ভালোবাসি তাই পর্ব-২২

0
2561

#ভালোবাসি তাই
part:22
Writer:Afifa Jannat Maysha

🍁

রাহুল ভাইয়াদের ড্রয়িংরুমে বসে আছি আমি আর সারা। আমাদের সামনের সোফায় বসে আছেন আন্টি। উনি একটার পর একটা গয়না পরিয়েই যাচ্ছেন আমায়। আর আমি চুপচাপ বসে সেগুলো পরছি। এমুহূর্তে তো যে ব্যাক্তি গয়না আবিষ্কার করেছে তার উপর ব্যাপক রাগ লাগছে আমার। সামনে পেলে কানের নিচে ঠাস ঠাস করে লাগিয়ে দিতাম কয়েকটা।

আমার পাশে বসেই আন্টিকে গয়না পছন্দ করতে উৎসাহিত করছে সারা। আমি এসবে বিরক্ত হচ্ছি সেটা ঠিকই বুঝতে পেরেছে সে। তাই আরও বেশি বেশি করে করছে। বেস্টফ্রেন্ড নামক জাতিটাই বোধহয় এমন হারামী। ওরা থাকলে আর কোনো শত্রুর প্রয়োজন পরবে বলে মনে হয় না আমার।

রাহুল ভাইয়া বাড়িতে নেই এখন। তাই একটু স্বস্তি পাচ্ছি আমি। আজকাল উনার সামনে পড়তেই কেমন লাগে আমার। আগে যেমন স্বাভাবিকভাবে কথা বলতাম এখন সেটা পারি না।

– বাহ এই ঝুমকোটা অনেক সুন্দর। তাই না সারা?

আন্টির কথার ধরনে মনে হচ্ছে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ পছন্দটাই মনে হয় সারার। সে যেটা পছন্দ করবে সেটা কখনোই খারাপ হতে পারে না। না মানে না। আন্টির তালে তাল মিলিয়ে সারাও বললো

– অভিয়েসলি আন্টি। এটা অনেক সুন্দর।

– কিন্তু এর আগেও তো দুইজোড়া ঝুমকো পছন্দ করেছি আমি। সবগুলোই তো অনেক সুন্দর। কোনটা নেবো বুঝতে পারছি না।

– আরে আন্টি এটা নিয়ে এতো চিন্তার কি আছে? সবগুলোই নিয়ে নিন। একটা মাত্র ছেলের বউ বলে কথা।

সারার এমন উত্তরে মরে যেতে ইচ্ছে করছে আমার। কি নিঃস্বকোচে বলে ফেললো তিনটাই নিয়ে নিন। আন্টি না থাকলে এতক্ষণে ওর বারোটা বাজিয়ে ফেলতাম আমি। আন্টি কতক্ষণ ভাবুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন সারার মুখপানে। তারপরই চোখমুখ চকচক করে উঠলো উনার৷ সারাকে বাহবা দিয়ে বললেন

– একদম ঠিক বলেছো তুমি। তিন জোড়া ঝুমকোই নেবো আমি।

– থেঙ্ক ইউ আন্টি। আমি জানতাম আমি ঠিক বলেছি।

– হুম। তবে একটা কথা ভুল বলেছো।

– কোন কথা আন্টি?

– ঐ যে একমাত্র ছেলের বউ বললে সেটা ভুল।

– মানে? মাইশা আপনার বাড়ির একমাত্র বউ না মানে কি রাহুল ভাইয়া আরো বিয়ে করেছে আন্টি?

আন্টির কথায় আমিও অবাক হয়েছি। তাই বলে সারার মতো এমন আজগুবি চিন্তা-ভাবনা মাথায় আসেনি যে রাহুল ভাইয়া আরেকটা বিয়ে করেছে। আন্টি হেঁসে হেঁসে বললেন

– আরে রাহুল বিয়ে করতে যাবে কেনো?

– তাহলে?

– মাইশা আমার একমাত্র বউমা না মানে হলো রাহুল আমার একমাত্র ছেলে না। আমার আরেকটা ছেলে আছে।

আন্টির কথায় আমি আর সারা একে অপরের মুখের দিকে তাকালাম। রাহুল ভাইয়ার ভাই আছে? আমরা তো জানতাম না।আমাদের দুজনের রিয়েকশন এমন যেনো রাহুল ভাইয়ার ভাই থাকা কোনো অপরাধ।

সারা সন্দেহপ্রবণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আন্টিকে জিজ্ঞেস করলো

– রাহুল ভাইয়ার ভাই মানে আপনার আরও একটা ছেলে আছে আন্টি?

– হ্যাঁ, কেনো তোমরা জানো না?

– না আন্টি। মাইশাও তো জানে না।

– ওহ, আগে না জানলেও আজ তো জেনে গেলে।

– হুম।

– আচ্ছা বাকি কথা পরে হবে এখন বলো কোন গয়নাগুলো নেবো।

আবারও আমার উপর শুরু হয়ে গেলো “গয়না ” নামক অত্যাচার। আমি আলাভোলা মানুষের মতো এই অত্যাচারটাই সহ্য করে নিচ্ছি মুখ বুজে। নিজের বেস্টুই যখন বেঈমানী করছে তখন তো সহ্য করতেই হবে।

আমাদের কাজকর্মের মাঝেই কলিংবেলের শব্দ এলো কানে। আমাদের বসতে বলে দরজা খুলতে গেলেন আন্টি। আন্টি চলে যেতেই সারা আমার দিকে আরেকটু চেপে এসে বলতে লাগলো

– আহা জানু তোর দেবর আছে। ভাবতে পারছিস বিষয়টা?

– কিসের বিষয়?

– আরে আমার কত সখ যে তোর বিয়েতে” দিদি তেরা দেবার দিওয়ানা গানে নাচবো “। সেজন্য তো তোর একটা দেবর থাকার প্রয়োজন।

– হুম বুঝলাম। কিন্তু তুই কিভাবে জানিস উনি আমার দেবর না ভাসুর। উনি তো রাহুল ভাইয়ার বড়ও হতে পারে।

– আমার মনে হয়না বড় হবে। তাহলে রাহুল ভাইয়ার বিয়ে কেনো আগে হবে?

– জানি না। এখন একদম চুপ থাকবি। উল্টাপাল্টা কথা বললে মেরে চ্যাপ্টা করে দেবো।

– জানি জানি।

আমাদের কথা মাঝেই ড্রয়িংরুমে ঢুকলেন রাহুল ভাইয়া। “অস্বস্তি ” নামক অনুভূতিটা আবার দানা বেধেছে আমার মাঝে। ছুটে চলে যেতে ইচ্ছে করছে আমার। উনি একপলক আমার দিকে তাকিয়ে হালকা হেঁসে চলে গেলেন উপরে। একটা বড় শ্বাস নিলাম আমি। এতক্ষন একমতো শ্বাস আটকে বসে ছিলাম যেনো।

-এখনই হাওয়া ফুস বেইবী?

– সারা তোর কি মনে হচ্ছে না আজকাল তুই আমার সাথে একটু বেশিই সাহস দেখাচ্ছিস?

– মনে হবে কেনো। আমি তো জানিই আমি আজকাল তোর সাথে বেশি সাহস দেখাচ্ছি। তুমি কি বুঝবে জানু। বেস্টুর বিয়ে ভাবতেই সাহসের পরিমাণ কয়েক মিটার বেড়ে যায়। যখন তোমার বেস্টুর বিয়ে হবে তখন বুঝবে।

– ওওও এবার আসল কাহিনী বুঝলাম। বললেই তো হয় যে তোরও বিয়ের সখ হয়েছে। এতো ঢং করার কি আছে।

– আরে তুই ভুল বুঝছিস।

– আমি জানি আমি কি বুঝেছি। এতো বিয়ের সখ হলে রাহুল ভাইয়ার ভাইয়ের সাথেই তোর বিয়ে দিয়ে দেবো। ঠিক হবে না বাবু?

এবার একটু ক্ষান্ত হলো সারা। মুখ ফুলিয়ে বসে রইলো চুপচাপ।

সবধনের গয়নাগাটি চুজ করা শেষ আন্টির। এতক্ষণে একটু শান্তিতে বসলাম আমি। কিন্তু আমার এই শান্তিটাকে অশান্তিতে বদলে দেওয়ার উদ্দেশ্যেই আন্টি।বললেন

– রাহুলের ঘর থেকে ঘুরে এসো মা। ভালো লাগবে।

– আন্টি আমি?

– হ্যাঁ, তুমি। কদিন পর তো ওটা তোমার নিজেরই ঘর হবে। তাই একবার দেখে এসো তোমার ঘরটা কেমন।

– না না আন্টি। লাগবে না।

আমার তখনের কথার প্রতিশোধ স্বরূপ সারা জোর দিয়ে বললো

– কে বলেছে লাগবে না। অভিয়েসলি লাগবে। আন্টি আপনি ওকে ঘরটা দেখিয়ে দিন। আসলে ওতো লজ্জা পাচ্ছে তাই এমন করছে। কিন্তু ওরও যাওয়ার ইচ্ছা আছে আন্টি শুধু প্রকাশ করছে না।

– আরে এতো লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। তুমি আমার সাথে এসো তো। সারা এখানেই একটু বসুক। কি বলো সারা?

– শিউর আন্টি। আমি এখানে ওয়েট করছি। মাইশা তোর যত টাইম লাগে লাগুক। আমি অপেক্ষা করবো।

– তাহলে তো হলোই। এবার তুমি চলোতো মা।

অবশেষে আন্টির সাথে পা বারালাম রাহুল ভাইয়ার ঘরের উদ্দেশ্যে। সারা মুচকি হাঁসির মাধ্যমেই তার জয়ের জানান দিচ্ছে। পেছন ফিরে সারার দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকালাম আমি। যার অর্থ ” বিয়ে কি শুধু আমারই হবে? তোমার সময় শুধে আসলে শোধ নেবো আমি। ” সেও চোখের ইশারায় উত্তর দিলো ” সেটা আমার বিয়ের সময়ই বোঝা যাবে। আপাতত নিজেরটা সামলা। ”

রাহুল ভাইয়ার ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছি আমি। আন্টি আমায় ঘরটা দেখিয়ে দিয়েই চলে গেছেন নিচে। আর আমি এখন ” অস্বস্তি ” নামক ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎই ঘরের দরজা খুললেন রাহুল ভাইয়া। আমায় এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটুও অবাক হলেন না উনি। যেনো উনি জানতেনই যে উনার ঘরে আসবো আমি। উনি স্বাভাবিকভাবেই বললেন

– এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেনো?ভেতরে এসো।

– না মানে আসলে হয়েছে কি।

– না মানে আসলে এসব কি হ্যাঁ? তোমার ফিউচার ঘর দেখতে এসেছো এটা নিয়ে এমন করার কিছু নেই। ভেতরে এসো।

রাহুল ভাইয়ার সাথে উনার ঘরে ঢুকলাম । ঘর দেখার কথা থাকলেও আমি তাকিয়ে আছি ফ্লোরের দিকে যেনো ফ্লোর নিয়ে গবেষণা করে ইয়া মোটা বই ছাপবো আমি। দুজনেই চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি। কি কথা বলবো বুঝতে পারছি না। কিন্তু এভাবে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকায় অস্বস্তি যেনো চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়েই চলেছে। মথায় অন্য কিছু না আসায় হুট করেই রাহুল ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করে বসলাম

– আপনার নাকি একটা ভাই আছে?

– হ্যাঁ, তুমি কি করে জানো?

– তখন আন্টি বললো।

– ওহ।

– উনি কি আপনার ছোট?

– হুম আমার ছোট।

– নাম কি উনার?

আমার প্রশ্নে শয়তান মার্কা একটা হাঁসি দিয়ে রাহুল ভাইয়া বললেন

– কি ব্যাপার বলোতো? হাজবেন্ডকে ছেড়ে হঠাৎ দেবরকে নিয়ে পড়লে যে?

রাহুল ভাইয়ার এমন কথা মোটেও আমার কাম্য নয়। এতোটা ফ্রীলি উনার সাথে কথা বলা আমার কাছে অসম্ভব না হলেও সম্ভবও নয়। এইমুহূর্তে চরম এক পরিস্থিতিতে পড়েছি আমি। কি উত্তর দেবো বুঝতে পারছি না।

– আরে এতো সিরিয়াস হওয়ার কিছু নেই মাইশা। আই ওয়াজ কিডিং। ওর নাম রোহান।

– ওহ নাইস নেইম।

-তাহলে কি আমার নাম সুন্দর না?

– সেটা না। আপনার নামও ভালো।

– ভালো না লাগলে বলো নাম পাল্টে ফেলি।

– কিসব বলছেন আপনি। আঙ্কেল আন্টি কত ভালোবেসে এই নাম দেয়েছেন আর আপনি নাম পাল্টে ফেলতে চাইছেন?

– পাশ করে গেছো।

রাহুল ভাইয়া কি কথার মধ্যে কি বলছেন সব মাথার বিশ হাত উপর দিয়ে গেছে আমার। বিশ হাত উপর থেকে টেনে এনে সেটা আবার মাথায় ঢুকানো সম্ভব নয় আমার পক্ষে। তাই রাহুল ভাইয়াকেই জিজ্ঞেস করলাম

– মানে?

– আরে আমি তোমায় পরিক্ষা করছিলাম যে তুমি আমার কথায় কেমন রিয়েক্ট করো। আর তুমি আমার আশানুরূপ রিয়েক্ট করেছো। তাই পাশ করে গেছো।

– ওহ। আচ্ছা, আপনার ভাই কোথায়? উনাকে তো কোনোদিনও দেখিনি।

– ও একবছর আগে স্কলারশিপ পেয়ে দেশের বাহিরে গেছে পড়াশুনা করতে।

– বিয়েতে আসবেন না?

– না। ওর এক্সাম পরে গেছে। তাই বলেছে রিসিপশনের দিন আসবে।

-ওহ।

– তা দেবরের বিষয়ে জানা শেষ হলে হাজবেন্ডের বিষয়ে জানার আগ্রহ আছে কি মেডাম?

– আই থিঙ্ক সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আমাদের তো ফিরতে হবে। পরে বেশি দেরি হয়ে যাবে।

– সব পালানোর ধান্দা। পালাও পালাও যত পারো পালাও সময় আমারও আসবে।

– কিসের সময় আসবে ভাইয়া?

সারার গলা পেয়ে দুজনেই তাকালাম দরজার দিকে। সে ঠোঁটের কোণে বিটকেল মার্কা হাঁসি ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সারা গলা খাকারি দিয়ে বলে উঠলো

– ডিসটার্ব করলাম নাতো ভাইয়া? আসলে খুব দরকার ছিলো মাইশার সাথে নয়তো আসতাম না।

– আরে না না শালিকা। কি দরকার আছে বলো।

– মাইশা শোন না আমি এখনি চলে যাচ্ছি। ভাইয়া পাশেই কোথাও আছে। এখন বাসায় যাবে তাই ভাবলাম আমিও চলে যাই। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। পরে প্রবলেম হতে পারে।

– তুই চলে গেলে আমি যাবো কার সাথে?

– কেনো রাহুল ভাইয়াকে কি তোর অকর্মার ঢেকি মনে হয়? উনি আছেন কি করতে?

– শালিকা তুমিই একমাত্র বুঝলে আমার কষ্টটা। সত্যিই তোমার বান্ধবী আমায় অকর্মার ঢেকি মনে করে।

– করলে করবে। আমি এখন গেলাম। দেরি হয়ে যাচ্ছে। আসি জানু।

সারা আমায় অসহায়ের মতো ফেলে রেখেই চলে গেলো বাসায়। আমার অবস্থা এখন বর্ননাতীত। তবুও বাসায় তো যেতেই হবে। তাই এক ডিব্বা অস্বস্তি নিয়েই রাহুল ভাইয়ার সাথে রউনা দিলাম বাসার উদ্দেশ্যে। রাহুল ভাইয়া বাইকে আসতে চেয়েছিলেন কিন্তু আমি গাড়ি নিয়ে আসতে বলায় বাইক আনেন নি উনি। এখন আমি গাড়িতে উনার পাশের সিটে বসে আছি।

হঠাৎ করেই চলন্ত গাড়ি থামিয়ে দিলেন রাহুল ভাইয়া। আচমকা এমন হওয়ায় সামনের দিকে ঝুকে পড়লাম আমি। উনাকে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই গাড়ি থেকে নেমে গেলেন উনি।

কি হয়েছে বুঝার চেষ্টা করতেই কানে এলো চিরচেনা সে কন্ঠ। বাইরে কথা বলছেন সায়ন ভাইয়া আর রাহুল ভাইয়া।

– আরে সায়ন তুই এখানে কি করছিস?

– এইতো তেমন কিছুই না।তুই কি করছিস?

– আমি মাইশাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে যাচ্ছি।

আর কোনো কথা শুনা গেলো না। তবে গাড়ির জানালার সামনে এসে দাঁড়ালেন সায়ন ভাইয়া।

– নেমে আয়।

– মানে কি?

– বাংলা বুঝিস না?

– নামবো কেনো?

-আমি তোকে বাসায় দিয়ে আসবো?

– কিন্তু আমি তো রাহুল ভাইয়ার সাথে যাবো।

– বিয়ের আগেই শশুড় বাড়ি যাওয়াটা ভালো দেখাবে না। তুই আমার সাথে যাবি।

– আপনিও তো তাহলে বিয়ের আগে শশুড় বাড়ি চলে যাবেন। সেটাও তো ঠিক না।

আমার কথার পরিপ্রেক্ষিতে আর কিছুই বললেন না সায়ন ভাইয়া। আমিও আর কিছু না বলে চলে এলাম রাহুল ভাইয়ার সাথে।

চলবে……….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here