#চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ১৮
____________
বোর্ডেন্স পার্ক। এই পার্কটি এডমন্টন সিটি এক্সিবিশন সেন্টারের সামনে অবস্থিত। পার্কের আরেক পাশে রয়েছে নর্থল্যান্ড ফার্ম। যেখানে গ্রীষ্ম কালে বিভিন্ন ধরণের সবজির চাষ করা হয়। পার্কের ভিতরে নানা ধরণের ভাস্কর্য রয়েছে। যার কারণে অন্যান্য পার্ক থেকে এটা আলাদা। পুরো পার্কটি সবুজের চাদরে ঢাকা। ভিতরে হাঁটার জন্য আলাদা ওয়াকওয়ে রয়েছে। শিশুদের জন্য রয়েছে আলাদা প্লে-গ্রাউন্ড। মর্নিং বা ইভিনিং ওয়াক করতে করতে মানুষজন ক্লান্ত হয়ে গেলে বসার বেঞ্চির অভাব নেই। এই পার্কে সারি সারি পাইন গাছ এবং ঝাউ গাছ লক্ষ্যনীয়। মিতুলের খুব একটা ভালো লাগেনি পার্কটি। আর ভাস্কর্য দেখতে তো ওর কোনো কালেই ভালো লাগে না। তবে কার্ল সাথে থাকায় ভালো না লাগলেও, অধিক ভালো এই পার্কটি ওর কাছে।
কার্ল এবং ও ওয়াকওয়েতে হাঁটছে। এখন বিকেল। বিকেলের পড়ন্ত রোদ পাইন গাছ অতিক্রম করে মুখমন্ডলে এসে পড়েছে। কালকে ওরা ভ্যাংকুভার চলে যাচ্ছে বলে, আজকে বিকেলে রেস্টুরেন্টে কার্লের সাথে দেখা করতে গিয়েছিল। তখন কার্ল ছুটি নিয়ে বাইরে ঘুরতে এলো ওকে নিয়ে।
মিতুল কার্লকে যতই দেখছে, ততই প্রেমে পড়ে যাচ্ছে। কী ভালো ছেলেটা! ভীষণ মিশুক। কথাও বলে খুব সুন্দর করে। মিতুলের ইচ্ছা করে কার্লের কথা রেকর্ড করে নেয় মোবাইলে। যেমনি ছবি তুলে নিয়েছিল গোপনে, তেমনি করে কথাও রেকর্ড নিতে ইচ্ছা করছে। চাইলেই পারে রেকর্ড করতে। কিন্তু কেন যেন করছে না।
মিতুল কার্লকে দেখতে দেখতে হেঁটে চলছে। কার্ল ওকে এই পার্কটি সম্পর্কে বলছে অনেক কিছু। কিন্তু সেসব শোনায় ওর মনোযোগ নেই। ও কার্লকে দেখার মনোযোগে হারাচ্ছে।
হঠাৎই কার্লের দৃষ্টি ওর উপর পড়লো। একদম চোখে চোখ। মিতুল থমকে যায়। চোখ সরিয়ে নেয় কার্লের থেকে। লজ্জা লাগছে ভীষণ। বেহায়া মেয়ের মতো কীভাবে দেখছিল কার্লকে, ইশ! মিতুলের নিজের কাছেই কেমন যেন লাগলো।
কার্লের মোবাইলে রিং হতে, মিতুল আবার তাকালো কার্লের দিকে। কার্ল হেসে কল রিসিভ করেছে। মোবাইলটা কানের সাথে ধরেই বললো,
“হাই!”
ওপাশের কলার কিছু একটা বলার পর কার্ল বললো,
“নো, আমি রেস্টুরেন্টে নেই। পার্কে আছি। এক ফরেইনার ফ্রেন্ডকে পার্ক ঘুরিয়ে দেখাচ্ছি। শি ইজ ফ্রম ব্যাংলাডেশ।”
ওপাশের কলার কিছু একটা বললো। কার্ল বললো,
“ও কে ও কে আই উইল কাম। জাস্ট পনেরো মিনিট লাগবে আমার।
হ্যাঁ, আসছি আমি। ও কে বাই!”
কার্ল কল কেটে দিলো। মিতুলের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আই অ্যাম সো স্যরি রাবা! আমাকে এখন চলে যেতে হবে। আমার খুব স্পেশাল একজন মানুষ আমার সাথে মিট করার জন্য ডাকছে। সুতরাং আমাকে যেতে হচ্ছে। আই অ্যাম এক্সট্রেমলি স্যরি যে তোমাকে বাসায় পৌঁছে দিতে পারছি না।”
কার্লকে এভাবে বলতে দেখে মিতুলের খারাপ লাগলো। মিতুল বললো,
“ইট’স ও কে। তোমার যেতে হলে তুমি যাও। এখানে এমন করে বলার কিছু নেই। আমি আরও কিছুটা সময় ঘুরে বাসায় চলে যাব।”
কার্লকে কিছুটা প্রফুল্ল হয়ে বলতে দেখা গেল,
“যার সাথে আমি দেখা করতে যাচ্ছি, তার সাথে তোমাকেও একদিন মিট করাবো। আশা করছি তুমি তাকে ভীষণ পছন্দ করবে।”
কার্ল একটু মিষ্টি করে হেসে চলে গেল। কতদূর গিয়ে আবার পিছন ফিরে বললো,
“বাই রাবা! শীঘ্রই দেখা হবে তোমার সাথে।”
মিতুল একটু হাসলো। কত বিনয়ী ছেলে কার্ল। প্রয়োজনীয় কাজ আছে বলে চলে যেতে হবে, সে জন্যও কত সুন্দর করে বোঝালো ওকে।
আর ওদিকে জায়িন, জোহানকে দেখো। ওই দুই ভাইয়ের তো অহংকারেই মাটিতে পা পড়ে না। চলে যাওয়ার সময় সূক্ষ্ম একটু বিদায়ও জানাতো না ওরা। মিতুল মনে মনে দুই ভাইয়ের প্রতি গভীর ক্ষোভ প্রকাশ করলো।
তারপর আবার কার্লের কথা ভাবলো। কার সাথে দেখা করতে যাচ্ছে কার্ল? কে সেই স্পেশাল মানুষ? খুবই ঘনিষ্ঠ কোনো বন্ধু না কি?
______________
ভ্যাঙ্কুভার।
কিছুক্ষণ হলো মিতুলরা ভ্যাঙ্কুভার ল্যান্ড করেছে। নতুন শহরের নতুন বাতাসই যেন মিতুলের মনে উদ্দীপনার ঢেউ তুলছে ক্ষণে ক্ষণে। এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়েছে বেশি সময় হয়নি। মাত্রই ট্যাক্সিতে উঠেছে। ওর দু চোখ ছুটছে বাইরের পরিবেশ দেখতে।
ওর পাশে রেশমী আন্টি বসা। রেশমী আন্টির পাশে জায়িন। সাদাত আঙ্কল সামনে বসেছেন। ট্যাক্সি থ্রি-স্টার হোটেল রেডিসনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। পাঁচ দিনের জন্য ভ্যাঙ্কুভার আছে ওরা। ওর স্বপ্নের ভ্যাঙ্কুভার!
মাত্র বারো, তেরো মিনিটের মধ্যে হোটেলের সামনে এসে ট্যাক্সি থামলো। এখানে আরও অনেক গাড়ি পার্ক করে রাখা। সব কিছু শৃঙ্খল। হোটেলটা বাইরে থেকে দেখেই মিতুলের মুগ্ধতার শেষ রইল না। অনেক বড়ো হোটেল। আকাশের নীলের বুকে পেজা তুলোর মতো সাদা রঙের মেঘের ভেলা যেন হোটেলের গায়ে জড়িয়ে আছে। হোটেলটা গ্লাসে আবৃত। গ্লাসে আকাশের প্রতিচ্ছবি ফুঁটে রয়েছে। হোটেলটার দিকে তাকালেই মনে হচ্ছে, আকাশের নীল সাদা আবির মেখেই বাইরের দিকটা তৈরি করা হয়েছে। মিতুল মুগ্ধতার বশে নিজের অজান্তেই বলে ফেললো,
“ওয়াও!”
বাইরের মুগ্ধতা শেষ হলে এবার ভিতরের মুগ্ধতায় ডোবার সময়।
এই হোটেলে দুটো রুম বুক করেছে ওরা। রুমে দুটো করে বেড। এক রুমে থাকবে ও এবং রেশমী আন্টি। অপর রুমে থাকবে সাদাত আঙ্কল এবং জায়িন।
মিতুল চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে রুমটা দেখছে। রুম বেশ ভালোই বড়ো। বেড দুটোও বড়ো আছে। একেকটা বেডে দুইটা বালিশ। দুই বেডের পাশে দুটো ল্যাম্পশেড নিয়ে, মোট চারটি ল্যাম্পশেড আছে রুমে। রুমের এক সাইডে দেয়ালের পাশ ঘেঁষে রাখা একটা ওয়ার্ডোব। ওয়ার্ডোবের উপরের দেয়ালে একটা টিভি।
একটা কাউচও আছে। রয়েছে তিনটা ফুলদানিও। দেয়ালে আছে কয়েকটা পেইন্টিং টানানো। রুমের সাথেই ওয়াশরুম। মিতুল ওয়াশরুমটাও দেখে নিলো। ওয়াশরুমটাও পছন্দ হয়েছে ওর।
রুমের দেয়াল জুড়ে আছে বিশাল আকৃতির গ্লাস উইন্ডো। ঠিক যেমন করে রেশমী আন্টিদের বাড়িতেও আছে। উইন্ডোর সামনে একটা আর্মচেয়ারও রাখা।
মিতুল উইন্ডোর দিকে এগিয়ে গেল। উৎসুক দৃষ্টি রাখলো উইন্ডোর বাইরে। দুপুরের রোদে বাইরের পরিবেশটা ঝকঝকে পরিষ্কার।
এখন ফ্রেশ হবে। ফ্রেশ হয়ে হোটেলটা ঘুরে দেখবে। শুনেছে এই হোটেলে ইনডোর পুলও আছে।
লাঞ্চের পর রেস্ট নিয়ে সবাই মিলে কুইন এলিজাবেথ পার্কে ঘুরতে যাওয়ার কথা ছিল। এমন কথা হয়েছিল বাড়িতে বসেই, যে যেদিন ভ্যাংকুভার যাবে, সেদিন বিকেলে কুইন এলিজাবেথ পার্কে ঘুরে বেড়াবে। কিন্তু লাঞ্চ করার সময় রেশমী আন্টি বললেন, তার এবং সাদাত আঙ্কলের রিচমন্ডে এক বন্ধুর বাসায় কী একটা কাজ আছে। তারা যেতে পারবে না পার্কে। জায়িনের সাথে একা যেতে বললো ওকে। মিতুলের একা একা জায়িনের সাথে যেতে ইচ্ছা করছিল না। কিন্তু বসন্তের ভ্যাঙ্কুভারের অপরূপ সৌন্দর্যে মাতোয়ারা রাশি রাশি চেরি ব্লসমে পরিপূর্ণ রাজ্য দেখার জন্য, ওর দু চোখ পিপাসার্ত হয়ে আছে। গোলাপি এবং সাদা চেরি ব্লসমের মধ্যে, সাদা চেরি ব্লসম বেশি প্রিয় ওর। এখানে অনেক সাদা চেরি আছে।
মিতুল একটু আগে ভাগেই জায়িনের সাথে বেরিয়ে পড়লো। এখান থেকে এলিজাবেথ পার্ক মাত্র সতেরো আঠারো মিনিটের পথ। ট্যাক্সিতে যাচ্ছে বলে কম সময়। বাসে গেলে এর থেকে একটু বেশি সময় লাগতো। আর হেঁটে গেলে আড়াই ঘণ্টার মতো।
ট্যাক্সি নিজ গতিতে এগিয়ে চলছে পার্কের উদ্দেশ্যে। মিতুল উইন্ডো দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। ওর দু চোখ বিমোহিত, মুগ্ধ! চেরি ব্লসম! ওর প্রিয় চেরি ব্লসমের রাজ্য এই ভ্যাঙ্কুভার।
এডমন্টনে যে চেরি ব্লসম দেখেছিল, ভ্যাঙ্কুভারের চেরি ব্লসমের কাছে তা কিছুই নয়।
রাস্তার দুই পাশেই সারি সারি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে চেরি ব্লসম ট্রি। প্রত্যেকটা গাছ ফুলে ভরপুর। পাপড়ি ঝরে পড়ে আছে নিচে। এখানে রোদ দেখা যাচ্ছে না। রাস্তার দুপাশের ফুলে ভরপুর চেরি গাছগুলো উপর থেকে মিলে ছাউনির মতো হয়ে, রাস্তাকে রোদ থেকে আড়াল করে রেখেছে একেবারে। কী অপরূপ এই দৃশ্য! দুই চোখ জুড়িয়ে যায় মুগ্ধতার কলকাতানে!
মিতুলের হঠাৎই কেন যেন জোহানের কথা মনে পড়ে গেল। জোহানকে মনে পড়ার রহস্যটা ও নিজেও বুঝতে পারছে না। জোহানের কনসার্ট রাতে। একটা আমেরিকান ব্যান্ডের সাথে। মিতুল ভাবছে, কেমন পারফর্ম করবে জোহান? ভালোই করবে নিশ্চয়ই। মিতুলের এই প্রথম মনে হলো, জোহান সাথে আসলে ভালো হতো।
জোহানের চিন্তা এখানেই থামিয়ে দিলো মিতুল। কুইন এলিজাবেথ পার্কে এসে গেছে ওরা।
ব্রিটেনের রানি কুইন এলিজাবেথকে সম্মাননা দেওয়ার জন্যই এই পার্কের নাম কুইন এলিজাবেথ পার্ক নামে নামকরণ করা হয়েছে। এই পার্কটি লিটল মাউন্টেন নামের একটি পাহাড়ের উপর গড়ে উঠেছে। পার্কটির আয়তন প্রায় ১৩০ একর।
মিতুল লক্ষ্য করলো অনেক অনেক গাড়ি পার্ক করে রাখা। এমনিতেই বসন্ত চলছে, তার উপর আজকে আবার ছুটির দিন। পার্কে যেন ভিড় একটু বেশিই। অনেককেই দেখা যাচ্ছে পার্কে ঘোরাঘুরি করতে। গাড়ি পার্ক করে রাখা রাস্তার পাশে আরও একটি সরু রাস্তা রয়েছে। মিতুল জায়িনের পিছন পিছন সেই রাস্তা দিয়ে হাঁটছে। একটু হাঁটতেই বাম সাইডে দেখলো চার পাঁচটা মতোন চেরি ব্লসম গাছ। গাছের নিচ ছায়া সুনিবিড়। জায়িন রাস্তা ছেড়ে দিয়ে সবুজ ঘাসে মোড়ানো জমিনে পা রাখলো। মিতুলও জায়িনের পিছন পিছন হাঁটতে লাগলো। ।হাঁটতে হাঁটতে চেরি ব্লসম ট্রির নিচে এসে গেল ওরা। অনেক মানুষ এখানে দাঁড়িয়ে আছে। হাসাহাসি করছে। ছবি তুলছে।
মিতুল দেখতে পেল গাছের তলাতে অনেক চেরি পাপড়ি পড়ে আছে। এখানে কিছুক্ষণ দাঁড়াতে চাইছিল মিতুল। কিন্তু জায়িন থামলো না। মিতুল জায়িনের সাথে সাথেই হাঁটতে লাগলো। কয়েক পা হেঁটে এসে দেখতে পেল এখানে একটা রাস্তা। গাড়ি চলছে। মানুষ জনও হাঁটছে। রাস্তার ওপাশেই আরও অনেকগুলো চেরি ব্লসম গাছ। মিতুল লক্ষ্য করলো পার্কটার এখানে সেখানে অনেক চেরি ব্লসম গাছ আছে। যেগুলো পার্কের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করছে তুলনামূলক ভাবে বেশি। মিতুল মোবাইল বের করে দ্রুত কয়েকটা ছবি তুলে নিলো চেরি ব্লসমের। সেলফিও তুললো।
জায়িন মিতুলের ছবি তোলার ব্যাপারটি লক্ষ্য করলো।
জায়িন একটা ব্যাপারে ভেবে পাচ্ছে না যে, ও গাইডের খাতায় নাম লেখালো কবে? আর গাইড হিসেবে এত উন্নতিও বা করলো কবে? মমের কি সেরা গাইড হিসেবে ওকেই চোখে পড়ে? মম কেন বার বার মিতুলকে একা ওর সাথে ঘুরতে পাঠিয়ে দিচ্ছে? কাউকে এখানে ওখানে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখানো খুব বেশি বিরক্ত লাগে ওর। আর মিতুলের সাথে তো ও ঠিক ফ্রি হয়েই চলতে পারে না। উহ, আজকেই ড্যাড, মমের কেন ড্যাডের ফ্রেন্ডের বাসায় যেতে হলো? আজকে সবাই মিলে একসাথে ঘোরাঘুরি করলে হতো না?
নিরিবিলি রাস্তা ধরে কিছুটা দূর হেঁটে আসতেই যেন পার্কের চেহারা বদলে গেল। রাস্তার পাশে পাশেই দেখা যাচ্ছে এখন রং বেরঙের ফুল। টিউলিপ ফুল এর মাঝে বিশেষ। যতই হাঁটছে, ততই পার্কের গভীরে চলে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে মিতুলের।
পার্কটা ঘুরে দেখতে দেখতে মিতুলের যা মনে হলো তা হলো, একে একটি পাহাড়ি ফুলের বাগান বললে মন্দ হবে না। কারণ, পুরো পার্কটিতে প্রায় শতাধিক রকমের ফুলের গাছ আছে। ফুলের গাছ ছাড়াও এখানে অনেক প্রকার বৃক্ষ আছে। বৃক্ষের অভাব নেই এই পার্কে। নিজ নিজ সৌন্দর্য নিয়ে একেকটা বৃক্ষ দাঁড়িয়ে আছে। হাইকিং করতে করতে হাঁপিয়ে গেলে বসার বেঞ্চির কোনো অভাব নেই। এখানে সেখানে বসার জন্য অনেক বেঞ্চি আছে। চাইলে গাছের ছায়ার নিচে বসেও বিশ্রাম করা যাবে।
এখানে ফ্যামিলি, ফ্রেন্ডসদের নিয়ে পিকনিকও করা যাবে। কারণ, পার্কের বিভিন্ন স্থানে অনেকগুলো ওপেন স্পেস রয়েছে, যা সবুজের চাদরে মোড়ানো। পাহাড়ি এই পার্কটির একদম ওপরে একটি গম্বুজ আকৃতির কাঁচের তৈরি ভবন দেখা যায়। এটি মূলত একটি কন্সারভেটরি। যেখানে বিভিন্ন দেশের, বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষ এনে সংরক্ষণ করা হয়। এটা অনেকটা গ্রিন হাউজের মতো। যাতে এখানকার তীব্র শীতকালীন আবহাওয়াতে গাছগুলো বেঁচে থাকতে পারে। যেখানে এই কন্সারভেটরির অবস্থান, তার অপর পাশ থেকে পুরো উত্তর ভ্যাংকুভার শহর দেখা যায়।
পাহাড়ি এই পার্কটির নিচে একটি রোজ গার্ডেনও রয়েছে। যেখানে গ্রীষ্মকালে নানান রঙের ফুটন্ত গোলাপ দেখা যায়। এই রোজ গার্ডেনের পাশেই রয়েছে একটি গলফ কোর্স, কয়েকটি পিকনিক স্পট এবং বাচ্চাদের জন্য একটি প্লে গ্রাউন্ড।
পার্কে ঘুরতে ঘুরতে রাত নেমে এসেছে। পুরো পার্কটি দেখে মিতুলের মনে হলো কুইন এলিজাবেথ পার্ক সৌন্দর্যে অনন্য একটি জায়গা। পার্কের ভিতরের ঝর্ণাটা মিতুলের সেই রকমের পছন্দ হয়েছে।
____________
রেডিসন হোটেলকে দিনের বেলা যতটা না সুন্দর লেগেছিল, তার থেকে অনেক গুণ বেশি সুন্দর লাগছে রাতে। চারিপাশে কেবল আলোর ছড়াছড়ি।
মিতুল কিছুক্ষণ লবিতে ঘোরাঘুরি করে রুমে চলে এলো।
রেশমী আন্টি এবং সাদাত আঙ্কল এখনও হোটেলে ফেরেননি।
মিতুল মোবাইলে জোহানের পারফর্ম দেখলো এইমাত্র। ভিডিয়োটা জোহানই পাঠিয়েছে। পারফর্ম কেমন হয়েছে জানাতে বলেছে।
মিতুল প্রথমে কিছুই লিখতে চায়নি। কিন্তু পরে ভাবলো, জোহানকে একটু উৎসাহ দেওয়া দরকার। যদিও জোহানের ফ্রেন্ড সার্কেলের সবাই-ই বোধহয় ওকে উৎসাহ দিয়ে মাথায় তুলে ফেলেছে। কনসার্টের ভিডিয়ো ছাড়াও আরও একটা ভিডিয়ো পাঠিয়েছে জোহান। যে ভিডিয়োটা ওর ফ্রেন্ডসদের সাথে। যাতে দেখা গেল ওর ফ্রেন্ড সার্কেলের বেশির ভাগই ওর সাথে উইনিপেগ গিয়েছে। ভিডিয়ো টাতে মিতুলকে সবাই হাই, হ্যালো জানিয়েছে। মিতুলের মনে হলো ওদের বন্ধুত্ব খুব বেশি গাঢ়।
মিতুল জোহানের প্রশংসা করে লিখলো,
‘সুন্দর পারফর্ম ছিল। আশা করি ভবিষ্যতে আরও বেশি ভালো করবে। এবং নিজের স্বপ্নটাও পূরণ করে ফেলবে দ্রুত।’
ম্যাসেজটা পাঠানোর একটু সময় পরই জোহান কল করলো। মিতুল বিরক্ত হলো। জোহানের সাথে ফোনে কথা বলার একদমই ইচ্ছা নেই ওর। তাছাড়া আগে কখনো ফোনে কথা বলেনি জোহানের সাথে। প্রথম ফোনে কথা বলতে ওর অস্বস্তি হবে। মিতুল কলটি কেটে দিতে চাইছিল। কিন্তু কী ভেবেই আবার রিসিভ করলো।
“হ্যালো!”
ওপাশে জোহানের আহ্লাদী কণ্ঠ শোনা গেল,
“হোয়াট আর ইউ ডুয়িং?”
“শুয়ে আছি।” মিতুলের মোটেই জানতে ইচ্ছা করছিল না, জোহান কী করছে। তবুও জিজ্ঞেস করলো,
“তুমি কী করছো?”
“আমি? আমি ক্লাবে আছি। শব্দ শুনে বুঝতে পারছো না?”
“তো ক্লাবে বসে মজা করো। আমাকে কেন ফোন করেছো?”
জোহান মিতুলের প্রশ্নের উত্তর দিলো না। উল্টো নিজেই প্রশ্ন করে বসলো,
“আজকে সারাদিন তুমি আমাকে খুব মিস করেছো নিশ্চয়ই, তাই না?”
জোহানের এমন প্রশ্নে মিতুল হকচকিয়ে গেল। একটু একটু মনে পড়ছিল জোহানকে। কিন্তু অতটা না। মিতুল বললো,
“তোমাকে কেন মিস করবো? তোমাকে আবার মিস করার কী আছে?”
“মিস করার কিছু নেই বলছো?”
“হ্যাঁ, কিছুই নেই।”
“ঠিক আছে। মিস করার কিছু আছে কি নেই সেটা পরে দেখবো। কোন হোটেলে উঠছো তোমরা?”
“কেন তুমি জানো না? হোটেল তো আগে থেকেই বুকিং করা ছিল।”
“জানলে কি তোমার কাছে জিজ্ঞেস করতাম?যেখানে আমি যাব না, সেখানকার খবর রাখার প্রয়োজন মনে করিনি।”
“তাহলে এখন আবার জিজ্ঞেস করছো কেন কোন হোটেলে আছি? তুমি এসব জেনে কী করবে?”
“জেনে কী করবো মানে? আমার মম, ড্যাড, ব্রাদার সবাই ওখানে আছে। এখন সেটা জানাও কি দোষ আমার? বললে কী হবে? আমি কি ভ্যানকুভার গিয়ে তোমাকে কিডন্যাপ করে উইনিপেগ নিয়ে আসবো?”
“কে জানে তুমি কী করো।”
“কোন হোটেলে আছো?”
“রেডিসন।”
“রেডিসন? এয়ারপোর্টের কাছাকাছি? তোমরা একটা থ্রি-স্টার হোটেলে গিয়ে উঠেছো? কেন ফাইভ-স্টার, ফোর-স্টার হোটেলের কি অভাব পড়েছিল?”
জোহানের কথা শুনে মিতুলের মেজাজ খারাপ হলো। বললো,
“হ্যাঁ, এখানে হোটেলের অভাব পড়েছে। বসন্ত চলছে তো এখন, সব দর্শনার্থীদের ভিড় এখানে। উইনিপেগে তো নিশ্চয়ই এত ভিড় নেই। তা তুমি কত বড়ো হোটেলে আছো? টেন-স্টার হোটেলে আছো না কি?”
“টেন স্টার হোটেল থাকলে সেখানেই উঠতাম। ছাড়ো সেসব। জানো তো মিতুল, এখানে এসেছি প্রায় বিশ মিনিট হলো। সেই থেকে লক্ষ্য করছি একটা মেয়ে নানা ভাবে আমার আকর্ষণ পাওয়ার চেষ্টা করছে। আমি কিন্তু মেয়েটাকে দেখছি চুপি চুপি। ভালোই লাগছে মেয়েটাকে। মেয়েটা সেই রকম সুন্দর। লম্বাও অনেকখানি। আমার মতোই। মেয়েটা যে কী সুন্দর তোমাকে বোঝাতে পারব না। যদিও এরকম মেয়ের চলাচল আমার আশেপাশে অহরহ। দিনে ষাট, সত্তর সুন্দরী মেয়ের প্রপোজ আসে আমার কাছে। তবুও এই মেয়েটাকে কেন যেন একটু আলাদা মনে হচ্ছে সবার থেকে। তোমার কী মনে হয়? মেয়েটাকে কি বুঝতে দেওয়া উচিত, যে আমি ওর উপর আকৃষ্ট?”
“তুমি আমার কাছে জিজ্ঞেস করছো কেন এসব? তোমার যা ভালো মনে হয়, তাই করো। আজকেই মেয়েটার সাথে সকল কথাবার্তা ফাইনাল করে, কালকেই ডেটে চলে যাও। তোমাকে তো আর কেউ এই বিষয়ে বাধা দেবে না। তুমি তো নিজের ইচ্ছা স্বাধীন ভাবে চলো। এ বিষয়ে তো তুমি মুক্ত স্বাধীন। তোমার যা ইচ্ছা তাই…”
মিতুল পুরো কথা শেষ করলো না। তার আগেই ফোন কেটে দিলো। কারণ, জোহানের সাথে কথা বলার মাঝেই কার্লের কল এসেছে। মিতুলের চোখে ব্যাপারটা পড়তেই টুপ করে জোহানের ফোন কেটে দিলো। কার্লের কল আসার পরও জোহানের সাথে কথা বলে কে?
মিতুল কার্লের কাছে কল ব্যাক করলো।
____________
ব্রেকফাস্ট টাইম।
হোটেলের রেস্টুরেন্টে ব্রেকফাস্ট করার জন্য বসেছে ওরা। রেশমী আন্টি এখনও উপস্থিত হননি। মিতুল সাদাত আঙ্কল এবং জায়িনের সাথে বসে আছে। এখানে আরও অনেকে ব্রেকফাস্ট করছে। মিতুলদের অর্ডার দেওয়া শেষ। খাবার এসে পৌঁছয়নি এখনও।
মিতুল নীরব বসে আছে। একটা চামচ নাড়াচাড়া করছে। জায়িন বসে বসে মোবাইল ঘাটছে। সাদত আঙ্কলও তাই। মিতুলের কাছে মোবাইল থাকলে মিতুলও এখন তাই করতো। কিন্তু বোকার মতো মোবাইলটা রুমে ফেলে এসেছে। ধ্যাত ভালো লাগছে না।
মিতুল যখন নিজের বিরক্তিকর প্রহরগুলো গুনছিল, ঠিক তখনই শুনতে পেল দূর থেকে একটা পরিচিত কণ্ঠ ডেকে উঠেছে ওকে। মিতুল থমকে গেল। বাতাসের বুক চিরে দুটো শব্দ ওর কানকে নাড়িয়ে দিলো।
আর সেই শব্দ দুটি হলো,
“হেই তুলতুল…”
মিতুল চকিতে শব্দ অনুসরণ করে রেস্টুরেন্টের প্রবেশ দরজায় তাকালো। যা দেখলো, তা ছিল ওর জন্য বিস্ময়কর। দেখতে পেল দরজায় জোহান দাঁড়ানো। জোহানের গায়ে কালো রঙের হুডি। হুডির ভিতর থেকে সাদা রঙের গেঞ্জি উঁকি দিচ্ছে। মাথায় হুডি টানা, পরনে কালো জিন্স। হাতে লাগেজ ধরা। মিতুলের ধারণা ও নির্ঘাত ভুল দেখছে। যে জোহান উইনিপেগ, সেই জোহানকে কী করে ও এই ভ্যাঙ্কুভার দেখতে পারে? এ অবশ্যই চোখের ভ্ৰম!
(চলবে)