#এ_শহরে_বৃষ্টি_নামুক❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-৬
নিভ্রান অবিশ্বাস নিয়ে তাকালো।বললো,”মজা নিচ্ছেন?”
রাত্রি থতমত খেলো।চোখমুখ কুঁচকে বললো,”মজা নিবে কেনো?সত্যি বলছি।”
সামনে তাকিয়েই হাসলো নিভ্রান।চুলে মাঝে হাত চালিয়ে হঠাৎই মুখটা আবারো নিয়ে গেলো রাত্রির ঘাড়ের কাছে।বুক ভরে শ্বাস নিতেই আড়ষ্ট হয়ে গেলো রাত্রি।থেমে থেমে বললো,
—“কি করছেন?”
নিভ্রান নাক সরিয়ে তৎক্ষনাত উওর দিলো,
—“আমি তীব্র ঘ্রান পাচ্ছি রাত।আর আপনি বলছেন আপনি পারফিউম দেননা।সিরিয়াসলি?”
—“আমি মিথ্যে কেন বলবো?”বাচ্চাসূলভ গলায় কাতর হয়ে বললো রাত্রি।কন্ঠে নিজেকে সঠিক প্রমান করার টান।নিভ্রান একআঙ্গুলে কপাল ঘষলো।রাত্রির অসহায় চাহনী দেখে মূহুর্তেই হেসে ফেললো।মেয়েটা অল্পতেই অস্থির হয়ে পরে।মুখের হাসি বজায় রেখেই ডানহাতে মাথার পিছের অংশে হাত বুলিয়ে দিলে সে।কোমল কন্ঠে বললো,
—“আচ্ছা,মানলাম পারফিউম দেননি।এটা আপনার নিজস্ব ঘ্রান।”
নতজানু হয়ে গেলো রাত্রি।মা ছাড়া অন্য কারো কাছ থেকে এমন স্নেহ তার দীর্ঘদিনের অপরিচিত।মায়ের আদর ও তো সহসা তার কপালে জুটেনা।চট্রগ্রাম গেলে এক দুদিন তারপর আবার সেই নিসঙ্গতা,একাকিত্ব।কান্নাগুলো গিলে নিজেকে সামলে প্রসঙ্গ পাল্টানোর চেষ্টা করলো রাত্রি।বললো,
—“আপনি কোথায় থাকেন?আমার বাসার কাছেই?”
—“হু”অন্যমনস্ক হয়ে উওর দিলো নিভ্রান।রাত্রি বুঝলোনা তার কথা।বৃষ্টি পরছে টুপটাপ।হাত পা আংশিক ভিজলেও ভিজার মতো ভিজছেনা।রাত্রির মনে হচ্ছে নিভ্রান আটকে গেছে।চোখের অপলক দৃষ্টিই বলে দিচ্ছে লোকটার বৃষ্টি কতো পছন্দ।সশব্দে গলা ঝাড়লো সে।নিভ্রান সচকিত হয়ে তাকালো।অস্থির কন্ঠে বললো,
—“কি হলো?গলায় কিছু আটকেছে?পানি কিনে আনবো?।”
বিহ্বল চোখে চেয়ে রাত্রি এলোমেলো গলায় উওর দিলো,”কিছু হয়নি।শান্ত হন।”
—“ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন।”
—“কেনো?”
নিভ্রান হাসলো শুধু।উওর দিলোনা।রাত্রি গুমোট হয়ে গেছে আবারো।নিভ্রানের কথা,একটুতেই প্রবল অস্থিরতা,দায়িত্বশীল কাজকর্ম সবকিছুতেই কেন যেন ভয়ংকর কোনো অনুভূতির আভাস পাচ্ছে সে।
কিন্তু এসব তো তার জন্য নিষিদ্ধ।নিষিদ্ধ দিকে দৃষ্টি না দেয়াই শ্রেয়।
—“আমিও একাই থাকি রাত।ঠি ক আপনার মতো।একদম একা।”
—“কেনো?”ভাবনার জগত থেকে বেরিয়ে সন্ধিহান কন্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়লো রাত্রি।একটা পূর্ণ গোলাকার বৃষ্টির ফোঁটা গালের মাঝ বরাবর এসে পড়েছে।নিভ্রান তার দিকে ফিরে মুচকি হাসলো।হাত বাড়িয়ে বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে আলতো করে পানিটা মুছিয়ে দিয়ে ধীরস্হির কন্ঠে বললো,”বলবোনে একদিন।”
খানিকবাদে প্রশ্ন করলো রাত্রি,
—“কটা বাজে?”।কন্ঠে উৎকন্ঠা,ভীতভাব।নিভ্রান কপাল কুঁচকে ঘড়ি দেখলো।অন্ধকারেও তার সিলভার ঘড়িটা নতুনের মতো চকচক করছে।
—“ন’টা পয়তাল্লিশ।কেনো?কিছু হয়েছে?”
রাত্রি ধাতস্থ হলো।মুখের ভীতিভাবটা কিছুটা কমেছে।হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে ঠোঁটের উপরের ঘামটুকু মুছে নিলো সে।বললো,
—“দশটার পর গেট বন্ধ করে দিবে।একটু তাড়াতাড়ি যেতে বলুননা।”
—“চিন্তার কিছু নেই।দশটার আগেই পৌছে যাবো।”আশ্বস্ত করে বললো নিভ্রান।
____________
একহাতে কুঁচি ধরে সাবধানে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠছে রাত্রি।চোখ মেঝের দিকে।সিড়িতেই দেখা হলো বাড়িওয়ালা চাচির সাথে।নাম রাহেলা।সালাম দিয়ে ভদ্রমহিলাকে যাওয়ার জায়গা দিয়ে সাইড হয়ে দাড়ালো রাত্রি।।ভদ্রমহিলা গেলো না।ছুকছুক চোখে আপাদমস্তক রাত্রিকে দেখে তীরের মতো তীক্ষ্ণ গলায় বললে,
—“মাইয়া মানুষ এতো রাতে আসো ক্যান?জানোনা দশটার পরে গেট বন্ধ।”ভদ্রমহিলার কন্ঠে গ্রাম্য টান আছে।
রাত্রির রাগ হলেও ভদ্রভাবেই বললো,
—“দশটার আগেই এসেছি আন্টি।”
রাহেলা যেন প্রস্তুত ছিলো পড়ের প্রশ্ন ছোঁড়ার জন্য।
—“তুমি এত রাতে আইবা কেনো?আগে আসতে পারোনা?মেয়েমানুষের এতো বাইরে বাইরে কি?”
—“আমার টি উশনি ছিলো।তাছাড়া নিয়ম সবার জন্য এক।আমিতো দশটার আগেই এসেছি।এত প্রশ্ন করছেন কেনো?”দাঁতে দাঁতে চেপে উওর দিয়ে পুনরায় সালাম দিয়ে “আসছি” বলে পাশ কাটিয়ে গটগট করে উপরে উঠে গেলো রাত্রি।এদেরকে মাঝেমধ্য উচিত কথাটা বলে দিতে হয়।নয়তো অবলা ভেবে অপদস্ত করার প্রভাব দিন দিন বেড়েই যাবে।
রাহেলা কটমটে দৃষ্টিতে রাত্রির যাওয়ার দিকে চেয়ে রইলো।মেয়েটাকে তার সবদিক দিয়েই পছন্দ শুধু কটা কটা কথা ছাড়া।এই নজরকাড়া রুপে তার ভাইগ্না তো গতবার এবাসায় আসার পর পাগলই হয়ে গিয়েছিলো।যে করেই হোক এ মেয়েকে লাগবেই।মেয়ের বাবা নেই শুনেও ভাইগ্নার পাগলামিতে রাত্রিকে প্রস্তাব দিয়েছিলো সে।কিন্তু রাত্রি খুবই স্পষ্ট ভাষার তাকে না করে দিয়েছিলো।রুগ্ন শ্বাস ছাড়লো রাহেলা।মেয়েটার এই দেমাগ তার আর সহ্য হচ্ছেনা।
___________
রাত গভীর হয়েছে।খাবার খেয়ে সব গুছিয়ে সোজা বিছানায় গা এলিয়ে দিলো রাত্রি।ফোন লাগালো মায়ের নাম্বারে।ভেতরটা খুব স্বস্তিহীন লাগছে।বুক ধরফর করছে।ফোন রিসিভ হলো।রাত্রি মৃদু কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
—“মা?”
ওপাশ থেকে মায়ের কন্ঠ শোনা গেলোনা।ভেসে আসলো একজন পুরুষের ভরাট গলা,”দিতেছি।”পাল্টা কিছু বললোনা রাত্রি।দরজা খোলার ক্যাড়ক্যাড় শব্দে বোঝা গেলো ফোনটা একটু পরে মায়ের কাছে পৌছে যাবে।লোকটা তার আপন মামা।তবুও লোকটার প্রতি বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধাভক্তি নেই রাত্রির।ইনি হচ্ছে তার দেখা নিকৃষ্ট মানুষ জনদের মধ্য একজন।
একটু পরেই মায়ের স্নেহমাখা ডাক শোনা গেলো।
—“রাত।”
রাত্রি দাঁত বের করে হাসলো।প্রশান্তির হাসি।এই “রাত” ডাকটায় কি যেনো আছে।খুব শান্তি দেয়।আগে শুধু মা আর বাবা-ই তাকে এ নামে ডাকতো।বাবা চলে যাওয়ার পর শুধু মা একা ডাকতো এখন আবার নিভ্রানও যোগ হয়েছে।
—“তুমি ঠি ক আছো মা?পায়ের ব্যাথা কমেছে?”
রুবিনা বেগম জোরপূর্বক হেসে জবার দিলেন,”আমি ঠি ক আছি রে মা।”
—“ওই লোকটা আজ কোনো ঝামেলা করেছিলো?”রাত্রির সোজাসাপটা কঠিন গলার প্রশ্ন।
—“ধ্যাত্ ওই লোকটা ওই লোকটা বলিস কেনো?তোর মামা হয়না?গুরুজন দের এভাবে ডাকতে নেই।”
—“উনার গুরুজন হওয়ার যোগ্যতা নেই মা।”
—“আমাকে থাকতে দেয় এই তো বেশ।”
রাত্রি রাগ নামালো।মাকে এসব বলে লাভ নেই।সে খুব সহজ সরল মানুষ।গলার স্বর স্বাভাবিক করে সে বললো,
—“বাদ দাও।”
কিছুক্ষণ কথার পর ফোনের দিকে তাকালো রাত্রি।লেখা উঠেছে চৌদ্দ মিনিট ত্রিশ সেকেন্ড।তপ্ত শ্বাস ছাড়লো সে।মায়ের সাথেও মেপে মেপে কথা বলতে হয় আজকাল।ফোনটা আবারো কানে লাগিয়ে বিরস,বেজার কন্ঠে বললো,
—“আজ রাখছি মা।ফোনের টাকা শেষ হয়ে যাবে।”
রুবিনা বেগম সন্তষ্ট কন্ঠে বললেন,”আচ্ছা মা,তুই কেটে দে তাহলে।আমিতো পারিনা।”
—“তুমি পারোনা না।বলো তুমি ওই লোকের ফোনে চাপ দিতে ভয় পাও।”
মেয়ের স্পষ্টভাষী কথায় মিইয়ে গেলেন রুবিনা বেগম।বলার মতো কিছু পেলেন না।ফোন কাটার আগে রাত্রি গমগমে গলায় বলে উঠলো,
—“ওই লোকের বাসায় আর থাকতে হবেনা।অনার্সটা শুধু কম্প্লিট হোক।তোমাকে যেভাবেই হোক ঢাকায় নিয়ে আসবো আমি।দেখো।”
মেয়ে রেগে যাচ্ছে বুঝতেই রুবিনা বেগম পরিস্থিতি ঠান্ডা করার জন্য হাসলেন।বললেন,
—“হয়েছে এতো চাপ নিতে হবেনা।একটু দম নে এবার।”
_____________
পরেরদিন রাতেরবেলা।
টি উশনির বাসা থেকে নামতেই নিভ্রান কে দেখে অবাক হলোনা রাত্রি।কাল রিকশা থেকে নামার পড়ই নিভ্রান তাকে বলেছিলো আজকে তারা একসাথে ফিরবে।নিভ্রানের আবদার মাখা কন্ঠের বিপরীতে মানা করতে পারেনি সে।সম্মতি দিয়েছিলো।
তবে অবাক হলো নিভ্রানকে গাড়িতে বসা দেখে।তাকে দেখেই গাড়ির কাঁচ নামালো নিভ্রান।বললো,”এসেছেন তাহলে।”বলে একবার ঘড়ির দিকে তাকালো।তারপর ফিচেল গলায় বললো,আজকে বোধহয় একটু বেশি পড়িয়েছেন।”
রাত্রি অপ্রস্তুত হাসলো।বললো,
—“স্টুডেন্টের পরীক্ষা তো সামনে।তাই আরকি।”
নিভ্রান গাড়ির চাবি ঘুরাচ্ছে।রাত্রি তড়িঘড়ি করে বললো,”আমি গাড়িতে যেতে পারবোনা।দমবন্ধ লাগে এসব।”
নিভ্রান ঠোঁট এলিয়ে হাসলো।সিটবেল্ট খুলতে খুলতে বললো,”আপনাকে যেতে বলেছে কে?নেমে যাচ্ছিতো”বলতে বলতেই নেমে এলো সে।গাড়ির দরজা লক করে অজান্তেই নিজের হাত বাড়িয়ে বললো,”আসুন।”
একটু দ্বিধা করে হলেও পরম ভরসায় হাতটা ধরলো রাত্রি।নিভ্রান তা শক্ত করে আঁকড়ে নিলো।
শুরু হলো পাশাপাশি পদচারণ।
______________
গলির মোড়ে প্রায় পৌঁছেই গেছে তারা।কথা বলায় মশগুল ছিলো তার মাঝেই ডাক পড়লো।
—“এই মেয়ে…।”
রাত্রি ফিরে তাকালো।মুদি দোকানদারওয়ালা ডাকছে তাকে।কারনটাও সে জানে।টাকা বাকী আছে।
নিভ্রানের ফোন বাজলো।সে ফোন কানে তুলে দোকানদারের দিকে তাকালো।রাত্রি হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,”আপনি দাড়ান,আমি একটু আসছি।”বলেই দোকানের সামনে গেলো সে।নিভ্রান একটু দুরে গিয়ে দাড়ালো।জরুরি ফোন এসেছে।
—“তুমি তো দেখাই দাওনা।সেই যে বাকির সদাই নিলা।টাকা তো আর দিলানা।”পান খাওয়া লাল দাঁত বের করে বললো মতিন মিয়া।
রাত্রি বিনীত স্বরে বললো,”সামনের মাসেই দিয়ে দিবো চাচা।এ’কটা দিন একটু অপেক্ষা করেন।”
—“এখনো কও সামনের মাসে?হইবোনা।আমার এহনই লাগবো।কোনো ছাড়াছাড়ি নাই।আমার টাকা দিয়ে তারপর তুমি যাইবা।”
—“চাচা…”
মতিন মিয়া রাত্রির নরম স্বর শুনে আরো পেয়ে বসলো।বললো,
—“টাকা না থাকলে জিনিস নাও কেন?রাত বিরেতে প্রেমিক নিয়ে ঘুরো আর টাকা দিতে পারোনা তাইনা?তামাশা নাকি?”
রাত্রি নিমিষেই অগ্নিমূর্তি ধারণ করলো।তেজি গলায় বললো,”মুখ সামলে কথা বলুন চাচা।আপনার টাকা…”
—“ওই মাইয়া,কারো রাগ দেখাও তুমি?টাকা না থাকলে…”এটুকু বলেই রাত্রির গায়ের ওড়না হাতের মুঠোয় চেপে ধরলো মতিন মিয়া।
সাথেসাথেই সজোরে চিৎকার করে উঠলো রাত্রি।হিংস্র বাঘিনীর মতো বললো,”ওড়না ছাড়ুন।”
~চলবে~
[রিচেক হয়নি।বানান ভুল থাকলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।]