#ধারাবাহিক_গল্প
#হৃদয়ে_রেখেছি_তোমায়
দ্বিতীয়_পর্ব
#আসেফা_ফেরদৌস
আবীর আসতে দু এক মিনিট লাগলো। এসে দরজা খুললো। মৃদুলা বোকার মত দাঁড়িয়ে আছে। অবনী আবীরকে দেখে চিৎকার করে উঠলো। বললো, কি আশ্চর্য! বাবা, তুমি আজকে বাসায! আমরা তো নানুর বাসায় ছিলাম তুমি কখন এলে?
আবীর অবনীর কথার উত্তর দিলো না। হাসলো শুধু। এরপর সোজা নিজের রুমে চলে গেলো। মৃদুলা এখনো স্থির দাঁড়িয়ে আছে। ধাক্কাটা সামলে নিতে পারেনি। অবনী বারবার প্রশ্ন করছে, মা বলোনা, বাবা কখন এলো, আমাদের কে কিছু বলেনি কেন? মৃদুলা বিমূঢ়ের মতো বললো, জানি না। মনে মনে ভাবছে, মৃদুলা আর অবনী আবীরকে একটু কাছে পাওয়ার জন্যে কতটা অধীর অপেক্ষায় থাকে তাতো আবীরের অজানা নয়! আজকাল তো প্রায়ই এসব নিয়ে আবীরের সাথে ওর কথা কথা কাটাকাটি হচ্ছে। অথচ আজ ও জলদি বাসায় ফিরছে এবং দিব্যি ঘুমাচ্ছে! কিন্তু মৃদুলাকে একটা ফোন করেনি! আসতে বলেনি, কেন? কেন ও একা একা সময় কাটাতে চেয়েছে? ওর কি মৃদুলা আর অবনীর কথা একবারও মনে পড়েনি? ওদের প্রয়োজন কি আবীরের জীবনে ফুরোতে বসেছে? এতটাই কি বদলে গিয়েছে আবীর! মৃদুলা আর ভাবতে পারছেনা। অবনী ওকে সমানে ঝাকাচ্ছে, বলছে,কি হলো মা বলছো না কেন, বাবা কেন আমাদেরকে কিছু বললো না? মৃদুলা বললো, চলো অবনী, হাতমুখ ধুয়ে কাপড় পাল্টে নেবে। এসো।
মৃদুলা যখন গোসল সেরে বেরিয়েছে তখন ঘড়ি বলছে সময় রাত দশটা। অবনী আর ও গেস্ট রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে কাপড় বদলে নিয়েছে। আবীর যখন বেডরুমে ঘুমাচ্ছে, ঘুমাক না। বেডরুমে গেলে অবনীর কথাবার্তা এবং পারিপার্শ্বিক বিভিন্ন শব্দে ও বিরক্ত হবে।
একটু পর মনের ইচ্ছের কিছুটা বিরুদ্ধেই মৃদুলা বেডরুমে ঢুকলো। দেখলো আবীর তখনো ঘুমাচ্ছে। মৃদুলা বিছানায় ওর পাশে গিয়ে বসলো। মাথায় হাত রেখে বললো, আবীর ওঠো, চলো খাবে। খাবার গরম দিয়েছি।
আবীর মনে মনে বললো, এতক্ষনে? ও আসলে জেগেই আছে। ফোন রিং এর শব্দে ঐ যে ঘুম ভেঙেছে, আর আসেনি। ইচ্ছে করছে মৃদুলার সাথে চরম একটা ঝগড়া বাধিয়ে দিতে। কিন্তু বেচারা ঘুরে বেড়িয়ে এসেছে, নিশ্চয় ফুরফুরে মেজাজে আছে। এমন সময় চাইলেও ঝগড়া শুরু করা যায় না, বিবেকে বাধে। তাছাড়া অবনী এখনো সজাগ, ওদের দুজনকে ঝগড়া করতে দেখলে মেয়েটা মন খারাপ করে ফেলবে। সে আবার প্রচন্ড মা ভক্ত মেয়ে। অবনীর সামনে ওর মাকে কিছু বলাই যায় না। মৃদুলাকে কিছু বললে, বা ও মন খারাপ করলে অবনী ভীষণ কান্নাকাটি জুড়ে দেয়। ছোটবেলা থেকে আবীর শুনে এসেছে মেয়েরা সাধারণত বাবার ভক্ত হয়। অবনীর বেলায় কেন যে ব্যপারটা উল্টো হলো বুঝতে পারেনা ও। হয়তো বাবার চেয়ে মাকেই বেশি কাছে পায় তাই মার সঙ্গে মাখামাখিটা বেশি। হৃদয়ের সম্পর্কটা বেশি গভীর। আবীর মেনে নিয়েছে। কষ্ট পেলেও কখনো আক্ষেপ করেনি। কার কাছেই বা করবে! তাছাড়া নিজের অবুঝ সন্তানের উপর কি অভিমান চলে?
মৃদুলা আবার বললো, আবীর ওঠো, এসো,খাবে।
-তোমরা খাও মৃদুল, আমার শরীরটা ভালো নেই। উঠতে ইচ্ছে করছেনা।
বাসায় ফিরে কি খেয়েছো? মৃদুলা প্রশ্ন করলো। আবীর মনে মনে বললো, কি এমন ছিলো বাসায়, যা আমি খেতে পারি? কিন্তু মুখে বললো,বাদ দাও।
মৃদুলা বললো, অনেক সময় ইচ্ছের বিরুদ্ধে জোর করেও তো খেতে হয়। তুমি নাহয় হালকা কিছু খাও।
আবীরের মেজাজটা চড়ে গেলো। ভেতরে ভেতরে রাগে ফেটে পড়ছে। মনে মনে বললো, দুপুর থেকে ভাতই খাইনি, অথচ উনি আমাকে আহ্লাদ করে হালকা কিছু খেতে বলছেন! পেটে ভাতের খিদে থাকলে হালকা কিছু খাওয়া যায় বুঝি? বুঝেও না বোঝার ভান করা আরকি! কিন্তু মুখে কিছু বললো না।
মৃদুলা আবার বললো, আবীর, আ্যই আবীর!
আহ্ বললাম তো! উঠতে ইচ্ছে করছেনা। তোমরা খাও। বলতে গিয়ে গলাটা চড়ে গেলো ওর।
আবীর চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। কাঁথাটা গায়ের উপর টেনে নিলো। মৃদুলা ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে। বেশ বুঝতে পারছে, ভীষণ খিদে লেগেছে আবীরের, কিন্তু রাগ করে খাবেনা। আজকাল হয়তো আবীর ওকে মনের কথা সেভাবে খুলে বলেনা, কিন্তু মৃদুলার ভালোবাসাটা তো এখনো আগের মতই রয়ে গেছে, মুখে না বললেও আবীরকে বুঝে নিতে কষ্ট হয় না ওর। স্পষ্ট বুঝতে পারছে, মনে মনে খুব কষ্ট পেয়েছে আবীর। অভিমান করছে মৃদুলার উপর। এবং এ অভিমান ভাঙানো মৃদুলার পক্ষে এখন অসম্ভব। কিন্তু মৃদুলার পক্ষে অসম্ভব হলেও আরেকজনের জন্য ব্যপারটা মোটেও কষ্টের হবেনা। মৃদূলা উঠে দাঁড়ালো। আবীর বললো, যাবার সময় লাইটটা নিভিয়ে দিও। মৃদুলা কিছু বললো না, বেরিয়ে যাবার সময় লাইট নিভিয়ে ডিম লাইটটা জ্বালিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেলো।
অবনী ওর ঘরে বসে খেলছে। মৃদুলা ওর রুমে গিয়ে ঢুকলো। বললো, আম্মু খেতে এসো।
-আসছি মা।
আচ্ছা শোন, বাবাকে গিয়ে তুমি একটু ডেকে তোলো তো। বাবার শরীরটা ভালো নেই, মনটাও খারাপ।
-কেন? বাবার মন খারাপ কেন?
-ওমা এই যে আমরা আজকে বেড়াতে গেলাম, এত মজা করলাম, বাবাকে তো সঙ্গে নিয়ে যাইনি, মন খারাপ হবেনা? তাছাড়া আজকে তোমার সঙ্গে সময় কাটাতে বাবা জলদি বাসায় ফিরছে। অথচ তুমি তো ছিলেনা, তোমার বাবা একা একাই বাসায় ছিলো, কষ্ট হয়নি বুঝি?
-হ্যাঁ তাতো নিশ্চয়ই হয়েছে।
-তো যাও। বাবাকে ডেকে ওঠাও। আর আমাকে যেভাবে ঝাঁকিয়ে ওঠাও সেভাবে ডাকবে না, মাথায় হাত বুলিয়ে অস্তে আস্তে ডাকবে। যদি উঠতে না চায়, তুমি জোর করবে।
-বাবা যদি আমাকে বকা দেয়?
অবনীর কথা শুনে মৃদুলা হেসে ফেললো। বললো, তোমাকে ও কিছুই বলবেনা। আস্তে করে বললো, তুমি তো আর আমি না।
অবনী বললো, তুমি আমার সঙ্গে এসোনা মা,আমার ভয় করছে।
-বাবা কি তোমাকে কখনো বকা দিয়েছে?
অবনী না সূচক মাথা ঝাকালো।
তাহলে আর ভয় কিসের? যাও, কিছু হবে না। অবনী পা বাড়াতেই মৃদুলা বললো, মামনি শোন, বাবার মনটা যে খারাপ, এবং তোমাকে এ কথাটা আমি বলেছি এ ব্যাপারে কোন কিছুই তুমি বাবাকে বলবেনা। তাহলে ও কষ্ট পাবে।
-আচ্ছা।
আবীর ওর বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে। ক্ষোভে দুঃখে ঘুমাতে পারছেনা। বুঝতে পারছে মৃদুলা ওকে আর আগের মত ভালোবাসেনা, তাইতো ও খাবেনা বলতেই কেমন চট করে উঠে চলে গেলো। জোর করে উঠানোর চেষ্টাও করলো না, অনুরোধ,অনুনয় কিছুই করলো না! হয়তো বুঝতেই পারেনি, আবীরের কেমন খিদে লেগেছে, কতটা কষ্ট হয়েছে। বুঝতে পারেনি বলছে কেন, আসলে বুঝতে চায়নি। অথচ একটা সময় ছিলো যখন ওর চোখের দিকে তাকিয়ে মৃদুলা মনের কথা পর্যন্ত পড়ে ফেলতে পারতো, হয়তো এমনটা প্রত্যাশা করাও এখন বাড়াবাড়ি চাওয়া। আবীরের শরীরটা আবার খারাপ করতে শুরু করেছে, বেশ দুর্বল লাগছে। ও চুপচাপ শূয়ে আছে। এমন সময় অবনী ঘরে ঢুকলো। পায়ে পায়ে এগুচ্ছে সে। অবনীকে ঢুকতে দেখে আবীর চোখ বন্ধ করে ফেললো। যেন অবনী মনে করে ও ঘূমিয়ে আছে। অবনী এসে বিছানায় উঠলো। মৃদুলা দরজার আড়ালে এসে দাঁড়িয়েছে। অবনী আবীরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আবীরের চোখে পানি চলে আসার মতো অবস্থা! অবনী পাখির মতো মিষ্টি কন্ঠে ডাকলো, বাবা, ওঠো, আমার ভীষণ খিদে পেয়েছে, চলো, একসাথে খাই।
আবীর নিজেকে স্বাভাবিক রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে, কিন্তু মনে হচ্ছে চোখের জল আটকে রাখতে পারবেনা। ও হালকা প্রতিবাদ করলো, বললো, আমার শরীরটা ভালো নেই মা, খেতে ইচ্ছে করছেনা। তোমরা গিয়ে খাও। যদিও কন্ঠ শুনে মৃদুলা পরিস্কার বুঝতে পারছে, গলায় জোর নেই ওর।
এবার অবনী বললো, বাবা প্লিজ এসো না, কতদিন তোমার সাথে একসঙ্গে খাইনা, কতদিন রাতে তোমার সঙ্গে দেখা হয়না, তুমি যখন বাসায় ফেরো, ততক্ষণে আমি ঘুমিয়ে যাই, আমার ভীষণ ইচ্ছে করে তোমার সাথে একসঙ্গে খেতে, একসঙ্গে খেলতে, অথচ তোমার তো কোনো সময়ই নেই। আজকে তুমি বাসায় আছো, তবুও আমার সঙ্গে খাবেনা?
মৃদুলা দরজার আড়াল থেকে শুনছে। জানে, এ অনুরোধ আবীরের পক্ষে উপেক্ষা করা সম্ভব নয়।
আবীর চোখ মেললো। ওর চোখ ছলছল করছে। অবনী বললো, বাবা তুমি আজকে বাসায় এসে একা একা সময় কাটিয়েছো, তবুও আমাদেরকে ফোন করেনি, কেন? তুমি একটা ফোন করেই দেখতে, আমরা সঙ্গে সঙ্গে চলে আসতাম। তোমার কি আমাদের কথা একটুও মনে পড়েনি বাবা?
মৃদুলার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। এ প্রশ্নটা এতক্ষণ ধরে ওর মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। অথচ আবীরকে বলতে পারেনি।
আবীর উঠে বসলো। অবনীকে ওর কোলের ওপর বসালো। হেসে বললো, সরি আম্মু। তুমি কষ্ট পেয়েছো?
পাইনি আবার! সরি বললে কাজ হবেনা। তুমি আমাদের সঙ্গে খেতে এসো। না হলে আমি আরো বেশি কষ্ট পাবো।
আচ্ছা, চলো যাই। আবীর বললো। অবনী ঝট করে আবীরের গলা জড়িয়ে ধরে বললো, থ্যাংক ইউ বাবা।
মৃদুলা রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালো। চায়না আবীর ওকে এ মুহূর্তে দেখুক। মনে মনে ভাবছে, অবনী যেভাবে আবীরকে অভিযোগ করলো, এমন অভিযোগ ও করলে আজ নির্ঘাত একটা ঝগড়া হয়ে যেতো। অথচ মেয়ের সামনে বাবার আত্মসমর্পণ ছাড়া উপায় ছিলো না।
চলবে
আগের পর্বের লিংক
https://www.facebook.com/groups/canvasbd/permalink/4309865125725314/