#চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ৫১
____________
যেদিন প্রথম কানাডা এসেছিল, সেদিন শুধু ক্যামিলাকে পাঠানো হয়েছিল মিতুলকে আনতে। কিন্তু আজ যখন ও চলে যাচ্ছে তখন সবাই-ই এলো ওকে এয়ারপোর্ট ছাড়তে। এমনকি সাদাত আঙ্কলও এসেছেন। মিতুলের চলে যাওয়ার অন্তিম মুহূর্তে রেশমী আন্টি কপালে চুমু খেয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলেন মিতুলকে। ঠিক যেমন প্রথম দিনে জড়িয়ে ধরেছিলেন। রেশমী আন্টির বাহু বন্ধনে আবদ্ধ রত অবস্থায় মিতুল মনে মনে বললো,
“প্লিজ আন্টি, জোহানকে কষ্ট দিও না। একটু বেশি ভালোবেসো ওকে। ঠিক যেমনি জায়িনকে ভালোবাসো, তেমনি ওকেও ভালোবেসো। ও তো তোমারই ছেলে।”
মিতুল কথাগুলো মুখে বলতে চাইছিল। কিন্তু সব কথা যে মুখে বলা যায় না। অনেক কথা অন্তরে গুমরে মরে।
রেশমী নিজের বাহু বন্ধন থেকে মুক্ত করলেন মিতুলকে। বললেন,
“তোমাকে অনেক মনে পড়বে। এতদিনে খুব আপন হয়ে গেছো তুমি আমাদের।”
মিতুলের মাঝে মর্মভেদী কষ্ট ছেয়ে আছে। না জোহানের অমন মর্মান্তিক বিদায়ের সাথে পরিচিত ছিল ও, আর না নিজের এমন বিদায়ের সাথে। কানাডায় থাকাকালীন এই শেষ সময়ে জোহানকে দেখার জন্য ওর মনটা হাহাকার করছে। মনে কষ্ট নিয়েও মিতুল স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো,
“তোমাদের সবাইকেও আমি খুব মিস করবো। তোমরাও খুব আপন হয়ে গেছো আমার। বাংলাদেশের মাটিতে গিয়ে তোমাদের প্রতিনিয়ত মনে পড়বে আমার।”
ক্যামিলার দিকে চোখ চলে যায় মিতুলের। এই মানুষটা শুরু থেকে প্রিয় ছিল ওর। ক্যামিলার কাছে এসে ক্যামিলাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। চোখের পাতায় তালা এঁটে বললো,
“তোমাকে ভীষণ মিস করবো। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তুমি বেশ যত্ন নিয়েছো আমার। তুমি আমার অন্যতম প্রিয় একটা মানুষ। আই উইল মিস ইউ সো মাচ!”
মিতুলের কণ্ঠ একটু নিচু স্বরে কথাগুলো জানান দেয় ক্যামিলাকে। ক্যামিলা ছাড়া বাকি জনদের কানে কথাগুলো স্পষ্টভাবে ধরা দিলো না।
মিতুল ক্যামিলাকে ছেড়ে দিলে ক্যামিলা ওর মাথায় হাত বুলালো একটু আলতো করে। মুখে মিষ্টি হাসির রেখা টেনে মিতুলকে বললো,
“তোমাকেও মিস করবো। আমাদের আবার দেখা হবে সেই আশা রাখি।”
“সবাইকেই যাওয়ার আগে কিছু না কিছু বলে যাচ্ছ। আমাকে কিছু বলবে না?” মধ্য থেকে হুট করে বলে উঠলো জায়িন।
মিতুল কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। মনে মনে কথা সাজিয়ে নিতে একটু সময় লাগলো।
“হ্যাঁ, তোমাকেও খুব মিস করবো। ভালো থেকো।”
“পৌঁছে জানিও কিন্তু।” বললেন সাদাত আঙ্কল।
“অবশ্যই জানাবো আঙ্কল। আসি এখন। সময় হয়ে গেছে।”
রেশমী আন্টি বললেন,
“ভালো একটি যাত্রা কাটুক মাই চাইল্ড।”
মিতুল একটু হাসার চেষ্টা করলো। সবাইকে বিদায় জানিয়ে তারপর ঘুরে দাঁড়ালো যাওয়ার জন্য। মনে কালো ক্ষয়িঞ্চু মন খারাপের মেঘ নিয়ে পায়ে পায়ে এগিয়ে চললো। এমন মুহূর্তে জোহানকে মনে পড়ছে খুব। এই কানাডার বুকে জোহানের সাথে কাটানো সুপ্ত মুখরতাগুলো ফেলে যাচ্ছে। আর সাথে নিয়ে যাচ্ছে স্মৃতি। এই স্মৃতিগুলোই খুব যন্ত্রণা দেবে মাঝে মাঝে। কারণ জোহানের সাথে আবার এমন করে সময় কাটানোর জন্য মন বিদ্রোহ করবে মাঝে মাঝেই। মিতুল হাঁটতে হাঁটতে পিছন থেকে জায়িনের কণ্ঠ শুনতে পেল,
“খুব মিস করবো তোমায় মিতুল!”
জায়িনের কথা কেবল মিতুলের কানকেই স্পর্শ করতে পারলো, মন পর্যন্ত পৌঁছতে পারলো না। মন ঘিরে যে এখন শুধু জোহান। জোহানের বিচরণে মন প্রাঙ্গণ পরিপূর্ণ। অন্যকিছু এখন এই মনে ধারণকৃত হওয়ার নয়। মিতুল যেতে যেতে মনের মাধুরী দিয়ে এই কানাডার বাতাসের সাথে একটি কথাই ছড়িয়ে দিলো নীরবে,
‘ভালোবাসি জোহান, খুব ভালোবাসি!’
_____________
মিতুল যখন বাংলাদেশে পৌঁছলো তখন বাংলাদেশে রাত নয়টা। দীর্ঘ চব্বিশ ঘণ্টার জার্নি ছিল।
ব্যাগপত্র নিয়ে বের হতেই দুই ভাইকে দেখতে পেল। আনন্দে মিতুলের চোখ অশ্রু ভরাট হলো। কতদিন পর দেখা! দূরে দাঁড়িয়েই মিতুল ভাইদের ডেকে উঠলো,
“ব্রো, ভাইয়া!”
তারপর ছুটে আসতে চাইলো ভাইদের কাছে। কিন্তু মাঝপথেই ঘটলো বিপত্তি। ব্যাগপত্রের সাথে একটা পা বেকায়দায় লেগে বেঁকে বসলো। ধপাত করে মিতুল পড়ে গেল ফ্লোরে। ‘আহ্’ করে একটা শব্দ উচ্চারিত হলো ওর মুখ থেকে।
মিতুলের ভাইয়েরা উদ্বিগ্ন হয়ে ছুটে এলো ওর কাছে।
“ঠিক আছিস?”
মিতুল ভাইদের দিকে তাকিয়ে বললো,
“হুম, আই এম ও কে।”
মিতুলের ভাইয়েরা মিতুলকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করলো। না পায়ে তেমন লাগেনি। ঠিকই আছে।
এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে মিতুল বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলো। অনেক দিন পর বাংলাদেশের বাতাস লাগলো গায়ে। প্রিয় স্বদেশ ওর। এই বাংলাদেশের ভূমিতেই তো ওর জন্ম, বেড়ে ওঠা। ওর কত আপন এই বাংলাদেশ। তবুও বাংলাদেশের মাটিতে পা রেখে ওর মনটা কানাডার জন্য কেমন করে উঠলো। ঠিক কানাডার জন্যও নয়, জোহানের জন্য। আবার কবে জোহানের সাথে দেখা হবে ওর? বাংলাদেশের বৃষ্টিতে কবে ভিজবে জোহানের সাথে?
মিতুলকে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মিলান, মানে মিতুলের বড়ো ভাই বললো,
“কিরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? গাড়িতে ওঠ।”
ভাইয়ের কথায় মিতুলের সম্বিৎ ফিরলো। গাড়ির পিছনের আসনে উঠে বসলো। ছোট ভাই নাবিলকে দেওয়া হলো ড্রাইভ করতে। আর পিছনে বসে ওরা দুই ভাই বোন গল্প জুড়ে বসলো। বড়ো ভাইয়ের সাথে মিতুলের একটু বেশি ভাব। ওর বড়ো ভাইটাও প্রায় ওরই মতো।
“কানাডা কেমন দেখলি? রেশমী আন্টির ফ্যামিলি, বাড়িঘর সব কেমন ছিল?”
বড়ো ভাইয়ের প্রশ্নে মিতুল সহজ ভাবে উত্তর দিলো,
“ভালো ছিল সব।”
“শুধু ভালো?”
“না, খুব ভালো।”
“আন্টির ছেলেরা? ওরা কেমন ছিল? একজনের সাথে তো ভিডিয়ো কলে কথা হলো। আরেক জনকে তো দেখিওনি, আর কথাও হয়নি।”
জোহানের কথা আরও গভীর ভাবে মনে পড়ে গেল মিতুলের। বললো,
“ভালো। ওনার ছেলেরা খুব ভালো। কতটা ভালো সেটা প্রকাশ করা কঠিন। একটা বদমাইশও যে এতটা ভালো হতে পারে জানতাম না আমি।” শেষের কথাটা কিছুটা অস্পষ্ট শোনালো। ধরতে পারলো না কেউ। তাই নাবিল প্রশ্ন করলো,
“কী?”
“না, কিছু না।”
পথে আসার সময় আরও অনেক কথা হলো ভাইদের সাথে। কানাডা থেকে তাদের জন্য কী কী এনেছে এসব অনেক কথা বার্তাই হলো। মিতুল ভাইদের জন্য তেমন কিছুই আনেনি। শুধু দুই ভাইয়ের জন্য দুইটা ঘড়ি এনেছে। তবে ঘড়ি দুইটা দামি। এছাড়া রেশমী আন্টি ওর ফ্যামিলির সবার জন্য কেনাকাটা করেছিলেন। সেগুলো আছে।
মিতুলরা থাকে একটা আট তলা বিল্ডিং এর চার নম্বর ফ্ল্যাটে। এই বিল্ডিংটা ওদের নিজেদের। প্রতিটা ফ্ল্যাটই ভাড়া দেওয়া। এই বিল্ডিং থেকেও ভালোই আয় হয় ওদের। ফ্ল্যাটগুলো অনেক বড়ো। রুমের সংখ্যাও বেশি এবং রুমগুলো আকৃতিতেও বড়ো। তাই ভাড়া একটু বেশি। এই বিল্ডিং এ শুধু ফ্যামিলি ভাড়া দেওয়া হয়।
এই বাড়িটা ছাড়াও ওদের আরও দুইটা বাড়ি আছে ঢাকায়।
কলিং বেল চাপতেই মিতুলের মা দরজা খুলে দিলেন।
মিতুল একটু ভালো করে দেখলো মাকে। ফর্সা গোলগাল একটি মুখ। নাকে গোল্ডেন নোজ পিন বসে আছে। পরনে কালো রঙের থ্রি পিস। মিতুলের মনে হলো এই তিন মাসে মা’র একটুও পরিবর্তন হয়নি। ঠিক আগের মতোই আছে। মাকে দেখে মিতুলের আবেগ সব ঠুকরে উঠলো। মিতুল স্থির থাকতে পারলো না, জড়িয়ে ধরলো মাকে। অশ্রু ঝরিয়ে ফেললো চোখ থেকে।
“তোমায় মিস করেছি মা। অনেক বেশি মিস করেছি।”
মাহিরা বেশিক্ষণ মেয়েকে বুকে রাখলেন না, ছাড়িয়ে নিতে নিতে বললেন,
“হয়েছে হয়েছে ছাড়।”
মিতুল সোফায় বসা আব্বুর দিকে তাকিয়ে বললো,
“আসসালামু আলাইকুম আব্বু। কেমন আছো?”
“ওয়ালাইকুমুস সালাম। আলহামদুলিল্লাহ ভালোই। জার্নি নিশ্চয়ই খুব ক্লান্তিকর ছিল। রুমে গিয়ে ফ্রেশ হও আগে। তারপর খাওয়া দাওয়া করে ঘুম দাও।”
মিতুল একটু হেসে বললো,
“ঠিক আছে।”
অশ্রু লেপ্টানো চোখের হাসি মুখটা অদ্ভুত দেখালো মিতুলের। মিতুল হাতের লাগেজটা নিয়ে নিজের রুমের দিকে গেল। ওর রুমটা লিভিং রুম থেকে অদৃশ্যমান।
মিতুলের আরেকটা লাগেজ নাবিল পৌঁছে দিলো রুমে। মিতুল চাইলে ভাইদের হাতেই এই দুটো লাগেজই ছেড়ে দিতে পারতো। নিজের কষ্ট করতে হতো না। কিন্তু ও ছাড়েনি। এটার ভিতরই আছে জোহান এবং ওর সুন্দর একটি মুহূর্তের ক্যামেরা বন্দি ছবি। মিতুল রুমের দরজা আটকে নিজের রুমটায় চোখ বুলালো এ মাথা থেকে ও মাথা। তিন মাস পর নিজের রুমে দাঁড়িয়ে আছে ও। সবকিছুই ঠিক যেমন রেখে গিয়েছিল তেমন আছে। মা যত্ন নিয়েছে ওর রুমটার। মিতুল প্রথমেই লাগেজ খুললো। জামা কাপড়ের নিচ থেকে বের করলো ওর এবং জোহানের ছবিটা। ছবিটা দেখেই হৃদয় কেঁদে উঠলো। চোখের কোল টপকে দু ফোঁটা জল গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো ছবিটার উপর। শক্ত কাচ ভেদ করে অশ্রুটুকু ছুঁতে পারলো না ছবির দেহকে। মিতুল গভীর ভালোবাসায় একটা চুমু খেলো ছবিতে থাকা জোহানকে। ইতোমধ্যেই ভীষণ মিস করছে জোহানকে।
মিতুল ছবিটা কিছুক্ষণ দেখলো। তারপর আবারও ঢুকিয়ে রাখলো লাগেজে। এরপর গিয়ে দাঁড়ালো আয়নার সামনে। চেহারার অবস্থা মোটেই ভালো না। চোখের নিচটা কেমন কালো দেখাচ্ছে। ঠোঁট দুটো শুকনো। চুলের অবস্থা আছে ঠিকঠাক। মিতুলের চোখ গলায় আটকে গেল। হাত বাড়িয়ে জোহানের দেওয়া নেকলেস স্পর্শ করলো। জোহানের বিদায়ের শেষ মুহূর্তটা মনে পড়ছে। মিতুলের চোখে আবারও অশ্রু ভিড় জমালো। কী করে থাকবে ও জোহানকে ছাড়া?
মিতুল প্রথমে চাইলো ফ্রেশ না হয়েই ঘুমিয়ে পড়বে। ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। যেদিন এত দীর্ঘ জার্নি করে কানাডা পৌঁছেছিল, সেদিন এত ক্লান্ত অনুভব হয়নি। কিন্তু আজ দেশে ফিরে হচ্ছে। ক্লান্তি যেন একদম আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে ওকে।
মিতুল শেষমেশ ফ্রেশ না হয়ে ঘুমানোর চিন্তা বাদ দিলো। ওয়াশরুমে ঢুকে হাত, মুখ ধুয়ে নিলো। শুধু হাত, মুখ ধুয়ে শান্তি আসছে না।
মিতুল ঠিক করলো গোসলটা এখনই সেরে নেবে। তাতে ক্লান্তিটাও একটু কমবে, আর ঘুমটাও ভালো হবে।
মিতুল গোসল করে নিলো। ড্রাই মেশিন দিয়ে চুলগুলো শুকিয়ে নেবে, সে ইচ্ছাও হলো না। ভেজা চুল নিয়েই শুয়ে পড়বে ঠিক করলো। এর মাঝেই মায়ের ডাক কানে এলো। খেতে ডাকছে। মিতুলের এখন খাওয়ার ইচ্ছা নেই। ওর ইচ্ছা এখন ঘুমের। মাকে জানান দিলো কথাটা,
“আমি এখন খাবো না মা। পরে খাবো। একটু ঘুমাবো এখন।”
মাহিরা কথা শুনলেন না,
“এখন ঘুমালে তোমার ঘুম কখন ভাঙবে তার কোনো ঠিক নেই। দেখা যাবে রাত একটায় উঠে চোরের মতো খাবার খুঁজে বেড়াবে। এখনই খেতে এসো।”
মা কথাটা ভুল বললেন। ও কি এই বাড়িতে নতুন? খাবার কোথায় রাখা থাকে সেটা তো ও জানেই। চোরের মতো খাবার খুঁজে বেড়ানোর তো কোনো প্রয়োজন নেই। তবুও মিতুল মায়ের কথা অমান্য করতে পারলো না।
“তাড়াতাড়ি এসো।” মাহিরা আরও একবার আসার তাগিদ জানালেন।
মিতুল বাধ্য মেয়ের মতো এলো কিচেনে। কিচেনের এক পাশে ডাইনিং টেবিল। শুধু মিতুলই উপস্থিত। আর কেউ নেই।
“আব্বু, ভাইয়েরা খাবে না?”
“তারা আরও পরে খাবে, তুমি খেয়ে নাও।”
টেবিলে মিতুলের খাবার সাজানো। মিতুল বেসিনে হাত ধুয়ে খেতে বসলো।
এক লোকমা মুখে তুলতেই মনে পড়ে গেল জোহানকে। শেষ দিন জোহানকে খাইয়ে দিয়েছিল। আবার কবে খাইয়ে দেওয়ার সৌভাগ্য হবে?
মাহিরা মিতুলের পাশের চেয়ারটা টেনে বসলেন। জোহানকে ভাবতে গিয়ে মিতুলের খাওয়া থেমে গিয়েছিল। মাকে পাশে বসতে দেখে দ্রুত খেতে লাগলো। খাবারে বিশেষ কিছু না। ভাত, কৈ মাছ ফ্রাই, দেশি মুরগির ঝোল, কলমি শাক, এবং কী একটা ভাজি। দৈনন্দিন খাবারের মতো। মিতুল আশা করেছিল ও আসবে বলে এখানে পোলাও, কোরমা, আরও অনেক কিছু রান্না করে রাখা হবে। কিন্তু সেসব কিছুই পেল না এসে।
“তারপর, কেমন দেখলে তোমার রেশমী আন্টিকে?”
মায়ের প্রশ্ন শুনে মিতুল একটু থমকালো। মায়ের প্রশ্নটা একটু গরমিল লাগছে ওর কাছে। মা কি প্রশ্ন করতে ভুল করেছেন? ও তো কানাডা ভ্রমণ শেষে বাংলাদেশ ফিরলো, সুতরাং মায়ের প্রশ্নটা তো এমন হওয়া উচিত ছিল,
‘তারপর, কেমন দেখলে কানাডা?’
তা না করে এটা কেমন প্রশ্ন করলেন?
হবে হয়তো একটু মিসটেক হয়ে গেছে মায়ের। মিতুল বললো,
“হ্যাঁ, ভালো। রেশমী আন্টি খুব ভালো একজন মানুষ। শুধু…”
মিতুল বলতে গিয়েও থামলো। রেশমী আন্টি যে জোহানের প্রতি উদাসীন, সেটা কি মায়ের কাছে বলা ঠিক হবে?
“থেমে গেলে কেন? শুধু কী?”
মিতুল থতমত খেয়ে গেল। কী বলবে? মিতুল ভাবতে ভাবতেই বলে ফেললো,
“তেমন কিছু না। শুধু ওনারা একটু বেশি ধনী।”
মাহিরা হেসে ফেললেন। তার মেয়েটা বরাবরই এরকম।
“ধনী তো কী হয়েছে? তোমার কি থাকতে কোনো সমস্যা হয়েছে?”
মিতুল না বোধক মাথা নাড়লো।
মাহিরা বললেন,
“রেশমি ভালো সেটা তো বুঝলাম। কিন্তু ওর ছেলেরা? ছেলেরা কেমন?”
“ভালো।”
“দুজনই ভালো? শুনেছি, ওর ছোট ছেলেটা না কি ওর কোনো কথা শোনে না, কাজ বাজ কিছু করে না, সারা দিন টইটই করে ঘুরে বেড়ায়, আবার মদও না কি খায়?”
মা গলাটা কেমন করে যেন বললেন কথাগুলো।
মিতুলের একটুও ভালো লাগলো না। বেশ গায়ে লাগলো জোহানের সম্পর্কে এমন কথা শুনতে। মিতুল কাঠ গলায় জিজ্ঞেস করলো,
“কে বলেছে তোমাকে এসব?”
“রেশমী নিজেই তো বললো। একদিন ওর ছেলেদের নিয়ে কথা হচ্ছিল। তখন বললো, ওর বড়ো ছেলের ধারে কাছেও নেই ওর ছোট ছেলেটা। মোটেই কথা শোনে না। নিজের ইচ্ছা মতো চলে। রেশমী তো বেশ চিন্তায় আছে ওর ছোট ছেলেকে নিয়ে।”
“তাই না কি? আমি নিজে এরকম কিছু কখনো দেখিনি। তার ছোট ছেলেকেও বেশ ভালোই দেখেছি। তার কথা শোনে না এমন তো কিছু দেখলাম না। রেশমী আন্টি তো আমাকে প্রথম তার ছোট ছেলের সাথেই ঘুরতে পাঠিয়েছিল। রেশমী আন্টি যখন তার ছোট ছেলেকে বলেছিল আমাকে বাইরে ঘুরতে নিয়ে যেতে, তখন তো তার ছোট ছেলে বিনা কথাতেই রাজি হয়ে গিয়েছিল। যদি কথাই না শুনতো, তাহলে এভাবে মেনে নিতো মায়ের কথা? আর কাজ বাজ! ও অবশ্যই কাজ করে। ও একজন সিঙ্গার। গান করে। ওর এ্যালবামও বের হয়েছে। খুব শীঘ্রই একটা গ্রুপের সাথেও এড হয়ে যাবে।”
“আর মদ?”
মিতুল এই কথায় একটু দমে গেল। তবে থেমে গেল না। বললো,
“হ্যাঁ, আগে মাঝে মধ্যে একটু আধটু মদ খেতো। যখন প্রথম গিয়েছিলাম সে সময় দেখেছিলাম এক দুই বার খেতে। তবে এখন আর খায় না। মদ ছুঁয়েও দেখে না।”
“ওহ, বেশ! বুঝলাম। রেশমীর বড়ো ছেলের কথা বলো এখন। কেমন দেখলে বড়ো ছেলেকে?”
মিতুলের মাথায় জায়িনের সম্পর্কে বলার জন্য ‘অহংকারী’ শব্দটা ছাড়া আর কিছু আসছে না। কিন্তু এটা তো আর মাকে বলা যায় না। বাংলাদেশ ফিরেই যদি বদনাম শুরু করে দেয়, সেটা কি ভালো দেখায়? মিতুল বললো,
“খারাপ না। বড়ো চাকরি করে। অনেক ডলার কামায়। ভালোই।”
“দেখতে শুনতে?”
“দেখতে শুনতেও ভালো। ফর্সা, চেহারা ভালো, লম্বা। ছেলেদের তো আবার লম্বা হওয়াটা বিশাল বড়ো প্লাস পয়েন্ট। ওরা দুই ভাই-ই খুব লম্বা। একই হাইট।”
“ও, তাহলে তো বেশ ভালোই। শুনেছি বড়োটা খুবই ভদ্র। মায়ের কথা খুব মেনে চলে। মা যা বলে তাই শোনে। খুবই ভালো ছেলে।”
মিতুলের ভালো লাগছে না জায়িনের কথা শুনতে। রেশমী আন্টি বড়ো ছেলের এত সুনাম গাইলো, আর ছোট ছেলের কি না দুর্নাম! বড়ো ছেলের সম্পর্কে যে সুনাম গাইলো, তাও তো ভুল। জায়িন না কি ভদ্র! ভদ্র না ছাই! একটা অহংকারী কী করে ভদ্র হয়? ভদ্র মুখোশধারী শয়তান হতে পারে।
মিতুল খাওয়া দাওয়া শেষে বিছানায় এসে গা এলিয়ে দিলো। শান্তির সাগরে ডুবে গেল যেন। কতদিন পর আবার নিজের বিছানায় শুয়েছে!
এই বালিশ, বিছানার চাদর, এই রুম সবই ওর নিজস্ব আপন। তবে তিন মাসের জন্য রেশমী আন্টির বাড়ির ওই রুমটাও ওর কম আপন ছিল না। মনে হচ্ছিল ওটা যেন ওর নিজেরই রুম। অনেক বছর থেকেছে ওই রুমে। মিতুল বিভিন্ন টুকিটাকি ভাবনায় ডুবে গেল।
হঠাৎ একসময় মনে পড়লো, ও বাংলাদেশ পৌঁছে গেছে সেটা জোহানকে জানানো হয়নি। জোহান জানাতে বলেছিল ওকে।
মিতুল দ্রুত শোয়া থেকে উঠে গেল। ব্যাগ কোথায় ওর? ব্যাগ ওয়ার্ডোবের উপর। মিতুল দৌঁড়ে গেল ওয়ার্ডোবের দিকে। ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে বিছানায় ফেরত এলো।
জোহানকে কীভাবে জানাবে সেটা নিয়ে একটু দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। ম্যাসেজ দিয়ে জানাবে? না কি কল দিয়ে? না না কল দিয়ে জানাতে পারবে না। জোহানের সাথে কিছুতেই ফোনে কথা বলা সম্ভব নয় এখন। গলা কাঁপবে, বুক কাঁপবে! পারবে না। মিতুল ছোট করে একটা ম্যাসেজ দিলো,
‘আমি বাংলাদেশ পৌঁছে গেছি।’
এর বেশি আর কিছুই লিখতে পারলো না। হাতও কাঁপলো। মিতুলের হঠাৎ এমন লাগছে কেন জানে না। কেমন একটা সংকোচ বোধ হচ্ছে। জোহানের থেকে দূরে চলে এসেছে বলে এমন হচ্ছে?
ম্যাসেজটা পাঠানোর একটু পরই হঠাৎ কল এলো। জোহানের নামটা দেখে মিতুলের ভিতরটা নড়ে উঠলো। হৃদস্পন্দন বেড়ে যেতে লাগলো। মিতুল ঘেমে যেতে লাগলো। হঠাৎ অনুভব করলো ওর খুব গরম লাগছে। এসির রিমোটটা বিছানার পাশে সাইড টেবিলে। গিয়ে যে রিমোটটা এনে এসি চালু করবে সেটাও পারছে না। এখান থেকে এখন একদমই নড়তে ইচ্ছা করছে না।
প্রথম কলটা রিং হতে হতে কেটে গেল। সঙ্গে সঙ্গে আবারও একবার কল এলো। মিতুলের মন জোহানের সাথে কথা বলতে চাইছে, কিন্তু ঠিক পেরে উঠছে না। হাতে যেন এই মুহূর্তে কল রিসিভ করার শক্তিটুকু নেই। গলায়ও শক্তি নেই যে জোহান কিছু জিজ্ঞেস করলে উত্তর দেবে। কী করবে? এবারের কলটাও রিং হতে হতে কেটে গেল। মিতুল আর সত্যিই এভাবে বসে থাকতে পারছে না। সাইড টেবিল থেকে এসির রিমোট এনে এসি চালু করলো। ধীরে ধীরে রুমটা ঠান্ডা হয়ে উঠলো। মিতুলের মনে হলো ওর ভিতরটাও একটু শান্ত হচ্ছে। মোবাইলে ম্যাসেজ আসার শব্দ হলো। মিতুল মোবাইলটা হাতে তুলে নিলো। ম্যাসেজ সিন করলো,
‘হেই তুলতুল, হোয়াট’স ইওর প্রবলেম? হোয়াই আরন’ট ইউ রিসিভিং মাই কল?’
ম্যাসেজটা সিন করেও মিতুল বিপাকে পড়লো। এবার কী উত্তর দেবে? যদি কোনো উত্তর না দেয় জোহান কী ভাববে? চিন্তা করবে না?
মিতুল টাইপিং করতে লাগলো,
‘কিছু না। আসলে এমনিই…’
মিতুল এইটুকু লেখার মাঝেই আবারও জোহানের ম্যাসেজ এলো,
‘আমি এখনই ভিডিয়ো কল দেবো। রিসিভ করবে।’
ম্যাসেজটা পাঠিয়েই জোহান ভিডিয়ো কল দিলো।
মিতুলের দিশেহারা লাগছে। কী করবে? মিতুল কলটা রিসিভ করলো। তবে মোবাইল ফিরিয়ে রাখলো অন্যদিকে।
জোহান মিতুলকে না দেখে বললো,
“হেই, হোয়্যার আর ইউ? আই ক্যানন’ট সি ইউ। হোয়্যার আর ইউ হাইডিং? শো মি ইওর ফেস। হেই তুলতুল…”
মিতুল এবার আর নিজের মুখ না দেখিয়ে পারলো না। নিজের চেহারা সামনে আনলো। জোহান মুখে প্রশস্ত হাসি ফুঁটিয়ে বললো,
“এই তো তুমি। এতক্ষণ কোথায় লুকিয়ে ছিলে? হুহ্? কোথায়?” শেষের দিকে জোহান ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্ন করে।
মিতুলের ইতস্তত বোধ হচ্ছে। বললো,
“লুকাবো কেন? আমি তো এখানেই ছিলাম।”
“আমি তো দেখতে পাইনি তোমায়? এটা কি আমার চোখের ভুল? না কি তুমি কোনো ম্যাজিক জানো? ম্যাজিকের মাধ্যমে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিলে?”
মিতুল ভীষণ লজ্জা পাচ্ছে। জোহানের কাছে তা ধরা দিলো না। জিজ্ঞেস করলো,
“কোথায় আছো তুমি?”
“দেখবে কোথায় আছি? দাঁড়াও দেখাচ্ছি।” জোহান ব্যাক ক্যামেরায় আশপাশ ঘুরিয়ে দেখালো মিতুলকে। মিতুল কয়েকজন ছেলে এবং বাদ্যযন্ত্র ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেল না। জোহান ক্যামেরা আবার নিজের দিকে ফিরিয়ে বললো,
“রিহার্সেল চলছিল এতক্ষণ। এইমাত্র ব্রেক নেওয়া হলো।”
“ও। কনসার্ট কবে?”
“দু দিন পর। কী করছো তুমি?”
জোহানের সাথে কথা বলতে মিতুলের কেমন যেন লাগছে। স্বাভাবিক থাকতে পারছে না ঠিক। বললো,
“রুমে বসে আছি।”
“রুমে আছো? তোমার রুমটা দেখাও তো।”
মিতুল একটু হকচকিয়ে গেল।
“রুম কেন দেখাবো?”
“দেখতে চেয়েছি বলে।”
মিতুল আর কথা না বাড়িয়ে রুমটা দেখালো।
জোহান বললো,
“বাহ মিতুল, তুমি তো দেখছি খুব গোছানো স্বভাবের।”
মিতুল একটু থমকে গেল। অপমানও বোধও করলো যেন একটু।
“গোছানো স্বভাবের মানে? আমাকে আগে কি তোমার অগোছালো স্বভাবের মনে হতো?”
“আমি সেটা বলিনি।”
“তাহলে কী বলেছো? আমি শিওর তুমি এটাই বুঝিয়েছো।”
“উহ! এটা বোঝাইনি আমি।”
মিতুল মনে মনে এটা মেনে নিতে পারছে না। তবুও আর কিছু বললো না।
জোহান বললো,
“একটা জিনিস দেখাবো তোমায়।”
“কী জিনিস?”
জোহান হঠাৎ সামনে একটা ফুল ধরে বললো,
“টা-ডা…”
“এটা কী?”
“ফুল। একটা মেয়ে দিয়েছে।”
মিতুলের কান দাঁড়িয়ে গেল।
“কে দিয়েছে?”
“একটা মেয়ে।” স্বাভাবিক কণ্ঠ জোহানের।
মিতুলের ভিতরটা রাগে ফুঁসে উঠছে।
“একটা মেয়ে ফুল দিলো, আর তুমি নিয়ে নিলে? কোন মেয়ে? কী নাম? কোথায় বসে দিলো তোমাকে ফুল? তুমি কেন নিলে? তুমি না ফুল অপছন্দ করো? তাহলে কেন নিলে তুমি ফুল?”
“আমি ফুল অপছন্দ করি সেটা তো বলিনি। আমি বলেছি ফুল আমার প্রিয় নয়। তাই বলে অপছন্দ করি সেটা তো নয়। আর ফুলটা আমি নিয়েছি শুধু তোমাকে দেখানোর জন্য।”
“আমাকে দেখানোর জন্য কেন? আমি কি জীবনে ফুল দেখিনি? আমার ব্যালকনিতেও বিভিন্ন ধরণের ফুল আছে।”
“তাই?”
“হ্যাঁ।”
“কী কী ফুল আছে?”
“তোমাকে বলতে হবে?”
“বলবে না?”
“না।”
“ঠিক আছে। রাজশাহী কবে যাচ্ছ তুমি?”
“কম হলেও দশ দিন তো থাকবোই এখানে।”
“ও, শোনো…”
“কী?”
“টরন্টো পা রাখা অবধি এ যাবৎ দশটা মেয়ে প্রোপোজ করেছে আমায়। সব মেয়েগুলোই সুন্দর, লম্বা। আর…”
জোহানের বলার মাঝেই মিতুল কল কেটে দিলো। জোহান কী বলছে এসব? ওকে নিজের প্রোপোজ কাহিনী শোনাচ্ছে? বদমাইশ!
মোবাইলে ম্যাসেজ আসার শব্দ হলো। মিতুল ঘট করে মোবাইলটা বিছানা থেকে তুলে নিলো।
‘হেই মিতুল, কী হলো তোমার? কল কেটে দিলে কেন? আমার কথা শুনে গায়ে লাগলো? না কি হৃদয়ে?’
আবার আরেকটা ম্যাসেজ পাঠালো জোহান।
‘আমি তো জাস্ট মজা করেছি তোমার সাথে। কোনো প্রোপোজ পাইনি আমি। আর এই ফুলটা একজন শুভাকাঙ্ক্ষী দিয়েছে আমাকে। যে আমার গান শোনে।’
একটু পর আবার ম্যাসেজ এলো জোহানের,
‘বাই দ্য ওয়ে, মন কি একটু ভালো হলো তোমার? এই যে মজা করলাম তোমার সাথে, মন তো একটু ভালো হওয়া উচিত। হলো?’
মিতুলের ভিতরটা আবেগী হয়ে উঠলো। জোহানটা সত্যিই পাগল! ঠিক বুঝে ওঠা যায় না ওকে।
এই ম্যাসেজটা পাঠানোর পর পরই আরেকটা ম্যাসেজ পাঠালো,
‘শেষ সময়ে একটা জিনিস দেবো তোমায়।’
মিতুল জোহানের এই ম্যাসেজটা দেখে একটু অবাক হলো। কী দেবে জোহান? কীভাবে দেবে?
একটু পরই একটা ভিডিয়ো এলো।
মিতুল প্লে করতেই দেখতে পেল, জোহান হাত দিয়ে লাভের আকৃতি করে বলছে,
“লাভ ইউ!”
এতটুকুই ভিডিয়োটা।
মিতুলের মনটা সত্যিই ভালো হয়ে গেল ভিডিয়োটা দেখে। একবার একবার করে দশবার দেখলো। এখনও দেখা বাকি।
(চলবে)