#এ_শহরে_বৃষ্টি_নামুক❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-১০
রাত্রির সর্বাঙ্গ যেনো সদ্য ছুঁয়ে দেয়া লজ্জাবতী গাছের পাতার ন্যায় নুঁইয়ে পড়লো।শরীরে এক অদ্ভুত শিহরণের শীতল বিচরণ।বুকটা কাঁপছে।বুকের ভেতর থাকা মনটা কাঁপছে।নিভ্রানের চুলে আটকে থাকা পানির ফোঁটা টুপ করে পাপড়ির উপর পরলো।চোখের পাতা ঝাপসা হয়ে বন্ধ হয়ে গেলো।কোঁণ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো একফোঁটা নোনতা জল।বৃষ্টির পানির সাথে মিলিয়ে যাওয়ায় তা আলাদা করা গেলোনা।
দু’চোখ বন্ধ অবস্থায়ই রাত্রি চরম কাতরতা নিয়ে প্রার্থনা করে উঠলো,”তাই যেনো হয়,আমি যেনো শুধু আপনার হই”।
নিভ্রানের চোখে বেগতিক নিমগ্নতা।কাঁধের পাশ দিয়ে রাস্তায় ছড়িয়ে পড়মুছে রাত্রির ভেজা চুল।সেই চুনের একদম কাছে নাক নিয়ে লম্বা শ্বাস নেয়া মাত্রই ছন্নছাড়া রাশভারি কন্ঠে স্বগতোক্তি করলো সে,”আপনি…আপনি কি মাখেন রাত?এত..এতটা।”কন্ঠ নিভিয়ে আসে।আসক্তের মতো আবারো গন্ধ নেয় সে।যেনো সেখানে কোনো নেশাদ্রব্য লুকায়িত আছে।রাত্রি কুঁকড়ে যায়।লোকটা কি করছে?হুঁশে নেই নাকি?হাতটাও রাস্তার সাথে এত চাপ দিয়ে ধরেছে যা তার পক্ষে ছাড়ানো প্রায় অসম্ভব।তবু চেষ্টা করে সে।হাতের বাঁধনে নাড়াচাড়া হতেই কাঁধ থেকে মাথা তুলে চোখে চোখ রাখে নিভ্রান।কিছু সময় খুব একান্তে অতিবাহিত হয়।চোখে চোখে নিরব কথোপকোথন শেষে রাত্রি দৃষ্টি নামায়।বলে,
—“সরুন।”
নিভ্রানের নিষ্পলক দৃষ্টি রাত্রির ভিজে উঠা পাতলা ঠোঁটের দিকে।হাতের চাপটা আরো দৃঢ় করে আচ্ছন্নের মতো বুলি আওড়ায় সে,
—“আর একটু দেখি।”
বৃষ্টির গতিক কমে আসার ভাব নেই।আকাশ যেনো তার সব মেঘ আজই উজার করে দিবে পৃথিবীতে।রাত্রি উশখুশ করলো।বন্ধনমুক্ত থাকা অপরপাশের হাতটা নিভ্রানের পিঠ থেকে সরিয়ে নিলো।নিভ্রানের চুল উল্টো হয়ে থাকার কারণে কপালের উপর এসে পড়েছে।হাতের পাঁচআঙ্গুলে ডুবিয়ে সেই চুলগুলো খুব যত্নে গুছিয়ে দিতে দিতে সে বললো,
—“আর কত দেখবেন?এভাবে ভিজতে থাকলে অসুস্থ হয়ে পড়বেনতো।”
—“আপনিও তো ভিজছেন।আপনি অসুস্থ হবেন না?”
রাত্রি হাসলো।তার অর্ধাংশে একবিন্দু পানি পড়তে দিচ্ছেনা লোকটার সুঠাম দেহ।তার ছোট্ট শরীরটা চাপা পড়ে গেছে দেহতলে।একনজর সেদিকে চোখ বুলিয়ে সে ফিচেল গলায় বললো,
—“আপনি ভিজতে দিচ্ছেন কই?”
—“দিচ্ছিনা তাইনা?” বলেই সরু চোখে তাকালো নিভ্রান।রাত্রির চেপে রাখা হাতটা ছেড়ে দিয়ে নিজের বরফ শীতল হাতের ছোঁয়া রাত্রির কপাল থেকে নামাতে নামাতে গলা ছাড়িয়ে ঘাড়ে গলিয়ে দিলো।
রাত্রির কি যেন হলো।কাঁপা কাঁপা কন্ঠে সে বললো,
—“সরুননা।”
নিভ্রান ম্রান হাসলো।চোখ ঘুরিয়ে ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে রাত্রিকে ছেড়ে দিয়ে আবারো সটান হয়ে শুয়ে পড়লো রাস্তায়।পরমূহুর্তেই রাত্রির একহাত টেনে চেপে ধরলো বুকের মাঝখানে।রাত্রি মানা করতে পারলোনা।চুপটি করে লোকটার বুকের স্পন্দনগুলো গুনতে থাকলো মনোযোগী ভঙ্গিতে।
অনেকটা সময় কেটে গেছে হয়তোবা।যখন ধ্যান ভাঙলো তখন রাতের আঁধার অনেকটা ঘনিয়ে এসেছে।চারিপাশে নিস্তব্দতারা প্রহর বাড়াচ্ছে।বৃষ্টির গতি এখন একটু নিস্তেজ।গাছপালায় চোখ বুলিয়ে ঘাড় কাত করে পাশে তাকালো রাত্রি।কি আশ্চর্য!লোকটা এখনো একই দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে রয়েছে।চোখের ভাষাটা তখনকার মতোই খুব ভিন্ন।মুগ্ধতাদের ভীড় জমেছে চোখের কোলজুড়ে।চট করে উঠে বসলো রাত্রি।জর্জেট কাপড়ের হাল্কা গোলাপি জামা ভিজে সবই স্পষ্ট দৃশ্যমান।তৎক্ষণাৎ দৃষ্টি সংযত করলো নিভ্রান।তার এভাবে তাকিয়ে থাকা মেয়েটাকে অস্বস্তিতে ফেলবে।রাত্রি রাস্তায় লেপ্টে থাকা ওড়না সামলে নিতে নিতে বললো,
—“আপনি বাড়ি ফিরবেননা?”
নিভ্রান উঠে বসলো।চোখে মুখে উদাসীনতা,”ইচ্ছে যে করছেনা।”
—“তবে আমাকে পৌছে দিন।তারপর আবার এসে যতক্ষণ ইচ্ছা ‘ইচ্ছেপূরন’ করেন।এখন উঠুনতো জলদি।”
নিভ্রান চুল ঝাড়লো।শার্টের হাতা গুটিয়ে কলার ঠি ক করে চাপা গলায় বললো,”আপনি জানেন এখন ক’টা বাজে?কাঁটায় কাঁটায় রাত বারোটা।”কন্ঠে অপরাধী ভাব।সত্যি বলতে সে নিজেই বুঝেনি এতো সময় কখন পার হলো।রাত্রিকে দেখতে দেখতে আর কোনো কিছুর খেয়ালই ছিলোনা।মাত্র ঘড়ি দেখলো।নয়তো সে কখনোই রাত্রিকে এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন করতোনা।
রাত্রি উঠে দাড়াচ্ছিলো।কথাটা কানে যেতেই যেনো মুখ থুবড়ে হোঁচট খেলো সে।অবিশ্বাস্য ভঙ্গিতে দ্রুত ঝুঁকে নিভ্রানের হাত টেনে ঘড়ি দেখলো।সত্যিই বারোটা বাজে।এত সময় কখন কাটলো?মাথাটা চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠছে।এসময় বাড়ি ফেরা মানে কলঙ্কের দাগ নিজহাতে গায়ে ছুঁইয়ে দেয়া।কি করবে কি করবে ভাবতে ভাবতেই সে অস্থির কন্ঠে বললো,
—“এখন কি করবো আমি?কিভাবে ফিরবো?”কন্ঠ ধরে গেলো।কান্না কান্না হয়ে এলো মুখশ্রী।নিভ্রান চট করে উঠে দাড়ালো।মাথায় হাত রেখে অভয় দিয়ে বললো,”আহা!কাঁদবেননা রাত।আমার বাসায় চলুন।বিশ্বাস করুন,আপনি নিরাপদে থাকবেন।”
—“আমি আপনাকে বিশ্বাস করি।”
—“তবে?এতো আপত্তি কেনো?”
—“আপনি বুঝতে পারছেন না?”অসহায়ত্ব জেঁকে ধরেছে রাত্রির কন্ঠস্বর।
—“বুঝতে চাইছি না।আপনি চলুনতো।এখনো কাঁপছেন।ঠান্ডা লেগে যাবে।”
—“কিন্তু…”বলে দু’মিনিট ভাবলো রাত্রি।তার পক্ষে সম্ভব না বাইরে পুরো রাত কাটিয়ে দেয়া।আর বাসায় ফেরাটাতো আরো অসম্ভব।বাড়ির চৌকাঠ টা এখন ধারালো ফলার মতো।সেটা মাড়াতে হলে পা কে ক্ষতবিক্ষত করতে হবে।আর সেই আঘাতের দাগ বয়ে বেড়াতে হবে সারাজীবন।তিক্ত শ্বাস ফেললো সে।একেবারেই উপায়ন্তর না পেয়ে নিচু গলায় বললো,”আচ্ছা,চলুন।”
_____________
সাজানো গোছানো ছিমছাম পরিবেশের বিশাল ফ্ল্যাট।আগাগোড়াই যেনো সাদায় মোড়ানো।বড় বড় সোফা,দেয়ালের রং,মেঝের টাইলস,এমনকি পর্দাগুলোও সাদা।পায়ের জুতো খুলতে খুলতে ভ্রু কুঁচকালো রাত্রি।ড্রইংরুমের এপাশ থেকে থেকে ওপাশে নজর বুলাতে বুলাতে বললো,”আপনার একা থাকার জন্য এতো বড় ফ্ল্যাট লাগে নাকি?ছোট খাটো একটা নিলেই তো পারেন।টাকা আছে বলেই খরচ করতে হবে এমনতো কোনো কথা নেই।”
নিভ্রান মুচকি হেসে বললো,”সবসময়তো আর একা থাকবোনা।একসময় তো পাশের মানুষটারো থাকতে হবে সাথে।”
রাত্রি থতমত খেলেও দমে গেলোনা।বললো,”সে যাই হোক,দুজন মানুষের জন্যও এত বড় জায়গায় দরকার নেই।”
—“বাচ্চা কাচ্চা হলে তারাও থাকবে।”নিভ্রানের দুষ্টু গলা।রাত্রি “ছিহ্” বলে কপাল কুঁচকালো।তারপর তেজি গলায় বললো,”আপনি আপনার বাবা-মা,ভাইবোনদের সঙ্গে নিয়ে থাকলেইতো পারেন।”নিভ্রানের মুখের ভাবভঙ্গি বদলে গেলো।তবুও রাত্রির সাথে রাগ দেখালোনা সে।প্রসঙ্গ এড়িয়ে স্বাভাবিক গলায় বললো,”আপনি আসুন,এতক্ষণ ধরে ভিজে আছেন।কাপড় পাল্টে শাওয়ার নিন।”
—“আমি কি পড়বো?”রাত্রি চিন্তিত গলা।
নিভ্রানকে একবারেই চিন্তামুক্ত দেখালো।পাশের একটা রুমের দরজা খুলতে খুলতে সে বললো,”মা আসে মাঝে মাঝে।দু’একদিন থাকে।শাড়ি টাড়ি বোধহয় রাখা আছে এই ঘরে।একটা বের করে দিচ্ছি।আসুন।”
রাত্রি গুটি গুটি পায়ে রুমে ঢুকলো।নিভ্রান লাইট জ্বেলে আলমারির পাল্লা খুলতেই হ্যাঙ্গারে ঝুলানো শাড়ি গুলো চোখে পড়লো।মনে মনে স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলে সে জায়গা থেকে একটু সরে বললো,”কোনটা পরবেন দেখুন।”
—“একটা দিলেই হবে।”রাত্রির জড়োসড়ো উওর।নিভ্রান যেনো এই কথার অপেক্ষাতেই ছিলো।অনুমতি পেয়ে যেতেই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শাড়িগুলো দেখে একটা সাদা মধ্যে সুতোর কাজ করা শাড়ি বের করলো সে।এটা মানাবে মেয়েটাকে।শাড়ির ভাঁজের উপরেই ব্লাউজ রাখা।নিভ্রান কপালে ভাঁজ ফেললো।
একবার রাত্রি দিকে চেয়ে কিছু একটা পরখ করে সে বললো,”আপনি খুব চিকন।ব্লাউজ অনেক ঢিলে হবে।”
রাত্রি কাঁচুমাচু করলো।বিনীত স্বরে বললো,
—“সমস্যা নেই।পরতে পারলেই হলো।”
নিভ্রান তার হাতে শাড়ি দিয়ে নিজের রুমে নিয়ে গেলো।বললো,”ওই বাথরুমের গিজারটা নষ্ট।ঠিক করা হয়নি।আপনি এটায় যান,টাওয়াল ভেতরেই আছে।গরম পানি দিয়ে শাওয়ার নিবেন।নয়তো আবার জ্বর আসতে পারে।”
রাত্রি বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়িয়ে ঢুকে গেলো।ভেতর থেকে দরজা আটকানোর শব্দে নিশ্চিত হতেই নিভ্রান নিজের জামাকাপড় নিয়ে পাশের রুমে চলে গেলো।ঠান্ডা পানিতেই গোসল করতে হবে।উপায় নেই।এভাবে এতক্ষণ থাকলে নির্ঘাত সর্দি লাগবে।
রাত্রি যখন বেরোলো তখন নিভ্রান শাওয়ার শেষ করে বিছানায় বসে আছে।পাশেই ফাস্ট এইড বক্স রাখা।
রাত্রিকে বেরোতে দেখেই তাড়া দিলো সে,”আপনার ব্যান্ডেজ ভিজে গেছেনা?নতুন করে বেঁধে নিন।”
নিভ্রানের উৎকন্ঠায় আবারো মনটা প্রশান্তিময় হাওয়ায় ভরে উঠলো রাত্রির।মুচকি হেসে সে বললো,”আপনি অযথাই এতো টেনশন করছেন।কাঁটাটা কিন্তু অতো গভীর না।তখন রক্তটা একটু বেশি পড়েছে বলে মনে হচ্ছিলো খুব লেগেছে।”
—“চুপ করুনতো।অল্প থেকেই কতো কিছু হয়ে যায় জানেন?”
রাত্রি নিজের অজান্তেই চমকে উঠলো।নিভ্রানের কথাটা অন্যভাবে মস্তিষ্কে আঘাত করছে।আসলেইতো,”অল্প থেকে তো অনেক কিছুই হয়ে যায়।”
ভাবনার মাঝেই নিভ্রান তাকে টেনে বিছানায় বসিয়ে গজ তুলা বের করে হাতে ধরিয়ে দিলো।অত:পর রুম ত্যাগ করার জন্য উদ্যত হয়ে বললো,”হয়ে গেলে ডাইনিংয়ে আসেন।ডিনারটা করে নিই।”
নিভ্রান তার কথা রেখেছে।ডিনার শেষ হতেই একেবারে নিরাপদে রাত্রিকে নিজের ঘরে শুইয়ে নিজে অন্যরুমে চলে গেছে।একবার ভালো করে তাকায়নি পর্যন্ত।এমন কোনো কথাও বলেনি যেটায় রাত্রি লজ্জায় পড়ে।যেনো রাত্রির এবাড়িতে থাকাটা খুব স্বাভাবিক।
______________
সকাল সাতটা…
অনবরত কলিংবেলের শব্দে ঘুম ভাঙলো নিভ্রানের।আড়মোড়া ভেঙে উঠলো সে।এসময় কে এভাবে বেল বাজাচ্ছে?বুয়াতো আসে ন’টার পর।দাড়োয়ান এমন করে বেল বাজানোর সাহস পাবেনা।তবে?
হাই তুলে বিছানা ছাড়লো সে।গেটের দিকে যাওয়ার আগে একবার নিজের রুমের দরজাটা হাল্কা ফাঁক করে রাত্রিকে দেখে নিলো।যাক,মেয়েটার ঘুম ভাঙেনি।সাদা ব্ল্যাঙ্কেটে মোড়ানো ঘুমন্ত অবস্থায় তাকে কোনো অপরুপ শুভ্রকন্যার চেয়ে কম লাগছে না।মনে হচ্ছে,বিশাল আকাশের একটুকরো সাদা মেঘ তার বিছানায় মাঝখানে এসে লুটিয়ে পড়েছে।
আনমনেই হাসলো নিভ্রান।দরজাটা নি:শব্দে বন্ধ করে আবারো পা বাড়ালো মেইন গেটের দিকে।
~চলবে~