এ শহরে বৃষ্টি নামুক❤️পর্ব-১৭

0
1317

#এ_শহরে_বৃষ্টি_নামুক❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-১৭

বাড়িজুড়ে গম্ভীর নিস্তব্ধতা।এয়ারকন্ডিশনারের হাল্কা ভনভনে আওয়াজটা কানে আসছে শুধু।কপালের ক্ষতটায় একটা সরু চিনচিনে অনুভূতি হতেই ঘুম ভেঙে গেলো নাহিদার।চোখ কুঁচকে ব্যাথাটা সহ্য করার চেষ্টা করলো।মূহুর্তেই অদম্য বিষাদের ধারালো দংশনে কেঁদে উঠলো মাতৃসূলভ নরম মনটা।
বাসনাহীন ছোঁয়ায় ব্যান্ডেজটার উপর আঙ্গুল বুলালো সে।
গতকাল রাত্রিকে নিয়ে একটু বেশিই বলে ফেলেছিলো।তাই হয়তো নিভ্রানের থেকে এটাই প্রাপ্য ছিলো তার।নিজের যাচ্ছেতাই ব্যাবহারের কথা ভেবে নির্মম,কলোষিত একটা শ্বাস বেরিয়ে এলো বুক চিড়ে।
হেলানো মাথা সোজা করলেন নাহিদা।রাত্রি তখনো চুপটি করে ঘুমিয়ে আছে কোলের মাঝখানটায়।সেই নিষ্পাপ মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন তিনি।মুখের উপর ছড়িয়ে পড়া ঘন চুলগুলো কানের পিছে গুঁজে দিয়ে আদুরে আবেশে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।ঘুমের ঘোরেই অপ্রত্যাশিত স্নেহ,আসকারা পেয়ে হাল্কা নড়ে চড়ে উঠলো রাত্রি।একহাতে গাল চুলকে আবারো শক্তপক্তভাবে ঘাপটি মেরে ঘুমিয়ে পড়লো ধীরে ধীরে।যেনো এই কোলটা তার নিজস্ব মালিকানার অন্তর্ভুক্ত।নাহিদা নি:শব্দে হেসে ফেললেন।মেয়েটা যথেষ্ট সুন্দরী।প্রথমদিন একটু চটা স্বভাবের মনে হলেও কাল বেশ নম্র-ভদ্রই মনে হয়েছে।পোশাক-আশাকে বেশ শালীনতা আছে।কোনো উগ্রতা ছোঁয়া নেই।ওইদিন সে এতকিছু বলার পরও তেমন কোনো বেয়াদবি করেনি।আবার রাতের বেলা তাকে এসির মধ্যেও ঘামতে দেখে নিজে থেকেই গ্লাসে করে পানি এনে দিয়েছিলো খাওয়ার জন্য।
তাছাড়া যেই মেয়ে তার ছেলের জন্য মধ্যরাতে এভাবে ছুটে আসতে পারে তার প্রতি একটু নরম হওয়াই যায়।পারিবারিক,আর্থিক খুঁত গুলো দেখেও না দেখার ভান করাই যায়।
ভোরবেলা রাত্রিকে ঘুমের মাঝে ঢলে পরতে দেখে তিনি নিজেই মাথাটা খুব সাবধানে কোলের উপর টেনে নিয়েছিলেন।মেয়েটার ভেঙে আসা ক্লান্তিকর মুখটা তার মাতৃত্বে নাড়া দিয়েছিলো খুব সহজেই।বাকিসব ভুলে সে আধঘুমন্ত রাত্রিকে সযত্ন ঘুম পাড়িয়েছিলেন কোলের মধ্য।
দরজা খুলে বেরিয়ে আসলো নিভ্রান।পরণের জামাকাপড় পাল্টাতে গিয়েছিলো সে।টি-শার্টে কেমন একটা মদের গন্ধ লেগেছিলো।তাই রাত্রিকে জাগানোর আগে সেটা পাল্টে নেয়াই শ্রেয় মনে হয়েছে।নয়তো মেয়েটা আবার কি না কি বলে ফেলে!
নাহিদাকে জাগ্রত অবস্থায় দেখে একটু বিব্রত বোধ করলো সে।মায়ের সাথে করা গতকালের আচরণে ভেতরে ভেতরে হাজারবার ক্ষমা চেয়ে ফেললেও মুখে এখন পর্যন্ত কিচ্ছুটি বলতে পারেনি।কোথায় যেন বাঁধছে।
কি যেন একটা আটকে দিচ্ছে বারবার।কাছাকাছি আসতেই বেশ অবাক হয় সে।মা রাতের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে?তাও সজাগ অবস্থায়?সে তো ভেবেছিলো ঘুমের ঘোরে বোধহয় মেয়েটা ভুলে মায়ের কোলে চলে গেছে তাই নাহিদার ঘুম ভাঙার আগেই রাতকে ঘরে নিয়ে যেতে এসেছিলো সে।
নাহিদা মেঝের দিকে চেয়ে আছে।নিভ্রানকে এদিকেই আসতে দেখে আরো একটু গুরুগম্ভীর হয় তার চেহারা।
নিভ্রান ইততস্ত করলো।নিজের মায়ের সামনে নিজেরই কেমন দমবন্ধ লাগছে।দ্বিধাগ্রস্ত গলায় ডাক দিলো,
—“রাত উঠুন।”

রাত্রি মধ্য কোনো পরিবর্তন পরিলক্ষিত হলোনা।নিভ্রানের ডাক তার কান পর্যন্তও পৌছায়নি।নাহিদা তখনো চুপচাপ ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।নিভ্রান আবারো ডাক দিতে গেলেই সে গম্ভীর কন্ঠে বললো,
—“মেয়েটা সারারাত ঘুমাতে পারেনি।…ঘুম ভাঙলে নিজেই উঠে যাবে।কারো ডাকতে হবেনা।”

নিভ্রান কয়েকবার চোখ ঝাপটালো।কপাল কুঁচকে বোঝার চেষ্টা করলো।মা কি সত্যি সত্যিই এসব বলছে?ঠি ক বিশ্বাস হচ্ছেনা।একরাতে এমন কি হয়ে গেলো?তবুও মিহি প্রতিবাদ করলো সে।বললো,
—“ঘরে যেয়ে ঘুমাক।”

নাহিদার মনটা যেনো চুপসে গেলো।ছেলে কি তাকে এতটুকু বিশ্বাসও করতে পারছেনা?তার মা কি এতই খারাপ?মেয়েটা একটু তার কোলে ঘুমাতেও পারবেনা?সে কি এতটাই অধম,পরিত্যাগের যোগ্য।চোখ চিকচিক করে উঠলো।ধরা গলায় বললো সে,
—“আমিতো মেরে ফেলছিনা ওকে।এখানে ঘুমালে কি সমস্যা?”

—“কেনো ও না নোংরা মেয়ে?রাস্তার মেয়ে?এখানে তো ওকে শোভা পায়না…”না চাইতেও বেশ উচ্চস্বরে কথা বলে ফেললো নিভ্রান।রাত্রির তন্দ্রা কেটে গেলো নিমিষেই।দ্রুত চোখ মেলে নিজেকে নাহিদার কোলের উপর আবিষ্কার করতেই বিমূঢ় হয়ে উঠলো অবচেতন মন।নাহিদা ততক্ষনে হাত সরিয়ে নিয়েছে মাথা থেকে।রাত্রি উদ্বিগ্ন গতিতে উঠে বসলো।বিচলিত কন্ঠে বললো,”আমি আসলে…বুঝতে পারিনি আন্টি।”

নাহিদা নিশ্চুপ।নিভ্রানের কথাগুলো আবার অনুশোচনার সাগরে ডুবিয়ে দিচ্ছে তাকে।আচ্ছা,তখন কেনো সে ওসব বললো?এখন মনে হচ্ছে সে আসলেই খারাপ মানুষ।সমাজের গতানুগতিক চিন্তাধারা তার ভেতরের বিবেক টাকে গ্রাস করে ফেলেছে।অমানুষে পরিণত করে ফেলেছে।নিভ্রানের কথার পৃষ্ঠে কোনো কথা বলেই চুপচাপ সেখান থেকে উঠে গেলেন তিনি।তারপর ধীরপায়ে চলে গেলেন ঘরের ভেতর।নিভ্রান আলগা চোখে একবার দেখে নিয়ে পূর্ণদৃষ্টি নিক্ষেপ করলো রাত্রির দিকে।দুহাত আড়াআড়িভাবে বুকের উপর ভাঁজ করে চাপা রাগ নিয়ে বললো,
—“আপনি না কোথাও যাবেননা?”

রাত্রি অপরাধী চোখে তাকালো।সোফা থেকে পা নামিয়ে বসে মিন মিন করে বললো,
—“যাইনি তো।”

—“চুপচাপ রুমে আসুন।”আদেশি গলায় কথাটা বলে আর একমূহুর্ত দাড়ালোনা নিভ্রান।রাত্রি দুহাতে চোখ ঢললো।ছোট্ট একটা হাই তুলে দেয়ালে লাগানো বড় ঘড়িটার দিকে তাকালো।সকাল আটটা বিশ।আজকে শুক্রবার।ভার্সিটি নেই কিন্তু বিকেলের দিকে একটা টি উশনি আছে।তাঁড়া নেই তেমন তবু এখানে থাকতে
অস্বস্তিতে কাঁটা দিয়ে উঠছে।এ বাড়ির সব ঝামেলা যে তাকে ঘিরেই।
নিশাদ একবার ঘাড় উঁচালো।রাত্রিকে উদ্দেশ্য করে ম্যাজম্যাজে গলায় বললো,
—“ওই সোফার বড় বালিশটা দেন তো আপু।এই ছোটটায় মাথাই আটছেনা।”

রাত্রি থতমত খেয়ে উঠে দাড়ালো।নিশাদের ইশারা করা বালিশটা নিয়ে তার হাতে দিলো।নিশাদ মুচকি হেসে কৃতজ্ঞতা জানালো।ঘুম ঘুম কন্ঠেই বিরবির করলো,

—“এ ওকে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছে।ও একে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছে।মাঝখান দিয়ে এদের পাড়াপাড়ি দেখতে দেখতে আমারই ঘুম হচ্ছেনা।”তারপর একটু গলা বাড়িয়ে বললো,”আপনি জলদি যানতো ভাইয়ার কাছে নয়তো আবার চেঁচাতে চেঁচাতে আমার অবশিষ্ট ঘুমটুকুও ধ্বংস্ব করে দিবে।”

নিভ্রান ঘরের পর্দা সরিয়ে দিচ্ছিলো।বৃষ্টি থেমে গেলেও বাহ্যজগৎ তখনো ভিজে চুপচুপে।মেঘের ঘন পরতে সূর্য দেখা দিতে পারছেনা।মেঘ-রৌদ্রের রেশারেশির জোড়ে আকাশের এককোণে অলৌকিক একটা আলোরকশ্নির সরুরেখা সৃষ্টি হয়েছে।মনে হচ্ছে একটু পড়েই যেনো তা দু’ভাগ হয়ে আশ্চর্য্য কিছু বেরিয়ে আসবে ভেতর থেকে।
রাত্রি ঢুকলো তখনই।চুপচাপ যেয়ে বসলো বিছানায়।মনটা একদম ভালো লাগছে না।মনে হচ্ছে এই মা-ছেলের মধুর সম্পর্কের মধ্য কাঁটা হয়ে বিঁধে আছে সে।একটা উটকো,অসহ্য কাঁটা।অচিরেই নিজেকে কেমন ঝামেলা মনে হচ্ছে।কেনো সব ছেড়েছুড়ে এই লোকটাকেই তার ভালবাসতে হলো?সব অনুভূতি যেয়ে কেনো এই লোকটার উপরই আছরে পড়লো?এত উপর নিচের কেনো সমান হতে হলো?
রাত্রির বিষন্ন চেহারাটা একপলক দেখে ধীরপায়ে এগিয়ে এলো নিভ্রান।রাত্রির ঠি ক সামনে হাঁটুগেড়ে বসলো।দুহাত নিজের হাতের মাঝে টেনে নিয়ে কোমল স্বরে বললো,
—“মন খারাপ কেনো?মা আবার বাজে কিছু বলেছে আপনাকে?”

—“না তো।”বলে আৎকে উঠলো রাত্রি।লোকটা খালি নিজের মাকে ভুল বুঝে কেনো?আবার তখন কিভাবে কথা বললো।নিভ্রান একমনে তার হাতদুটো নাড়াচাড়া করে যাচ্ছে।রাত্রি একটু সাহস জুগিয়ে বললো,
—“আপনি উনার সাথে ওভাবে কথা বললেন কেনো?”

নিভ্রান চমকালো না।রাত্রির হাত নাড়াচাড়া করতে করতেই নিচু গলায় বললো,
—“আপনি জানেননা রাত।মা আপনাকে নিয়ে কত বাজে কথা বলেছে।”

রাত্রি দ্বিগুন অস্থিরতা নিয়ে বললো,
—“সে তো আমাকে নিয়ে বলেছে।কিছু বলার হলে আমি বলব।আপনি ওমন ধমক দিয়ে কেনো কথা বললেন?উনি কষ্ট পেলেন না?মায়ের সাথে কেউ এভাবে কথা বলে?”

—“মাথা ঠি ক ছিলোনা।”নিভ্রানের অকপট স্বীকারত্তি।মেয়েটার গলায় একটা ক্ষ্যাপা ক্ষ্যাপা ভাব আছে।বোঝা যাচ্ছে নাহিদার সাথে তার ওমন ব্যাবহার সে কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি।

রাত্রি আবার বললো,
—“মাথা ঠি ক ছিলোনা বলে এমন করবেন?আর আন্টির মাথায় ব্যান্ডেজ কেনো?আপনি উনাকে মেরেছেন?”

—“বাদ দিন ওসব।”

রাত্রি হাঁসফাঁস করে উঠলো।লোকটা কি সত্যিই নিজের মা কে মেরেছে?কন্ঠে জোর দিলো সে,”বলুন।”

নিভ্রান দৃষ্টি নামিয়ে ফেললো।ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে বললো,
—“দেখুন,আমি শোপিস ছুড়ে মেরেছিলাম কিন্তু সেটা মা কে উদ্দেশ্য করে নয়।মায়ের মাথায় লেগে যাওয়াটা নিতান্তই একটা দূর্ঘটনা।আমি বুঝিনি।”

রাত্রির মুখটা আপনাআপনিই ‘হা’ হয়ে গেলো।অদ্ভুত বেদনায় নিংড়ে উঠলো মন।তার নিজেরই খারাপ লাগছে না জানি ওই মহিলাটার মন লেগেছিলো।নিজের ছেলে আঘাত করেছে।তার মাকে যদি সে নিভ্রানের জন্য আঘাত করতো তবে তার মায়ের কেমন লাগতো?নাহিদা যে এখন পর্যন্ত তাকে কিছুই বলেননি এইতো ঢের।নিজেরই একছুটে বাড়ি থেকে চলে যেতে ইচ্ছা করছে।অপরাধবোধে শরীর নেতিয়ে আসছে।
কন্ঠ কাঁদো কাঁদো হয়ে এলো।বর্ণনাতীত যন্ত্রনা নিয়ে সে বললো,
—“আপনি এমন কেনো করলেন?আপনার মা না উনি?আমি তো পরে আগে তো আপনার মা।তাইনা?”

~চলবে~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here