৯+১০
#একগুচ্ছ_ভালোবাসা
লেখনীতে : আনিশা সাবিহা (ছদ্মবেশী)
পর্ব : ৯
আশেপাশে চোরের মত উঁকি দিলাম আমি। সোফার দিকে চোখ যেতেই ধড়ফড় করে উঠলাম। অনুরাগের ভয়ে বেড থেকে তাড়াতাড়ি নেমে গেলাম। তারপর আবার উনার দিকে তাকালাম। স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লাম আমি। অনুরাগ ঘুমোচ্ছেন গুটিশুটি হয়ে। তবুও মনের মাঝে একটা প্রশ্ন থেকেই যায়। আমি এখানে কেন? আর অনুরাগ কি আমার জন্য সোফায় ঘুমোচ্ছেন? কিছুক্ষণ ভেবে ও যখন উত্তরের কোন কূলকিনারা পেলাম না তখন গুটি গুটি পায়ে হেঁটে উনার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। উনি কি সত্যিই ঘুমিয়ে আছেন? একটা শুকনো ঢোক গিলে অনুরাগ এর দিকে একটু হেলে তাকালাম। সাথে সাথে নিজের বড় বড় চোখ গুলো মেললেন উনি। আমি চমকে সোজা হয়ে কয়েক ধাপ পিছিয়ে গেলাম। চোখ বন্ধ করে হাত সামনে রেখে জোরে জোরে বললাম….
–“আমি ইচ্ছে করে বিছানায় ঘুমোয়নি। ক…কি করে যে আমি সেখানে ঘুমিয়ে পড়লাম আমি জানি না। প্লিজ আমাকে কিছু বলবেন না।”
–“আমি তোমাকে ওখানে শুইয়ে দিয়েছিলাম।”
লোকটার কথায় হাত সোজা করে রেখে ওনার দিকে তাকালাম। আমি বিস্মিত কন্ঠে বললাম….
–“আপনি??”
–“হুম আমি।”
আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম। উনি আমাকে বিছানায় শুইয়েছেন? ব্যাপারটা যেন কোন মতেই হজম হলো না। আমার চোখ আরো বিস্মিত হল। যা দেখে অনুরাগও ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। সূক্ষ্ম গলায় বললেন…
–“কি হয়েছে এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? আমার মুখে কি কিছু ভরে আছে? নাকি আজব লাগছে দেখতে?”
–“না কিছুনা। (থতমত খেয়ে)
উনি কিছু না বলে ওয়াশরুমে চলে গেলেন। আমি হাবলাকান্ত হয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলাম। এটা কি স্বপ্ন ছিল? আমার ভাবনার অন্ত না হতেই অদ্রিজার কান্না কানে এলো। ও ঘুম থেকে উঠে পড়েছে। ফোলা আপেলের মত মুখটা সূর্যের আলোতে আরো লাল হয়ে যাচ্ছে। আমি মুচকি হেসে মেয়েটার দিকে এগিয়ে গেলাম।
সকাল হতে না হতেই সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। আমি রান্না ঘরে ঢুকছি আর বের হচ্ছি। যেন ব্যস্ততার অন্ত নেই আমার। নৌশিনও টুকটাক আমাকে সাহায্য করে চলেছে। ওদিকে অদ্রিজা কে নিয়ে বসে আছে অর্ণব এবং অনুরাগ। বর্ণদা এখনও নিচে নামেনি। হয়তো এখনো পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছে। কেননা ছোটবেলা থেকে বর্ণদার অভ্যেস দেরিতে ঘুম থেকে ওঠা। হয়তো আজও সেই অভ্যাস রয়ে। গেছে এক সময় আমিও তার অভ্যাস ছিলাম। এখন হয়তো আমি নেই। তবে একদিক থেকে ভালোই হয়েছে। বর্ণদা থাকলে ঠিকঠাক কাজ হয়তো আমার দ্বারা হবে না। ওর মুখোমুখি হতে আমার হাত-পা কাঁপে। তাই এই ক্ষেত্রে সুবিধা হয়েছে। কিন্তু সুবিধা জিনিসটা বেশিক্ষন টিকলো না। শিস বাজাতে বাজাতে একপা দুপা করে এসে থেকে নেমে পড়ল সে। তার শিস বাজানোর শব্দ শুনে আমি বুঝে গেলাম সে ঘুম থেকে উঠেছে। নিজের কাজে ব্যস্ত থাকার চেষ্টা করলাম আমি।তবুও নিজের চোখ জোড়া থেমে থাকল না উকিঁ দিলাম রান্নাঘর থেকে ড্রইংরুমে। তবে বর্ণদার দিকে চোখ গেল না। চোখটা গেল অনুরাগ এর দিকে। চোখ জোড়া কি কনফিউজড হয়ে গেল? অদ্ভুত ব্যাপার স্যাপার….! চোখ ফিরিয়ে নিজের কাজে মন দিলাম।
রান্না বান্না সেরে নৌশিনকে বললাম সবাইকে যেন ডেকে নেয় খাবার টেবিলে। নৌশিন মাথা নাড়িয়ে রান্না ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে গেল।
আমি একে একে খাবারগুলো টেবিলে নিয়ে যেতে লাগলাম। সবাই ধীরে ধীরে খাবার টেবিলে এসে বসে পড়ল। আমিও সবশেষে ডিম ভাজির বাটিটা নিয়ে যেতে লাগলাম খাবার টেবিলের দিকে। টেবিলের কাছে যাওয়ার সাথে সাথে পায়ে হালকা চিনচিন ব্যাথা করে উঠলো। পায়ের দিকে মোচড় খেলাম আমি। হাত থেকে কাচের বাটি টা পড়ে গিয়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। পায়ের যন্ত্রণায় পড়ে গেলাম আমি ডান হাতটা গিয়ে কাঁচের টুকরোগুলো ওপরে পড়লো যন্ত্রণায় চেঁচিয়ে উঠলাম আমি। আমার চেঁচানো দেখে সবাই ছুটে এলো। ডান হাতটা উঠিয়ে দেখতেই চমকিত হলাম। হাতের ভিতর কাঁচের টুকরোগুলো লেগে আছে আর হাত থেকে রক্ত বের হতে শুরু করেছে। ভয়ে কেঁদে দিলাম। আমি আমার কান্না দেখে তড়িঘড়ি করে অনুরাগ ও বর্ণদা বসে পড়লো হাঁটু গেড়ে। বর্ণদা আমার হাত ধরার আগেই অনুরাগ আমার হাত ধরে ফুঁ দিতে থাকলো। বর্ণদার মুখটা একটু থমথমে হয়ে গেল। অনুরাগ তখনও খেয়াল করেনি বর্ণদাও তারই মত অস্থির হয়ে বসে আছে। উনি আমার হাত নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। অনুরাগ অস্থির কন্ঠে বললেন….
–“নিজের খেয়াল রাখতে শেখোনি অনুশ্রী?কি করলে সব বলতো?”
আমি কান্না থামিয়ে উনার অস্থিরতা দেখতে থাকলাম। আমার ব্যাথাতে কি মনে কষ্ট পাচ্ছেন? নৌশিন আমার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো….
–“এসব কি করে হলো? কিভাবে পড়ে গেলে…?”
–“তেমন কিছু না পা মোচর দিয়ে উঠেছিল তাই….”
অনুরাগ আমাকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দিলেন।
আমাকে উঠিয়ে তড়িঘড়ি করে ওপরে নিয়ে চলে এলেন। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমার হাত থেকে কাঁচের টুকরোগুলো বের করেন। আমি চোখ বন্ধ করে শুধু ব্যাথা অনুভব করছিলাম। এবার সত্যি সত্যিই আমার মনে হচ্ছে অনুরাগই তো এই লোকটা? উনি যে এতটা কেয়ার করবেন সেটা আমার ভাবনার বাইরে ছিল। মুখটা হাঁ করে তাকিয়ে আছি আমি। লোকটার দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছি ওনার মধ্যে কি পরিবর্তন এসেছে?? সব কিছুই হয়তো মায়ার খেলা! বাড়িতে তো একটা পোষা প্রাণী থাকলেও তার প্রতি মায়া জন্মে তার খেয়াল রাখতে ইচ্ছা হয়। হয়তো এখানেও ঠিক আমার ক্ষেত্রে তাই হয়েছে।
আমার হাতে ব্যান্ডেজ করে দিয়ে আমার দিকে চোখ তুলে তাকালেন অনুরাগ। এতক্ষণ যেন উনি একটা উত্তেজনার মাঝে দিয়ে যাচ্ছিলেন। দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে উনি স্বস্তির কন্ঠে বলে উঠলেন….
–“ব্যাথা কমেছে…?
আমি তখনও চুপ। আসলে ওনার ভেতরকার পরিবর্তন দেখতে বড়ই ব্যস্ত। আমি মনে হচ্ছে অন্য অনুরাগ কে দেখছি।
এরই মাঝে উনার যেন হুঁশ ফিরে এলো। যেন নিজের কাছে নিজেই হতভম্ব উনি। এপাশ-ওপাশ তাকিয়ে বললেন,,,
–“আসলে তোমার লেগেছিল তাই একটা অস্থির হয়ে পড়েছিলাম। সরি!”
–“এতে সরি বলার কী হলো? আপনি কি কোনো
অন্যায় করেছেন?
অনুরাগও হয়তো কয়েক সেকেন্ড তাই ভাবলেন। সত্যি তো সে কোন অন্যায় করেননি। থতমত খেয়ে কি করবেন সেটা ভেবে না পেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। উনার কাজে আমি একটু হাসলাম। তারপর আমিও বের হয়ে গেলাম উনার পিছন পিছন। ড্রইং রুমে যেতেই সবাই আমাকে এটা ওটা প্রশ্ন করতে শুরু করল। আমি ঠিক আছে কিনা আমার বেশী লেগেছে কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি! কিন্তু আমার এই চোখ জোড়া চলে গেল বর্ণদার দিকে। সে এক পাশে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে। একবার আমার দিকে তাকাচ্ছে। আমি সবার কথার প্রতিত্তোরে হু হা বললাম। সবাই স্বস্তি মনে গিয়ে আবারও খাবার টেবিলে বসলো। তবে বর্ণদা সেখানে দাঁড়িয়ে থাকল এক কোনে। সবাই চলে গেলে অনুরাগও গলা খাঁকারি দিয়ে গিয়ে খাবার টেবিলে বসলেন। বর্ণদা গুটিগুটি পায়ে আমার কাছে এগিয়ে এলো। গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলো…
–“এখন ব্যাথা কমেছে?”
আমি মাথা নাড়ালাম। সেও মাথা নাড়িয়ে বলল…
–“হ্যাঁ তা তো কমবেই। তোর বর ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে বলে কথা। অবশ্যই যত্নের সাথে ব্যান্ডেজ করেছে। হয়তো হাতে দু’একখানা চুমুও দিয়েছে। তাতে তো একবারে ব্যথা সেরে গেছে তাই না রে?”
আমি ভ্রু কুঁচকে তীক্ষ্ম গলায় বললাম….
–“খোঁচা দিয়ে কথা বলছ…?”
সে হাসলো তবে তার হাসিতে রস কষ নেই।
–“খোঁচা দিয়ে কথা বলার সাহস আছে? আমার দ্যা বিগ বিজনেসম্যান আজমাইন অনুরাগ চৌধুরীর স্ত্রী তুই। তোকে খোঁচা মেরে কথা বললে যদি তোর বর আমার নামে মান হানির কেস করে দেয় তখন তো জেলে যেতে হবে!”
–“তোমার সাথে কথা বলায় বেকার!”
কথাটা বলে ধুপধাপ করে এসে নাক ফুলিয়ে বসে পড়লাম চেয়ারে। অর্ণবের কোল থেকে অদ্রিজাকে নিয়ে নিলাম।
খাওয়াদাওয়া শেষে যথারীতি অর্ণব আর অনুরাগ অফিসের কাজে বেরিয়ে গেল। আমি বাম দিয়ে চামুচ দিয়ে খেতে শুরু করলাম। খেতে একটু সমস্যা হচ্ছে বটে। তবে কাউকে বলতে পারছি না। দুইবার খাবার মুখে দিয়ে সমস্যার চোটে উঠতে লাগলাম আমি চেয়ার থেকে। হঠাৎ কেউ আমার বাহুতে হাত রেখে বসিয়ে দিল। আমাকে চরম অবাক করে দিয়ে অনুরাগ আমার সামনে এলেন। চামুচ দিয়ে খাবার তুলে আমার মুখের সামনে তুলে ধরলেন উনি।
আমি বুঝতে পারছি না। উনি কি আমাকে অবাক করাতে করাতে স্ট্রোক করিয়ে মারবেন নাকি। আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,,,
–“আপনি না…”
আর কিছু বলার আগেই আমার মুখে খাবার ঢুকিয়ে দিলেন উনি। শান্ত গলায় বললেন,,,
–“খেতে সমস্যা হবে বললেই পারতে। অযথা নিজে কষ্ট করে খাওয়ার প্রয়োজন নেই তো।”
আমি মুখ ফুলিয়ে খেতে শুরু করলাম। মনে মনে রাগের ঠেলায় লুচির মতো ফুলছি আমি। বলতে ইচ্ছে করছে,’তুই জানিস না আমি কাটা হাত নিয়ে খেতে পারব না? জেনেও না জানার ভান করিস?’
তবে পেটে থাকলেও মুখ দিয়ে কথাগুলো বের হলো না। আমি খেতে থাকলাম। হঠাৎ মনে হলো কেউ আড়াল থেকে সরে গেল। তার ছায়া যেন আশেপাশেই ছিল তার উধাও হয়ে গেল। বর্ণদা কি এসেছিল?
আমাকে খাইয়ে অনুরাগ তড়িঘড়ি করে অফিসে চলে গেলেন।
আমিও অদ্রিজাকে নিয়ে সিঁড়ির দিকে এগোতে নিলেই বর্ণদা এসে আমার সামনে দাঁড়াল। আমি থেমে গেলাম। অদ্রিজার দিকে সে হাত বাড়িয়ে বলল,,,
–“ওকে আমার কোলে দে।”
–“তোমার কোলে কেন?”
আমার প্রশ্নে রাগান্বিত চোখে তাকাল সে। যেন আমি কোনো ভুল কিছু বলেছি।
–“সিরিয়াসলি? বাচ্চাকে কোলে নিতে কোনো কারণ লাগে? তার ওপর ও তোর মেয়ে। ওকে কোলে না নিলে হয়?”
কথাটা বলে আমার কোল থেকে অদ্রিজাকে নিয়ে নিল বর্ণদা। আমার চাহনি দেখে সে কিছু একটা বুঝে বলল,,
–“অবাক হচ্ছিস? অবাক হওয়ার তো কথা নয়। তোর মেয়েই তো ও। তুই তো নিজেই বলেছিস। আমিও মেনে নিয়েছি। তুই সম্পূর্ণ অন্যকারো!!”
আমার খানিকটা রাগ হলো। নিজের ভালোবাসার প্রতি বিন্দুমাত্র বিশ্বাস নেই দেখছি তার। খিটমিট করে বললাম,,,
–“হ্যাঁ অদ্রিজা আমার মেয়ে। কারণ রক্ত কখনো সম্পর্কের একমাত্র সূত্র হতে পারে না। আমি অদ্রিজাকে কখনো জানতেই দেব না ও আমার মেয়ে নয়। ও আমার গর্ভে জন্মায়নি এটা কখনোই জানবে না ও। আর আমি অন্যকারো ঠিকই বলেছো। অন্যকারো হয়েছি কেন জানো? তোমার মা বাধ্য করেছে। আমাকে কিছু বলার আগে তোমার মাকে প্রশ্ন করো।”
কথাটা বলে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে থাকলাম আমি। পিছনে ঘাড় ঘুড়িয়ে আবারও বললাম,,,
–“আর হ্যাঁ অদ্রিজাকে কিছুক্ষণ পরেই দিয়ে যেও। ওকে কিছুক্ষণ পর পর খাওয়াতে হয়।”
কথাটা বলে তাড়াতাড়ি চলে এলাম আমি ঘরে। আর পুড়তে চাই না বর্ণদার আগুনে। নিজের মনো জ্বলা আগুনে নিজেই পুরে ছাড়খার হয়ে যাচ্ছি। এর মধ্যে বর্ণদার আগুনে পুড়তে চাই না আর!
দুপুরের হালকা রোদে অদ্রিজাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। আমার একমাত্র সারাদিনের সাথি সে। ওকে ছাড়া যেন সময়ই কাটতে চায় না। যেন খুব আপন কেউ আমার। সবে সবে অদ্রিজাকে গোসল করিয়ে দিয়েছি। ছোট্ট শরীরে যেন ঠান্ডা না লাগে তার কারণে দাঁড়িয়ে আছি রোদে। ও আমার গলার চেইন নাড়ছে আবার মুখে দেওয়ার চেষ্টা করছে। আমি বার বার চেইন সরিয়ে নিচ্ছি তবুও একই কাজ করছে ও। আমি হাসছি ওর কর্মকান্ডে। ওর কপালের সাথে কপাল ঠেকিয়ে বললাম,,,
–“আমার মেয়েটার খিদে পেয়েছে বুঝি? খাবার খাবে?”
অদ্রিজা কিছু না বলে আঙ্গুল মুখে পুরে দিল। আমি কিছু বলতেই বাড়ির মেইন গেটে শব্দ হলো। আমি ওদিকে দেখতেই দেখলাম মেইন গেট দিয়ে আমার বয়সী একটা মেয়ে সাথে একজন বয়স্ক মহিলা বাগানে ঢুকছেন। তাদেরকে চেনার চেষ্টা করলাম। কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বুঝলাম ওদেরকে চিনি না আমি। ওরা এগিয়ে এলো বাড়ির দিকে।
আমিও অদ্রিজাকে দোলনায় বসিয়ে ওরা কারা সেটা জানতে রুম থেকে বেরিয়ে গেলাম। নিচে পা রাখতে না রাখতে বয়স্ক গলার আওয়াজ জোরে জোরে ভেসে এলো আমার কানে।
–“কোথায় আমার নাতনি? কোথায় রেখেছো তোমরা? আমার কাছে দাও।”
বয়স্ক মহিলার কথার আগামাথা কিছুই বুঝলাম না। ওদের দিকে এগিয়ে যেতেই দেখলাম নৌশিন দাঁড়িয়ে ওদের কিছু বোঝানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু ওরা যেন বেশ জোরাজোরি করছে।
আমি নৌশিনের কাছে এসে ওর কানে ফিসফিস করে বললাম,,
–“উনারা কারা নৌশিন?”
–“এই বয়স্ক মহিলা অনামিকা ভাবির মা। আর ওই মেয়েটা অনামিকা ভাবির ছোট বোন সুনয়না। ওরা নাকি আজকে নাতনীকে নিয়ে নিজেদের বাড়ি নিয়ে যেতে এসেছেন।” (কানে কানে)
আমি আঁতকে উঠলাম। না আমি আমার অদ্রিজাকে কিছুতেই নিয়ে যেতে দেব না। ওদের দিকে তাকালাম। ওরা আমাকে অদ্ভুত ভাবে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নিল। আমি মহিলাটিকে সালাম দিতেই উনি বললেন,,,
–“ওহ তুমিই তাহলে সেই মেয়ে? যাকে অনুরাগ ঢ্যাং ঢ্যাং করে বিয়ে করে নিয়ে এসেছে?”
মহিলাটির কথা বলার ধরণ একে বারেই ভালো লাগল না আমার। আমি কিছু বলার আগেই সুনয়না নামের মেয়েটা বলল,,
–“মা দেখেছো? মেয়েটাকে দেখেই মনে হচ্ছে ওর অন্তর বিষে ভরা। সৎমা হলে যা হয়। না জানি আমাদের অদ্রিজার কি অবস্থা করে রেখেছে!”
চলবে….🍀🍀
বি.দ্র. ইনবক্সে অনেকেই প্রশ্ন করছেন আমি কেন গল্প দিচ্ছি না নিয়মিত। তাদেরকে বলছি আমি অসুস্থ খুবই। জ্বরে বিছানা থেকে ওঠা দায় হয়ে পড়েছে আমার কাছে। আমি কি করে গল্প দেব এই অবস্থায়? আশা করি আমার সমস্যা বুঝবেন। আজকে হালকা ভালো লাগছে আগের থেকে। তবে আম্মু হাতে ফোন দিচ্ছে না জ্বরের কারণে। যার কারণে গল্প লিখতে পারছি না। কাল থেকে নিয়মিত গল্প দেওয়ার চেষ্টা করব ইনশা আল্লাহ।
#একগুচ্ছ_ভালোবাসা
লেখনীতে : আনিশা সাবিহা (ছদ্মবেশী)
পর্ব : ১০
উনারা আমাকে কোন রকম কথা বলার সুযোগই দিলেন না। আমার পাশ কাটিয়ে সুনয়না নামক মেয়েটি ওপর সিঁড়ি দিয়ে তাড়াহুড়ো করে অনুরাগের ঘরের দিকে ছুটে গেল। আমার বুকটা ধুক করে উঠলো। ওরা কি তবে আমার অদ্রিজাকে নিয়ে যাবে? ওকে ছাড়া কিভাবে থাকব আমিঁ না কিছুতেই না! আর ভাবতে পারছিনা। আমিও একপ্রকার দৌড়েই উপরে উঠে এলাম। আমার পিছে পিছে এলো নৌশিন এবং অনামিকার মা । বর্ণদাও বিষয়টি দেখার জন্য উপরে উঠে এলো। আমি ঘরের কাছাকাছি আসতেই ঘরের ভেতর থেকে অদ্রিজার কান্নার আওয়াজ পেলাম। আরো অস্থির হয়ে ছুটে এলাম ঘরের দিকে। ঘরে ঢুকতেই চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। সুনয়না অদ্রিজা কে কোলে নিয়ে একবার ওপরের দিকে ছেড়ে দিচ্ছে একবার ধরছে। এতে ছোট্ট মেয়েটার কান্নার বেগ বাড়ছে। আমি কপাল ভাঁজ করে এগিয়ে গেলাম সুনয়নার দিকে। কিছুটা গাম্ভীর্যের সাথে বললাম….
–“আমার কোলে অদ্রিজা কে দাও।”
আমার কথায় মেয়েটা এক পলক আমার দিকে তাকাল। কিন্তু পাত্তা না দিয়ে আবারও অদ্রিজা কে ওপরে তুলে ছুঁড়ে মারল। আবার ধরল। আমি সেটা দেখে রাগের সাথে বললাম….
–“কি করছো…? ওর ভয় লাগছে। কান্না করছে দেখতে পাচ্ছো না তুমি?”
–“ও আমার বোনের মেয়ে ওর সাথে আমি কি করবো না করবো সেটা আমার একান্ত ব্যাপার। এখানে তোমাকে নাক না গলালেও চলবে।”
আমি দ্বিগুণ শক্ত গলায় বললাম…..
–“একজন খালামণির অধিকারের থেকে একজন মায়ের অধিকার সবথেকে বেশি হয়। ইউ হ্যাভ টু নো দ্যাট।”
–“হোয়াট কি বললে? অদ্রিজা তোমার মেয়ে? নাইস জোকস…! (হেঁসে)
–“হ্যাঁ আমার মেয়ে। আমি ওর দ্বিতীয় মা।
অদ্রিজার দিকে তাকালাম আমি। মেয়েটা সমানে কান্নাকাটি করে চলেছে। আর বারবার আমার দিকে হাত বাড়াচ্ছে। আমি সুনয়নার কাছ থেকে অদ্রিজাকে নিজের কোলে একপ্রকার ছিনিয়ে নিলাম। সুনয়না হাঁ করে চেয়ে রইল আমার দিকে। আমার তাতে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।
আমার কোলে আসার সাথে সাথে মেয়েটা নিজের কান্না থামাতে শুরু করলো।
আমি অদ্রিজার গালে চুমু খেয়ে বললাম….
–“এইতো তোমার মাম্মাম এসেছে। আর কান্না করতে হবে না সোনা।
আমার কথা হয়তো বুঝে ফেলল ছোট্ট মেয়েটা। নিজের কান্না থামিয়ে ও আমার দিকে টলটল দৃষ্টিতে চেয়ে রইল।
সুনয়নার দৃষ্টি অবাকতর থেকে অগ্নিদৃষ্টি হয়ে গেল। নিজের মায়ের কাছে এসে আমাকে দেখে সে বলল…
–“দেখেছো মা দেখেছো? মেয়েটার সাহস অদ্রিজাকে আমার কোল থেকে কেড়ে নিল! এত সাহস কে দিয়েছে তোমায়?? (আমার দিকে চোখ রাঙিয়ে)
আমাকে আর কিছু বলতে হলো না. বর্ণদা তাদের উদ্দেশ্যে বলল,,,
–আপনাদের কি মনে হয়? অদ্রিজা এখানে খারাপ আছে? না ও অনেক ভালো আছে। নুড়ি আই মিন অনু তো নিজের খেয়াল রাখার আগে অদ্রিজার খেয়াল রাখে সবসময়। ও খাওয়ার আগে অদ্রিজাকে খাইয়ে দেয়। সারাদিন অদ্রিজাকে কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। আপনারা যদি ওকে এখান থেকে নিয়ে যেতে পারেন না!
সুনয়না রেগেমেগে কিছু বলতে নিলে তার মা তাকে থামিয়ে দেয়। তার মা তীক্ষ্ণ গলায় বর্ণদার উদ্দেশ্যে বললেন…
–“তুমি কে আমাদের মাঝখানে কথা বলার? আর এসব কেয়ারিং তো প্রথম প্রথম সবাই করে। সৎ মায়ের মনে বিষ ছাড়া অন্য কিছু থাকেনা।”
‘সৎ মা’ নামক শব্দটি শুনে আমার বুকের ভেতরটা চিনচিন করে উঠলো। কারন আমি অদ্রিজার সৎ মা দ্বিতীয় মা হতে চাই। আমি চিৎকার করে বলে উঠলাম…..
–“আমি অনেক সৎ মা নই আমি ওর দ্বিতীয় মা। আমি ওকে নিয়ে যেতে দেব না।
–“কিহ এত বড় সাহস? আমার মুখে মুখে কথা?
আমি বিনয়ের সুরে বললাম….
–“ক্ষমা করবেন। কিন্তু আপনি আমাকে বাধ্য করলেন এভাবে শক্ত গলায় কথা বলতে। আমি এভাবে আপনার সাথে কথা বলতে চাইনি। আপনি গুরুজন মানুষ। আমি তো আপনার মেয়ের মত আমার উপর কি একটুও বিশ্বাস করা যায় না?
সুনয়নার মা মুখ ঘুরিয়ে তাকালেন। তারপরে কড়া গলায় বললেন,,,
–অনুরাগ কে ফোন করো আমি ওর সাথে সরাসরি কথা বলতে চাই।”
আমি নৌশিনকে উদ্দেশ্য করে বললাম…
–“উনাকে একটু ফোন করে তাড়াতাড়ি আসতে বলবে প্লিজ!”
নৌশিন হালকা মাথা নাড়িয়ে নিচে নিজের ফোন নিতে চলে গেল।
অফিসের কাজে মন বসাতে পারছে না অনুরাগ। মন কেমন যেন অস্থির অস্থির করছে। নিজের মনের বলা কথাগুলো নিজের কানেই ক্ষিণ শব্দে ভেসে আসছে। তাকে অনুশ্রীকে তার ভালোবাসার মানুষ এর সাথে মিলিয়ে দিতে হবে। সেটা যেকোন উপায়ে। তাও যেন নিজেকে কিছুতেই মানাতে পারছেনা। সে খুব কম সময়ে অনুশ্রীর মায়াজালে আটকে পড়েছে।
অনেক ভেবে একটা উপায় বের করে ফেলল অনুরাগ অবশেষে। তৎক্ষণাৎ ফোনের রিংটোন টা নিজের ছন্দে বেজে উঠলো। কম্পিউটার থেকে চোখ সরিয়ে ফোনের দিকে তাকাতেই ভ্রু কুঁচকে গেল তার। ফোন হাতে নিয়ে মুখ থেকে তিনটি টি ওয়ার্ডের শব্দ বেরিয়ে এলো…
–“নৌশিন!”
হালকা ঠোঁট উল্টে ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরল সে। ওপাশ থেকে হালকা চিন্তিত গলা ভেসে এলো,,
–“হ্যালো ভাইয়া।”
–“হ্যাঁ নৌশিন বলো।”
নৌশিন দ্বিগুণ চিন্তিত গলায় বলল….
–“বলছিলাম যে ভাইয়া আজকে আপনি অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরতে পারবেন?”
অনুরাগ ক্ষীন গলায় বলল….
–কিন্তু কেন বলতো …? কি হয়েছে? বাড়িতে সবকিছু ঠিক আছে তো?
–“হ্যাঁ ভাইয়া সবকিছু তো ঠিকই আছে। কিন্তু একটা ছোট্ট সমস্যা হয়েছে।
–“কি সমস্যা? ” (কপাল ভাঁজ করে)
–“আসলে অনামিকার ভাবির মা এসেছে আর সুনয়না এসেছে অদ্রিজা কে নিজেদের সাথে নিয়ে যেতে। সেটা নিয়ে একটু ঝামেলা হয়েছে আরকি।চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল অনুরাগ। তার নিজের মেয়েকে নিয়ে যাবে? অদ্রিজা যে অনামিকার সবথেকে বড় স্মৃতি তা এত সহজে সে কিছুতেই হারাতে দেবেনা। অনুরাগ উত্তেজিত গলায় বলল,,,,
–“কি বলছ? অদ্রিজা কে নিয়ে চলে যাননি তো উনারা?
–“না ভাইয়া অনুশ্রী ভাবী উনাদেরকে নিয়ে যেতে দেননি। তবুও অনামিকা ভাবির মা এখনও তার সিদ্ধান্তে অটল রয়েছেন। তাই আপনাকে ডেকেছেন।
অনুরাগ চটপট গলায় বলল….
–“আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আসছি বাড়িতে।”
কথাটা বলে কল কেটে দিল সে। ফোন হাত থেকে পকেটে রাখতেই তার কেবিনের দরজায় নক করলো কেউ। অনুরাগ জোর গলায় বলে উঠলো….
–“কাম ইন!”
কাঁচের দরজা ঠেলে ঠুলে ঢুকলো অফিসের ম্যানেজার। অনুরাগের টেবিলের সামনে এসে মিনমিনে গলায় বলে উঠলো….
–“স্যার আজকে দুটো ইম্পর্টেন্ট মিটিং আছে। কিছুক্ষণ আগে ক্লায়েন্টের ফোন এসেছিল। তারা আজকের মিটিং সেরে ফেলতে চান।
অনুরাগ নিজের পকেটে গাড়ির চাবি রেখে তাড়াহুড়ো কন্ঠে বলল…..
–“আমি আজকে আর কোনো মিটিং করতে পারবোনা। আই হ্যাভ টু গো রাইট নাউ। সো মিটিং টা ক্যান্সেল করে দিন। মিটিংটা কালকে নয়তো কয়েকদিন পরে রাখুন।
–“কিন্তু স্যার…..”
–“কোন কিন্তু নয় আমাকে এক্ষুনি বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়তে হবে। আর অর্ণব আমার ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করলে বলে দেবেন আমি বাড়িতে চলে গেছি।”
কথাটা বলে আর এক সেকেন্ডও দাঁড়ালো না অনুরাগ। হন্তদন্ত হয়ে চেয়ারের চিপা থেকে বেরিয়ে আসতে নিলে ওর চোখ পরল একটা গোল্ডেন রং এর ব্যাগ এর দিকে। মাথায় হাত দিয়ে আবারও হাত বাড়িয়ে ব্যাগটা হাতে তুলে নিল সে। তারপরে বেরিয়ে গেল নিজের কেবিন থেকে।
সুনয়নার মায়ের সামনে বসে আছেন অনুরাগ। তার পাশে দাঁড়িয়ে আছি আমি অদ্রিজা কে নিয়ে। এতক্ষণে না হলেও সুনয়না মেয়েটি আমার কোল থেকে অদ্রিজা কে নেওয়ার জন্য নিম্নে দশ বারের মত চেষ্টা করে গেছে। কিন্তু অদ্রিজা ওর করলে যেতে নারাজ। ও হাত বাড়ালেই অদ্রিজা শব্দ করে কেঁদে উঠছে। যার কারনে সুনয়না মুখ গোমরা করে দাঁড়িয়ে আছে মায়ের পাশে।
যদিও ব্যাপারটা বেশ মজা লেগেছে আমার! অনুরাগ ভার কন্ঠে বলে উঠলেন…
–“আপনি যতই চেষ্টা করুন না কেন আমার কাছ থেকে আমার মেয়েকে নিয়ে যেতে পারবেন না। আমার মেয়ে আমার কাছে থাকবে। ইজ দ্যাট ক্লিয়ার? ”
অনুরাগের এমন ধরনের কথায় যেন মহিলাটি একটু হতভম্ব হলেন। চমকিত গলায় বললেন….
–“অনুরাগ আমার কথার ধরন এমন পাল্টে গেছে কেন? এমন তো ছিলে না আগে। ও বুঝেছি… ওই মেয়েটাকে (আমার দিকে তাকিয়ে) বিয়ে করে এখন আমার প্রতি তোমার সম্মান টাও কমে গেছে। কেন? ওই মেয়েটা কি তোমায় শিখিয়ে দিয়েছে যাতে আমাকে তুমি সম্মান না করো?
আমি একটু অবাক হলাম বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ হয়ে কি পাগলের প্রলাপ বকছেন? উনি এসব না জেনেশুনে বলা কি ভিত্তিহীন নয়? অনুরাগও হয়তো ওনার কথা বার্তা পছন্দ করেননি। বিরক্তের শ্বাস ফেললেন উনি। থমথমে গলায় জবাব দিলেন….
–“আপনার যা ভাবার ভাবুন। আমার কিচ্ছু যায় আসেনা।আপনি অদ্রিজা কে নিতে এসে নিজের সম্মান নিজেই কমেছেন মা। আর এই মেয়ের কথা বলছিলেন না? (আমার দিকে ইশারা করে) এ মেয়েটার কারণেই অদ্রিজার সেবা যত্নের কোন কমতি হয় না। নিজের মেয়ের মত করে সব সময় আগলে রেখেছে অদ্রিজা কে।”
মহিলাটি খানিকটা থতমত খেয়ে বলে উঠলেন,,,
–“তা না হয় ঠিক আছে। ওর কাছে না হয় আমার নাতনি যত্নেই মানুষ হচ্ছে। তবে তোমায় যে বলেছিলাম আমার ছোট মেয়ে সুনয়নার কথা ভেবে দেখতে। অনামিকার ছোট বোন ও। অদ্রিজাকে অনেক ভালো করে দেখে রাখত। ওকে বিয়ে করার কথা ভাবতে বলেছিলাম আর তুমি অন্য মেয়েকে বিয়ে করে নিলে?”
অনুরাগ হালকা বিচলিত হলেন। সুনয়নার দিকে এক পলক তাকিয়ে নড়েচড়ে বসলেন উনি। আমি ঢ্যাব ঢ্যাব করে তাকিয়ে রইলাম। সুনয়নার সাথে তার মা বিয়ে দিতে চেয়েছিল? অদ্ভুত মানুষ বাবা! কেউ জেনেশুনে অন্যকারো সংসারের মাঝে মেয়েকে ঢুকিয়ে দেয়? আমার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ভিন্ন। কারণ আমার মা নেই। তবে মহিলাটির কথা শুনে অবাকের সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছে গেলাম।
অনুরাগ গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন,,,,
–“একজন বিয়ে হওয়া ছেলেকে কেন নিজের মেয়েকে গছিয়ে দিতে চান মা? আমি এই বিষয়টা বুঝলাম না। অনুশ্রী বিয়েতে রাজি ছিল জন্য ওকে বিয়ে করেছি। সুনয়না তুমিও কি বিয়েতে রাজি ছিলে নাকি?”
এই মূহুর্তে সবার দৃষ্টি সুনয়নার দিকে। সুনয়না ঢক গিলে গুটিশুটি মেরে দাঁড়িয়ে রইল কোনো জবাব দিলো না। অনুরাগ তার কোনো জবাব না পেয়ে বললেন,,,
–“জানতাম রাজি নও তুমি। মা দেখেছেন? ওকে কেন আমার মতো ছেলের হাতে তুলে দিতে চাইছিলেন? বাই দ্যা ওয়ে আমি ওকে বোনের নজরে দেখি। সো ওর সাথে এসব স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক বানাতে চাইনি কখনো।”
অনুরাগের পাল্টা জবাবে মুখ ফুলিয়ে বসে রইলেন সুনয়নার মা। নিজের মুখ খুলে বললেন,,,
–“আচ্ছা ঠিক আছে সব মানলাম। ওই অনুশ্রী মেয়েটা যে অদ্রিজাকে দেখে রাখে সেটাও মানলাম। তবে পুরোপুরি বিশ্বাস হলো না। আমি সুনয়নাকে রেখে যাব। সুনয়না দেখবে অদ্রিজাকে ও ভালোভাবে দেখাশোনা করে কি না।”
–“সুনয়না কেন আপনিও থেকে নিজ চোখে দেখে গেলেই পারেন।”
–“না বাপু। এসব শহরে দমবন্ধ করা পরিবেশে থাকতে পারব না আমি।”
নাক শিটকে বললেন মহিলাটি। অনুরাগ বাঁকা হেঁসে বললেন,,,
–“ঠিক আছে মানলাম। তাহলে আরো কিছুক্ষণ রয়েসয়ে বিশ্রাম করে যান অন্তত!”
উনি মাথা নাড়ালেন। আমি সবার কথাবার্তা মনোযোগ দিয়ে শুনতেই খেয়াল করলাম অদ্রিজা আমার ঘাড়ে মাথা রেখে আছে। ভালো করে ওর দিকে তাকাতেই দেখলাম ঘুমিয়ে পড়েছে মেয়েটা। ওর ডাইপার টাও ভিজে লাগছে।
আমি কিছু না বলে নিঃশব্দে সেখান থেকে চলে আসতে নিলে বর্ণদা বলল,,
–“কোথায় যাচ্ছিস?”
–“ঘরে। অদ্রিজা ঘুমিয়ে পড়েছে ওকে শুইয়ে দিতে হবে।”
বর্ণদা আর কিছু বলল না। আমি সিঁড়ি দিয়ে উঠতে পেছন থেকে শুনতে পেলাম বর্ণদার গলা।
–“অনুরাগ ভাই আমি কালকে বাড়ি চলে যেতে চাই।”
বর্ণদা চলে যাবে? চোখের দেখাও আর দেখতে পাব না কি তবে? পিছন ফিরে তাকালাম তার দিকে। অনুরাগ হালকা হেসে বললেন,,,
–“এতো তাড়াতাড়ি যাওয়ার কি আছে বলো তো? আরো কয়েকদিন থেকে যাও!!”
বর্ণদা আমার দিকে তাকিয়ে বিরবির করে বলল,,,
–“কার জন্য থাকব? যার জন্য থাকতে চাই সে যে অন্য কারো!”
বর্ণদার চাহনি দেখে দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে উঠে চলে এলাম আমি। এসে অদ্রিজাকে শুইয়ে দিতে দিতে চোখ থেকে একফোঁটা পানি পড়ল অদ্রিজার গালে। অদ্রিজাকে নড়েচড়ে উঠল। ওর গাল থেকে শাড়ির আঁচল দিয়ে পানি মুছে দিলাম আলতো করে। ওর দিকে মলিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম আমি অনেকক্ষণ।
দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে পেছন ঘুরে তাকাতেই চমকে উঠলাম।
–“আপনি?”
অনুরাগ ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন,,,
–“হুমম আমি। অন্য কেউ আসার কথা ছিল বুঝি?”
আমি বিরক্তির সুরে বেড থেকে নামতে নামতে বললাম,,,
–“আপনি কি সোজাসাপ্টা কথা বলতে পারেন না? কার আসার কথা থাকতে পারে?”
–“কেন বর্ণর!”
প্রথমে উনার কথা ভালোভাবে কানে তুললাম না। পরক্ষণেই মনে হলো উনি বর্ণদার কথা বললেন। আমি কাঁচুমাচু হয়ে গেলাম উনার কথা শুনে। শুকনো ঢক গিলতেই উনি মলিন হাসলেন। তারপর জোরেই হেঁসে উঠলেন।
–“জাস্ট কিডিং উইথ ইউ। মজা করতেই দেখি তোমার চেহারার রঙই পাল্টে গেছে। হাহাহ! আবব ওয়েট এই নাও তোমার জন্য এটা।”
সোফায় থাকা গোল্ডেন রঙের ব্যাগটা আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন উনি। আমি জিজ্ঞেসু দৃষ্টিতে উনার দিকে তাকিয়ে বললাম,,,
–“কি আছে ব্যাগে?”
–নিজে খুলে দেখলেই তো পারো।”
আমি আর কোনো কথা না বলে ব্যাগ থেকে একটা বক্স বের করলাম। উল্টেপাল্টে দেখতেই বুঝতে পারলাম এটা ফোনের বক্স! উনার দিকে এক পলক তাকাতেই উনি ইশারা করে আমাকে বক্সটা খুলতে বললেন। আমি বক্সটা খুলতেই একটা দামি ফোন দেখতে পেলাম। কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,,,
–“এ…এতো দামি ফ..ফোন! আমি নিতে পারব না।”
উনি আমার কাছে এগিয়ে এলেন গম্ভীর মুখ নিয়ে। আমি দুইধাপ পিছিয়ে আসতেই উনি আমার আরো কাছে এগিয়ে এলেন। আমি ঢক গিলে উনার দিকে তাকালাম। আমার দিকে একটু হেলে উনি বলে উঠলেন,,,
–“তোমাকে নিতেই হবে। দ্যাটস মাই অর্ডার।”
কথাটা বলে আমার চুল কানে গুঁজে দিলেন উনি। আমি কেঁপে উঠলাম। মুচকি হেসে আমার দিকে সরে দাঁড়ালেন। আমি স্বস্তির শ্বাস ফেলে উনার দিকে বাঁকা চোখে তাকালাম।
সন্ধ্যার নামতে নামতেই চলে গেলেন সুনয়নার মা। থেকে গেলো সুনয়না। রাতে খেয়েদেয়ে সবাই এখন যে যার রুমে শুয়ে পড়েছে। এদিকে অদ্রিজার চোখে ঘুমের রেশ নেই। কেননা সন্ধ্যে পর্যন্ত ঘুমিয়েই উঠেছে সে। আমি একবার কোলে নিয়ে ঘুমিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছি একবার অনুরাগ কোলে নিয়ে ঘুমিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। অনুরাগ ওকে নিয়ে বেডে শুয়ে পড়েছেন। অদ্রিজার পিঠে থাবা দিয়ে দিয়ে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করছেন। হয়ত উনিই ঘুমিয়ে দিতে পাড়বেন ওকে।
নিচে শুয়ে পড়লাম কম্বল নিয়ে। কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে থাকলাম। হঠাৎ অনুরাগের আর কোনো কন্ঠস্বর শুনতে পেলাম না আমি। শুধু অদ্রিজা নিজের ভঙিতে কথা বলেই চলেছে। ব্যাপারটা দেখার জন্য চোখ মেললাম। ওমা! অনুরাগ দেখি অদ্রিজাকে ঘুম পাড়াতে গিয়ে নিজেই ঘুমিয়ে পড়েছেন। আর অদ্রিজা অনুরাগের বুকের ওপর উঠে অনুরাগের মাথা বুলিয়ে দিয়ে যেন উনার ঘুম আরো গাঢ় করার চেষ্টা করছে। মেয়েকে ঘুমিয়ে দিতে চেয়ে নিজেই ঘুমিয়ে পড়লেন? এখন দেখি মেয়েই বাবাকে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছেন।
ফিক করে হেঁসে দিলাম কান্ডকারখানা দেখে। আমার হাসির শব্দ শুনে অনুরাগ ধরফর করে উঠে পড়লেন। চোখ কচলে আমার দিকে আর অদ্রিজার দিকে অসহায় ভাবে তাকালেন। এভাবেই কেটে গেল আমাদের রাত!
চলবে…..🍀🍀
বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।