ভালোবাসি আমি যে তোমায় পর্ব: ১৩

0
3049

#ভালোবাসি_আমি_যে_তোমায়
#Sohani_Simu
পর্ব: ১৩

সকাল থেকে মনটা খুব খারাপ কারন আজ সন্ধ্যার দিকে আম্মুরা ঢাকা চলে যাবে।মন মরা হয়ে টিভিতে দ্যা জঙ্গল বুক দেখছি।আম্মু রান্নাঘর থেকে বের হয়ে আমাকে বলল,

আম্মু: যা তোর অ্যাঙ্কেল অ্যান্টি আর চাঁদ কে ডেকে নিয়ে আয় আমি গোসলটা সেরে নিই।১:৩০ বেজে গেল তাও আসছেননা কেন….উনারা আসলেই সবাইকে খেতে দিব।

আমি: আর একটু পরে যাই?ইচ্ছে গোসল করছে।

আম্মু: না এখনই যা। তাড়াতাড়ি সবাইকে নিয়ে চলে আসবি।যা উঠ।(টিভি অফ করে দিয়ে)

আমি: একা একা যাব?..এই আপু চল না।

আফ্রা:পারবোনা তুই যা, আমি বিজি আছি।(নেইল পলিশ দিতে দিতে)

আমি আর কোন উপায় না পেয়ে চুলের কাঁটা দিয়ে চুল বাঁধতে বাঁধতে বেড়িয়ে গেলাম।২ মিনিটে উনাদের বাসার সামনে চলেও আসলাম, কারন উনারা এখন আমাদের সামনের বাসাতেই থাকেন।
বাসার সামনে দাঁড়িয়ে ভাবছি,চলে তো এলাম এখন কি হবে? নির্ভীক ভাইয়া দুদিন আমার সাথে কথা বলার কত চেষ্টা করলেন অথচ আমি উনাকে এভয়েড করলাম।সকালে ইচ্ছের কাছে শুনলাম নির্ভীক ভাইয়া নাকি জেনে গিয়েছিলেন আমরা উনাকে সারপ্রাইজ দিতে চাই তাই উনার পরিচয় আগে আমাদের দেন নি যাতে সারপ্রাইজটা নষ্ট না হয়ে যায়।অথচ আমি উল্টা-পাল্টা কিসব ভেবেছি।ইচ্ছের কথা শুনার পরই আমি নির্ভীক ভাইয়াকে সরি বলার জন্য ফোন দিয়েছিলাম কিন্তু উনি ধরলেন না।এখন বাহিরে দাঁড়িয়ে ভাবছি কি করে উনার সাথে কথা বলা শুরু করবো।এত ভেবে কাজ নেই ভেতরে যাই আগে তারপর উনাকে দেখতে পেলেই সরি বলবো।

বাসার ভেতরে যেয়ে দেখি অ্যাঙ্কেল কিছু দরকারি কাগজ পত্র ঘাটছেন।
আমি: অ্যাঙ্কেল আপনি এখনও কাজ করছেন?আর অ্যান্টি কোথায়?চলুন আমাদের বাসায় সাবাই আপনাদের জন্য ওয়েট করছে।

অ্যাঙ্কেল: হ্যা রে মা, যাব। কিন্তু দেখনা তোর অ্যান্টি হসপিটাল থেকে এখনও আসেনি।তাই একটু কাজে বসলাম।

অ্যান্টি: এই তো আমি এসে গেছি, যাও তুমি রেডি হয়ে নাও আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।চাঁদ কোথায়?(ব্যস্ত হয়ে)

অ্যাঙ্কেল: ওর রুমেই আছে।(কাগজ গোছাতে গোছাতে)

অ্যান্টি:অন্ত,যানা মা চাঁদকে ডেকে নিয়ে আয়।

এইটাই সুযোগ এই সুযোগে উনাকে সরি বলা হয়ে যাবে আর কথাও বলা হবে।(মনে মনে)
আমি:কিন্তু অ্যান্টি,ভাইয়ার রুম কোনটা?

অ্যান্টি: উপরে গিয়ে ডানদিকে শেষ রুম।

বলেই অ্যান্টি নিচে উনার রুমে ঢুকে গেলেন।আমি সিঁড়ি দিয়ে উঠে ডানদিকে যেতে লাগলাম।উনাদের বাসাটা বিশাল আর সুন্দরও কিন্তু এত বড় বাসায় মাত্র তিনজন লোক আর দুজন কাজের লোক থাকেন চারপাশ টা খুব শান্ত হয়ে আছে,এতদিন আমাদের বেলকুনি আর ছাদ থেকে এই বাসাকে ভুতের বাসায় মেনেছি তাই কেমন ভয় ভয় লাগছে।আর একটা রুম পরই শেষ রুম। সামনের রুমে দরজার সামনে যেয়ে দরজা খোলা দেখে ভিতরে তাকিয়ে দেখি নির্ভীক ভাইয়া টেবিল চেয়ারে বসে ল্যাপটপে কিছু করছেন।উনাকে দেখে মনে হচ্ছে উনি এইমাত্র শাওয়ার নিয়ে এখানে এসেছেন কারন উনার সামনের দিকের ভেজা চুল গুলো চোখের ভ্রুর উপর পরে আছে।উনি কালো টিশার্ট আর কালো ট্রাউজার পরে আছেন।উনার দৃষ্টি ল্যাপটপে স্থির।আমি রুমের ভেতরে চারপাশে তাকালাম।শুধু বই আর বই রুমটা বেশি বড় নয়।তাও এটা একটা পারফেক্ট পারিবারিক লাইব্রেরী।
কতক্ষণ হয়ে গেল আমি এসেছি কিন্তু উনি একবারও দরজার দিকে তাকালেন না।আমি দরজায় ধীরে করে টোকা দিলাম। আওয়াজ পেয়ে উনি আমার দিকে তাকালেন কিন্তু কিছু না বলেই চোখ নামিয়ে ল্যাপটপে কাজ করতে লাগলেন।আমি এবার বেশ বুঝতে পারছি আমি দুদিন কথা না বলাই উনি রাগ করেছেন।

আমি ধীর পায়ে উনার সামনে গিয়ে বললাম,

আমি: ভাইয়া আই আম সরি,আমি আপনাকে ভুল বুঝেছিলাম।(মাথা নিচু করে)..চলুন অ্যান্টি নিচে ডাকছে।

উনি আমার দিকে তাকিয়ে ল্যাপটপ অফ করে উঠে দাঁড়ালেন।তারপর আমাকে কিছু না বলেই রুম থেকে বেড়িয়ে নিচে আসলেন।আমার খারাপ লাগলো উনি আমার সাথে কথা বললেন না।আমিও নিচে আসলাম।তারপর সবাই আমাদের বাসায় গেলাম।

দুপুরের লান্চ শেষে বড়রা সোফাই বসে বড়দের মতো কথা বলছে আর আমরা ছোটরা জারিফ ভাইয়ার রুমে এসে আড্ডা দিচ্ছি।এখানে আমি,ইচ্ছে,আপু,জারিফ ভাইয়া আর নির্ভীক ভাইয়া আছি।সবাই কিছুনা কিছু নিয়ে হাসি ঠাট্টা করছে শুধু আমার মুখটায় বন্ধ, আমার মুখে কোন হাসি নেই।কারন নির্ভীক ভাইয়া আমার সাথে কথায় বলছেন না কত বার আমি এটা ওটা জিজ্ঞেস করলাম উনি আমার সাথে একটা কথাও বললেন না অথচ সবার সাথে হেসে হেসে কথা বলছেন।খুব খারাপ লাগছে আমার, হয়ত উনারও এমনই খারাপ লেগেছে।আমি জারিফ ভাইয়ার পাশে বেডের উপর বসে আছি।আমার সামনে একটু দূরে নির্ভীক ভাইয়া বসে আছেন,উনি আমার দিকে তাকাচ্ছেনও না।আপুর সাথে হেসে হেসে কথা বলছেন,
নির্ভীক: যদিও তুমি আমার থেকে ৩৩ দিনের ছোট তাও আমি তোমাকে ভাবি ডাকবো।আর আমি তোমার একমাত্র দেবর আদর করে তুমি আমাকে যা খুশি ডাকতে পার আই ডোন্ট মাইন্ড।আর হ্যা আপনি বলা যাবেনা,দুদিন থেকে দেখছি আপনি বলছো।

আফ্রা: ওকে,তুমি (হেসে)।আর আমি নির্ভীক ভাইয়া বলেই ডাকবো।

ইচ্ছে: কিন্তু আপু নির্ভীক ভাইয়া আর তুমি ৩৩ দিনের ছোট-বড় হলে তুমি পড়াশুনায় ভাইয়ার থেকে পিছিয়ে কেন?(কনফিউজড্ হয়ে)

আফ্রা: ঢাকায় যেয়ে ২ ক্লাস নিচে এডমিশন নিতে হয়েছিল।

আমি ওদের কথা শুনতে শুনতে ভাইয়ার একহাত জড়িয়ে ধরে ভাইয়ার কাঁধে মাথা রাখলাম।

জারিফ:কি হয়েছে ছোটপাখি?শরীর খারাপ করছে?(আমার গালে এক হাত দিয়ে)

সবাই আমার দিকে তাকালো এতক্ষণ আমাকে কেউ খেয়ালি করেনি।নির্ভীক ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে দেখলাম আমার দিকে উদ্বিগ্ম চোখে তাকিয়ে আছেন।আমি সঙ্গে সঙ্গে চোখ নামিয়ে জারিফ ভাইয়াকে বললাম,

আমি: তোমরা আজি চলে যাবে?(মন খারাপ করে)

জারিফ: হুম আজই যেতে হবে কাল ইম্পরট্যান্ট মিটিং আছে।
আমি:ওহ।
বলেই উঠে দাঁড়ালাম।
আফ্রা: কই যাবি?

আমি: আম্মুর কাছে যাব।
বলেই চলে আসলাম। বুঝতে পারছি পেছন থেকে সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

নিচে আসতেই শুনতে পেলাম।অ্যান্টি বলছেন, “তাহলে ঐ কথায় রইল,আজ থেকে আমরা ওয়াদা বদ্ধ”।আমি পেছন থেকে এসে আম্মুর পাশে বসতে বসতে বললাম, “কিসের ওয়াদা?”…আম্মু থতমত করে বলল,” কিসের আবার রাযীন আর আফ্রার বিয়ের”।
আমি:বিয়ে তো ঠিক হয়ে গিয়েছে।

আম্মু: তুই ওসব বুঝবিনা।

আমি:আচ্ছা।কিন্তু তোমরা আজ যেওনা প্লিজ!

বাবা: না মামুনি,যেতে হবে। আমাদের আর আটকিওনা। তোমার ফুপ্পি-ফুপ্পা তো আছেই আর এখন থেকে তোমার অ্যাঙ্কেল অ্যান্টি ও এখানে থাকবে।একদম মন খারাপ করে থাকবেনা।

আমি মাথা নিচু করে ওদের কথা শুনলাম।কারন আমার চোখে পানি ছলছল করছে। আমি উঠে রুমে যাওয়ার জন্য হাটা দিলাম।সিঁড়ি দিয়ে উঠে রুমের দিকে যেতেই দেখি নির্ভীক ভাইয়া ফোন কানে ধরে দাঁড়িয়ে আছেন।জানি উনি কথা বলবেন না তাই আমি উনার দিকে আর না তাকিয়েই রুমে যেয়ে দরজা বন্ধ করে দিলাম।সারাবিকেল আর রুম থেকে বের হইনি।ইচ্ছে এসে ডেকেছিল আমি ওকে বলে দিয়েছি মাথা ধরেছে ঘুমাবো তাই আর কেউ বিরক্ত করেনি।অথচ আমার চোখে ঘুম নেই।নির্ভীক ভাইয়ার আমাকে ইগনোর করে চলা আর আম্মুদের চলে যাওয়া আমি মানতে পারছিনা।সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে আমি ফ্রেশ হয়ে বাহিরে এসে দেখি সবাই রেডি।অ্যাঙ্কেল অ্যান্টি নির্ভীক ভাইয়া এখনও আছেন।

আফ্রা:কিরে তোকে দেখে তো মনে হচ্ছেনা তুই ঘুমিয়েছিস।
আমি: না ঘুমাইনি এমনি শুয়েছিলাম।
আম্মু:এখনও মাথা ব্যাথা করছে,আম্মু?(গালে হাত দিয়ে)

আমি:না।(মন খারাপ করে)
আফ্রা:এই ইচ্ছে দেখিস ওকে।আমরা গেলে প্যানিক হতে দিসনা।
ইচ্ছে: ডোন্ট ওরি,আমি তো আছি।
বাবা:ওকে আমরা তাহলে আসছি,সবাই ভাল থাক।

জারিফ: তোরা সাবধানে থাকবি।আর ভার্সিটিতে প্রবলেম হলে অ্যাঙ্কেল কে জানাবি(আমার আর ইচ্ছের দিকে তাকিয়ে)।আর নির্ভীক তোর সাথে আমার কিছু কথা আছে।

বলেই জারিফ ভাইয়া নির্ভীক ভাইয়ার কাঁধে হাত দিয়ে গল্প করতে করতে গাড়ির দিকে গেলেন।বাবা, আম্মু আর আপুও সবার থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে গিয়ে উঠলেন।গাড়ি ছাড়লো,আমি গাড়ির পেছন পেছন গেইট পর্যন্ত এগিয়ে গেলাম।কিছু ভাল লাগছেনা,সব ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।ঘাড়ে কারও হাতের স্পর্শ পেয়ে তাকিয়ে দেখি ইচ্ছে।ওকে জড়িয়ে ধরে এইবার কেদেই দিলাম। আমার কান্না করা দেখে সবাই আমার কাছে এগিয়ে এসে শান্তনা দিতে থাকলো।নির্ভীক ভাইয়া দূরে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে,উনার চোখের ভাষা বুঝতে পারছিনা তবে মনে হচ্ছে উনি কষ্ট পাচ্ছেন।আমি ফোঁপাতে ফোঁপাতে বাসায় চলে আসলাম।বেলকুনিতে এসে মেঝেতে বসে ফুপিয়ে কান্না করতে লাগলাম।

কিছুক্ষণপর ইচ্ছে এসে আমার পাশে বসলো।

ইচ্ছে: তোর কি কিছু হয়েছে?কাঁদছিস কেন এভাবে?

ওর কথা শুনে আমি ভাবতে লাগলাম।আমি কেন এত কাঁদছি?বাবা-আম্মু চলে যাওয়ায় আমার এত কান্না করার মতো কষ্ট হয়নি।তবে নির্ভীক ভাইয়ার আচরণে আমি খুব কষ্ট পাচ্ছি।আমার প্রতি উনার ইগনোরেন্স আমি সহ্য করতে পারছিনা উনার কথা মনে পড়লেই অভিমানে দুচোখ জলে ভরে আসছে।এই কটা দিনেই উনি আমার মনে কতটা জায়গা করে নিয়েছেন।

ইচ্ছে:কিরে কিছু বল।
আমি:কথা বলতে ইচ্ছে করছেনা।(ইচ্ছের কোলে মাথা রেখে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে)

ইচ্ছে:একি তোর তো অনেক জ্বর।আর কাঁপছিস ও।(মাথায় হাত দিয়ে)চল রুমে চল।

আমি: থাকি না এখানে কিছুক্ষণ।(চোখ বন্ধ করে)

ইচ্ছে:দেখেছেন ভাইয়া?ও প্যানিক হলেই অসুস্থ হয়ে যায়।তাই তাড়াহুড়ো করে এখানে আসলাম।

ইচ্ছের কথা শুনে ভেতরে ধক করে উঠলো। নির্ভীক ভাইয়া এখানেই আছেন,তাই মনে মনে ভাবলাম, এটাই লাস্টবার উনাকে সরি বলবো তারপরও উনি আমার সাথে কথা না বললে আমি আর কোনদিন উনার সাথে কথা বলবোনা।
চোখ খুলে তাকাতে পারছিনা,মাথা ঘুরছে, গলা দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছেনা।কোন মতে চোখ বন্ধ করে বললাম,”ভাইয়া আমি সরি।”

সঙ্গে সঙ্গে অনুভব করলাম কেউ আমার হাত দুহাতের মুঠোতে নিয়ে চুমু খেল। কিছুক্ষণ পর মনে হল আমি শূন্যে ভাসছি।তারপর আর কিছু মনে নেই।

চলবে…………..!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here