এ শহরে বৃষ্টি নামুক❤️পর্ব২৯

0
1263

#এ_শহরে_বৃষ্টি_নামুক❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-২৯

নদীর জলটা এখন রুপালি রংয়ের। চাঁদের আলোর সে কি তেজ! পুরো নদীটাকে রুপার অলংকারে ভরিয়ে দিয়েছে যেনো। ঝলমলে চাকচিক্যে জলের রুপ কয়েকসহস্র বেড়ে গেছে। সম্মোহন লেগে যায়। সন্ধ্যা থেকে বইখাতা গুছিয়ে আলমারি খুলে বসেছে রাত্রি। এতো শাড়ি কাপড় রাখবে কোথায়? নিভ্রানের জামাকাপড় সরাবে নাকি? তাকে ফ্যালফ্যাল করে আলমারির দিকে চেয়ে খাকতে দেখে ল্যাপটপ রেখে এগিয়ে এলো নিভ্রান। নিজের শার্টগুলো একদম কোঁণায় চাপিয়ে অনেকটা জায়গা বের করে দিলো। তারপর আবার চুপচাপ যেয়ে ল্যাপটপের সামনে বসে পড়লো। রাত্রি হাসলো মনে মনে। একটা একটা করে শাড়ি নিয়ে সাজিয়ে সাজিয়ে রাখলো। হঠাৎই শার্ট দিয়ে ঢেকে যাওয়া নিচের জায়গাটা থেকে কিছু একটায় হাত লাগতেই ভ্রু কুচকে গেলো তার। একটু টান দিতেই দেখলো লাল রঙা বিয়ের বেনারসি। কি সুন্দর কাজ করা!
এই শাড়িটার কথাই তবে সেইদিন বলছিলো নিভ্রান। ওইযে নিশাদ নিয়ে যেতে ভুলে গিয়েছিলো। রাত্রি হাতে তুলে নিল। আলতো করে আঙ্গুল বুলিয়ে বললো,
—“আপনি এটা কখন কিনেছেন?”

নিভ্রান তাকালো। ঘাড় বাকিয়ে রাত্রির হাতের শাড়িটা দেখে ভাবলেশহীন কন্ঠে বললো,”অনেক আগে।”

—“অনেক আগে মানে? কেনো কিনেছিলেন?”

নিভ্রান উঠে দাড়ালো। রাত্রির পিছে দাড়িয়ে আলমারির তাঁক এ একহাত ঠেস দিলো। পিঠের সাথে বুক ছুঁয়ে যেতেই অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে কুঁকরে গেলো রাত্রি। হাতটা একটু কাঁপলো। নিভ্রান তার কাঁপুনি তোয়াক্কা না করে কাঁধে থুতনি ঠেকিয়ে ফিসফিস করে বললো,”মনে আছে? তোমার সাথে যেদিন দ্বিতীয়বার দেখা হলো? তুমি কদম ফুল নামিয়ে দিতে বললে? আমি ভুলক্রমে একটু কাছাকাছি এসে যেতেই সেই যে তোমার গালদুটো লাল হয়ে উঠলো। সেদিনই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে নিয়েছিলাম এই রাঙাবতী কেই আমার লাগবে। আমার দেয়া লাল বেনারসি শুধু এই মেয়েটাই গায়ে জড়াবে। আর কেউ না। সেদিন তোমার বাসা থেকে আসার সময় মার্কেট থেকে বিয়ের শাড়ি কিনে তবেই বাড়ি ফিরেছিলাম আমি। বুঝলে?”

রাত্রি বাক্যহীন, শব্দহীন, স্তব্দ, বিমূঢ়। টুপ করে একফোঁটা পানি পড়লো শাড়ির উপর। কান্না কি তবে সুখেও আসে? আসেতো। একশবার আসে, হাজারবার আসে। নতুবা সে কেনো কাঁদলো? তার তো কোনো দু:খ নেই।
নিভ্রানের চাপা হাসি মিলিয়ে গেলো। কাঁধ থেকে থুতনি উঠিয়ে রাত্রিকে সামনে ঘুরালো সে। রাত্রি মাথা নুইয়ে রেখেছে। শব্দহীন অশ্রুপাত। গাল বেয়ে ঠোঁটের কাছে যেয়ে জমা হচ্ছে নোনা পানি। নিভ্রান গাল-ঠোঁট মুছিয়ে দিলো।
চিবুকে তর্জনী রেখে মাথা উঁচু করালো। গোলাপি অধরে নিষ্পলক চেয়ে থেকে নম্র গলায় বললো,
—“তুমি কি শুধু আমাকেই পাও কেঁদে কেটে ভস্ম করে দিতে? অন্য কারো সামনে তো কখনো কাঁদতে দেখি না। সবসময় বেঁছে বেঁছে একমাত্র আমাকেই কষ্ট দেয়া?”

রাত্রি ঠোঁট কামড়ে ধরলো। কান্নাভেজা কন্ঠে বললো,”আপনি এমন করেন কেনো?”

—আমি কি করলাম?”

—“সব তো আপনিই করেন।”

নিভ্রান হাসলো। হাসলে তার চোখের কোণে ভাঁজ পরে। কি যে সুন্দর দেখায়। রাত্রি নাক টেনে তপ্ত কন্ঠে বললো,”খবরদার! হাসবেন না।”
নিভ্রানের কপালে ভাঁজ পড়লো। হাসি থামার বদলে আরো প্রশস্ত হলো। চোখের কোণটা আরো সুন্দর হলো।
রাত্রি মুখ কুচকে সরে গেলো। শাড়িটা আগের জায়গায় রেখে নিভ্রানকে সরিয়ে আলমারি বন্ধ করলো।
_____________

রাতের খাবার খাওয়ার পর একটু বই নিয়ে বসেছিলো রাত্রি।
নিভ্রান তখন বাইরে গিয়েছিলো কেনো যেনো। দরজায় নক হতেই বসা থেকে দাড়িয়ে গেলো সে। হাত থেকে বই রেখে দ্রুত যেয়ে দরজা খুলতেই দেখলো নওশাদ সাহেব দাড়িয়ে আছেন। বিনীত ভঙ্গিতে সরে দাড়িয়ে নওশাদ সাহেবকে ঢুকার জায়গা করে দিলো সে। নওশাদ সাহেব ঠোঁট এলিয়ে হাসলেন। মেয়েটার আচার- আচরণ, আদব- কায়দার মুগ্ধ না হয়ে পারেন না তিনি। একটু উশৃঙ্খলতা নই কোনোকিছুতে।
এমনিতে ছেলের কোনোকিছু পছন্দ না হলেও এই ব্যাপারে ছেলের পছন্দ বেশ পছন্দ হয়েছে তার।

রাত্রি আমতা আমতা করলো,”উনি তো বাইরে গিয়েছেন।”

নওশাদ সাহেব সোফায় বসে বললেন,
—“না না ওর কাছে আসিনি। তোমার সাথেই একটু কথা বলতে আসলাম মা। কাল সকালে তো চলেই যাবো। তোমার তো আবার ভার্সিটি আছে তখন, আর সময় পাবোনা। বসো।”

রাত্রি পাশে বসলো। নামানো কন্ঠে বললো,
—“কাল চলে যাবেন কেনো?”

—“আমরা তো এখানে থাকি না মা। চলে তো যেতেই হবে। পারলে তোমাকেও সঙ্গে নিয়ে যেতাম। কিন্তু…আচ্ছা, বাদ দাও। খাওয়াদাওয়া ঠি ক মতো হয়েছে?”

রাত্রি মাথা নাড়ালো। নওশাদ সাহেব লম্বা শ্বাস ফেললেন। মেয়েটা খুব চুপচাপ স্বভাবের। অযথা কথা বলে না একদম। ছেলের রাগ সম্পর্কে জানেন তিনি। রাগ উঠলে কোনোদিকে হুঁশ থাকেনা। ছোট থেকেই এমন। এই মেয়েটাকে একা রেখে যাবে যদি রাগের বশে কিছু হয়ে যায়? সংসারে তো কতকিছু নিয়েই ঝগড়া বাঁধে।
তিনি হাল্কা গলায় বললেন,
—“শোনো মা, নিভ্রান তোমাকে বিয়ে করেছে ঠি ক। কিন্তু যদি কখনো ও তোমার সাথে অন্যায় আচরন করে। কক্ষণো যদি তোমার গায়ে হাত তুলে তুমি কিন্তু চুপ করে থাকবে না। তোমার বাবা নেই। আমিই তোমার বাবা। আমাকেই বাবা ডাকবে। তোমার বাবা থাকলেও নিশ্চয় এই কথাগুলোই বলতেন। আমরা চলে যাবার পর তোমার গায়ে একটা ফুলের টোঁকা পড়লেও তুমি হয় আমাকে জানাবে নয়তো নাহিদা কে জানাবে।
ঠি কাছে? কোনো ভয় পাবে না।”

রাত্রি অসহায় চোখে চেয়ে রয়েছে। মানুষ এতো ভালো হয়? এই পরিবারটাকে না দেখলে হয়তো জানাই হতোনা। কিন্তু নিভ্রান আর তার বাবার মাঝে এতো দুরত্ব কেনো? একটু ভালো করে কথা বলেনা দুজন। একটু বিশ্বাস নেই। মাথা নিচু করে মিনমিন করলো সে,
—“উনি কখনো আমার গায়ে হাত তুলবেন না বাবা।”

নওশাদ সাহেব কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,
—“সে আমি জানি। তবুও যদি কখনো এমন হয় তুমি সহ্য করে থাকবে না।”

রাত্রি “জি, আচ্ছা” বলে সম্মতি দিতেই দরজা খুলে গটগট করে নিভ্রান ঢুকলো। বাবাকে আড়চোখে দেখে নিয়ে থমথমে চেহারায় ব্যালকনির দিকে পা বাড়াতেই নওশাদ সাহেব ডেকে উঠলেন,”ওকে ওষুধগুলো খাইয়েছো?”

নিভ্রান দাড়িয়ে গেলো। ছোট্ট করে বললো,” খাওয়াবো, একটু পরে।”

—“পরে কেনো? রাতের খাবারের পর খাওয়াতে বলেছে না?”

—“আধঘন্টা পর দিতে বলেছে।”

নওশাদ লাগবে সাথেসাথেই বললেন,”আধঘন্টা হয়ে গেছে। ঘড়ি দেখো। আর ঘুমের ওষুধ দিয়োনা আজ।”

নিভ্রান আরো কিছু বলার আগেই রাত্রি তড়িঘড়ি করে উঠে দাড়িয়ে বললো,”আমি খেয়ে নিচ্ছি।”
নিভ্রান এগিয়ে এলো। রাত্রিকে সরিয়ে ড্রয়ের খুলে প্রেসক্রিপসন মিলিয়ে ওষুধ বের করতে করতেই নওশাদ সাহেব কাছে এসে রাত্রির মাথায় হাত রেখে বললেন,”তাহলে আসি, সকালে হয়তোবা আর কথা হবেনা। একটু আগে আগেই বেরিয়ে পড়বো তো।”

রাত্রি মাথা কাত করলো। নওশাদ সাহেব বেরিয়ে গেলেন। রাত্রি যেয়ে দরজাটা আটকালো।

—“বসো এখানে।”বিছানার দিকে ইশারা করলো নিভ্রান। হাতের চার- পাঁচটা ট্যাবলেট। রাত্রি বসলো। দ্বিধাগ্রস্ত কন্ঠে বলল,”ঘুমের ওষুধও আছে?”

—“উহুম। দেইনি। শরীর দূর্বল হয়ে যায় তোমার।”

রাত্রি চাপা হাসলো। লোকটা নিজের বাবার কথা মানে কিন্তু প্রকাশ করেনা। ঠান্ডা যুদ্ধ!
_____________

রাত্রি বসে আছে বিছানায় হেলান দিয়ে। গলা পর্যন্ত ব্ল্যাঙ্কেট টানা। নিভ্রান আবার ব্যালকনির দরজা বন্ধ করে এসি ছেড়ে দিয়ে শাওয়ার নিতে গিয়েছে একটু আগে। তাকে অবশ্য ঘুমাতে বলে গিয়েছে কিন্তু ঠান্ডায়
টি কতে না পেরে সে উঠে বসেছে। বিছানায় রিমোটটাও খুঁজে পাচ্ছেনা। এত ঠান্ডায় থাকে কিভাবে মানুষ?
ইশশ… দাঁতে দাঁত লেগে যাচ্ছে।

নিভ্রান বেরিয়ে এলো একটু পরেই। গায়ে আধভেজা ধূসর টি-শার্ট। কালো ট্রাউজার। গলায় টাওয়াল ঝুলিয়ে একহাতে চুল ঝাড়ছে। রাত্রিকে বসে বসে মাথার উপর ব্ল্যাঙ্কেট টেনে রাখতে দেখেই হেসে ফেললো সে,
—“এভাবে বসে আছো কেনো? ঘুম আসছেনা?।”

রাত্রি মাথা বের করলো। ফর্সা চেহারা ফ্যাকাশে সাদা। শুভ্র মেঘের টুকরো যেনো। শুকনো গলায় সে বললো,
—“আপনি এতো রাতে গোসল করেন কেনো? ঠান্ডা লাগে না?”

নিভ্রান গলা থেকে টাওয়ালটা নামিয়ে সোফায় রাখলো। রাত্রির কাছে এগিয়ে আসতে আসতে বললো,
—” লাগবে কিভাবে?”

—“মানে?”

নিভ্রান বসে পড়লো পাশে। ব্ল্যাঙ্কেট টা টেনে নামিয়ে দিলো। কিছু একটা দেখে সন্দিহান কন্ঠে বললো,
—“ব্লাউজের সেফটিপিন খুলোনি? কেনো? ঘুমালে বিঁধে যাবেতো। দেখি।”বলেই ঝুঁকে গেলো সে। কাঁধের পাশ দিয়ে মাথা গলিয়ে পিঠের দিকে তাকালো। রাত্রি উষখুষ করছে। নিভ্রান হাসলো। সাবধানে সেফটিপিনের খুলে নিয়ে উঠে দাড়িয়ে বললো,”এতো কাঁপাকাঁপি করো কেনো?”

রাত্রি প্রত্যুওর করলোনা। নিভ্রান ঘরের বাতি নিভিয়ে দিয়ে পাশে শুয়ে পরতেই গুটিশুটি হয়ে গেলো সে।
লজ্জা করছে খুব। লোকটা হয়তো কালও পাশে শুয়েছে কিন্তু সে তো আর চেতনায় ছিলোনা।
নিভ্রান সহজেই বুঝলো তার দ্বিধা। বালিশের নিচ থেকে এসির রিমোটটা বের করে তাপমাত্রা কমিয়ে ঠান্ডা বাড়িয়ে দিলো সে। রাত্রি হত্ববিহল দৃষ্টিতে চেয়ে বললো,” কি করেন? আমার শীত করে তো।”

নিভ্রান আবছা অন্ধকারেই চোখে চোখ রাখলো। কি কি যেনো বললো চোখে চোখে। রাত্রি বুঝলো নাকি না জানেনা কিন্তু খানিকবাদে নিজে থেকেই কিছুটা চেপে এলো নিভ্রানের দিকে। নিভ্রান মুচকি হাসলো। আদরমাখানো নরম হাতে তাকে কাছে টেনে নিতে নিতে বললো,
—“আমার নিরুত্তাপের শহরে একমাত্র উত্তাপ হয়ে এসেছো তুমি।…তুমিহীন আমি যে আবার তীব্র শীতলতায় কাবু হয়ে যাবো প্রিয়তমা। শৈত্যপ্রবাহে হিম হয়ে যাবে হৃদয়, তোমার উত্তাপ টা যে আমার ভীষণ ভীষণ প্রয়োজন।”

~চলবে~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here