শুভ্র বর্ষণ পর্ব- ২৪

0
2167

#শুভ্র_বর্ষণ
#প্রভা_আফরিন
#পর্ব_২৪

“আমি শয়নগৃহে, চারপায়ীর উপর বসিয়া মাংসের হাড় চিবাইতে ছিলাম। মিট মিট করিয়া ক্ষুদ্র আলো জ্বলিতেছে, দেওয়ালের ওপর চঞ্চল ছায়া, প্রেতবৎ নাচিতেছে। মাংস হাতে নিমীলিতলোচনে আমি ভাবিতেছিলাম যে, আমার যদি আজ গায়ে হলুদ হইতো, বর হিসেবে কে থাকিত। এমন সময় একটি ক্ষুদ্র শব্দ হইলো, “ঘেউ!”
চাহিয়া দেখিয়া হঠাৎ বুঝিতে পারিলাম না। প্রথমে মনে হইলো, একটি শিয়াল হঠাৎ কুকুরত্ব প্রাপ্ত হইয়া, আমার নিকট মাংসের হাড় ভিক্ষা করিতে আসিয়াছে। প্রথম উদ্যমে, পাষাণবৎ কঠিন হইয়া, বলিব মনে করিলাম যে, শিয়াল মহাশয়কে ইতিপূর্বে যথোচিত মাংসের হাড় দেওয়া গিয়াছে, এক্ষণে আর অতিরিক্ত হাড় দেওয়া যাইতে পারে না। বিশেষ অপরিমিত লোভ ভালো নহে।
শিয়াল বলিল, “ঘেউ!”

তখন চক্ষু মেলিয়া ভালো করিয়া দেখিলাম যে, শিয়াল নহে। একটি ক্ষুদ্র কুকুর। ফুপি আমার জন্য যে মাংস রাখিয়া গিয়াছিল, সে সকল তাহার পাকস্থলীতে স্থান পাইয়াছে, আমি তখন গায়ে হলুদের স্টেজে বরের কল্পনায় ব্যস্ত, অত দেখি নাই।
এক্ষণে সারমেয়(কুকুর), মাংস যুক্ত হাড় চিবাইয়া পরিতৃপ্ত হইয়া আপন মনের সুখ এ জগতে প্রকাশিত করিবার অভিপ্রায়ে, অতি চিকন স্বরে বলিল, “ঘেউ!”

বলিতে পারি না, বুঝি তাহার ভিতর একটু ব্যঙ্গ ছিল। বুঝি, সারমেয় মনে মনে হাসিয়া আমার পানে চাহিয়া ভাবিতেছিলো,
“কেহ মরে বরের খোজে, কেহ খায় মাংস।”
বুঝি সে “ঘেউ!” শব্দে একটু মন বুঝিবার অভিপ্রায় ছিলো। বুঝি টফির মনের ভাব, “তোমার মাংস তো খাইয়া বসিয়া আছি– এখন বল কী?”
বলি কী? আমি তো ঠিক করিতে পারিলাম না। মাংস আমার বাপেরও নয়। মাংস গরুর, রাধিয়াছে ফুপি। অতএব সে মাংসে আমারও অধিকার, টফিরও তাই। সুতরাং রাগ করিতে পারি না।”

শোভার অভিনয়ে মিহা এবং সুমা বেগম হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খায়। সুমা বেগম রান্না করে একবাটি মাংস শোভাকে খাওয়ার জন্য দিয়ে গিয়েছিলো। সন্ধ্যার পরই হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হবে। সাজগোজ করার পর শোভা দাতে কুটোটি নাড়বে না জেনে আগেই ওর প্রিয় কষা মাংস রেধে দিয়ে গেছেন তিনি। বাটি ফেরত নিতে এসে দেখে ফ্লোরে বসে হাড় চিবাতে মগ্ন টফি। শোভা তখন সাজগোজে ব্যস্ত। সুমা বেগম রেগে গিয়ে বলেন,

“তোকে বলে গেছি সাজগোজের আগে একটু খেয়ে নিবি, আর তুই কিনা টফিকে খাওয়াচ্ছিস? ওর খাবার কি কম পড়েছিলো?”

এই কথার উত্তরে শোভা কমলাকান্তের মতো ভাব নিয়ে নিজের ও টফির মাংস খাওয়ার বর্ণনা দিলো। সুমা বেগম শোভার মাথায় চাপড় মেরে বেরিয়ে যান। মিহা এগিয়ে এসে শোভার কাধ জড়িয়ে বলে,

“রিয়াদ ভাইয়ার বিরহে কি আজকাল আফিং খাচ্ছিস নাকি?”

“ইশ! আমি কেনো তার বিরহে থাকবো? বরং সে আমার বিরহে আফিং খাবে।”

“আচ্ছা তাই!”

“হ্যাঁ, তাই। এখন দেখতে দাও তোমাকে।”

শোভা হাত ধরে মিহাকে নিজের সামনে দাড় করালো। হলুদ সবুজের সংমিশ্রণে একটি কাতান লেহেঙ্গায় সেজেছে মিহা। আর্টিফিশিয়াল ফুলের গহনা শোভা পেয়েছে কানে, গলায়, হাতে, কোমড়ে এবং মাথায়। খোপা করে রাখা চুলে গাজরা জড়ানো। তারওপর তুলে দেওয়া হয়েছে সবুজ পাড়ের ঘোমটা। দুইহাত ভর্তি মেহেদি। শোভা টিকলিটা সোজা করে দিয়ে বললো,

“মাশাআল্লাহ! আমার আপুর নজর না লাগুক। নিশান্ত ভাইয়া দেখলে নির্ঘাত ছোটখাটো হার্ট অ্যাটাক করবে।”

মিহা প্রশস্ত এক হাসি দিলো। শোভার পড়নে হলুদ শাড়ি, নিশান্তের বাড়ি থেকে দিয়েছে। মিহা ওর গাল টিপে দিয়ে বললো,
“তোকেও সুন্দর লাগছে। শাড়িতো একদমই পড়তে চাস না। দেখ, শাড়ি পড়লে কত সুন্দর লাগে তোকে।”

শোভা রেড ম্যাট লিপস্টিক দিয়ে গুনগুন করতে করতে মিহাকে চোখ টিপ দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। মিহা শোভার যাওয়ার দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইলো। আজকাল ওর মনে যে কি চলে, বোঝা দায়। মিহা মোবাইল নিলো নিশান্তকে ভিডিও কল দিতে। কিন্তু ফোন বাজলো আশেপাশেই কোথাও। মিহা একটু চমকালো। এদিক ওদিক নজর বুলিয়ে বুঝলো আওয়াজটা বারান্দা থেকে আসছে। ফোন কেটে দিয়ে কয়েক কদম এগোতেই থেমে গেলো।
বারান্দার দরজায় প্রিয় মানুষটির আগমন ঘটেছে। নিশান্ত পাঞ্জাবি পড়ে বুকে হাত গুজে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ঠোঁটে মনকাড়া হাসি। মিহা কেনো জানি অবাক হতে গিয়েও পারলো না। নিশান্ত এমন কিছু করবে এটাই যেন সে জানতো। অন্তত শোভার একটু আগের হাবভাবে কিছুটা আন্দাজ করেছিলো। এগিয়ে গিয়ে থমথমে মুখে বললো,

“আপনি এখানে কেনো এসেছেন? আপনাকে না বলেছি কালকের আগে কোনো দেখা নয়! কেউ দেখলে কি ভাববে?”

নিশান্ত সেসব কথার ধারে কাছে গেলো না। মিহাকে হাত ধরে কাছে টেনে মোবাইলের ফ্রন্ট ক্যামেরা অন করলো। “স্মাইল প্লিজ!” বলে বেশ কয়েকটা সেলফি তুলে নিলো দুজনে। মিহাকে বারবার দরজার দিকে তাকাতে দেখে নিশান্ত বললো,

“এতো ছটফট করছো কেনো মাহযাবীন? ঘরে তুমি তোমার স্বামীর সাথে আছো। হবু বরের সাথে না। আর এখন কেউ আসবেও না। বাইরে আমার শালি ‘দ্যা বডিগার্ড শোভা’ পাহারা দিচ্ছে। আমাকে একটু দেখতে দাও প্রান ভরে।”

মিহা নিশান্তের বাহুবন্ধনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। কিছুক্ষণ পর বললো,
“আর কত দেখবেন। আমার লজ্জা লাগছে এবার।”

“তোমায় দেখে তৃষ্ণা মিটাতে চাই। অথচ দেখলে তৃষ্ণা আরো বেড়ে যায়।”

“তাহলে দেখা কমিয়ে দিন। তৃষ্ণা কমই থাকুক নাহয়।”

“তুমি আমার মনকে শাখের করাত বনিয়েছো। যে এগোলেও কাটে, পিছালেও কাটে। না দেখলে ছটফটানি কমেনা, দেখলেও তৃষ্ণা মেটে না।”

মিহা হেসে নিজের হাতের মেহেদি নিশান্তের চোখের সামনে মেলে ধরলো। ঠিক মাঝখানটায় নিশান্তের নাম জ্বলজ্বল করছে। নিশান্ত হাত দু’টো ঠোঁটের সাথে চেপে ধরে অগণিত ভালোবাসার স্পর্শ দিলো। মিহা আরক্তনয়নে আলতো করে নিশান্তের বুকে মিশে গেলো। হঠাৎ গালে ভেজা কিছুর অস্তিত্ব অনুভূত হওয়ায় মুখ তুলে তাকালো। গাল হাত দিতে বুঝলো মেকাপের প্রলেপে আবৃত গালে স্বামী হলুদ ছুইয়েছে। মনে শুভ্র অনুভূতির উৎপত্তি ঘটলেও মুখে কপট রাগ দেখানোর চেষ্টা করলো মিহা।

“এটা কি করলেন! এখনোও হলুদের অনুষ্ঠান শুরুই হয়নি। সবাই কে কি বলবো?”

এমন সময় দরজায় ঠকঠক শব্দ হলো। শোভা তাড়া দিলো। নিশান্ত হেসে বললো,
“আমার বউকে হলুদ ছোয়ানোর অধিকার সবার আগে আমার। তাই করে গেলাম। এবার আমার ছুটি।”

নিশান্ত চলে যেতে নিলে মিহা ওর হাত চেপে ধরলো। চোখ বন্ধ করে নিশান্তের গলা জড়িয়ে ধরে ওকে সামান্য নিচু করলো। তারপর গালের সাথে গালের ঘর্ষণে নিশান্তের ছোয়ানো হলুদ টুকু দুজনের গালে ভাগ করে নিয়ে নিশান্তকে ছেড়ে দিয়ে ছুটে পালালো মিহা। নিশান্ত ওর কান্ডে ঠোঁট কামড়ে হাসলো।

_________

স্টেজে বসানো হয়েছে মিহাকে। গালে হলুদের উপস্থিতি দেখে অনেকেই কারণ জিজ্ঞেস করছিলো। শোভা’ই সবাইকে বলেছে দুষ্টুমি করে একটু হলুদ লাগিয়ে দিয়েছে। এই নিয়ে অনেকে বকাও দিলো, কেনো মেকাপ নষ্ট করলো তাই নিয়ে।
শোভা সেসব কথা গায়ে না মেখে আঁচল গোছাতে গোছাতে নিচে নেমে এলো। রিয়াদ যেন এতোক্ষণ ওকেই খুজছিলো এমনভাবে সামনে এসে দাড়ালো। বললো,

“একটু দূরে এসো, কথা আছে।”

শোভা জানে কি কথা বলবে। এই দুইদিন শোভা রিয়াদকে বেশ জ্বালিয়েছে। বেচারা কতবার কতভাবে মনের কথা বলতে চেয়েছে অথচ শোভা পাত্তাই দেয়নি। কেনো জানি ছেলেটাকে পেছনে ঘোরাতে মজাই লাগছে। শোভা রিয়াদের পেছনে পেছনে গেলো। স্টেজের ভীড় থেকে বেরিয়ে খোলা যায়গায় দাড়ালো রিয়াদ। সাথে দাড়ালো শোভা। রিয়াদ শোভাকে ভালো করে দেখলো। বললো,

“শাড়িতে একটুও সুন্দর লাগছে না তোমায়। বয়স্ক মহিলা মনে হচ্ছে। কিসব পড়েছো তুমি!”

শোভার রাগ হলো। এতোদূর ডেকে এনে বলছে সুন্দর লাগছে না! অথচ সে আজ রিয়াদের জন্যই এতো সুন্দর করে, সময় নিয়ে সেজেছিলো। মনে মনে ভেবে এসেছিলো আজ কয়েকটা প্রশংসা শুনবে এই লোকের থেকে। ধ্যাত! এই রিয়াদের থেকে ভালো কিছু আশা করা যায় নাকি। ভালোবাসার কথাটাও সরাসরি বলে না। ইনিয়েবিনিয়ে বললে কে রাজি হতে চায় শুনি?

শোভা কোমড়ে হাত দিয়ে বললো,
“বেশ করেছি শাড়ি পড়েছি। আরো পড়বো। তাতে আপনার কি?”

“আমার কিছুই না। তা শোনো যা বলতে ডেকেছিলাম।”

শোভা হাত উঁচিয়ে থামিয়ে দিয়ে বললো,
“জানি জানি। আপনার সেই হৃদয়হরণীকে এনে দিতে বলবেন, তাইতো। সে আসবে না। এমন মিনমিন করলে হৃদয়হরণী কেনো পেত্নীও জুটবে না। মনের কথা সরাসরি বলে দিন। প্রপোজ করুন, তারপর মানবে কিনা আমি বুঝে নেবো।”

“থামো এবার। তোমায় আর তাকে খুজে এনে দিতে হবে না।”

“হবে না মানে?”

রিয়াদ মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো,
“হ্যাঁ, খুজে দিতে হবে না। তার মন পেয়ে গেছি আমি। খুব শীগ্রই আমার হতে চলেছে সে।”

শোভা হতভম্ব হয়ে গেলো। কার মন পেয়ে গেলো! শোভা তো ওর সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। রিয়াদ মুচকি হেসে চুলে আঙুল চালিয়ে ব্যাক ব্রাশ করতে করতে চলে গেলো স্টেজের দিকে।
শোভা কাদো কাদো মুখ করে ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। বিড়বিড় করে বললো,

“এটা কি হলো?”

_______

আরিফ সাহেব মিহাকে হলুদ ছোয়াতে গিয়ে দূর থেকে রিয়াদ এবং শোভাকে দেখলেন। ইদানীং তার চোখে পড়ছে শোভা এবং রিয়াদের মেলামেশাটা। হয়তো সবারই চোখে পড়ছে। তিনি শোভাকে না বুঝলেও নিজের কোলেপিঠে করে বড় করা ছেলেকে ঠিকই বোঝে। এই মেলামেশা টুকুর ভবিষ্যৎ ফলাফলও তিনি স্পষ্ট বুঝতে পারছেন। মনে মনে হাসলেন আরিফ সাহেব।
মেয়েটা মন্দ নয়। আরিফ সাহেবের জন্য অত্যাধিক খুশির খবর এটা। কয়েকটা দিন পরই আনোয়ার সাহেবের কাছে কথাটা তুলে দেখবেন। মনে হয়না কারো আপত্তি হবে। তাছাড়া মেয়েকে বাড়ির কাছে রাখতে পারলে আনোয়ার সাহেবের পরিবারও খুশিই হবে বোধহয়। নিজের মনে কথাগুলো ভেবে প্রফুল্লচিত্তে বাড়িতে প্রবেশ করলেন। তার স্ত্রী এখনো মেকাপ করতেই ব্যস্ত। আরিফ সাহেব বিরক্ত হলেন। বললেন,

“আর কত সাজবে বুড়ি? অনুষ্ঠান শেষ হলো বলে।”

“চুপ করোতো। কি বুড়ি বুড়ি লাগিয়েছো শুনি! এই এতো সেজেগুজে থাকতাম বলেই না তুমি পাগল হয়েছিলে আমার জন্য।”

আরিফ সাহেব স্ত্রীর কথায় কেশে উঠলেন। বললেন,
“তাহলেই ভাবো, এইসব রঙচঙ দিয়েই আমায় ডুপ্লিকেট সুন্দরী ধরিয়ে দিয়েছিলো তোমার বাপ।”

স্বামীর কথায় ফুসে উঠলো রিয়াদের মা।পরিস্থিতি সামলাতে আরিফ সাহেব বললো,
“ছেলের বউকে ঘরে তোলার সময় হলো। এবার তো শ্বাশুড়ি ভাব আনো নিজের মাঝে।”

“শ্বাশুড়ি হলে কি সাজা যাবে না? বরং আমি আমার বউমাকে নিয়েই সাজবো।”

আরিফ সাহেব হতাশ হলো। চোখের চশমা ঠিক করে বললো,
“বিদেশি ফিদেশি ছেলের বউয়ের কথা ভুলে যাও। বউ খোজার দায়িত্বটুকু ছেলেকেই নাহয় দাও। আমরা ওকে সমর্থন করতে পারি শুধু, নিজেদের পছন্দ ওর উপর চাপিয়ে দিতে পারি না। ছেলেকে বোঝার চেষ্টা করো, তাহলে সাথে বউমাও পেয়ে যাবে।”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here