। বরাবরই খুব পড়ুয়া ছাত্র ছিল আশিন। জ্ঞানান্বেষণের একটা খিদে ছিল ওর মধ্যে। এই খিদেটাই বোধহয় সাহিত্যে আরও বেশ করে ঝুঁকিয়ে দিয়েছিল ওকে।
সময় পেলে ও বিভিন্ন কবি ও লেখক সম্পর্কে জানার চেষ্টা করত। বিশ্লেষণ করতে চাইত ওঁদের নানারকম লেখা। সেবার ছুটিতে বাড়ি ফেরার সময় সাথে করে বিপুল সংখ্যক বই নিয়ে এসেছিল। রবী ঠাকুরের ভূত চড়েছিল যে ওর মাথায়।
আশিনের ধারণা সেবার রবী ঠাকুরই বোধহয় দৈবভাবে ওর বুকের ভেতর নরম মাটিতে একটা রহস্যবীজ বুনে দিয়েছিলেন। ছোট্ট করে যে বীজটার নাম “ভালোবাসা” জানে সকলে। সময়টা ছিল প্রবল বৃষ্টি-বাদলের। শ্রাবণ মাস। আকাশ জুড়ে ধূসর মেঘের ঘনঘটা। সুযোগ পেলেই বুঁজে আসা প্রকৃতি জানান দেয় যখন তখন মন খারাপের মেঘগুলি বৃষ্টির রূপ ধরে নামতে শুরু করবে ধরায়। তেমনই এক বৃষ্টি-বাদল দিনের ঘটনা। বাইরে ইলশেগুঁড়ি থাকলেও আলোর কমতি ছিল না। বারান্দায় ইজি চেয়ারে মৃদু দুলতে দুলতে রবী ঠাকুরের বইয়ে চোখ বুলচ্ছিল আশিন। দাদার কালের গ্রামোফোনটায় বাজছিল রবী ঠাকুরেরই একটা গান “বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল”
গানের অন্তরা যখন শুরু হলো তখনই ইলশেগুঁড়ি রূপ নিল ছন্দময় ঝমঝম বৃষ্টির। প্রকৃতি কি কোনোভাবে গানের সাথে তাল মেলালো? কে জানে!
খানিক বিরক্ত হয়ে পড়েছিল আশিন। শীতল পানির ছাঁট খোলা বারান্দায় ছুটে এসে বইসুদ্ধ ওকে ভিজিয়ে দিচ্ছিল। বই-টই ভিজিয়ে একসা হয়ে ও সিদ্ধান্ত নিলো এখন ঘরে যাওয়া চাই।
উঠল, গান বন্ধ করল এবং ঘরের দিকে পা বাড়াবে ঠিক সেই মুহুর্তে রুমঝুম বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে কানে লাগল পাহাড়ি ঝর্ণার মতো প্রাণচঞ্চল খিলখিল হাসির শব্দ। শুরুটায় ভারী অবাক হলো ও। কে হাসছে এত মধুর করে? বই ফেলে কৌতূহলী চোখে বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়ালে দেখতে পেলো নীচে কদম গাছের তলায় প্রবল উচ্ছ্বাসে এক কিশোরী বৃষ্টি গায়ে মাখছে আর নরম হয়ে যাওয়া ডাল থেকে টুপটুপ করে কদম ছিঁড়ছে। চেনা মুখে অপরিচিতের ছাপ। অদ্ভুত এক ভ্রম;উপমা।
একটুখানি বিস্ময় আর অপার মুগ্ধতায় ডুবে যেতে যেতে আশিন টের পাচ্ছিল অন্দরমহলে অদ্ভুত এক আলোড়ন সৃষ্টি হতে চলেছে। যা এতদিনে একটিবারের জন্যেও অনুভব করেনি ও। অনুভূতিটা সম্পূর্ণ নতুন আর খুব রহস্যময়ও। ঠিক ভাষায় বর্ণনা করার মতো নয়। যেন বুকের নরম মাটিতে তীক্ষ্ণ আঁচড়ের আভাস।
নতুন অনুভূতিটাকে যখন ও মাত্র জানতে শুরু করল তখনই নীচে থেকে মিষ্টি স্বরে প্রশ্ন ভেসে এলো,
— গানটা বন্ধ করলে কেন মেজো ভাই? ভালই তো চলছিল।
অবচেতনে ও পাল্টা উত্তর করল,
— তুইও তো গাইতে জানিস। গেয়ে ফেল গানটা।
— বলছ গাইবো?
— হ্যাঁ গা।
— ঠিকাছে।
অল্প হেসে গলা পরিষ্কার করে সে গাইতে শুরু করল, “বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল, করেছ দান”
সদ্য জন্মানো অনুভূতির পালে জোর হাওয়া এইটেকেই বলা চলে। অচীরেই এ আচ্ছন্ন করে ফেলল আশিনকে ভয়াবহ প্রেমজ্বরে। শরীরের জ্বর, সে তো ভাইরাসে হয়, পথ্যে সারে; কিন্তু মনের জ্বরের পথ্য কই?
হাজার চেষ্টা করেও মনের জ্বরটাকে সারানো সম্ভব হলো না আশিনের পক্ষে। নাকি তার চেষ্টাটাই ছিল ভীষণ দুর্বল?
অনেকবার অপরাধী মনে হয়েছে নিজেকে। যাকে এতদিন বোন বলে ডেকেছে তাকে কীভাবে..
এরপর প্রেমিক মনটাই অন্য সত্তা হয়ে যুক্তিখণ্ডন করেছে, আপন ভাই-বোন তো তারা নয়। এ ভালোলাগায় দোষ নেই।
দুইরকম ভাবনা মনে পুষে রাখতে হয়েছে। যদি ডাকে সাড়া দেয় সে অনুযায়ী এক ভাবনা, সাড়া না দিলে এক ভাবনা।
এত বছরে অনেকবার চেষ্টাও করেছে উপমাকে মনের কথা জানানোর। পারেনি। সুযোগ হয়ে ওঠেনি। কখনও মনে হয়েছে বয়সটা সঠিক নয় আর কটাদিন যাক। এখন উপযুক্ত সময় এলো কিন্তু আশিনের মনে হচ্ছে ও দেরি করে ফেলেছে। কেন মনে হচ্ছে, মেয়েটার হৃদয়ে অন্যকেউ অধিকার জমিয়ে ফেলেছে। তবে তার এতখানি অপেক্ষা সবটা কি বিফলে চলে যাবে?
বাড়ি ফিরে এক দুপুর মনমরা হয়ে শুয়ে রইল উপমা। নাওয়া হলো না, খাওয়া হলো না, কিচ্ছু হলো না। জান্নাতিকে বলে টেলিফোন আনিয়েছিল ওপরে। কয়েকবার রওনকের নম্বরে চেষ্টাও করেছিল। কেউ ধরেনি। দুশ্চিন্তায় পাগল পাগল অবস্থা। এদিকে ওকে নামিয়ে দিয়ে মামা তৎক্ষনাৎ চলে গেছেন কলেজে। মিটিং হবে। ডাক পড়েছিল। মামা এলেও না-হয় শোনা যেত কি অবস্থা ওখানকার। কিন্তু মামাও আসছে না।
এত দুশ্চিন্তার ভারে শুয়ে থাকতে থাকতে অতিষ্ঠ হয়ে গেল উপমা। একসময় উঠে কাপড় পাল্টে নিলো। হাতে মুখে কিছুটা পানির ঝাপটা দিয়ে গুমোট ভাবটা কমাতে ছাদের দিকে পা বাড়াল।
এই অসময়ে ছাদে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছিল আশিন। উপমা গেলে সামনাসামনি হয়ে গেল দুজনের। অস্বস্তিকর একটা পরিস্থিতি। দু’জনেই একসঙ্গে বিব্রত হলো। আশিনের বিব্রতভাব চোখেমুখে ফুটে উঠল। চট করে সিগারেটটা ফেলে দিলো সে। তবে উপমা নিজের অস্বস্তি আড়াল করতে পারল ভালোভাবেই। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সে এগিয়ে গেল আশিনের দিকে। চোখ সরু করে বলল,
— মেজো ভাই তুমি সিগারেট খাও?
উপমাকে বিস্মিত হতে দেখে লজ্জিতভাবে হাসল আশিন।
— সে তো এই বয়সে একটু-আধটু সবাই খায় রে। এত অবাক হচ্ছিস কেন?
— মামি জানে?
— জানে বোধহয়।
— সেকি, তুমি বলেছ? বকেনি?
পুনরায় হাসল আশিন। মাথা নেড়ে বলল,
— ধুস্ সব কথা মাকে বলতে আছে নাকি! আর বকবে কেন, আমি কি সেই ছোটোটি আছি?
— তাই তো।
বোকা প্রশ্নে আবারও বিব্রত হলো উপমা।
আশিন শুধল,
— পরীক্ষা ছিল না তোর আজকে। কেমন হলো?
— আর বোলো না। পরীক্ষা তো স্থগিত করে দিয়েছে।
— বলিস কি রে।
— হু। দা ঙ্গা বেজেছে না কলেজে! সেজন্য সব স্থগিত। পরিস্থিতি ভালো নয়। দেখে এলাম আমরা। খানিক পরপরই মারামারির শব্দ।
— আব্বা তো বোধহয় সেখানেই গেলেন।
চিন্তাগ্রস্ত স্বরে বলল আশিন। উপমা হ্যাঁ বোধক মাথা দোলালো।
এরপর ক্ষণিকের নীরবতা। অযথাই আসমার গোলাপ চারাগুলো ঘুরে ঘুরে দেখল উপমা, ছাদের এ মাথা-ওমাথা পায়চারি করল।
আশিন কিচ্ছু বলল না। চুপচাপ তক্তপোষের ওপর বসে রইল। ও মূলত কথা সাজাচ্ছে। সবটা আজই বলে দেবে কি না ভাবছে!
ভাবতে ভাবতে একসময় ডাকল উপমাকে। শুধল,
— তাহলে স্থগিত পরীক্ষাগুলো কবে থেকে হচ্ছে?
— নোটিশ দিয়ে জানাবে বলেছে।
সংক্ষেপে জবাব দিলো উপমা। পুনরায় মিনিট দুয়েকের নিস্তব্ধতা। একসময় কথা গোছাতে গোছাতে আশিন বলে ফেলল,
— বহুদিন থেকে তোকে একটা কথা বলব বলে ভাবছিলাম উপ।
এ বাড়িতে সকলে উপমাকে আনন্দি ডাকলেও আশিনই একমাত্র যে ওকে উপ কিংবা উপমা এই দুই নামে ডাকে। উপমা খানিক আঁচ করতে পারল। শরীরটা দুলে উঠল ওর। তথাপি নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলল,
— হ্যাঁ বলো।
— কথাটা হয়তোবা তুই জানিস।
থামল আশিন। মাথা চুলকোল, হাত মুচড়ল। এরপর ছোট্ট শ্বাস ফেলে উপমার চোখে চোখ রাখল।
— আমি তোকে পছন্দ করি উপ। বিয়ে করতে চাই তোকে।
উপমা প্রত্যাশা করেছিল এমন কিছুই। আশংকা সত্যি হয়ে যাওয়ায় বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। ওড়না চেপে ধরে মাথা নীচু করে বলল,
— কিন্তু আমি.. আমি তো তোমাকে ঐ নজরে কখনো দেখি না মেজো ভাই। আমি..
গলা বুঁজে আসতে লাগল উপমার। চোখজোড়া ছলছল। দাঁতে ঠোঁট কামড়ে সে কান্নামাখা স্বরে বলল,
— বড় ভাই, সেজো ভাইয়ের মতো তোমাকেও আপন ভাই ভেবে এসেছি সবসময়। তোমাদের কাউকে নিয়ে কক্ষনও অন্যরকম চিন্তা মাথায় আসেনি, আসা সম্ভবও না। আমাকে মাফ করো মেজো ভাই প্লিজ। আমি পারব না।
স্পষ্ট প্রত্যাখ্যাত হবার পর যন্ত্রণা হলো আশিনের; বেশ যন্ত্রণা হলো। ফ্যাকাশে হয়ে গেল মুখ। হৃদয়ের গহীন থেকে হতাশামিশ্রিত দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। অথচ দুইরকম ভাবনাই ভেবে রেখেছিল সে। তবুও কেন যে এত কষ্ট হলো!
উপমা ততক্ষণে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করেছে। মুখ তুলে দুর্বল চোখে আশিন ওর দিকে চাইল একবার। বলল,
— ধুস্ পাগল কাঁদিস কেন? পছন্দ-অপছন্দ থাকতে পারে না মানুষের? এতটুকুতে কাঁদতে আছে! আমারই বোধহয় বুঝেশুনে নিজের ওপর লাগাম টানা উচিৎ ছিল।
শেষ কথাটা খুব ধীরে বলল আশিন। উপমা পাল্টা কিচ্ছু বলতে পারল না। কেন যে নিজেকে ওর অপরাধী লাগছে। জেনে-বুঝে তো মন ভাঙেনি ও আশিনের। তবুও ওর জন্য আশিন কষ্ট পেলো। এই ভেবে কান্না উথলে আসতে লাগল।
আশিন কিছু বলবার মতো পাচ্ছে না। নিজের সাথেই তো পেরে উঠছে না ও। অন্য কাউকে কি করে সান্ত্বনা দেবে?
একপর্যায়ে তাই কোমল স্বরে বলল,
— তুই বরং ঘরে যা উপ। এত কাঁদিস না। তোর কোনো ভুল নেই।
উপমা তাই চাইছিল। সম্মতি পেয়ে ঝড়ের বেগে সে নেমে এলো নীচে। পথিমধ্যে আসমার সাথে দেখা হলো। কান্নায় ফুলে ওঠা তার মুখচোখ দেখে আটকাতে চাইছিল আসমা। সে শুনল না। হাত ছাড়িয়ে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘরের দোর এঁটে দিলো। এরপর বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে বালিশে মুখ চেপে কাঁদতে লাগল। তার কান্নাটা শুধু আশিনকে না করেছে বলে নয়। এই কান্নার ভেতর লুকিয়ে আছে রওনককে নিয়ে দুশ্চিন্তাও। এতক্ষণ দুশ্চিন্তাগুলো পলকা মেঘের মতো জমে ছিল ওর ভেতরে। আশিন কেবল উপলক্ষ হয়ে মেঘগুলোকে টোকা দিয়ে দিলো। আর তা বিষাদ হয়ে ঝরে পড়তে লাগল উপমার চোখজোড়া বেয়ে।
দীর্ঘক্ষণ একমনে কেঁদে গেল উপমা। একসময় কান্নার গতি কমল। তখন কেবল কাত হয়ে শুয়ে ফোঁপাচ্ছিল।
চমকে উঠতে হলো পড়ার টেবিলে সশব্দে বেজে ওঠা টেবিল ঘড়ির অ্যালার্মের আওয়াজে। ধড়ফড় করে উঠে বসে বুকে হাত রাখল উপমা৷ বিরক্তি দৃষ্টিতে চাইল টেবিলের ওপর বাজতে থাকা কালো ছোট্ট ঘড়িটার দিকে। এই যে অ্যালার্মটা। এটাও কিন্তু রওনকের জন্যই দিয়ে রাখা। বিকেলের এই সময়টা বাড়ির সবাই নিজ নিজ ঘরে অবস্থান করে। নজরে পড়ার ভয় নেই। রওনককে ও বলে রেখেছিল ফোনটোন করলে যেন এই সময়েই করে। তাহলে নির্ভয়ে একটু কথা বলতে পারবে। কিন্তু রওনক তো রওনক। নিজে যা ভালো বোঝে তাই করে। অন্য কারোর কথা সে শুনবে কেন?
নির্দিষ্ট একটা সময় বেঁধে দেয়া সত্ত্বেও ওসবের তোয়াক্কা সে করে না। যখন মন চায় কল দেয়। সবসময় তো উপমা রিসিভ করতে পারে না৷ বাড়ির অন্য সদ্যসরা করে। পরিচিত কণ্ঠস্বর না শুনলেই মাস্তানটা আবার কল কে’টে দেয়। নাক-মুখ কুঁচকে ভেঙচি কাটল উপমা। যেন রওনক ওর সামনেই আছে।
বেচারি কি সুন্দর অ্যালার্ম দিয়ে রেখেছিল। কই কাজেই তো লাগে না। বন্ধ করতেও মনে নেই। সময় হয়েছে টুইটুই করে বেজে চলেছে।
একসময় শব্দের তীব্রতা সহ্য করতে না পেরে বাধ্য হয়ে উঠে পড়ল উপমা ওটা বন্ধ করতে। চোখ মুছে হতাশভাবে শ্বাস ফেলল । বিছানা থেকে নেমে ধপ ধপ শব্দ করে এগিয়ে গেল টেবিলের দিকে। অবিরত বাজতে থাকা ঘড়িটা বন্ধ করে শব্দ করে রাখল টেবিলের ওপর। আজ তো জানালাও আটকানো হয়নি। কি হিম হিম বাতাস আসছে! সাথে আসছে রাজ্যের মশা। এলোমেলো চুলগুলোকে হাত খোঁপা করতে করতে জানালার দিকে ফিরল উপমা। অভ্যেসবশত তার চোখ চলে গেল জানালা ভেদ করে বাইরের ব্যস্ত রাস্তাটার দিকে। নজর ঘুরিয়ে চারিদিকটা পর্যবেক্ষণ করল ও। হুট করে দৃষ্টি থেমে গেল রাস্তার অপর পাশে মুদি দোকানটার সামনে। নিজের প্রাণপ্রিয় জলপাই রঙা হোন্ডায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে এদিকেই তাকিয়ে আছে তার প্রেমিক পুরুষ। যার চিন্তায় এতক্ষণ টালমাটাল অবস্থা হয়েছিল উপমার।
আপনাআপনি চুল থেকে হাত সরে গেল ওর। ছুটে গিয়ে জানালার গরাদ আঁকড়ে ধরে ঠিকঠাকভাবে বাইরে তাকানোর চেষ্টা করল। সূর্য ডুবেছে মাত্র। সাঁঝ নামবে বলে। তা সত্ত্বেও বাইরের সবকিছু ক্ষীণ আলোয় দৃশ্যমান। নিজের চোখকে যেন ও বিশ্বাস করতে পারল না। বার দুয়েক চোখ মুছে একই দৃশ্য দেখতে পেলে আনন্দে নেচে উঠল ওর মন। জানালা গলিয়ে হাত বের করে রওনককে উদ্দেশ্য করে হাত নাড়ল ও। বিনিময়ে হেলান দেয়া থেকে সোজা হয়ে দাঁড়াল রওনক। মৃদু হেসে ইশারা করল পেছনের গেটের দিকে। উপমা হাত নেড়ে না করল, যেতে পারবে না। তা সত্ত্বেও রওনক ইশারা করল পেছনের গেটে। কপাল চাপড়ে চটপট উপমা টেবিলের ওপর থেকে খাতা টেনে নিলো। একটা পৃষ্ঠা ছিঁড়ে লিখল,
“বাড়িভর্তি মানুষ। এখন যেতে পারব না। সাথে ফোন থাকলে কল দিন”
লেখা শেষে ইতিউতি চাইল কীভাবে পাঠাবে। বেশি কষ্ট করতে হলো না। পেপারওয়েট ছিল ওর। ড্রয়ার থেকে বের করে কাগজ মুড়ে জানালার কাছে ছুটে গেল। এরপর রওনককে ইশারা করল রাস্তা পার হয়ে গলির মুখে দাঁড়াতে। কালক্ষেপণ করল না রওনক। চট করে রাস্তা পার হয়ে চলে এল।
কাছাকাছি এলে কাগজটা ছুঁড়ে দিলো উপমা তার দিকে। নিশানা ভালো। ক্যাচ করে নিলো রওনক।
চিঠি পড়ে ইশারায় বোঝালো সাথে ফোন নেই। কাজ শেষ হলেই ফোনটা জমা দিয়ে দিয়েছে আনিস শেখের কাছে।
উপমার মন খারাপ হয়ে গেল। পুনরায় কাগজ ছিঁড়ে সে চিঠি লিখল,
“তাহলে তো কথা হচ্ছে না। আপনি বরং ফিরে যান। কেউ দেখে ফেললে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। কত লোক রাস্তায়! সেজো ভাইয়ের আসার সময়ও হয়েছে। সুযোগ পেলে রাতে কল দেবেন। দেখাসাক্ষাৎ কবে হবে বলতে পারছি না।”
লিখে একটু গ্যাপ দিলো উপমা৷ এরপর লিখল,
” সময় পেলে না, অবশ্যই কল দেবেন। অনেক জরুরি কথা আছে আপনার সাথে। আচ্ছা সকালে ব্যথা পেয়েছিলেন তাই না? বিধ্বস্ত লাগছিল আপনাকে। বেশি ব্যথা পেলে ডাক্তারের কাছে যান দয়া করে। অবহেলা করে নিষ্ঠুরের মতো আমাকে কষ্ট দেবেন না। পারব না আমি এতটা সইতে”
এবার নিজের পাঞ্চ ক্লিপে মুড়ে চিঠি পাঠাল উপমা। সময় নিয়ে পুরোটা পড়ল রওনক। অজান্তেই তার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল। আদর-যত্ন করার আরেকটা মানুষ যোগ হয়েছে ওর জীবনে। আনন্দের কথা। একইসাথে খারাপ লাগল মনভরে মেয়েটার সাথে কথা হলো না। অবশ্য কথা বলার উদ্দেশ্যে সে আসেনি। একপলক দেখবে বলে এসেছিল। সকালবেলা যে ওকে দেখে বিষণ্ন হয়ে পড়েছিল উপমা, টের পেয়েছিল রওনক। আরেকবার দেখা হওয়া জরুরি ছিল। তাই বাড়তি ভাবনা না ভেবে সোজা চলে এসেছে ও উপমাদের বাড়ি সম্মুখে।
পাঞ্চক্লিপ আর পেপারওয়েট আলাদাভাবে পকেটে ঢুকিয়ে কাগজ দুখানা ভাঁজ করে মানিব্যাগে ঢুকিয়ে রাখল রওনক। ইশারায় উপমাকে বোঝালো রাতে কল করবে। সাথে সময়টাও বাতলে দিতে ভুলল না।
এরপর মিনিটখানেক নীরবে চোখভরে, মনভরে দু’জন দু’জনার দিকে তাকিয়ে রইল। আজান পড়ে গেলে আর দেরি করা সম্ভব হলো না রওনকের পক্ষে। মৃদু হেসে বিদায় জানিয়ে ফিরতি পথ ধরল সে। রওনক চলে যাওয়ার পরও অনেকটা সময় গরাদে মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল উপমা। মানুষটার কণ্ঠ শোনার পরই তার উচাটন মন শান্ত হবে, অন্যথা নয়।
________________
অফিস শেষ করে আজ উর্বশীর পাড়ায় রওয়ানা হয়েছে অতনু। নিজাম চৌধুরী আসছে আগামী সপ্তাহে। প্রস্তুত হতে বলতে হবে মেয়েটাকে। সৌন্দর্যের যদিও কমতি নেই ওর মধ্যে, তবে আরেকটু ঘষামাজা প্রয়োজন। আকর্ষণীয় দেখানো চাই। কিছু বিষয় শিখিয়ে পড়িয়েও দিতে হবে। বুড়োটার আবার চাহিদার নানা রূপ।
ড্রাইভিং করতে করতে ছোট্ট ব্র্যান্ডির বোতলটা বের করে গলা ভিজিয়ে নিলো অতনু। জিপে সবসময় রাখা থাকে একটা বোতল। প্রতিদিন সময়ে-অসময়ে প্রয়োজন পড়ে অতনুর। বাড়িতে তো খাওয়া বারণ। কেউই জানে না যে ওর রাজনীতির বাইরে অন্য নেশা আছে। জানলে..
ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল অতনু। কি সুন্দর নিজের দু’টো সত্ত্বাকে আলাদা করে রাখতে পেরেছে। এক সত্ত্বা আরেক সত্ত্বার ছায়ার খোঁজ অবধি জানে না।
উর্বশীর ফ্ল্যাটটা একটু ভেতর দিকে। ক্যান্টনমেন্ট সংলগ্ন এলাকায়। ভেবেচিন্তেই এ পাড়াটা বেছে নিয়েছে অতনু। বাড়ির লোকরা কদাচিত এদিকটায় আসে। এদিকে আবার অনেক উর্ধ্বতন কর্মকর্তারও বাড়ি। পরিচিত কারোর সাথে দেখা হলে বেশ বাহানা বানানো যাবে, কোনো উর্ধ্বতন কর্মকর্তার সাথে মিটিং ছিল। যদিও তাকে জেরা করার দুঃসাহস কারোর নেই। এটাই তো ক্ষমতায় থাকার মজা।
ঝাঁকড়া চুলগুলোয় হাত বুলতে বুলতে দ্বিতীয়বার হেসে উঠল অতনু।
পৌঁছতে বিশেষ সময় লাগল না। দারোয়ান এক দেখায় চিনে ফেলল তাকে। সালাম ঠুকে সহাস্যে দরজা খুলে দিলো। গ্যারাজে গাড়ি পার্ক করে বোতলের অবশিষ্ট ম’দটুকু এক চুমুকে শেষ করে তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠল অতনু।
অতনুর উপস্থিতি কীভাবে যেন বুঝে যায় উর্বশী। তার ধ্যানজ্ঞান সমস্তটা জুড়ে এই মানুষটা। প্রত্যেকটা দিন চাতকিনীর মতো বসে থাকে সে মানুষটার কণ্ঠস্বর শুনতে, তার সান্নিধ্য পেতে। মানুষটা এত নিষ্ঠুর! কেবল তড়পায় তাকে।
হতাশামিশ্রিত শ্বাস টেনে সদরদরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল উর্বশী। মিনিটখানেকও হলো না নিজের উপস্থিতি জানান দিতে কলিংবেলে দু’বার চাপ দিলো অতনু। নিমেষে মুখখানা হাসি হাসি হয়ে উঠল উর্বশীর। চমৎকার হাসিটা ঠোঁটে ঝুলিয়ে চট করে দরজা খুলে দিলো।
বাড়িতে সে সবসময় শাড়িই পরে। আধুনিক কায়দায় সুন্দর কুঁচি করে। সেজেগুজে থাকতে হয় না। স্থলপদ্মের মতন সর্বাবস্থায় সে আকর্ষণীয়।
হাস্যোজ্জ্বল উর্বশীর মুখখানার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল অতনু। ঈষৎ হেসে দরজায় হেলান দিয়ে ঠোঁট কামড়ে বলল,
— মাইরি সিস্টার তোমার সৌন্দর্যে একটা অন্যরকম ধার আছে। একফোঁটা প্রসাধনীর চিহ্ন নেই মুখে তা সত্ত্বেও এত মারাত্মক লাগছে! ইন্দ্রসভা থেকে উঠে এসেছ নাকি?
অতনুর প্রশংসায় হাসি গাঢ় হলো উর্বশীর। চোখেমুখে গৌরবের ছাপ স্পষ্ট। খানিকটা অহম নিয়েই সে বলল,
— সাবধান লেকিন। কখন এই ধারে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাও।
মাথা দোলালো অতনু। লতানো কোমরটা বাহুবদ্ধ করে এক ঝটকায় কাছে টেনে নিয়ে ওর এলোমেলো চুলগুলোকে কানের পিঠে গুঁজে দিতে দিতে প্রতুত্তর করল,
— তোমায় ধারালো বানানো শানটা তো আমিই। এত সহজে আমাকে ক্ষত-বিক্ষত করতে পারবে?
অতনুর দিকে চোখ তুলে চাইল উর্বশী। ওর হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় চেপে ধরে বলল,
— সেটাই। গোটা আমিটাকে অধিকার করে রাখার মালিক তো তুমিই। তোমাকে একটা আঁচড় কা’টার সাধ্যিও আমার নেই।
— এতদিন বাদে এলাম। তুমি আবারও ইমোশনাল ডায়লগ দিতে শুরু করলে।
ভীষণ বিরক্ত হলো অতনু। ওর গালে আলতো ঠোঁট স্পর্শ করে উর্বশী হাসল।
— আচ্ছা গুস্তাখি মাফ। এখন বলো তো চোখমুখ এত শুকনো কেন? ঠিকছে খাওয়াদাওয়া করো না নাকি!
— তুমি যত্ন করে খাওয়াও না বলে এমন শুকিয়ে গেছি।
— ইশশ কি মিথ্যে কথা! মিথ্যে কিন্তু তোমাকে একদাম স্যুট করে না বাংগালী বাবু।
— বলছো?
ওপর নীচে মাথা দোলালো উর্বশী। অতনু বলল,
— তবে সত্যি কথাই বলি। সারাদিন অফিসে ছিলাম। ক্লান্ত লাগছে। খাবার দাবার থাকলে কিছু দাও। ইঁদুর ছুটছে পেটে।
— সেকি! চলো তবে হাতমুখ ধুয়ে নাও। খাবার রাঁধাই আছে। গারাম করে দিচ্ছি।
— হু চলো।
চলো বললেও উর্বশীর কোমরটা ছাড়ল না অতনু। বরং আরেকটু কাছে টেনে নিয়ে কাঁধ আর গলায় বার কয়েক নাকমুখ ঘষল, কোমরের কাছটায় ঘনঘন চাপ দিলো;এরপর ছেড়ে দিলো।
এসব আদর-সোহাগ বড্ড পছন্দ উর্বশীর। বারণ করল না সে। এতদিন পর পর সান্নিধ্য পায় মানুষটার। মন ভরে না৷ যদি কোনোকিছু করে তাকে বেঁধে রাখা যেত!
অতনুকে ফ্রেশ হতে বলে চপল পায়ে রান্নাঘরের দিকে এগোতে লাগল উর্বশী। দরজা আটকে ওর পেছন পেছন পা বাড়িয়ে অতনু আচমকা বলে উঠল,
“আর যাই হোক তুমি কিন্তু আমার সুখের রসদ উর্বশী। তোমার ছোঁয়ায় কি জাদু আছে? চোখের পলকে আমার সমস্ত ক্লান্তিগুলো মিটিয়ে দাও”
বিনিময়ে নীরবই রইল উর্বশী, কিছু বলল না। কোন সুখের রসদ সে, শারীরিক নাকি মানসিক? তার তো দুটোই হওয়া চাই। অতনু তাকে কোনটা ভাবে?
চলবে,
Sinin Tasnim Sara
★unedited