ভালোবাসি আমি যে তোমায় পর্ব:৬০

0
2634

#ভালোবাসি_আমি_যে_তোমায়
#Sohani_Simu
পর্ব:৬০

মুখের উপর সাদা কাপড় থাকায় সাদা ছাড়া কিছু দেখতে পাচ্ছিনা।এদিকে নিঃশ্বাস নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে।কাঁপাকাঁপা হাতে মুখের উপরের সাদা কাপড় সরাবো তখনই কেউ এক টানে কাপড় সরিয়ে দিল।আমি ঝাপসা চোখে একটা সুন্দরী মেয়েকে দেখতে পেলাম, দেখে কোন হসপিটালের নার্স মনে হচ্ছে। উনি আমাকে দেখেই ব্যস্ত হয়ে দৌঁড়ে বেড়িয়ে গেলেন আর আমি একটু অক্সিজেনের জন্য ছটফট করতে লাগলাম।উঠে বসার চেষ্টা করছি কিন্তু পারছিনা।নার্সটার কথা শুনতে পেলাম।উনি চেঁচিয়ে বলছেন,
নার্স :ডক্টর তাড়াতাড়ি আসুন পেশেন্ট এখনও বেঁচে আছে।

সঙ্গে সঙ্গে কয়েকটা লোক দৌঁড়ে এখানে আসলো।কাউকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিনা কিন্তু একজনকে খুব চেনা লাগছে।লোকটা আমার কাছে এসে ঝুকতেই আমি তার গলার কাছে জামা শক্ত করে ধরলাম।একবার শ্বাস নেয়ার জন্য অটোমেটিক আমি বেড থেকে কয়েক ইঞ্চি উপরে লাফিয়ে উঠছি কিন্তু শ্বাস নিতে পারছিনা।আমার মুখে মাস্ক লাগিয়ে দিল।বামহাতেও কি যেন করছে দেখতে পাচ্ছিনা।প্রায় ২০মিনিট পর আমি একটু স্টেবল হলাম। ধীরে ধীরে সব ক্লিয়ার হতে লাগলো।ডান দিকে তাকিয়ে দেখি নির্ভীক ভাইয়া।আমি উনার কালো টি শার্টের কলার শক্ত করে ধরে আছি আর উনি আমার হাত ধরে বসে আছেন।একি অবস্থা হয়েছে উনার!চুলগুলো কাকের বাসা হয়ে আছে। চোখ দিয়ে জল পড়ছে,চোখের নিচে কালো গর্ত হয়ে গেছে,আর প্রথম বারের মতো উনার খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি গুলো প্রায় এক ইঞ্চি মতো লম্বা দেখছি।আমি উনার সাথে কথা বলার চেষ্টা করছি কিন্তু মুখের অক্সিজেন মাস্কের জন্য পারছিনা।বাম হাত দিয়ে মাস্ক সরানোর চেষ্টা করতেই আমার হাত ধরে আটকিয়ে দিল।আমি বাম দিকে তাকিয়ে দেখি রাযীন ভাইয়া সহ আরও দুটো ডক্টর।রাযীন ভাইয়া নির্ভীক ভাইয়ার পাশে এসে বললেন,
রাযীন:চাঁদ তুই এবার বাহিরে যা।

আমি নির্ভীক ভাইয়ার কলার শক্ত করে চেপে ধরলাম কিন্তু উনি আমার হাত খুলে উনার দুহাতের মুঠোই নিয়ে আমার হাতে উনার ঠোঁট চেপে ধরে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন।এইদিকে আরেকটা বজ্জাত ডক্টর আমাকে ইন্জেকশন দিচ্ছে।যদিও ক্যানুলায় পুস করছে কিন্তু আমি মেডিসিন আমার শিরা উপশিরায় ফিল করতে পারছি।মেডিসিন গুলো আমার হাতের ভিতরে কাঁটার মতো ফুটছে,যন্ত্রনা হচ্ছে খুব। এখন আবার তাকিয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে।মাথায় আঘাত পেয়েছি বুঝতে পারছি।ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করে নিলাম।একটা ডক্টর বলছে,

ডক্টর:সি ইজ ভেরি লাকি।আমরা তো ধরেই নিয়েছিলাম ও মারা গিয়েছে।

রাযীন:ডক্টর আমি আরেকবার ওর সিটিস্কান করাতে চাই।
ডক্টর:ইয়াহ সিউর।

তারপর আর কেউ কিছু বলল না।একনাগাড়ে টি..প টি..প টি..প শব্দ হচ্ছে সেটা শুনতে শুনতে আমি ঘুমিয়ে গেলাম।

ঘুম ভাঙ্গলে তাকিয়ে দেখি জারিফ ভাইয়া বেডের পাশে বসে আছে।আমি একটু নড়তেই ভাইয়া উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
জারিফ:সিস্টার দেখুন ও জেগে গেছে।(আমার একহাত ধরে)
সিস্টার:আমি দেখছি আপনি ডক্টর সাহাকে ডাকুন।

ভাইয়া দ্রুত রুম থেকে বেড়িয়ে গেল।নার্স টা আমার পেছন দিকের ওয়ালে তাকিয়ে পেপারে কিছু লিখছে।লিখা শেষ করে স্যালাইন খুলে দিল।একটু পরই ভাইয়া ডক্টর নিয়ে আসলো।বয়স্ক ডক্টর টা এসেই আমার চেক আপ শুরু করে দিল।লাইফ সাপোর্ট, অক্সিজেন মাস্ক খুলে দিয়ে বলল,
ডক্টর:মামুনি এখন কেমন ফিল করছো?কথা বলো।দেখোতো উনাকে চিনতে পারছো?(ভাইয়ার দিকে ইশারা করে)
আমি:ভাইয়া।(দূর্বল কন্ঠে)

ডক্টর:ভেরি গুড।সি ইজ আউট অফ ডেন্জার নাও(ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে)।সিস্টার?পেশেন্টকে কেবিনে শিফট করার ব্যবস্থা করুন।

আমাকে আইসিইউ থেকে সাধারন কেবিনে শিফট করা হলো।ভাইয়া এসে পাশে বসতেই বললাম,
আমি:নির্ভীক ভাইয়া কোথায়?(দূর্বল কন্ঠে)

জারিফ:বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছি।ঝামেলা করছিল এখানে।(আমার মাথায় আলতো করে হাত ছুয়ে)

তখনই রুমে কেউ হন্ত দন্ত হয়ে ছুটে এল।তাকিয়ে দেখি নির্ভীক ভাইয়া।ভয়ানক বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে উনাকে।

জারিফ:আয় ও উঠেছে। তোরা কথা বল আমি আসছি।(উঠে দাঁড়িয়ে)

ভাইয়া যেতেই উনি এসে আমকে শুয়ে থাকা অবস্থাতেই জড়িয়ে ধরলেন।আমিও উনাকে দুইহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলাম।কিছুক্ষণ পর উনি মাথা তুলে বললেন,
নির্ভীক:আর কখনও আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা মাথাতেও আনবানা,কেন বলেছিলে ওসব কথা?আর কখনও বলবানা।(আমার গালে হাত দিয়ে)

আমি:একদিনেই নিজের কি অবস্থা করেছেন।ফ্রেশ হয়ে আসুন,আপনাকে এভাবে দেখে শান্তি পাচ্ছি না।(উনার হাতে হাত রেখে)

নির্ভীক:একদিন?তেরো দিন কোমায় ছিলা তুমি।তেরোটা দিন আমার সাথে কথা বলোনি,আমার দিকে একবার তাকিয়ে দেখোনি।এত কষ্ট আমি লাইফে কখনও পাইনি।ডক্টর বলেছিল,” সি ইজ নো মোর”।আমি শেষ হয়ে গেছি।(আমার গলায় মুখ গুজে কাঁদতে কাঁদতে)

উনার কথা শুনে আমি হতবাক।তেরোটা দিন আমার লাইফ থেকে চলে গেল আর আমি কিছু টেরও পেলাম না।মাথায় হাত দিয়ে দেখি পেছনের দিকে ব্যান্ডেজ করা।উনার পিঠে আর মাথায় হাত রেখে উনাকে বললাম,

আমি:কাঁদবেন না প্লিজ।কিছু হয়নি আমার।বাসায় যাবো চলুন।(দূর্বল কন্ঠে)
নির্ভীক:হুম কালই বাসায় নিয়ে যাবো।এখন ঘুমাও অনেক রাত হয়েছে।(গলা থেকে মাথা তুলে)

আমি:আমাকে একটু বাহিরে নিয়ে চলুন।দম বন্ধ লাগছে এখানে।নদীর ধারে নিয়ে চলুন।(চোখ বন্ধ করে)

নির্ভীক:আমরা এখন ঢাকায় আছি।রাজশাহী গেলে তোমাকে নদীর ধারে নিয়ে যাবো,ওকে?বেলকুনিতে যাবা?(গালে হাত দিয়ে)
আমি:হুম।(উঠার চেষ্টা করে)
নির্ভীক:ওয়েট ওয়েট।এভাবে উঠতে পারবানা।একটু ওয়েট করো।

উনি কেবিনের সোফার কাছে যেয়ে একটা সিঙ্গেল সোফা বেলকুনি তে নিয়ে গেলেন তারপর আমার কাছে এসে আমাকে কোলে নিয়ে সোফায় গিয়ে বসলেন।আমি মাথা তুলে থাকতেই পারছিনা তাই উনার বুকে মাথা দিয়ে রাখলাম।উনি আমাকে জড়িয়ে ধরে সোফায় হেলান দিয়ে আছেন।আমি দূর্বল চোখে রাতের শহর দেখতে লাগলাম।কিছুক্ষণ পর উনাকে বললাম,

আমি:আমাকে কেউ ধাক্কা দিয়েছিল।
নির্ভীক:কি???(অবাক হয়ে)

আমি:পেছন থেকে জোড়ে ধাক্কা দিয়েছিল।আমি রেলিং ধরার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু পারিনি।(হতাশ হয়ে)

নির্ভীক: আমি ওকে এবার খুন করে ফেলবো,এখান থেকে যাই শুধু একবার।(রাগী কন্ঠে)

আমি:কাকে?আপনি কোন ঝামেলা করবেননা প্লিজ।(চিন্তিত হয়ে)
নির্ভীক:ঘুমাও।(মাথায় কিস করে)

আমি আর কোন কথা বললাম না।বেশি কথা বললে মাথায় লাগছে।উনার হৃদপিন্ডের ঢিপ ঢিপ শব্দ শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে গেলাম।

.
সকাল হতেই সবাই আমার সাথে দেখা করতে এসেছে। ইচ্ছেকে দেখে আমি অবাক।যেই মেয়ে জীবনে শাড়ি পরতে চায়না সে আজ শাড়ি পরে এসেছে।ওকে দেখে বিবাহিত লাগছে কিন্তু সবার সামনে ওর বিয়ের কথা বলতে পারছিনা।বাবা,আন্মু,ভাইয়া,আপু,রাযীন ভাইয়া,ফুপ্পা,ইচ্ছে,প্রান্ত ভাইয়া আর নির্ভীক ভাইয়া এখানে আছে।হঠাৎ দরজা ঠেলে আরাফ ভাইয়া ভেতরে আসলো।আমার দিকে এগিয়ে এসে মলিন হেসে বলল,
আরাফ:এখন কেমন আছো অন্ত?(আমার দিকে তাকিয়ে)

আমি:ভাল।(আরাফ ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে)
জারিফ:আরাফ ছোটপাখিকে আর একবার ব্লাড দিতে হবে ডক্টর আমার ব্লাড আর নিবেনা বলছে।তোকেই দিতে হবে নাহলে বাহিরের কে না কে দিবে।(আরাফ ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে)

রাযীন:এক কাজ কর তোরা দুজনই একটু করে দে।আরাফও তো সেদিন রাজশাহীতে কম ব্লাড দেইনি। অপারেশনে প্রচুর ব্লাড লস হয়েছে।এর জন্য এত ব্লাড দিতে হচ্ছে।(আমার পাশে দাঁড়িয়ে থেকে)

আরাফ:যত লাগে নে, নো প্রবলেম।(জারিফ ভাইয়ার পাশে বসে)

নির্ভীক ভাইয়া আমার পাশে বসে আছেন।অনেকক্ষণ ধরে ফোনে কি যেন করছেন।তেমন কথা বলছেন না।খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে উনাকে।রাযীন ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন,
নির্ভীক:যা করার তাড়াতাড়ি করে ওকে ডিসচার্জ করে দাও।বাসায় নিয়ে যাবো।(গম্ভীর মুখ করে)

রাযীন:দুদিন পর ডিসচার্জ করবে আমি ডক্টরের সাথে কথা বলেনিয়েছি।(নির্ভীক ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে)

নির্ভীক:আমি ওকে আজই বাসায় নিয়ে যাবো আর তুমিই তো ট্রিটমেন্ট করছো।বাসায় প্রবলেম হলে তুমি তো আছোই।(ফোন পকেটে ঢুকিয়ে)

রাযীন:আমি তো করছি কিন্তু দুদিন এখানে থাকলে ওর ড্রেসিং করাতে সুবিধা হতো আর তাছাড়াও হসপিটালের একটা নিয়ম আছে নিয়মের বাহিরে ওরা কিছু করবেনা।অন্তর শরীরটাও তো ভাল নেই।

নির্ভীক ভাইয়া বেডের পাশে রাখা টুলে জোড়ে লাথি দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ভ্রু কুচকে বললেন,
নির্ভীক:ডেসিং তুমি বাসায় করে দিবা আমি সব এনে দিবো।ব্লাড লাগলে এখনই দাও নাহলে রাজশাহী যেয়ে দাও।আমি প্লেনের টিকিট করে ফেলেছি।(রেগে)

বলেই উনি হন হন করে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলেন।সবাই চিন্তিত হয়ে উনার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে শুধু আরাফ ভাইয়া মুচকি হাসছে।

চলবে………..!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here