#হাতটা_রেখো_বাড়িয়ে
#পর্ব-৩৬
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি
প্রায় দুই তিন ঘন্টা পর ধারার ঘুম ভাঙে। চোখ খুলে হাসপাতালের সিলিং চোখে পড়তেই প্রথমে ঠাওর করতে পারে না সে আসলে কোথায়? সারাদিন পেটে কিছু পড়েনি। শরীর ভীষণ ক্লান্ত। তার উপর বেশ কয়েক জায়গায় আঘাতের যন্ত্রণা। তবুও দীর্ঘ এক ঘুমের ফলে এখন শরীর একটু ভালো। সিলিং থেকে চোখ সরিয়ে পাশে নিতেই হাসপাতালের বেডের স্ট্যান্ডে ঝুলে থাকা এক পরিত্যক্ত স্যালাইনের নল দেখেই ধারার পূর্বের সকল কথা মনে পড়ে যায়। ক্ষণবিলম্ব না করেই সে গায়ের থেকে সাদা চাদর সরিয়ে অস্ফুট স্বরে শুদ্ধ বলে ডেকে উঠে দ্রুত বেগে শুদ্ধ’র কেবিনে যায়। একটা ঝড়ো হাওয়ার ন্যায় দরজাটা খুলতেই শুদ্ধ’র দু চোখ আস্তে করে ধারার দিকে যায়। ধারা যেন হঠাৎ থমকে যায়। এতক্ষণের ঘূর্ণিপাকের মতো উদ্বেলিত হওয়া তার সমস্ত অস্থিরতার বহিঃপ্রকাশ যেন এক নিমিষেই বন্ধ হয়ে যায়। ঠিক যেমন প্রকৃতির এক ভয়াল ঘূর্ণিঝড়ের পরে সমুদ্র যেভাবে শান্ত হয়। মিনিট খানেকের মতো ধারা কিছু বলতে পারে না। নড়তেও পারে না। শুধু ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় তাকিয়ে থাকে তার প্রাণের সঞ্চার, প্রশান্তির আধার, জীবনের স্বস্তিদায়ক সেই দৃষ্টিযুগলের দিকে। পৃথিবী যেন হঠাৎ করেই থমকে যায় তার কাছে। আর অন্য কিছু তার দৃষ্টিতে আসে না। আসে শুধু একটা দরজা, হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে থাকা তার ভালোবাসা আর তাদের মধ্যকার ক্ষুদ্র দূরত্ব। ধারা অপলক তাকিয়ে থেকে বশীকরণের মতো আস্তে আস্তে এগোতে থাকে। ধারাকে দেখে শুদ্ধ তার বা হাতের কাঁপা কাঁপা আঙ্গুলগুলো বিছানা থেকে আস্তে আস্তে তোলার চেষ্টা করে। শুদ্ধ’র বেডের কাছে এসে নিজের হাতটা আস্তে আস্তে শুদ্ধ’র আলতো উঁচু করে দেওয়া হাতের নিচে রেখে আঁকড়ে ধরে ধারা। তারপরই হঠাৎ মেঝেতে বসে পড়ে। শুদ্ধ’র আঁকড়ে ধরা হাতটায় একটা চুমু দিয়ে নিজের মুখের কাছে নিয়ে কেঁদে উঠে ধারা। মৃত্যু থেকে বেঁচে ফেরা স্বামীর হাত ধরে তার শব্দহীন কান্না সেখানে উপস্থিত সকলের মন ছুঁয়ে দেয়। অন ডিউটিতে থাকা হেড ডক্টর চশমা খুলে নিজের চোখ মুছে। নার্সেরাও আবেগ্লাপুত হয়। কখন যেন অজান্তেই মনে প্রাণে তারাও চাইছিলো মেয়েটি তার স্বামী ফিরে পাক। এখন যখন তা পূর্ণ হলো তখন মেয়েটির সাথে সাথে তারাও একধরনের প্রশান্তি খুঁজে পায়৷ মাথায় হাতে ব্যান্ডেজ পেঁচানো শুদ্ধ ধারাকে মাথা নাড়িয়ে নিষেধ করে কাঁদার। তার অবস্থা এখন একটু ভালো। আউট অফ ডেঞ্জার। সেই ঘন্টাখানেক আগে যখন তার জ্ঞান ফিরেছিলো তখন থেকেই ধারাকে খুঁজে চলছিলো সে৷ এখন যখন সেই কাঙ্খিত মুহুর্তটি এলো তখন ধারার সাথে সেও খানিক আবেগ্লাপুত হয়ে পড়লো। শুদ্ধ’র বারণ শুনে ধারা ঝটপট চোখের পানি মুছে মুখে হাসি টেনে উঠে দাঁড়ালো। তার শুদ্ধ বেঁচে ফিরেছে। সে আর কাঁদবে কেন? শুদ্ধ শোওয়া থেকে বসার চেষ্টা করলো। কষ্ট হলো, পারলো না। ডাক্তার নিষেধ করলো। কিন্তু শুদ্ধ শুনলো না। খোদেজা শুদ্ধকে ধরে পেছনে বালিশ দিয়ে বসার জন্য সাহায্য করতে চাইলো। হঠাৎ শুদ্ধ কেমন আতঙ্কগ্রস্ত স্বরে বলে উঠলো,
‘একি! আমি আমার পা নাড়াতে পারছি না কেন?’
একরাশ বিস্ময় নিয়ে ডাক্তারের দিকে তাকালো ধারা। ডাক্তার কেমন যেন ইতস্তত করে সঙ্গে সঙ্গেই ফিচেল হেসে উঠে বলল,
‘আরে ও তেমন কিছু না। ছোটখাটো মাইনর ইনজুরি। তোমার এতো বড় একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে! এখনই তো তুমি হাঁটতে পারবে না। হাত পা নাড়াতে একটু তো সমস্যা হবেই। তুমি টেনশন নিয়ো না। কিছুদিন গেলেই ঠিক হয়ে যাবে।’
ডাক্তারের কথায় শুদ্ধ খানিক আশ্বস্ত হলো। আশ্বস্ত হলো ধারাও। কিন্তু এরপরই ডাক্তার তাকে একা ডেকে যা বলল তা পুরোই স্তম্ভিত করে রেখে দিলো তাকে।
__________________________________________
হাসপাতালে পনেরো দিন কাটানোর পর শুদ্ধ বাড়িতে ফিরে আসলো, হুইল চেয়ারে। ধারা হুইলচেয়ারে শুদ্ধকে টেনে রুমে নিয়ে এলো। হাত দিয়ে ধরে উঠিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলো তাকে। শুদ্ধ কিছুই বললো না। কেমন যেন বিষন্ন হয়ে রইলো। ধারা মুখে হাসি টেনে বলল,
‘খাবে কিছু? তোমার জন্য স্যুপ বানিয়ে নিয়ে আসি?’
শুদ্ধ আস্তে করে মাথা নেড়ে না করলো। ধারার মধ্যে মন খারাপের ছায়া নেমে আসতে চাইলেও সে তাতে গা করলো না। আবারও হাসি টেনে রুমের পর্দাগুলো আরেকটু সরিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘আজকে আবহাওয়া খুব সুন্দর তাই না! দেখো, আকাশটা কতো সুন্দর লাগছে।’
শুদ্ধ আস্তে করে বলল, ‘আমি হাঁটতে পারবো কবে ধারা?’
ধারার হাত থেমে গেলো। নিজেকে সামলিয়ে ধারা প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বলল, ‘কটা দিন একটু রেস্ট নিতেই হাঁপিয়ে উঠছো! তুমিও না! আমি তোমার জন্য জুস নিয়ে আসছি।’
ধারা দ্রুত সেখান থেকে চলে যেতে লাগলো। আস্তে করে একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো শুদ্ধ। সেই দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শুনে ধারা দরজা মুখে দাঁড়িয়ে পড়লো। তার মুখে মেঘের ছায়া নেমে আসলো। ধারার মনে পড়ে গেলো সেদিন ডাক্তার তাকে নিজের চেম্বারে ডেকে কি বলেছিল,
‘শুদ্ধ’র পা নাড়াতে না পারা কোন মাইনর ইনজুরির কারণে না। শুদ্ধ সামনে ছিল বলে তখন মিথ্যা বলতে হয়েছে। এক্সিডেন্টের কারণে ও’র মস্তিষ্কে আঘাতের ফলে মস্তিষ্ক থেকে নার্ভে সংকেত প্রেরণে বাঁধা সৃষ্টি হচ্ছে। যার ফলে আশঙ্কা করা হচ্ছে ও’র দুই পায়ের নিচের অংশ সম্ভবত প্যারালাইজড হয়ে গেছে৷ তবে এটা চিরস্থায়ী নাকি সাময়িক সেটা ও’র রিপোর্ট দেখে এখনই বলা যাচ্ছে না। যদি সাময়িক সময়ের জন্যও হয়ে থাকে তবুও সেটা ঠিক হতে অনেক সময়ের প্রয়োজন হবে। যার ফলে শুদ্ধ হাঁটতে পারবে না। সময় লাগবে। চিকিৎসা নিতে হবে। ভেঙে পড়া যাবে না। কিন্তু এই সময় টায় বেশিরভাগ পেশেন্টই ভেঙে পড়ে। প্যারালাইসিসের কারণে তাদের স্বাভাবিক জীবন যাপনে ব্যাঘাত ঘটে। তারা হাঁটতে পারে না। যার ফলে পেশেন্ট মানসিক ভাবে খুব বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। যেহেতু আবারো স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা যাবে কিনা সেটা আগের থেকেই গ্যারান্টি দিয়ে বলা সম্ভব না তাই তারা খুব হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ভেবেই নেয় যে তারা আর কোনদিন হাঁটতে পারবে না। জীবনের প্রতি বিস্বাদ ভাব এসে পড়ে। মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। এবং অনেকের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতাও বেড়ে যায়। তাই এই সময় পেশেন্টকে অবশ্যই প্রচুর মানসিক সাপোর্ট আর যত্নে রাখতে হয়। হাল না ছেড়ে দিতে উৎসাহিত করতে হয়। চিকিৎসা বিজ্ঞান এখন অনেক উন্নত। এর উপর ফিজিওথেরাপির ব্যবস্থাও আছে। আমরা ভালো কিছুর আশা রাখতে পারি৷ কিন্তু তার আগে পেশেন্টের নিজের মনোবল থাকা অনেক প্রয়োজন। তার নিজের চেষ্টা আর মনের জোরই তাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে পারে। মানসিক শক্তি ছাড়া এই অসুস্থতা কাটিয়ে উঠা বেশ কঠিন।
পেশেন্ট যদি হাল ছেড়ে দেয় তবে এই কেসে ট্রিটমেন্টও আর কোন কাজে আসে না।’
ডাক্তারের কথা মনে করে ধারা আরেকবার পেছনে ফিরে শুদ্ধ’র দিকে তাকায়। দেখে শুদ্ধ নিরব হয়ে মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে। ধারার বুক চিড়েও একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে।
একে একে শুদ্ধ’র দিনগুলো হুইলচেয়ারেই কাটতে থাকে। কাজের চাপে আটকে থাকা শুদ্ধ’র এখন অবসরের অবকাশ নেই। সারাটা দিন বসে থাকা ছাড়া আর কিছুই করার নেই তার। আর কিই বা সে করবে! সামান্য হুইলচেয়ারে বসতে হলেও তার অন্যের সাহায্য লাগে। এমনকি এখান থেকে ওখানে যেতে হলেও ডাকতে হয় অন্যদের। সাহায্য নিতে হয় হুইলচেয়ারের। পা দুটো তো প্রায় অচল। সবকিছু হুট করেই কেমন যেন পাল্টে যায়। নিজের পায়ে হাঁটতে না পারায় সে না ফ্যাক্টরিতে যেতে পারে আর না তার ফলের খামারে। সব কাজে শ্লথ তৈরি হয়। হতে থাকে ক্ষতি। এই তো সবেই পরিপূর্ণ সাফল্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল সে। একের পর এক সুযোগ এসে ধরা দিচ্ছিল তাকে। যা সে যথাযথ কাজেও লাগাচ্ছিল। কিন্তু এই উঠতি সাফল্যের মাঝেই হঠাৎ এই দূর্ঘটনা নেমে এসে জীবনটাকে যেন নিচের দিকে টেনে ধরলো। সবকিছু থেমে গেলো। শুদ্ধ’র কিছু করার থাকে না। শুধু সারাক্ষণ বিষন্ন মনে বিছানায় হেলান দিয়ে বসে থাকে। কখনো কখনো হুইলচেয়ার টেনে জানালার কাছে গিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার মুখে এখন আর সেই নজরকাড়া টোল পড়া হাসি দেখা যায় না। আগের মতো তার মুখে আর সেই দুষ্টুমির ঝিলিক খেলা করে না। সবকিছুই নিরব, নির্লিপ্ত। শুদ্ধকে এই অবস্থায় দেখে সবথেকে বেশি যন্ত্রণায় ভোগে ধারা। যেই শুদ্ধ সবসময় নিজের কাজে মশগুল থাকতো, সবসময় কিছু না কিছু নতুন করার চেষ্টায় থাকতো আজ সেই উদ্যমি, পরিশ্রমী শুদ্ধ উদাস হয়ে বসে আছে হুইলচেয়ারে। যার মুখের প্রতিটি শব্দই এক আকাশ অনুপ্রেরণা বহন করতো আজ সেই হয়ে আছে হতাশায় বিবর্জিত। এই দৃশ্য ধারার জন্য যে ঠিক কতোটা অসহনীয় তা শুধু উপরওয়ালাই জানেন। তবুও সে নিজেকে সামলে সবকিছু স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু আগের মতো সবকিছু আর তেমন সহজ হয় না। আর না আগের মতো থাকে তাদের সম্পর্ক। শুদ্ধ’র মেজজ আজকাল কেমন যেন খিটখিটে হয়ে গেছে। হয় বেশি কথাই বলে না, মনমরা হয়ে থাকে। নয়তো অল্পতেই রেগে যায়। পায়ের ব্যায়ামও করতে চায় না। চেষ্টা ছেড়ে দেয়। নিজেকে অন্যের উপর বোঝা মনে করে। কষ্ট পায়। মন খারাপ করে। জীবনটাই যেন বিস্বাদ বোধ হয় তার।
__________________________________________
অন্যদিনের মতোই সকালের পরে জানালার কাছে হুইলচেয়ারে বসে ছিল শুদ্ধ। দৃষ্টি আকাশের দিকে নিবদ্ধ। সেই দৃষ্টিতে কোন আশা নেই, স্বপ্ন নেই। আছে শুধু হতাশা। ধারা দরজা ঠেলে সেই সময় ভেতরে প্রবেশ করে। রুমে কারো প্রবেশের শব্দে শুদ্ধ খানিক হকচকিয়ে গিয়ে নিজেকে সামলে নেয়। ধারা এসে শুদ্ধ’র দিকে তাকিয়ে একবার মিষ্টি করে হেসে বিছানার উপর পরে থাকা শুদ্ধ’র কাপড় চোপড় গোছাতে থাকে। বালিশের দিকে চোখ যেতেই হঠাৎ ধারার গতকাল রাতের কথা মনে পড়ে। রাতের অন্ধকারে দৃষ্টি আড়াল করে শুদ্ধ কিভাবে তাকে বলেছিল, তার মতো অচলকে ছেড়ে দিয়ে ধারাকে নতুন করে জীবন শুরু করতে। শুধু কি গতকালই! এর আগেও তো শুদ্ধ কতবার কতো ভাবে ধারাকে এই কথাগুলো বলেছে। প্রতিবারের মতোই ধারা বিরক্ত হয়েছে। কখনো কখনো এড়িয়ে গেছে। ধারার ভাবনায় ছেদ ঘটে বাইরে থেকে ভেসে আসা আওয়াজে। শুদ্ধ জানালা দিয়ে সেদিকটায় তাকিয়ে বলে,
‘এমন শব্দ কিসের?’
ধারা স্মিত হেসে বলল, ‘আমাদের বিল্ডিংয়ের পাশে বাচ্চাদের খেলার ছোটখাট একটা পার্ক তৈরি হচ্ছে। বিকেলে তোমাকে নিয়ে সেখানে যাবো কেমন? ঘুরে দেখো ভালো লাগবে।’
‘আমি গিয়ে কি করবো? হাঁটতে তো আর পারবো না!’
ধারা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। কি বলবে খুঁজে পায় না। প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য কিছু বলতে শুদ্ধ’র দিকে তাকাতেই দেখে শুদ্ধ হুইল ঘুরিয়ে কোথায় যেন যাচ্ছে। ধারা জিজ্ঞেস করলো,
‘কোথায় যাচ্ছো?’
শুদ্ধ বলল, ‘গরম লাগছে। গোসল করবো।’
‘আচ্ছা আমি এই কাপড়গুলো ভাঁজ করেই তোমাকে করিয়ে দিচ্ছি।’
শুদ্ধ বাথরুমের দিকে এগোতে এগোতে নির্লিপ্ত স্বরে বলল, ‘আমি পারবো।’
আস্তে করে পেছনে ঘুরে গেলো ধারা। চোখের পানি আটকানোর প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগলো। কারণ যতোটা সে জানে ততোটা শুদ্ধও জানে সে একা পারবে না।
দুপুরের পর খোদেজা চুমকিকে নিয়ে রূপনগরে গেলো। পরদিন সকালেই চলে আসবে। রান্নাঘরের ময়লার ঝুড়ি পুরো ভরে গেছে। বাসায় আর কেউ না থাকায় ধারাকেই সেটা ফেলতে নিচে যেতে হলো। শুদ্ধ ছিল তখন ঘুমিয়ে। হঠাৎ প্রস্রাবের বেগ আসায় তার ঘুম ভেঙে গেলো। সে ধারার নাম ধরে ডেকে উঠলো। কোন সাড়া পেলো না। এদিকে তার যাওয়া প্রয়োজন। সে বারবার একে একে ধারা, খোদেজার নাম ধরে জোরে জোরে ডাকতে লাগলো। কিন্তু কেউ এগিয়ে এলো না। বেগ বৃদ্ধি পেলে শুদ্ধ নিজে নিজেই বিছানা ছেড়ে উঠার চেষ্টা করলো। খুব কষ্ট হলো। প্রথম চেষ্টাতেই পারলো না। খুব কষ্টে বিছানার ধারে রাখা হুইলচেয়ারটি হাত দিয়ে টেনে নিয়ে নিজের পা টেনে টেনে বসার চেষ্টা করলো। পারলো না। হঠাৎ হুইলচেয়ার নিয়েই বিছানা ছেড়ে মুখ থুবড়ে মেঝেতে পড়ে গেলো। খালি মেঝে থেকে উঠার জন্য শুদ্ধ পাগলের মতো চেষ্টা করতে লাগলো। কিন্তু কারো সাহায্য ব্যতিত পারলো না। শুদ্ধ’র চোখ ফেটে জল বেরোতে লাগলো। নিজের অসহায়ত্বে চিৎকার করতে লাগলো সে। ততক্ষণে বাসায় ফিরে সেই চিৎকার শুনে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে রুমে ছুটে আসলো ধারা। শুদ্ধকে মেঝেতে এভাবে পড়ে থাকতে দেখে আতঙ্কিত হয়ে তাকে তাড়াতাড়ি তুলতে নিলো। শুদ্ধ কোনমতে শুধু বলল,
‘আমাকে তাড়াতাড়ি বাথরুমে নিয়ে চলো।’
শুদ্ধকে নিজের কাঁধে আশ্রয় দিয়ে দ্রুত শুদ্ধকে বাথরুমে নিয়ে গেলো ধারা। কিন্তু ততক্ষণে অনেকটা দেরি হয়ে গেলো।
__________________________________________
এই ঘটনাটা শুদ্ধ’র মনে গভীর দাগ কাটলো। তারপর থেকে আর ভালো মন্দ একটি কথাও বলেনি সে। পুরোটা সময় থম মেরে হুইলচেয়ারে একা একা বসে রইলো রুমে। একদম মূর্তির মতো স্তব্ধ। শুদ্ধ’র যাতে আর অপ্রস্তুত বোধ না হয় তাই ধারাও আর ইচ্ছে করে তার সামনে এলো না। ধীরে ধীরে রাত গভীর হলো। শুদ্ধ’র অবস্থানের কোন পরিবর্তন হলো না। একনাগাড়ে অন্যমনষ্ক দৃষ্টি ভেঙে হঠাৎ তার চোখ পড়লো সামনের ড্রেসিং টেবিলের আয়নায়। হুইলচেয়ারে বসা নিজের প্রতিবিম্ব চোখে পরতেই তার দুপুরের পরের সেই ঘটনাটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো। একদৃষ্টিতে আয়নার দিকেই তাকিয়ে রইলো সে। তার চোখ রক্তিম হতে লাগলো। হাতল ধরা হাতের মুঠি হতে লাগলো শক্ত থেকে শক্ত। হঠাৎ সে হাতের কাছের ভারী একটা শোপিজ তুলে আয়নার দিকে ছুঁড়ে মারলো। মুহুর্তের মধ্যে বিকট শব্দ তুলে আয়নাটি ভেঙে চুরমার হয়ে নিচে ঝনঝনিয়ে পড়লো। সঙ্গে সঙ্গেই শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে জোরে চিৎকার করে উঠলো শুদ্ধ। হাতের কাছে যাই পেলো হাত দিয়ে নিচে ছুঁড়ে মারলো। হুইলচেয়ার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চিৎকার করে এলোপাথাড়ি ছুটতে থেকে রুমের মধ্যে ধ্বংসলীলা চালাতে লাগলো। বিছানার চাদর টেনে ফেলে দিলো। কাঁচের জগ, গ্লাস যা পেলো তাই ভাঙতে লাগলো। একটা ফুলদানি তুলে দরজার দিকে মারতে গিয়েই হঠাৎ থমকে গেলো শুদ্ধ। দরজা মুখে শান্ত মুখে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে ধারা। তাকিয়ে আছে শুদ্ধ’র দিকে। শুদ্ধ’র প্রলয়কারী হুংকার মুহুর্তেই থেমে গিয়ে ফুলদানি ধরা হাতের বাঁধন শিথিল হয়ে এলো।
চলবে,
[গত পর্বের শুরুতেই কাকের ডাক আর পরে দূর্ঘটনার ফলে অনেকে কাকের ডাকটাকে অর্থবহ ভেবে বসেছেন। এটা আমি কুসংস্কার অর্থে লিখিনি। শুধু একটা শহুরে জীবনের সাধারণ সকালের বর্ণনা স্বরূপ লিখেছিলাম। প্রকৃত অর্থে কাকের ডাক দ্বারা যে কুসংস্কার বোঝায় এটা আমি ঠিক জানতাম না। নয়তো এরকমটা লিখতাম না। তাই প্লিজ এই বিবরণে বিভ্রান্ত হবেন না। একটা পাখি প্রজাতির জীব শুধুমাত্র কালো রঙের আর কণ্ঠ খুব একটা ভালো নয় বলে তার ডাক খারাপ বার্তা বহন করবে এমনটা ভাবা নিশ্চয়ই ঠিক না।]