#সৃজা
পর্বঃ১৬
লেখিকাঃআরুনীয়া চৌধুরী
সাফওয়ানের হাতটা সরিয়ে মাথাটা চেপে ধরলো দু হাতে সৃজা।এতক্ষণ শান্ত থাকলেও আর পারছেনা সে।সৃজার দিকে তাকিয়ে সাফওয়ান বারান্দায় গিয়ে সিগারেট ধরালো।নিজের না বলা কথাগুলো সিগারেটের ধোঁয়ায় উড়িয়ে দিচ্ছে।তার ভাবনায় আসে না যে সাফওয়ান চৌধুরীকে দেখলে অফিসের প্রত্যেকটা কর্মচারী ভয়ে সিটিয়ে যায়।সে কিনা নিজের স্ত্রীর রাগকে সহ্য করছে।
মাথা ঠান্ডা করে নিজ মনকে প্রশ্ন করলো সৃজা এ কি করছে সে?সেতো এতো দূর্বল না।নিজের মনকে জিজ্ঞেস করে সে একটাই উত্তর পেলো,হ্যা সে বিয়ের পর একটু একটু করে দূর্বল হয়ে পরেছে।আগের সৃজার সাথে এ সৃজার বিরাট পার্থক্য রয়েছে।পুরোনো সৃজা অন্যায়ের সাথে আপোষ করতো না,চরিত্রহীনদের ঘৃণা করতো,তাকে দেখলে মেয়েরা সাহস পেতো,ছেলেরা চোখ তুলে তার দিকে কথা বলতো না।সে সৃজা কোথায় গেলো।কোথায় বিলীন হয়ে গেলো তার অস্তিত্ব।
নাকি বিয়ে হওয়ার পর সব নারী এক হয়ে যায়।হ্যা,এমনটাই মেয়েরা বিয়ের পর দূর্বল হয়ে যায়। ধীরে ধীরে পারিপার্শিক অবস্থা তাদের বাধ্য করে নত হতে।তবে কি সৃজাও সেরকম হলো।সে কিভাবে স্বামী নামক এই পাপীকে সকলের থেকে লুকাচ্ছে আর কেনই বা লুকাবে সে।সে তো কোনো অন্যায় করেনি।
মাথাটা তুলে তাকালো সে সাফওয়ানের দিকে।পরক্ষনেই নিচে নামার জন্য পা বাড়ালো।সাফওয়ান অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো
“কোথায় যাচ্ছো তুমি।” বলতে বলতে সে ও পিছু পিছু গেলো।
সৃজা শুধু একটা কথাই বললো
“যা করবো শুধু দেখবেন।একটা কথাও শুনতে চাইনা আমি আপনার থেকে।”
দ্রুত পায়ে নিজ গন্তব্যে পৌছালো সৃজা।এলিজার রুমের সামনে গিয়ে জোরে জোরে নক করতে লাগলো।
এই ভয়টাই পাচ্ছিলো এলিজা।না জানি গতকালের সাহসের কি মূল্য দিতে হয় তাকে।যদিও অনেকটা ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করেই সাফওয়ানকে এ রুমে এনেছিলো সে। মেয়েটার চোখের দিকে তাকালেই তার একটু ভয় হয়।তবুও মনে মনে সাহস সঞ্চার করে দরজাটা খুলে দিলো।
সৃজা দরজার সামনে থেকেই এলিজার কনুইয়ে শক্ত করে ধরে টেনে হলরুমে আনলো। এলিজা হাত ছোটানোর চেষ্টা করলো।এলোমেলো কন্ঠে বললো
“হেই ইউ লিভ মাই হ্যান্ড।”
ওর কথা সৃজার কর্ণগোচর হলো না।সৃজার মাঝে যেনো জ্বীন ভর করেছে তার শক্তির সাথে সে পেরে উঠলো না।এলিজাকে এক প্রকার হলরুমের দরজার দিকে ছুড়ে মেরে চিৎকার করে বললো
” আমার স্বামীর রক্ষিতাকে আর এ বাড়িতে দেখতে চাই না আমি।গেট লস্ট।”
সৃজার চিৎকার শুনে বাড়ির সার্ভেন্ট সহ সকলেই মোটামোটি উপস্থিত হলো সেখানে।বিস্ময়ে কেউ কোনো কথা বলছে না।সৃজা এক সার্ভন্টকে ডেকে বললো
“গেস্ট রুম থেকে এর লাগেজটা নিয়ে এসো।দেখবে এই মেয়েটার কোনো তুচ্ছ জিনিসও যেনো না থাকে।” আরেকটা সার্ভেন্টকে ইশারা করে বললো
“টিউলিপের কাছে যাও।ওকে রুম থেকে বেরোতে দিবেনা।আমি চাইনা ও কোনো নোংরা মানুষের সামনে আসুক।” সার্ভেন্ট দুজন বেশ অবাক হলো কারণ সৃজা কখনো তাদের এভাবে আদেশ করেনি।ওদের দাড়িয়ে থাকতে দেখে,কিছুটা চিৎকার করে বললো
“চাকরি যাওয়ার ভয় থাকলে যেটা বলেছি সেটা করো।ফাস্ট।”
সার্ভেন্ট দুজন এক প্রকার দৌড়ে স্থান ত্যাগ করলো।টিউলিপের দাদী এগিয়ে এলো
“এই তুমি আমার মেয়েকে অপমান করছো কেনো?আর সাহস তো কম নয় ওকে ধাক্কা মারলে।আই এম গেটিং অ্যাংরি, ভেরি অ্যাংরি।”
“আপনি অ্যাংরি হলে আমার কিছু করার নেই।মেয়ের সাথে আপনিও চলে যেতে পারেন।” উত্তরের অপেক্ষা না করে তার লাগেজটাও আনতে বললো আরেকজন সার্ভেন্টকে।
সবই উপর থেকে দাড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলো সৃজার শাশুড়ী। তিনি অবাক হলেও কিছুটা আন্দাজ করতে পারছেন পরিস্থিতি।উপরের দিকে তাকিয়ে টিউলিপের দাদী তাকে বললো
“বেয়ান আপনি কিছু বলছেন না কেনো?এই দুদিনের মেয়েটা আমাদের অপমান করছে।”
সৃজার শাশুড়ী নিচে নেমে এলো সৃজার দিকে একবার তাকিয়ে বললো
“আমার কিছু বলার নেই বেয়ান।সৃজা এ বাড়ির ভবিষ্যৎ কর্ত্রী। হয়তো ভবিষ্যতে আমাকেও ওর কথা শুনে চলতে হবে।তাই এখন থেকেই ওর সিদ্ধান্তে আমি সম্মতি জানাচ্ছি।আর তাছাড়া আপনারা যে কাজে এসেছিলেন তা শেষ হয়েছে।এবার আসুন।” সৃজার কাছে এগিয়ে গেলেন তিনি।বললেন
“যা করবে কোনো কিছুকে পরোয়া না করে করবে।মনে রাখবে এসব তোমার।” বলেই সাফওয়ানের দিকে একবার তাকিয়ে উপরের দিকে পা বাড়ালেন।
মেয়ের এ রূপ দেখে সৃজার মা এগিয়ে এলেন।তিনি হলরুমের চেচামেচি শুনে এগিয়ে এসেছে।সৃজার বাবা একটু বাইরে গেছে গাড়ি ঠিক করতে।যদিও এ বাড়ির গাড়ি ব্যবহার করার কথা বলা হয়েছে।কিন্তু উনি আত্মসম্মান বজায় রাখার প্রচেষ্টায় কঠোর।সৃজার কাধেঁ হাত রেখে বললেন
“এসব কি হচ্ছে মা।এটা তোমার শ্বশুর বাড়ি।এভাবে বড়দের অপমান করতে নেই।”
মায়ের দিকে তাকালো সে।গমগমে আওয়াজে বললো
“আমি কোনো ভুল করছিনা মা।যার যে ব্যবহার প্রাপ্য সে সেটাই পাবে।” কথাটা বলে সাফওয়ানের দিকে তাকালো।তার কিছুই বলার নেই যেনো।সৃজার দিকে একবার তাকিয়ে বললো
“তোমার যা ইচ্ছে তাই করো।তবে এ বাড়ি থেকে এক পা বাইরে ফেলবেনা।মনে থাকে যেনো কথাটা।” বলেই গটগট পায়ে চলে গেলো।সৃজা তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে মনে মনে বললো আগে এই মেয়েটাকে দেখে নেই তারপর আপনাকেও ছাড়ছিনা আমি মি.চৌধুরী।
এলিজাও তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো।সৃজা সে দৃষ্টি অনুসরণ করে বললো
“ওইদিকে কি দেখছো?ওর আর কাজ নেই তোমার সাথে।তাই চলে যাচ্ছে।এবার নিজের রাস্তা দেখো।ভবিষ্যতে কারো সংসারে থার্ড পারসন হওয়ার আগে হাজারবার নয় মন দিয়ে একবার ভাববে তাহলেই হবে।নাও গেট লস্ট ফ্রম হেয়ার।” কথাগুলো বলে নিজের মায়ের হাতটা ধরে উপরের দিকে পা বাড়ালো।
যাওয়ার আগে সার্ভেন্টকে উদ্দেশ্য করে বললো ওনারা চলে গেলে দরজাটা লাগিয়ে দিবে।
মা আর বাবাকে বিদায় দিলো সৃজা।মায়ের বিভিন্ন প্রশ্নের কোনো উত্তর দেয়নি সে।বলেছে সময় মতো জানতে পারবে আর এখনই তার বাবাকে এসব না জানাতে।শুধু এটা বলেছে খুব শীগ্রই তাদের কাছে ফিরে যাবে।মায়ের বিচলিত চেহারাটা দেখেও ব্যথিত হৃদয়ে বিদায় জানালো সে।
সাফওয়ানও ভদ্রলোকের মতো শ্বশুড়-শাশুড়ীকে গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে গেলো।সৃজা তার দিকে তাকালো না।
নিজের বাবার প্রতিও রাগ হচ্ছে সৃজার কোনো কিছু না জেনে কেনো তাকে বিয়ে দিলো।শুধু কি টাকা পেয়েই আমি শান্তি পাবো?তিনি কি জানতেন না তার ছোট মেয়ে বেশি টাকা-পয়সা কোনোকালে পছন্দ করে না।বাবাকেও এসবের জবাব দিতে হবে।
মা বাবা যাওয়ার শেষ দৃশ্যটুকু নিজ অক্ষি অগোচর হতেই শাশুড়ীর রুমের দিকে পা বাড়ালো সে।শাশুড়ীকে দেখলো সার্ভেন্টের সাথে কথা বলতে।সৃজাকে দেখে তাকে বিদেয় করলো।সৃজা কোনো ভনিতা ছাড়াই বললো
“আমি ডিভোর্স চাই আম্মা।যদিও আপনাকে বলতে আমার খারাপ লাগছে।কিন্তু এটাই সত্যি কোনো চরিত্রহীনের সাথে আমি সংসার করতে পারবোনা।”
সৃজার শাশুড়ী চকিত বউমার কাঠিন্য মুখটার দিকে তাকালো।শীতল হলো তার চাহনি।কোমল কন্ঠে বললেন
“হুট করে জীবনের বড় সিদ্ধান্ত গুলো নিলে পরে আফসোস করতে হয় আগে ভেবে দেখো ঠিক করে।যা বলছো,যা করছো সব কি ঠিক?”
“কোনটা ঠিক করছিনা আম্মা?বলতে পারেন আমার ভুল কোথায়?”
“এক হাতে তালি বাজে না মা।গতকাল কি হয়েছে সবটাই আমি শুনেছি।কিন্তু তোমার কি এতে দোষ নেই?ঘরে বউ থাকতেও কেনো স্বামী অন্য মেয়ের সঙ্গ চাইবে?এর উত্তর আমাকে দিবে?আর সাফওয়ান আমাকে সবটা বলেছে।আমি চাইবো তুমিও তার পুরো কথা শুনে তারপর সিদ্ধান্ত নাও।”
“আপনি কি বলতে চাইছেন তার কোনো দোষ নেই?”
“আমি তা বলছিনা কিন্তু তোমাদের মধ্যে বিশ্বাসের খুব অভাব।একটা সম্পর্ক তৈরি হতে বিশ্বাসটা খুব প্রয়োজন যেটা তোমাদের মধ্যে নেই।একে অপরকে এখনো ঠিক করে চিনতেই পারোনি তোমরা।”
সৃজা অবাক হলো না তার কথায়।মা’তো সন্তান খারাপ হলেও রক্তের টানে তার কথা বলবে।তবে হ্যা তারও সাফওয়ানের সাথে বোঝাপড়ার দরকার আছে।শাশুড়ীকে কিছু না বলেই স্ব-কক্ষের দিকে পা বাড়ালো সৃজা।
চলবে….