এ শহরে বৃষ্টি নামুক❤️পর্ব৩৪

0
1163

#এ_শহরে_বৃষ্টি_নামুক❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-৩৪

রাত্রি জবুথবু হয়ে গেলো নিমিষেই। ভারিক্কি গলায় কথার ভয়ানক উগ্রতা সাথে পুরুষালী তীব্র বাসনাপূর্ণ চাহনীর বিপরীতে শরীর লাজুকপাতার মতো নিভিয়ে এলো। হৃদস্পন্দন বাড়তে লাগলো ভয়াবহ গতিতে। চোখের পাতা জানান দিলো খুব নিকটের উষ্ণ নিশ্বাসের বহরে সে কম্পিত হতে শুরু করেছে।
রাত্রি বারকয়েক নিজে নিজেই আওড়ালো,”লাল তিল, লাল তিল, লাল তিল।” শেষমেষ এর নির্দিষ্ট অবস্থানটা মনে এসে নাড়া দিতেই ঝংকার তুললো চোখের মনিতে। মতিষ্কের নিউরন নিস্তেজ হয়ে এলো। নিভ্রান ঠি ক ঠাক কাছে আসার আগেই তার কাঁধে জ্ঞান হারিয়ে অসার হয়ে গেলো রাত্রি। নিভ্রান হতভম্ব, কান্ডজ্ঞানহীন চেয়ে রইলো কয়েকমূহুর্ত। কি হয়ে গেলো ব্যাপারটা বুঝতে ঝুঝতেই কাঁধ থেকে মাথা হেলে পড়লো রাত্রির। নিভ্রান বিস্মিত, অবাকভাবটা কাটাতে চাইলো। কাটলো নাকি না জানেনা কিন্তু সেকেন্ড না পেরোতেই অচেতন রাত্রির গালে হাত রেখে শব্দ করে হেসে ফেললো সে। লজ্জার চোটে একেবারে সেন্সলেস হয়ে গেলো মেয়েটা? এতো লজ্জা?
গাল ফুলিয়ে ঠোঁট গোল করে হাঁফ ছেড়ে রাত্রিকে পাঁজাকোলা করে কোলে তুলে নিলো সে। বিছানার মাঝে শুইয়ে দিয়ে মুখে পানি ছিঁটালো অল্প করে। রাত্রি চোখমুখ কুঁচকালো সাথেসাথেই। একটু নড়েচড়ে ঠোঁট কামড়ে আবার স্হির হয়ে গেলো। নিভ্রান ডাকতে যেয়েও ডাকলোনা। থাক! এতক্ষণ রান্না করে এসেছে। এখন একটু শুয়ে থাক। ঘুম আপনাআপনিই ভেঙে যাবে।

যখন চোখ মেললো তখন কারো বুকে ঠেস দিয়ে আধশোয়া হয়ে আছে রাত্রি। পিটপিট করতেই বুঝতে পারলো তার মুখে মাখানো ভাতের লোকমা তুলে দিচ্ছে নিভ্রান। রাত্রি অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে খাবারটা চিবালো। দ্রুত গিলে সোজা হওয়ার জন্য একটু নড়ে উঠতেই নিভ্রান একনজর তাকিয়ে বললো,” আহা! ঘুম ভাঙলো কেনো? এতক্ষণ তো কি সুন্দর শুয়ে ছিলে।”
রাত্রি এদিক ওদিক তাকাল। কোলের উপর চোখ পরতেই দেখলো নিভ্রান প্লেটে মাছ ভাত মাখিয়ে এনেছে। সেখান থেকেই তুলে তুলে খাইয়ে দিচ্ছে। অর্ধেক প্লেট শেষ। তারমানে সে ঘুমের মধ্যই খাচ্ছিলো? ভাবনার সমাপ্তি না ঘটতেই নিভ্রান আবার খাবার ধরলো। রাত্রি কিছু বলতে যাবে তার আগেই চোখের ইশারায় নিষেধাজ্ঞা জারি করলো। মুখ খুলতে বললো। রাত্রি ছোট্ট করে হা করলো। নিভ্রান মুখে ভাত দিয়ে প্লেট থেকে মাছ নিয়ে দিতে দিতে বললো,
—” আগে খেয়ে নাও। পরে কথা বলো।”

রাত্রি দিরুক্তি করলোনা। বিনা বাক্যব্যয়ে প্লেটের সব খাবার শেষ করে হাল্কা গলায় বললো,
—“পানি…।”

নিভ্রান প্লেটটা সাইড টেবিলে রেখে গ্লাসভর্তি পানি খাইয়ে দিলো। ঠোঁটের কোঁণে লেগে থাকা ভাতের কণাটা তর্জনী দিয়ে মুখে ঢুকিয়ে দিলো। ঝোলামাখানো হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুখ মুছিয়ে বললো,
—“লজ্জায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলে। কি এমন বলেছিলাম আমি?”

—“ছিহ্, চুপ করুন। আস্ত নির্লজ্জ আপনি। আল্লাহ!”

নিভ্রান উঠে গেলো। প্লেটটা হাতে তুলে নিয়ে ভাবাবেগশুন্য হয়ে বললো,
—“আমি কি করলাম? আমি তো বেচারা গোষ্ঠীর সদস্য। তুমি জালাচ্ছো। তোমার তিল জালাচ্ছে। এতো বেসামাল হয়ে ঘুমালে আমি কি সারাক্ষণ চোখ বন্ধ করে রাখবো?”

রাত্রি চাপা রাগ, লজ্জায় গায়ের ব্ল্যাঙ্কেট সরাতে সরাতে তেঁতিয়ে উঠলো,
—“আমি ঘুমাবোইনা এখানে। আমি একাই শোন।”

সাথে সাথেই একটা গাঢ়, তুখর সাবধান চাহনী থামিয়ে দিলো তাকে। নিভ্রান ভ্রু উচিয়ে গমগমে গলায় বললো,
—“নেমে তো দেখো একবার।”

রাত্রি পা গুটিয়ে ফেললো দ্রুত । তপ্ত কন্ঠে বললো,”কি করবেন নামলে? মারবেন আমাকে? বাবা বলে গেছেন…আপনি মারলে আমি সোজা উনাকে ফোন দিবো কিন্তু।”

নিভ্রান ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলল,
—“তোমার বাবাকে ভয় পাই আমি?”

—“কেনো পাবেন না? আর আমার বাবা কি? আপনার বাবা না?”

নিভ্রান কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। অত:পর কাঁধের চুল গুলো পিছে দিতে দিতে বললো,”তোমাকে মারার আগে আমার হাত যেনো পঁচে ক্ষয় হয়ে যায়।”কথাটা বলে প্লেট হাতে দরজার দিকে পা বাড়ালো সে। বেরোনোর আগে ঘরের আলো নিভিয়ে দিলো।
—“শুয়ে থাকো। আমি আসছি।”

আকাশে আজ পূর্ণ চাঁদ। পূর্ণিমার বিস্তৃত লীলাখেলায় আলোয় আলোয় ভরে গেছে পৃথিবীর রাতের আঁধারে ডুবো শহর। দীপ্তিমান উজ্জলতায় অস্তিত্ব টি কিয়ে রাখতে অক্ষম তম্রসারা গোমড়ামুখেই বিদায় নিয়েছে।
নিভ্রান পর্দা টানার জন্য হাত বাড়াতেই মিনমিন করে আপত্তি করলো রাত্রি,
—“খোলাই থাক।”

নিভ্রান আর লাগালোনা। উল্টো আরো একটু সাইডে চাপিয়ে দিলো। ঘরের বাতি নিভানো তখনো। অনূভুতিরা হাতছানি দিচ্ছে এদিকে ওদিকে। ধরা দিলেই শান্তি তাদের। বিছানার মাঝে শোয়া লজ্জার রাজ্যর সম্রাজ্ঞীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো নিভ্রান। পাশে শুতে শুতে বললো,
—“জ্ঞান হারিয়োনা আবার। ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে।”

রাত্রি নিরব থেকে বললো,”আপনি বাবার সাথে এমন করেন কেনো?”

নিভ্রান কপালে হাত ঠেকিয়ে গম্ভীর গলায় বললো,
—“কি করেছি?”

—“এইযে উনাদের থেকে আলাদা থাকেন। বাবার সাথে ভালো করে কথাও বলেননা।’

নিভ্রান সময় না নিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলো,
—“তোমার বাবা ভালো করে কথা বলেন?”

রাত্রি আরো খানিকটা চুপসে গেলো,
—“খারাপ কি বললো?”

নিভ্রান উওর দিলোনা। বাবার সাথে মনমালিন্যর খুঁটি টা তার আসলেই জানা নেই। এই প্রসঙ্গ উঠলেই মনে শুধু একটা দৃশ্যেই ভেসে আসে। বিস্তর ঝগড়া ঝাঁটি শেষে রাগের বশে বাড়ি ছেড়ে যখন সে বেরোচ্ছিলো বাবা তাকে একবার পিছু অবধি ডাকেনি। একবারো আটকায়নি। একবারো না। ব্যস! অভিমানি মন সেই সময়টাতেই আটকে গেছে। সেই একরোখা ফিরে না যাওয়ার জেদটাকে পুষে পুষে পাহাড়সমান করেছে।
নিভ্রান সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে খুব গোপনে একটা ব্যাথাযুক্ত শ্বাস ছাড়লো। চাঁদের আলোতে রাত্রি স্পষ্ট দেখতে পেলো চোখের কোঁণ গড়িয়ে বালিশে একফোঁটা তিক্ত বহি:প্রকাশের একান্ত বিসর্জন।

—“জানেন, আমার বাবাকে আমি কতো ভালোবাসতাম? বাবা যখন চলে গেলো পুরো অবিশ্বাস্য লাগছিলো। আমি কখনো ভাবিইনাই আমার বাবা চলে যাবে। এ জিনিস আমার কল্পনাতেও আসেনি কখনো। হঠাৎ অকল্পনীয় ঘটনাটা আমাকে শেষমেষ পুরো কল্পনাতেই পাঠিয়ে দিলো। আমি রোজ রাতে সপ্নে দেখতাম বাবাকে। কতো গল্প করতাম আমরা। ঘুম থেকে উঠে দেখতাম আমার বালিশ ভিজানো।”

নিভ্রান বিরবির করলো,”সেদিন বাসে তো আমার বুক ভিজিয়ে দিয়েছিলে।”

—“কিছু বললেন?”

নিভ্রান কপালে রাখা হাত না মেলেই বললো,
—“উহুম, ঘুমাও।”

রাত্রি বিস্মিত নয়নে তাকালো। ছোট্ট গলায় বললো,
—“আপনি রাগ করলেন? আমি ঘুমাবো কি করে?”

নিভ্রান ভ্রু কুচকে ঘাড় ফিরালো। রাত্রির বিষন্ন চেহারা দেখে একমূহুর্ত ভ্রু কুঁচকালো। সেই চাহনীর অর্থোদ্ধার হয়ে যেতেই দ্রুত হাত মেলে দিলো,
—“সরি সরি। আসো।”

গভীর রাতে নিভ্রানের ঘুম ভাঙলো ফোঁপানোর আওয়াজে। চকিতে চোখ মেলেই বুঝলো তার পিঠ আঁকড়ে প্রথমদিনের মতোই অস্ফুট স্বরে কাঁদছে রাত্রি। গাল বেয়ে পড়ছে উত্তপ্ত পানি।
মুখে সেই “বাবা”, “বাবা” বুলি। নিভ্রান কিছুক্ষণ স্তব্ধ থেকে প্রথমদিনের মতোই তাকে আগলে ধরলো। মাথায় হাত বুলালো। হাত শক্ত করে মুঠোয় টেনে নিলো। মেয়েটা শান্ত হচ্ছেনা কিছুতেই। মধ্যরাত পেরিয়ে ফজরের আযান দিয়ে দিয়েছে। তখন একটু একটু করে ধাতস্থ হলো রাত্রি। কান্না থামলো। ঘুমে বিভোর হলো ফ্যাকাশে ভেজা মুখ।
_____________

সকালবেলা অফিসের জন্য তৈরি হতে হতে নিভ্রান বললো,”শুক্রবারে তোমাকে ওই বাসায় নিয়ে যাবোনে।”

রাত্রি চুল আচরাচ্চিলো। নিভ্রানের কথায় দৃষ্টি সরু হলো তার,”কোন বাসায়?”

নিভ্রান শান্ত স্বরে বললো,
—“তোমার বাবার বাসায়।”

রাত্রি চমকে তাকালো। তার জানামতে নিভ্রান ওই বাসায় যায়না কখনোই। নাহিদার কাছে শুনেছিলো। তিনি নাকি কতো বলেছেন কিন্তু নিভ্রানকে কিছুতেই নেয়া যায়নি। চোখ চকচক করে উঠলো। উৎফুল্ল স্বরে সে বললো,”সত্যি?”

—“হু, নিশাদ বলছিলো যাওয়ার কথা। নিয়ে যাবোনে। তোমার বাবার সাথেও দেখা হয়ে যাবে।”

রাত্রি বিরক্ত হলো,”আপনি আবারো ‘তোমার বাবা’ ‘তোমার বাবা’ করছেন কেনো?”

নিভ্রান বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে ফোঁস করে বললো,
—“আচ্ছা, ফাইন। বাবার বাসায় নিয়ে যাবো? খুশি?”

~চলবে~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here