১৮+ সতর্কতা
চিঠি দিও
৩১-৩ (সমাপ্তি পর্ব)
__________
রঞ্জু সাহেব উঠে যেতেই আলোচনায় একটু ভাটা পড়ল। বোঝা গেল কথাপ্রসঙ্গ এবার ঘুরতে চলেছে। কপটি ব্যক্তিগুলোর কৃত্রিম মুখাবরণ খুলে খসে পড়তে চলেছে ঝুরো পলেস্তারার মতো। হলোও তাই। হুট করে আলোচনার গভীরতা বেড়ে গেল ভীষণভাবে। আসমা নিজের সম্পৃক্ততা রাখতে চাইছিল না এসবে। ডাইনিং গোছানোর বাহানায় চাচা শ্বশুরের পেছন পেছন উঠে এলো সে। উপস্থিত অন্যেরাও এতে স্বস্তি পেলো খানিক।
বৈষয়িক কোনো আলাপ-আলোচনা চলছিল না যদিও। রাজনৈতিক-পারিবারিক এসব নিয়েই ছাড়া ছাড়া গল্প দীর্ঘ হলো। সবচেয়ে জঘন্য যে বিষয়টা ঘটল, প্রত্যেকে সুযোগ বুঝে আসমাকে উল্লেখ করে নানারকম অপ্রীতিকর মন্তব্য ছুঁড়তে করতে শুরু করল। সূচনা ঘটল যদিও নিজাম চৌধুরীর মাধ্যমে। আসমার গমন পথে বাঁকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে হঠাৎ হাত-পা ছাড়িয়ে বসলেন তিনি। দু আঙুলের ফাঁকে চুরুট নিয়ে বিষাক্ত ধোঁয়াটুকু বার দুয়েক টেনে শ্লেষের সাথে বললেন,
“বউ তো অতনুর খাসা রে। তা এই মেয়েকে পেলি কোথায়?”
উপযাচক হয়ে নিজামের সাথে সাথে বাকিরাও আগ্রহ দেখালো অতনু এবং আসমার বিয়ের গল্প শোনার ব্যাপারে।
পত্নীকে নিয়ে শ্লেষাত্মক মন্তব্য বিশেষ প্রভাব ফেলল না অতনুর মধ্যে। স্বভাবসুলভ হাসি দিয়ে অহমের সাথে তুলে এনে বিয়ে করার গল্পটা সবিস্তারে শোনালো সে। ভাবখানা এমন, বড় গৌরবের কাজ করেছে। সিংহ পুরুষ নিজের শৌর্যে-প্রতাপে অবদমিত করে রাখতে সক্ষম হয়েছে শ্বশুরালয়কে। যাঁদের সাথে নিত্য-নৈমত্তিক ওঠাবসা, সেসব ব্যক্তিগুলোর মন-মানসিকতা অনেকটা কাছাকাছি হওয়ায় মিছে অহমের গল্প শুনে ওরা সাবাশি দিলো বৈকি! নিজাম চৌধুরী অবশ্য কিছু বললেন না। আয়েশি ভঙ্গিতে চুরুটে টান দিতে দিতে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলেন। তার ধারণাই সঠিক, রঙ্গিন রাতের স্মৃতির কিচ্ছুই মনে নেই অতনুর। মনে থাকার কথাও নয়। গাঁ’জার ডোজে এই পৃথিবীতে থেকেও সে ছিল না, হারিয়ে গিয়েছিল এক কল্পনার জগতে। তবে অতনুর স্মৃতিতে ঘটনাটুকু মলিন হয়ে গেলেও নিজাম চৌধুরীর কাছে তা মলিন নয়। বাস্তবিক সে রাতটার মতো জীবন্ত এবং রঙ্গিন। নারী সঙ্গ সহজে ভোলে না নিজাম। এক নারী দেহে অন্য নারীকে কল্পনা করা তার অদ্ভুত ফ্যান্টাসি। আসমাও ফ্যান্টাসির বাইরে নয়। উদ্ভিন্নযৌবনা মেয়েটির ধারালো রূপ এবং সৌষ্ঠব দেহাবরণ মাথা নষ্ট করে দিয়েছিল নিজামের। সে রাতের পরেও একাধিকবার ওকে শয্যাসঙ্গীনি হিসেবে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা ছিল নিজামের মধ্যে। কিন্তু জোর করে নয়, স্বেচ্ছায়। কত রকমের প্রলোভন যে দেখিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। উঁহু মেয়ে রাজি হয়নি, উল্টো মেয়ের বাবা শাসিয়েছিল পলিটিক্যাল ক্যারিয়ার ধ্বংস করে দেবে। ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দার। অমন বালখিল্য হুমকি-ধমকিতে যা হাসি পেয়েছিল নিজামের! এরা বাপ মেয়ে পাগল নাকি? ক্যারিয়ার ধ্বংস তো দূরের ব্যাপার নিজাম চৌধুরী পর্যন্ত হাত বাড়ানোর চেষ্টা করে দেখুক! কীভাবে ওদেরকেই ধ্বংস করে দেয়। অতিরিক্ত দুঃসাহস দেখাতে এসেছিল বাপ-মেয়ে। প্রবল বিরক্তিতে আকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করে ওদেরকে সরিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল নিজামকে। কাজটা যদিও সে নিজে হাতে করেনি, আনিসকে দায়িত্ব দিয়েছিল। এখন বোঝা যাচ্ছে বিরাট ভুল হয়ে গেছে। চরম দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিয়েছে আনিস। নইলে এই মেয়ে বেঁচে ফেরে কি করে? ভাগ্যিস আনিস উপস্থিত নেই। রোষানল থেকে রেহাই পেত না সহজে। এমনিতেও অবশ্য পাবে না। জবাবদিহিতা ওকে করতেই হবে। এতবড় কাণ্ডজ্ঞানহীন লোক আনিস হতে পারে ভাবতেও কষ্ট হয় নিজামের।
তবে একটা জিনিস কিছুতেই মিলছে না। ভাগ্যের জোরে মেয়েটা বেঁচে গেলেও ওর পরিবারের সদস্যরা নিশ্চয়ই বাঁচতে পারেনি। এতটা কাঁচা কাজও আনিস করবে না, এ ভরসাটা আছে। নাহ্, কোনো না কোনো ঝামেলা তো এখানে অবশ্যই আছে; যা বাইরে থেকে বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু খোঁজখবর লাগালে নিশ্চিত কিছু না কিছু পাওয়া যাবে।
তবে যাইহোক এ কথাও ফেলে দেয়ার নয় এতদিন বাদে পুনরায় আকাঙ্ক্ষিত মেয়েটাকে চোখের সামনে দেখার পর থেকে ক্ষণে ক্ষণে নিজামের শরীরে কামনার অদ্ভুত তরঙ্গ খেলে যাচ্ছে। অদৃষ্ট ওকে পুনরায় টেনে এনেছে কালকুঠির দুয়ারে। এত সহজে এবার মুক্তি মিলবে না। মিলতে দেবে না নিজাম।
অদূর বিধ্বংসী পরিকল্পনার ছক আঁকাতে আঁকাতে নিজামের ঠোঁটের বক্র হাসি ক্রমশ গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়ে ওঠে।
ওদিকে ডাইনিংয়ের সামনে থেকে প্রায় আলোচনাই স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিল আসমা। একেকটা কথা কানে আসছিল আর দেহে বড় বড় ঘায়ের সৃষ্টি হচ্ছিল যেন তার। অতনু হাওলাদার মানুষটাকে ঘৃণা করার শতকোটি কারণ তৈরি হয়ে চলেছে প্রত্যেকদিন৷ একটা মানুষ এরূপ নিম্ন স্তরের কীভাবে হতে পারে?
অন্যের সাথে তাল মিলিয়ে নিজের স্ত্রীকে অসম্মান করা ভরা মজলিসে তাকে বিবস্ত্র করার মতোই ঘৃণিত এবং জঘন্যতম একটি অপরাধ৷
লোকে বলে বিয়ে নাকি একটা দায়িত্বের নাম। আচ্ছা তাদের কাছে দায়িত্বের সঠিক সংজ্ঞাটা কি? শুধু সঙ্গীর ভরণপোষণ কিংবা দৈহিক চাহিদার মধ্যেই কি দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়! তার আত্মিক চাহিদা কিংবা সম্মানের খেয়াল রাখার কোনো প্রয়োজনীয়তাই নেই? স্বামী-স্ত্রী তো একে অপরের আব্রুর মতো। যারা কিনা সর্বাবস্থায় একজন অপরজনকে সমস্ত পঙ্কিলতা থেকে হেফাজত করার ক্ষমতা রাখে।
সেখানে কেউ যদি এসবের ন্যূনতম তোয়াক্কা না করে বাইরের মানুষের সাথে তাল মিলিয়ে স্ত্রী-বিশ্লেষণে বসে যায়, তাহলে আদতে সে কখনো “সঙ্গী” সম্বোধন পাবার অধিকার রাখে না। কারণ তিন কালিমার জোরে স্বামী ঠিকই হওয়া যায়,কিন্তু সঙ্গী নয়।
চাপা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে টেবিল সেট করে ওপরের দিকে পা বাড়ায় আসমা৷ পরপর এতগুলো ধাক্কা একসঙ্গে নেবার ক্ষমতা ওর নেই। শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটছে দ্রুত। ঔষধ না নিতে পারলে অভিনয় চালিয়ে যাওয়ার শক্তিটুকু হারিয়ে ফেলবে। নিজের অসুস্থতার সাথে ফাইট করে স্বাভাবিক থাকার অভিনয় কতটা কঠিন ক্রমে উপলব্ধি করছে আসমা। আর সময় নষ্ট করা চলে না। যে উদ্দেশ্যে এ বাড়ির চৌকাঠ মাড়িয়েছে, জলদি তা সাধন করে মুক্তির খোঁজে পা বাড়াতে হবে। জীবনের থেকে ওর চাওয়ার কিছু নেই, না আছে বেঁচে থাকার কোনো কারণ। চব্বিশ-পঁচিশ বছরের ছোট্ট জীবনটার বেশি অর্ধেক সময় ওর ভীষণ সুখে কেটেছে। চমৎকার একটা পরিবারে জন্মে নিজেকে সৌভাগ্যবতী বলে অভিমান হয়েছে। যে পরিবারের প্রত্যেকটা সদস্য স্নিগ্ধ এক ভালোবাসার পরশে সিক্ত করে রাখত ওর সারাবেলা। অতীতে প্রায়শই ও ভাবত, পুনর্জন্ম বলে সত্যি কিছু থাকলে সৃষ্টিকর্তার দরবারে করজোড়ে একটা জিনিসই চাইবে, অন্য জন্মটায় এই গর্ভধারিনীর জঠরেই যেন ওর ঠাঁই হয়;এই পরিবারটাই যেন ওর আপন পরিবার হয়। এমন সুখের জীবনটাই যেন ও বারবার ফিরে পায়।
তবে আজ সময়ের কাছে ঠকে গিয়ে কিছু ক্লেশ গায়ে মাখার পর আর মনে হয় না পুনর্জন্ম সত্যি হোক,দ্বিতীয় আরেক জন্ম হোক; আরেকটা আসমার সৃষ্টি হোক। অতীতের সুখ পৃথিবীটাকেই আজ এত অসহ্য মনে হয় আসমার কাছে! মনে হয় আসমা নামক কারোর অস্তিত্ব না থাকলেই বোধহয় ভালো হতো!
চার দেয়ালের নিগূঢ় আঁধারে বিষাক্ত নিঃশ্বাস একে অপরের গায়ে ধাক্কা খেয়ে চতুষ্কোণে ছড়িয়ে পড়ে। ডেস্কের ড্রয়ার থেকে ঔষধের ছোট্ট শিশি বের করে একমুঠো ঔষধ মুখে পুরতে ইচ্ছে করে আসমার। থেমে যায় প্রতিশোধ নামক সংকল্পের কাছে। ভারী নিঃশ্বাস ফেলে দুটো ট্যাবলেট খেয়ে পুনরায় রেখে দেয় শিশিটা তার স্ব স্থানে। এরপর ক্ষণ কতক মাথা নীচু করে বিছানায় বসে থাকে। হালকা সবুজ ফুলের অফহোয়াইট বেড শিটটায় আনমনে আঙুলের আঁকিবুঁকি করে। খারাপ স্মৃতিগুলো অক্লান্ত চরকির মতো ঘুরপাক খেতে থাকে ওর মনে, মস্তিষ্কে। জোর খাটিয়েও এক মুহুর্তের জন্য ওগুলোকে সরাতে পারে না মস্তিষ্ক থেকে। একসময় ওর মায়াময়ী মনটার সমস্ত মায়া উবে গিয়ে প্রতিহিংসার অনল দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে। হিতাহিতজ্ঞানশূন্য ও চোখ মুছে এগিয়ে যায় কাঠের আলমারির দিকে। অন্দরের ছোট্ট দুটো ড্রয়ারের আড়ালে লুকিয়ে আছে বিভিন্ন সাইজের অসংখ্য কাঁচের শিশি যা একজন মানুষকে ভয়ানক সব মৃত্যুর সাথে পরিচয় করাতে সক্ষম। হাতের তালুতে সিক্ত চোখজোড়ার নোনাঅশ্রুটুকু মুছে একটা শিশি হাতে তুলে নেয় ও। আজ সব্বার খাবারে মিশিয়ে দেবে এই গরল। পৃথিবীর বুক থেকে নিকৃষ্ট মানুষগুলোকে নিশ্চিহ্ন করে চিরতরে বন্ধ করে ফেলবে জয়-পরাজয়, ঘৃণা-বিষাক্ত ভালোবাসা আর প্রতিরূপ-প্রতিহিংসের শব্দকাহনে সাজানো অভিশপ্ত বইটা।
জঠরের কাছে স্ট্রিকনিনের ভায়াল গুঁজে লম্বা শ্বাস টেনে তবেই ঘর ছেড়ে বেরয় আসমা। ভগ্ন বেশ ছেড়ে পূর্বের মতো সুস্থ-স্বাভাবিক রূপ ধারণ করে জাত অভিনেত্রীর মতো। ক্র্যাচে ভর করে কদম বাড়ায় সিঁড়ির দিকে, তখনই থেমে যেতে হয় মিষ্টি সুরের “ভাবী” সম্বোধনে। পেছন ফিরে দোরের কাছে অভ্রকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। ঘুমে ঢুলুঢুলু অভ্র হেলেদুলে ভাবীর সামনে এসে উপস্থিত হয়। কাতর গলায় শুধয়,
— ভাবী ক্ষুধা পেয়েছে। খাবার হয়নি?
— হয়েছে তো। খাবে? বেড়ে দেব?
উজ্জ্বল হাসির সাথে হ্যাঁ সূচক মাথা দোলায় অভ্র। বিপরীতে আসমা হাসে। আলতো করে গাল টেনে দিয়ে ওর কাঁধে হাত রেখে বলে,
— চলো।
নিষ্কলুষ মাতৃত্ববোধের প্রভাব কি না কে জানে! শিশুটির সাহচর্য ওর অন্দরের অশান্তি হুট করে কমিয়ে দেয়। অবচেতনে জঠরের কাছে যেখানটায় শিশি গুঁজে রাখা ওখানে হাত চলে যায়। সাথে অপরাধবোধের পলকা অনুভূতি নাড়া দিয়ে যায় মনে। দু সত্তায় ভাগ হয়ে একটি সত্তা ওর বিবেকের কাছে প্রশ্ন রাখে “নিরপরাধ মানুষগুলোকে এসবে টেনে আনা খুব জরুরী?” পরক্ষণেই দ্বিতীয় সত্তা বিদ্রোহ করে ওঠে,
“আলবাত জরুরী। অতীতে ও কিংবা ওর পরিবারও তো নিরপরাধ ছিল। অদৃষ্টের কাছে ওরা রেহাই পায়নি। এরাও পাবে না। কখনও না”
______________
রওনক তক্কে তক্কে আছে কখন সুযোগ মেলে আর কখন সে প্রিয়তমার ঘরে একটু ঢু মেরে আসে। তবে পরিস্থিতি দেখে যা মনে হচ্ছে আজ আর তাকে চমকে দেয়ার সুযোগ রওনকের হাতে আসবে না। অতনুর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বর্শার মতো যেভাবে গেঁথে আছে ওর ওপর! আচ্ছা বদমাশটা কি কিছু সন্দেহ করল?
অবচেতনে প্রশ্নটার উদ্ভব হলে অতনুর দিকে চোখ তুলে তাকাল রওনক। চোখাচোখি হলে কৃত্রিম সৌজন্যের হাসি ফোটালো দু’জনেই। আজকে রওনককে নিয়ে বেশ কিছু প্রশংসাসূচক বাক্য বেরিয়েছে অতনুর মুখ দিয়ে। শুধু অতনু বললে ভুল হবে সকলেই ওর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। “এই ছেলের ভবিষ্যৎ সুদূরপ্রসারী” এমন ভবিষ্যদ্বাণী করতেও অনেকে বিন্দুমাত্র দ্বিধাগ্রস্ত হয়নি।
এরপর আর উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটতে দেখা গেল না। রাতের খাবারের সময় হওয়ায় অতিথিদের নিয়ে ডাইনিংয়ের দিকে অগ্রসর হলো অতনু। খাওয়াদাওয়ার পর্ব মিটতে ঘড়ির কাঁটা অনেকটা এগোল। বারোটার পর মানে নূতন প্রহরের গননা। অতিথিদের বিদায় জানানোর সময় নিজাম ওর কাঁধে হাত রেখে মৃদু চাপ দিয়ে কৌতুক সুরে বললেন,
“সাথে চল। কাচারিতে বসতে হবে জরুরী কথা”
অতনুর যদিও ইচ্ছে ছিল না তেমন। তবে না করতে পারল না ও। মাথা দুলিয়ে আসমাকে জানিয়ে নিজামের সাথেই রওয়ানা হলো। সঙ্গে চতুরতার সাথে রওনককেও ডেকে নিতে ভুলল না। আজকের অতনুর হাবভাবে রওনক বুঝে গেল সন্দেহের তীর বিদ্ধ হয়ে গেছে ওর নিশানায়। নিশানা পাল্টানো আর সম্ভব নয়, তবে তীরের আঘাত থেকে দূরে সরার প্রয়াস শক্ত হাতেই করতে হবে।
অতনুর ভাবনা একরকম থাকলেও নিজামই চাইছিল না ওদের এসব আলোচনায় তৃতীয় কারোর উপস্থিতি থাকুক। কার্যসিদ্ধিতে বিঘ্ন ঘটতে পারে এতে। আশংকার ফলে কাচারি থেকে দ্রুতই ছুটি মিলল রওনকের। হোন্ডা পিটিয়ে ও আর বাড়ির পথ ধরল না। পুনরায় ফিরে এলো প্রিয়তমার নীড়ে। কোনোরূপ রিস্ক নিতে ইচ্ছে করল না ওর। হোন্ডা নিয়ে সোজা পেছনের গেট নির্দেশক গলির মুখে এসে দাঁড়াল। কসরত করা ওর শরীর পাচিল টপকাতে বিশেষ কষ্ট হলো না। লাইলির মজনু সেজে ও পটাপট পাইপ বেয়ে দোতলায় উঠে গেল। ভাগ্যিস বারান্দা হাফ ওয়ালের, গ্রীল লাগানো নেই বলে রক্ষে!
দ্বিতীয়বার রওনক যখন পা রেখেছে পুরো বাড়ি নিঝুম নিস্তব্ধতায় ডুবে। বারান্দায় লাগিয়ে রাখা কম পাওয়ারের বাতির ক্ষীণ আলোয় যতটুকু দৃশ্যমান পা টিপে টিপে সেই অনুসারে প্রিয়তমার দোরের সামনে উপস্থিত হলো রওনক। উপমার একটা বাজে অভ্যেস আছে, দরজা আটকে ও ঘুমাতে পারে না। সেজো ভাইয়ের কত ধমক খেতে হয়েছে তার জন্য। প্রতিদিন নিয়ম করে অতনু ধমক লাগিয়ে দরজায় খিল দেয়ায় ওর দ্বারা। আজ যেহেতু ভাই নেই তাই স্বভাবসুলভ উপমা দরজা আটকাতেও ভুলে গেছে। ফলে নকের উদ্দেশ্যে হাত রাখা মাত্র মৃদু ক্যাঁচ শব্দে দরজা খুলে যেতে দেখল রওনক। ভ্রু জোড়ায় ভাঁজ পড়ল ওর। বিলম্ব না করে ঘরে ঢুকে চট করে খিল তুলে দিলো। এরপর সুইচ বোর্ড খুঁজে বাতি জ্বালালে নজরে এলো পাতলা একটা কাঁথা আগাগোড়া জড়িয়ে ওর প্রিয়তমা ঘুমে কাঁদা। মাথার কিছু অংশ কেবল কাঁথার ফাঁক গলিয়ে বেরিয়ে আছে। অজান্তে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল। একটা হাত মুখের সামনে এনে পরীক্ষা করে দেখল নিঃশ্বাসে নেশাদ্রব্যের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে কি না। যাচ্ছে তবে ক্ষীণ। দূরে বসে কথা বলতে হবে ভেবে নিঃশব্দে বিছানার পাশে গিয়ে দাঁড়াল রওনক। ঘরময় দৃষ্টি বুলিয়ে উপমার পাশে বসে কাঁথাটা সরিয়ে দিলো মুখের ওপর থেকে। দৃশ্যমান হলো ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত, ঈষৎ ফোলা ভীষণ মায়াময় ঘুমন্ত মুখটা। একরাশ মুগ্ধতায় ডুবে গেল যেন সে। স্বভাবসুলভ আলতো হাতে প্রেয়সীর চিবুক স্পর্শ করে মৃদু-মধুর করে হাসলো। সস্নেহে মাথায় হাত বুলতে বুলতে যত্ন নিয়ে ডাকল,
— উপমা? এ্যাই মেয়ে ওঠো তো একটু।
বলা বাহুল্য উপমার ঘুম বিশেষ গাঢ় হয় না। লাইটের তীব্র আলোয় পূর্বেই ওর ঘুমে ব্যাঘাত ঘটেছে, মাথার ওপর শক্ত তালুর স্পর্শ এবং ভরাট কণ্ঠস্বরে এবার তো ঘুমটাই ভেঙে গেল। চোখ মেলে প্রেমিক পুরুষের অবয়ব দৃষ্টিগোচর হওয়ামাত্র হুড়মুড় করে উঠে বসল সে। চোখ মুছে জড়ানো গলায় উদ্বেগ ফুটিয়ে বলল,
— পাগল নাকি আপনি? না বলে না কয়ে হুট করে এখানে এলেন। আমার ভাই জানতে পারলে না… গলা শুকিয়ে আসছে তো।
উদ্বিগ্নতার সাথে বিরক্তিও ঝরে পড়ল উপমার কণ্ঠে। বিনিময়ে অস্থির হয়ে ওঠা প্রিয়তমাকে একহাতে কাছে টেনে নিয়ে মাথায় ফু ফু করে শান্ত করার চেষ্টা করল রওনক। ভ্রু জোড়া সংকুচিত করে বিড়বিড় করে বলল,
— ভাই দেখে ফেললে তো ভালই। লুকোচুরির অবকাশ নেই। সোজা বিয়ে করে ফেলব আমরা।
— উফফ রওনক, বলতে যতটা সহজ মনে হয় ততটা সহজ নয় এসব। ছাড়ুন তো। ফিরবেন এখন। নামুন বিছানা থেকে।
— কত কষ্ট করে এলাম আর তুমি আমায় তাড়িয়ে দিচ্ছ?
আহত স্বরে কথাটা বললে ওর দিকে পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকাল উপমা। কানের পিঠে চুল গুঁজে শক্ত গলায় বলল,
— বেশ করছি। এতবড় রিস্ক নেয়ার আগে আমায় জানানোর প্রয়োজন ছিল আপনার। দিনে দিনে বাচ্চা হয়ে যাচ্ছেন যেন।
— আরে পাগল মেয়ে তোমাকে ছাড়া থাকতে পারি না তো। তাই বার-বার ফিরে আসি।
এ কথার প্রেক্ষিতে অচীরে হাসি ফুটে উঠতে দেখা গেল উপমার ঠোঁটের কোণে। প্রেমিক পুরুষের মুখে ভালোবাসার কথা আনন্দ দেবে স্বাভাবিক। তথাপি নিজের কাঠিন্য বজায় রেখে চটপট বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াল। কোমরে হাত রেখে বলল,
— থাকতে পারেন না তাহলে বাসায় বলুন। বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে আসুন। তা তো আর পারবেন না।
— তুমি কি আমাকে ভীতু বলার চেষ্টা করছো?
— ভীতু নন আপনি! রাতের আঁধারে নজর বাঁচিয়ে প্রেমিকার ঘরে কারা আসে জানেন? থাক কঠিন শব্দ মুখে আনতে চাইছি না।
দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিলো উপমা। তা দেখে ছোট্ট শ্বাস ফেলে রওনকও উঠে দাঁড়াল। উপমার বাহু ধরে নিজের দিকে ফিরিয়ে আফসোসের সাথে বলল,
— বড্ড কঠোর তুমি মেয়ে। ঠিকাছে এবার থেকে যা হবে সামনা-সামনি হবে, ঝাঁ চকচকে দিনের আলোয়। প্রস্তুতি নাও বিয়ের ঘোড়া সওয়ার হলো বলে।
— আগে আপনি সওয়ার হয়ে দেখান। প্রস্তুতি আমার নেয়াই আছে।
— আচ্ছা তাই!
ঠোঁট কামড়ে হাসলো রওনক। ঈষৎ মাথা ঝুঁকিয়ে কানের কাছে মুখ এনে বলল,
— চিঠিটাও তবে তখনই দেই কি বলো?
এই একটা বাক্য; এক বাক্যের চোখজোড়া প্রসারিত হয়ে গেল উপমার। রওনকের বুকের কাছে শার্ট মুঠোয় চেপে ধরে বিস্ময়মিশ্রিত কণ্ঠে শুধল,
— আপনি চিঠি লিখেছেন আমার জন্য?
— লিখেছিলাম তো বটে। তবে এখন আর দেব না। রাতের আঁধারে দিলে তো…
বাক্য অসম্পূর্ণ রেখে প্রিয়তমার রঙহীন চেহারায় একবার দৃষ্টি বোলালো। বলল,
— চিঠিও পাবে দিনের আলোয়। সকলের সামনে, স্বীকৃতি পাবার পর।
— ইশশ আমি ততদিন অপেক্ষা করব কি করে? দিন না রওনক, দিন না।
বিষণ্ন গলায় গোঁ ধরল উপমা। ঠোঁট চেপে দু’দিকে মাথা নাড়ল রওনক। যার অর্থ সুযোগ হারিয়ে ফেলেছে। কাতর হয়ে উপমা কিছু বলতে চাইল, তার পূর্বেই ওর কথার গতি রোধ করে রওনকের প্যান্টের পকেটে সেলফোনটা ভাইব্রেট করে উঠল মৃদু মৃদু শব্দে, যা ও সন্ধ্যারাতেই উপহার পেয়েছিল অতনুর কাছে। সামনের দেয়াল ঘড়িতে দৃষ্টি বুলিয়ে ভ্রু কুঁচকে ফেলল রওনক। এত রাতে আবার কে কল করে? নূতন নম্বর তো থাকার কথা নয় কারোর কাছে। পকেটে হাত দিয়ে সেলফোনটা বের করলে বিস্ময়ভাব বেড়ে গেল। অপরিচিত একটি টেলিফোন নম্বর। হাতের ইশারায় উপমাকে চুপ করতে বলে কল রিসিভ করে কানে ঠেকালো রওনক। হ্যালো বলার অবকাশ পেলো না তার পূর্বেই ওপাশ থেকে ভেসে আসতে শোনা গেল অতনুর শীতল কন্ঠস্বর,
— রওনক যে পজিশনে আছিস কয়েকটা পোলারে নিয়া বাইর হয়া আয়। একটা লাশ গুম করতে হবে।
অপরপ্রান্তের এমন ভয়ানক বাক্য নিমেষে রওনকের চেহারার সব রঙ উড়িয়ে দিলো।
ফোনের স্পিকার বেশ লাউড হওয়ায় সে ভয় পেলো উপমার কানে না কথাগুলো চলে যায়। শুকনো হেসে উপমার থেকে খানিক দূরে গিয়ে নীচু স্বরে প্রশ্ন করল,
— কিসব বলতেছেন ভাই। মাথা ঠিক আছে? আপনি কারে…
পুনরায় পেছন ঘুরে উপমার দিকে তাকাল। ইশারায় উপমা জানতে চাইল, “কি?”
জবাবে আশানুরূপ কিছুই বলতে পারল না রওনক। মাথা দুলিয়ে ফোনটা আরেকটু শক্ত করে চেপে ধরে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। গরাদে হাত রেখে চাপা গলায় কিছু কথোপকথন চালালো যা উপমার বোধগম্য হলো না।
মিনিট দুয়েকের কথোপকথন শেষে দ্রুত হাতে ফোনটা পকেটে পুরে উপমার কাছে এগিয়ে এলো। দু’হাতে ওকে বুকে জড়িয়ে কপালে আলতো স্পর্শ এঁকে রওনক বলল,
— আমাকে যেতে হবে উপমা। জরুরি কাজ পড়ে গেছে।
— কোনো সমস্যা?
পলক ঝাপ্টে উদ্বিগ্ন স্বরে জানতে চাইল উপমা। জবাবে পুনরায় দু’দিকে মাথা দোলালো রওনক। কপোলে শীতল হাতের স্পর্শ দিয়ে ত্রস্তে বেরিয়ে গেল।
ওর মাথায় একটা কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে, প্রকৃতি নিজে থেকে কি প্রতিশোধের অবকাশ দিলো ওকে? এই মুহুর্তে ওর সামনে দুটো পথ একসঙ্গে খুলে গেছে,
এক. অতনুর কথা অনুযায়ী ছেলেপেলে জুটিয়ে ওকে সাহায্য করে বিশ্বস্ততা অর্জন করবে আর দুই. সোজা পুলিশ ডেকে অতনুকে ধরিয়ে দেবে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, রওনকের চেতনা এবং বিবেক উভয়ই দ্বিতীয় পথ অবলম্বনের দিকে জোর নির্দেশ জানাচ্ছে। দেখা যাক আদতে কোন পথ ও অনুসরণ করে।
নিস্তব্ধতার বুকে চিঁড় ধরিয়ে সাধের জলপাই রঙা হোন্ডায় তীক্ষ্ণ শব্দ তুলে জনহীন পথে স্পিড বাড়াতে বাড়াতে রওনকের ঠোঁটে গাঢ় হলো কুটিল, বক্র একটি হাসির রেখা। ওর হাসিই বলে দিচ্ছে পথ অনুসরণে বিন্দুমাত্র বিলম্ব করেনি ও।
কে জানে ওর এই সিদ্ধান্ত নূতন করে কোনো বিধ্বংসী গল্পের সূচনার ইঙ্গিত জানাচ্ছে কি না!
সমাপ্ত
Sara
★সমাপ্ত বলতে একেবারে সমাপ্ত নয়। অনির্দিষ্ট সমাপ্ত মানে প্রথম খণ্ডের।
দ্বিতীয় খণ্ড শুরু হবে দ্রুতই ইনশাআল্লাহ