শুভ্র বর্ষণ পর্ব-৩

0
3419

#শুভ্র_বর্ষণ
#প্রভা_আফরিন
#পর্ব_৩

বৃষ্টি থেমেছে মাঝরাতে। সকালে সূর্যের তীক্ষ্ণ আলো পরিবেশ দখল করেছে। আকাশ এখন একদম ঝকঝকে। শিরীন বেগম এবং সুমা বেগম হাতে হাতে সকালের খাবার তৈরী করছেন। দুইবছরে দুইজন যেন পরস্পরের সহযোগী হয়ে উঠেছেন। শিরীন বেগম খুবই স্বচ্ছ মনের মানুষ এবং স্বামী ভক্ত মহিলা। স্বামী যখন ননদকে বাড়িতে এনে তুললো তিনি খুশিই হয়েছিলেন। স্বামীর ব্যবসা, মেয়ের স্কুল, কলেজ এর জন্য শিরীন বেগমের সারাদিন কাটে একাকিত্বে। সেই একাকিত্ব ঘুচে গেছে ননদকে পেয়ে।

সুমা বেগম ভেবেছিলেন ভাইয়ের সংসারে থাকলে ধীরে ধীরে হয়তো ভাবীর চক্ষুশূল হয়ে উঠতে পারে। সম্পর্কের তিক্ততা বাড়তে পারে। তাই তিনি প্রথম প্রথম চলে যেতে চাইতেন। কিন্তু ধীরে ধীরে এই সংসার ও ভাবী তার আপন হয়ে উঠলো। এবাড়ির মায়া ছেড়ে আর যেতে পারলেন না। আর না ভাবীর সাথে মনমালিন্য হয়। বরং সবাই মিলেমিশে বাড়িটা প্রানবন্ত হয়ে উঠেছে। কাজের ক্ষেত্রে দুজনে মিলেমিশে সব করে ফেলেন। কেউ কাউকে কিছু বলে দিতে হয়না।

মিহা রান্নাঘরের সামনেই বসে আছে। পড়নে পাটভাঙা হালকা মিষ্টি রঙের শাড়ি। মা এবং মামি তাকে সংসার নিয়ে হাজারটা উপদেশ দিচ্ছেন। কিভাবে সকলের মন জুগিয়ে চলতে হয়, স্বামী এবং শ্বশুর বাড়ির মানুষের সেবা করতে হয়, বড় জায়ের সাথে মিলেমিশে থাকতে হয় ইত্যাদি নিয়ে উপদেশ।মিহা শুধু শুনে চলেছে। ওর বেশ ভালো লাগছে বিষয়টা। এতোদিন বড়দের সাংসারিক আলাপে খুব একটা নাক গলিয়েছে বলে মনে পড়ে না মিহার। তবে এখন তার মা এবং মামি ওর সামনেই সাংসারিক নানান আলোচনা করছে। একদিনে সকলের চোখে কেমন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হয়ে উঠেছে মিহা। সবই বিয়ে নামক আয়োজনের মাধ্যমে।

মা পরোটা বেলতে বেলতে বললো,
“তুই ওই বাড়ির সবার ছোট। ওরা তোকে যথেষ্ট ভালোবাসবে। প্রথম প্রথম কোনো কাজ করতে দেবে না। তাই বলে তুই হাত গুটিয়ে বসে থাকবি না। কোনো কাজ না থাকলে ওদের আশেপাশে থাকবি। রান্নার সময় পাশে থাকবি। ওরা কিভাবে কি করে শিখে রাখবি। হুট করে জা বা শ্বাশুড়ি মা অসুস্থ হয়ে পড়লে কিন্তু তোর ঘাড়ে তখন সংসারের দায়িত্ব পড়বে। তখন যেন ওরা তোর ওপর বিরক্ত না হয় তাই আগে থেকেই একটু একটু করে ভালোমন্দ গুলো বুঝে রাখবি।”
মিহা মাথা নাড়ালো। মামি সাথে আরো একটু যোগ করলো,

“গিয়েই প্রথম প্রথম কোনো দায়িত্ব নেওয়ার চেষ্টা করবি না। একজনের এতোদিনের গোছানো সংসারের হুট করে অন্য কেউ ভাগ বসাতে চাইলে দুই জায়ের সম্পর্ক তিক্ত হবে। তুই তোর জাকে বলবি এটা ওটা শিখিয়ে দিতে। কিছু করতে শ্বাশুড়ির অনুমতি চাইবি। ওনারা ভালো মানুষ। তোকে সবকিছুই করতে দেবে। অনুমতি নিয়ে সব করতে হবে বিষয়টা এমন না তবে এতে ওদের তোর ওপর ভালোবাসা বাড়বে।”

মিহা অনেকক্ষণ যাবত খেয়াল করছে শোভা ওর আশে পাশে ঘুরছে। কিছু হয়তো বলতে চাইছে কিন্তু পারছে না। উশখুশ করছে। মিহা তাকাতেই শোভা তাকে নিজের কাছে ডাকলো। মিহা উঠে ওর কাছে যেতেই শোভা হাত ধরে বসার ঘরের বা পাশে খোলা বারান্দায় নিয়ে গেলো।

“কি হলো এমন টানাটানি করছিস কেনো?”
শোভা তীক্ষ্ণ চোখে মিহাকে মাথা থেকে পা অবধি পরখ করলো৷ বললো,

“শুনেছি বিয়ে হওয়ার পর পরই মেয়েরা বদলাতে শুরু করে। সুন্দর হয়, শারীরিক এবং আচরণের পরিবর্তন হয়। তাই দেখছি কতটুকু বদলেছো একদিনে।”

মিহা চোখ গরম করলো।
“এইসব দেখার জন্য ডেকেছিস? একদিনে কি হয় ফাজিল মেয়ে।”

শোভা চাপা হাসি দিয়ে বললো,
“তোমার কি ঘুম পাচ্ছে আপু? কাল রাতে ঘুম হয়েছে তো? সকালে গোসল করেছো?” বলে মিহার চুলে আঙুল চালালো।

মিহা বুঝে গেলো শোভার ডেকে আনার কারণ। আরক্ত মুখে রাগ দেখানোর ভান করে শোভাকে মারতে লাগলো। বললো,

“শয়তান মেয়ে। আজ তোর হচ্ছে।”

শোভা হাসতে হাসতে মিহাকে পেছন থেকে জরিয়ে ধরলো। বললো,
“আচ্ছা এবার ভালো কথা বলছি। ভাইয়া কি উপহার দিলো শুনি।”

মিহা বললো,
“আসলে উনি ঠিক নিশ্চিত ছিলেন না কাল বিয়েটা হবে কিনা। তাই বিয়ের আংটি ছাড়া আর কিছু আনতে পারেননি। তবে বলেছে শীগ্রই দেবে।”

ওদের কথার মাঝেই পাশের বাড়ি থেকে একজনের উচ্চ কন্ঠে চেচামেচি শোনা গেলো। একজন নারী কন্ঠ চেচিয়ে বলছেন, “আমার গাদা, আমার গোলাপ কে ছিড়লো? কার এতো বড় স্পর্ধা?”

শোভা কথাগুলো শুনতেই চোরা চোখে মিহার দিকে তাকালো। মিহা তখন ওর দিকে তাকিয়েই ভ্রু নাচাচ্ছে। শোভা ফোকলা হাসি দিয়ে বললো,
“ইয়ে মানে তোমার প্রথম রাত পুষ্পময় করতে গিয়ে কার্পণ্য করিনি। নিজের কম ছিলো তো কি হয়েছে ওদের ফুল এমনিতেই ঝরে যায়। তাই একটি কাজে লাগালাম।”

“তাই বলে চুরি করবি?”

“তোমার তো আমাকে ধন্যবাদ দেওয়া উচিৎ। তোমার জন্য ঝুকি নিয়ে ইংলিশ আন্টির বাগান সাফাই করেছি।”

মিহা শাসনের সুরে বললো,
“এটা ঠিক হলো না। কখনো এমন করবি না বলে দিলাম।”

“আহা এতো ভেবো না তো। যাও ভাইয়ার কাছে যাও। পতিসেবা করো। এদিকটা আমি দেখছি। কে ফুল চুরি করেছে তার প্রমান তো আর নেই। হে হে।”
বলেই শোভা বেড়িয়ে গেলো বাড়ি থেকে।

শোভাদের পাশের বাড়ির প্রতিবেশীর বাগানটা খুব বড়। প্রতিবেশী আন্টিকে শোভা ইংলিশ আন্টি বলে। এটা বলার কারন মহিলাটি সবসময় বিদেশি সাজার চেষ্টায় মত্ত। চুল কেটে ঘাড়ে ফেলেছে এবং তাতে সোনালি রঙও করেছে। অথচ এখন তার চুল পেকে মাথা সাদা হওয়ার বয়স। শোভার বড্ড হাসি পায় মহিলাটার ওপর। তবে মিহা পছন্দ করেনা বলে ওর সামনে কিছু বলতে পারে না।

শোভা তার কাছে গিয়ে নিষ্পাপ মুখে জিজ্ঞেস করলো,
“কি হয়ে আন্টি? আপনার গাধা চুরি গেছে?”

“গাধা নয় মেয়ে গাদা। মারিগোল্ড। আমার বাগানের সব ফুল চুরি হয়ে গেছে রাতের বেলা। বৃষ্টির দিনে চোর আসে গ্রামে। তাই বলে শহরেও হানা দেবে! এমন একটা শান্তিপূর্ণ এলাকায় কিনা চোর! ওহহ মাই বেইবি ফ্লাওয়ার!”

শোভা যেন দুঃখ পেলো কথাটা শুনে।
“আসলেই আন্টি। থাক তবুও শুকরিয়া করুন যে আপনার ঘরে চুরি হয়নি। ফুলের ওপর দিয়ে গিয়েছে।”
এর বেশি কিছু বলার চেষ্টা করলো না। ওর মুখ যে হারে চলে তাতে দেখা যাবে গল্পের ফাকে হুট করে সত্যি কথাটা বলে ফেলেছে।

ফেরার সময় বাগানের খুটির সাথে বেধে রাখা ইংলিশ আন্টির ছোট শিয়ালের মতো দেখতে কুকুরটার সামনে হাটু গেড়ে বসে বললো,

” তোদের বাগানতো সাফ করে দিয়েছি। পাহারা দিসনি কাল? ওহহ বৃষ্টির জন্য ঘরে ছিলি মনে হয়।”
কুকুরটা ওর দিকে তাকিয়ে দুইবার ডেকে উঠলো।

“কি করছো শোভা?”

“কিছুনা আন্টি আপনার কুত্তাটা থুরি ডগি টা খুব কিউট। দেখলেই আদর করতে ইচ্ছে করে।”

__________

মিহা নিশান্তকে খাবারের জন্য ডাকতে রুমে ঢুকলো। নিশান্তের সামনে থাকতে লজ্জা করে বিধায় এতোক্ষন বাহিরে ঘুরেছে। নিশান্তের কথা মনে এলেই শুধু গতকালের উষ্ণ আলিঙ্গনের দৃশ্যটা চোখে ভেসে ওঠে। একা একাই লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে সে। নিশান্ত আঙুল চালিয়ে চুল ঠিক করছিলো। আয়নাতে মিহার প্রতিবিম্ব দেখে পেছনে ফিরে তাকালো। কিছুটা ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বললো,

“ভেবেছিলাম বিবাহের প্রথম রাত্রির ঘুমটা তোমার মুখ দেখে ভাঙবে। কিন্তু তুমিতো পুরো সকাল দেখাই দিলে না।”

নিশান্তের অভিমানী মুখ দেখে মিহার খারাপ লাগলো। ও কি একটু বেশিই দূরে থাকছে লোকটার? লজ্জা পেয়ে কি লোকটাকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে? মিহার লজ্জামাখা মুখে দুঃখেরা হানা দেওয়ার আগেই নিশান্ত ওর হাত চেপে ধরলো। টেনে নিজের কাছে এনে খাটে বসালো। মিহা মুহূর্তে ভরকে গেলেও নিজেকে সামলে নিলো। নিশান্ত ওর থুতনিতে আঙুল স্পর্শ করে মুখটা নিজের দিকে উঁচু করে বললো,

“এই মুখে লজ্জা মানায়। দুঃখ নয়। যতই দূরে সরার চেষ্টা করো না কেন সখী। আমার নীড়েই ফিরতে হবে তোমায়।”

সকালের খাবার শেষে নিশান্ত অফিস যাওয়ার জন্য তৈরী হয়ে নিলো। ছোট পরিসরে বিয়ে হওয়ায় ছুটি নেওয়া হয়নি। মিহাকে যখন বাড়িতে নিয়ে যাবে তখন লম্বা ছুটি নেবে বলে ভেবে রেখেছে নিশান্ত। আনোয়ার সাহেবের হজ্জ করা পর্যন্ত মিহাকে এখানে রাখতে চায়না নিশান্তের পরিবার। তারা আরো আগেই ছোট বউকে বাড়ি নিয়ে রাখতে চায়।
মিহা পুরোটা সময় নিশান্তের সাথেই রইলো। নিশান্ত হাতে ঘড়ি পড়ার সময় মিহাকে বললো,

“যদি অফিস থেকে বের হতে লেইট হয় তবে আমি আজ নাও আসতে পারি মাহযাবীন। তুমি অপেক্ষা করো না আমার জন্য।”

মিহা মাথা কাত করে সম্মতি দিলো। তবে ওর মনটা হঠাৎ একটু খারাপ হয়ে গেলো। মনেই হয় না কাল লোকটার সাথে প্রথম পরিচয় হয়েছে। এর মধ্যেই নিশান্ত তার আপন শক্তিতে ওর মধ্যে যায়গা করতে শুরু করেছে। আচ্ছা! ও পারছেতো নিশান্তের মনে যায়গা করতে?

মিহা ফোনটা এগিয়ে দিলো নিশান্তের দিকে। নিশান্ত সেটা পকেটে রাখতে গিয়ে মনে পড়লো মিহার মোবাইল নাম্বার নেওয়া হয়নি। সে মিহার দিকে ফোনটা এগিয়ে দিয়ে বললো নাম্বারটা সেভ করে দিতে। মিহা নাম্বারটা মাহযাবীন নামে সেভ করে ফেরত দিলো। নিশান্ত ফোনসহ মিহাকে আকড়ে ধরলো। মিহার মুখখানা আজলায় ভরে কতক্ষন তাকিয়ে রইলো ওর মুখপানে। মিহার ছুটে পালাতে ইচ্ছে করছে। এতো কাছে থাকলে ও খেই হারিয়ে ফেলে।

নিশান্ত মিহাকে দুইহাতে আবদ্ধ করে বললো,
” এই লজ্জা রাঙা নরম গাল, ভীতু চাহনি, কোমল কন্ঠের অধিকারী মিষ্টি মেয়েটা আমার বউ। আমার সহধর্মিণী। আমার এখনো বিশ্বাস হয় না।”

“বিশ্বাস না হলে ধরে আছেন কেনো?”

নিশান্ত শব্দ করে হাসলো। মিহা আরো নুইয়ে গেলো। মুখ ফসকে বলে ফেলেছে কথাটা।
দরজায় ঠক ঠক শব্দ শুনতেই মিহা ছিটকে সরে গেলো। ভেতরে প্রবেশ করলো শোভা। নিশান্তকে উদ্দেশ্য করে বললো,

“ভাইয়া আবহাওয়া খারাপ করছে। বৃষ্টি নামতে পারে। বাবা বলেছে আপনি বের হতে চাইলে যেন এক্ষুনি রওনা হোন।”

নিশান্ত মাথা নাড়লো। শোভা চলে যেতেই নিশান্ত মিহার কাছে বিদায় নিলো। বেরিয়ে যাওয়ার আগে টুপ করে মিহার কপালে নিজের ওষ্ঠদ্বয় ছুইয়ে গেলো নিশান্ত। মিহা যায়গাতেই জমে গেলো। বিস্ময় নিয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে রইলো। এটা কি হলো?

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here