#সৃজা
পর্বঃ১৯
লেখিকাঃআরুনীয়া চৌধুরী
রাগটাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য দুহাত মুষ্টিবদ্ধ করে সৃজার সামনেই দেয়ালে পরপর কয়েকবার ঘুষি মারলো।এতে সৃজার কিছুটা ভয় লাগলো।থামাতে চাইলো তবে অদৃশ্য এক শক্তি তাকে আটকে রাখলো।বৃষ্টির শব্দের মধ্যেও ঘুষি দেয়ার শব্দগুলো শোনা যাচ্ছিলো।
কিছুক্ষণ পর সৃজার দিকে চাইলো সাফওয়ান।ঠান্ডা গলায় বললো
“তোমার এমন কেনো মনে হচ্ছে আমি শুধু তোমার শরীরটাকে চাই,আমি তো সম্পূর্ণ তুমিটাকে চাই।তুমি কেনো বুঝোনা।” করুণ দৃষ্টিতে সৃজার দিকে তাকালো।বা হাত থেকে টপটপ করে রক্ত পরছে।মেঝেতে পরে বৃষ্টির পানির সাথে মিশে যাচ্ছে সে রক্ত।বাইরে বৃষ্টি থেমে গিয়ে মাঝে মাঝে বজ্রপাত হচ্ছে।কিন্তু তা এই মানব মানবীর মাঝে বিস্ময় জাগাচ্ছে না।
সৃজা এগোলো না, বরং কিছুটা পিছিয়ে গেলো।আর দূর্বল হবে না সে।অনেক বোকামি করেছে এ কদিন।যদিও তার বুকের ভেতরটা রক্তাক্ত হচ্ছে ক্ষণে ক্ষনে তবুও সে তা বাইরে প্রকাশ করবেনা।
সাফওয়ান আবারো বললো
“তুমি আমার সাথে এক রুমে থাকতে চাওনি,মেনে নিয়েছি সেটা।কিন্তু লুকিয়ে থাকছো কেনো।তোমাকে না দেখলে তো ভালো লাগে না।বুকের দিকে হাত দিয়ে বললো” It hurts,it realy hurts।”
সৃজা মুখ ফিরিয়ে নিজের অশ্রু লুকালো।এই লোকটা আবার নাটক করছে।আর ভুলবেনা সে এসব কথায়।
“ঠিক আছে তোমার অনুমতি ছাড়া আর কখনো তোমাকে ছুবো না।এবার রুমে চলো।এখানে কেনো পরে আছো?” বলেই এগিয়ে গিয়ে সৃজার হাতটা ধরে চলে যাওয়ার চেষ্টা করলো।
সৃজা ঠায় দাড়িয়ে রইলো।হাতটা দুহাতে ছাড়িয়ে নিলো।কন্ঠে জোর এনেই বললো
“আপনি বলেছিলেন ডিভোর্স ছাড়া যেকোনো শাস্তি মঞ্জুর আপনার।”
সাফওয়ান অবাক হয়ে তাকালো সৃজার দিকে।তার চোখে,মুখে আড়ষ্টভাব নেই,পাথরের মতো শক্ত হয়ে দাড়িয়ে আছে।বৃষ্টির পানিতে অনেকক্ষণ ভেজার কারণে মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।আর কি শাস্তি দিবে তাকে!!এটাই কি বেশি নয়।দুদিন ধরে সে অন্য রুমে আছে।না দেখা দিচ্ছে, না কথা বলছে।মুখটা স্বাভাবিক করে বললো
“কি বলতে চাও তুমি?”
“আজ বাবা বাসায় এলেই শুনবেন।এ বাড়ির প্রধান যিনি তার সামনেই বলবো।অপেক্ষা করুন।” কথাটা বলে সাফওয়ানকে মারিয়ে রুমে ঢুকলো।রুমেই এসেই কি যেনো খুজতে লাগলো।
সাফওয়ান চলেই যাচ্ছিলো।সৃজা হাতটা ধরে আটকে দিলো।বিছানায় বসিয়ে হাতে ড্রেসিং করে দিলো।সৃজা আপনমনে সাফওয়ানকে কতক্ষণ বকে গেলো।নিজে ভিজা কাপরে আছে সেদিকে তার খেয়াল নেই।মেঝেটাও ভিজে গেছে।সাফওয়ান পুরোটা সময় সৃজার দিকে তাকিয়ে রইলো।
সরতে গিয়ে ভিজা মেজেতে পরতে চলেছিলো সৃজা।কিন্তু পরক্ষণেই সামলে নিলো।সাফওয়ান কাছে আসার আগেই বললো
“আমি ঠিক আছি।এবার নিজের রুমে যান।”কথাটা বলেই গটগট পায়ে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালো।সাফওয়ান কতক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে রইলো।
অগত্যা সাফওয়ানকে উঠতে হলো।কোনো এক অদৃশ্য শক্তি তাকে এ রুমে বেধে রাখছে কিন্তু তাকে যেতে হবে।নাহলে সৃজাই হয়তো এ রুম ছেড়ে দিবে।ফোস করে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে রুম ত্যাগ করলো সাফওয়ান।
যাওয়ার সময় সার্ভেন্টকে বলে গেলো সৃজার রুম পরিষ্কার করে দিয়ে আসতে।রুমে বৃষ্টির পানি ছড়িয়ে রয়েছে।
ড্রয়িং রুমে পিন পতন নীরবতা বিরাজ করছে।সৃজার শাশুড়ী আর শ্বশুর সোফায় বসে আছে।সাফওয়ানও আরেক পাশের সোফায় বসে আছে।সানিয়াকে থাকতে বললেও কাজের অজুহাতে সে আসেনি এখনো।নীরবতা ভেঙে ইমরান চৌধুরী বললেন
“কি বলতে চাও বলো বউমা?”
সৃজা স্বাভাবিকভাবেই বললো
“আমি গ্রাজুয়েশন করতে বিদেশ যেতে চাই।এ বাড়ির সব ছেলে-মেয়েই বিদেশে পড়েছে।তাই আমারও ইচ্ছা চৌধুরী বাড়ির বউ হিসেবে আমিও বিদেশে পড়বো।”
সাফওয়ান অবাক হয়ে সৃজার দিকে তাকিয়ে রইলো।কিছুটা জোরেই বললো
“কোথাও যাবে না তুমি।বাংলাদেশে পড়তে হলে পড়বে আর না হয় পড়ার দরকার নেই।”
সাফওয়ানের দিকে তাকিয়ে ইমরান চৌধুরী বললেন
“তুমি চুপ থাকলেই ভালো হবে।আমাকে কথা বলতে দাও।আর আমার মনে হয় না বউমা ভুল কিছু দাবী করেছে।”
বাবার কথায় কিছুটা দমে গেলো সাফওয়ান।
সৃজার শাশুড়ীও অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো।ইমরান চৌধুরী ট্রে থেকে চায়ের কাপটা নিয়ে একটা চুমুক দিলেন তারপর বললেন
“তোমার শাশুড়ী চেয়েছিলো তুমি বাংলাদেশের কোনো রেপুটেড ভার্সিটিতে অ্যাডমিশন নাও।কিন্তু আমার ইচ্ছে ছিলো তুমিও অ্যাব্রোডে পড়ো।”
সৃজার শাশুড়ী মাঝখান থেকে বললেন
“সৃজা এ বাড়ির বউ তাই আমার মনে হয় ওর এখানে থেকেই পড়া উচিৎ। দূরে যাওয়ার কি প্রয়োজন,আমি বুঝতে পারছিনা।”
ইমরান চৌধুরী বললেন
“তুমি খুব ভালো করেই জানো এ বাড়ির ছেলে-মেয়ে আর বউদের মধ্যে কোনো পার্থক্য কখনোই করা হয়নি।তাই সে হিসেবে সৃজার ইচ্ছে পূরণ হবে।”
কথাটা শোনামাত্র এক প্রকার রাগ করেই সাফওয়ান ড্রয়িং রুম ত্যাগ করলো।তাহলে এই শাস্তিই দিতে চেয়েছিলো সৃজা তাকে।
আবারও চায়ের কাপে চুমুক দিলেন তিনি।বললেন
“কয়েকদিন পর সাফওয়ান আর তোমাকেই সব সামলাতে হবে তাই সে অনুযায়ী তোমার যোগ্যতাও অর্জন করা দরকার।”
“তুমি নিজে থেকে কথাটা বলায় আমি খুশি হয়েছি।”
সৃজার কথাটা পছন্দ হয়নি সে তো আর ওনাদের কোম্পানি সামলানোর জন্য পড়তে চায়না।নিজের পায়ে দাড়াতে চায় সে।নিজের দেশের জন্য কিছু করতে চায়।সৃজা ইতি উতি না করে বললো
“আমি মালয়েশিয়া যেতে চাই পড়ার জন্য।”
“সে তো ভালো কথা,তুমি যেখানে চাও সেখানেই পড়তে পারো।তাহলে আমি কিছুদিনের মধ্যেই সবকিছুর ব্যবস্থা করছি।”
“আপনাকে কোনো ব্যবস্থা করতে হবে না বাবা।মালয়েশিয়া আমার বড় বোন থাকে আমি সেখানেই পড়বো।আর দুলাভাই সব ব্যবস্থা করতে পারবে।আমি চাই না আপনি এ ব্যাপারে কষ্ট করুন।”
“কষ্ট কেনো বলছো।আর মান্থলি একটা খরচ আছে সেটার ব্যবস্থাও আমি করে দিবো।চৌধুরী বাড়ির বউ হয়ে অন্যের উপর নির্ভর হয়ে তোমায় চলতে হবেনা।”
অগত্যা সৃজাকে তাই মেনে নিতে হলো।মাথা নিচু করে নিজের রুমের দিকে হাটা দিলো।
বিদেশ যাওয়ার আগে আইএলটিএস পরীক্ষা দিতে হবে।এটাও ভাবলো সে।বিদেশ যাওয়ার আগে প্রায় তিন মাস সময় আছে তার হাতে।
রুমের লাইটটা অন করেই ভুত দেখার মতো চমকে উঠলো সৃজা।সাফওয়ান বিছানায় শুয়ে আছে।হাতে তার সিগারেট,তবে ধরায়নি সেটা।আঙ্গুলের মাঝে নিয়ে নাড়াচাড়া করছে।সৃজাকে দেখে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললো
“ওহ তুমি এসে গেছো।যাও লাইটারটা নিয়ে এসো।বোধ হয় ওই রুমেই ফেলে এসেছি।সিগারেটটা ধরাতে পারছিনা একটা লাইটারের জন্য।” বলে আবারও সৃজার রুমে রাখা দ্য কিস পেইন্টিংটার দিকে তাকিয়ে রইলো।
সৃজাও সেদিকে দৃষ্টি দিলো।নাহ্ এই লোকটা কখনোই ভালো হবেনা।বেশরম কোথাকার!!কত কিছুই তো আছে এরুমে, তোর ওই দিকে তাকানোর দরকার কি?কতবার ভেবেছে পেইন্টিংটা এ ঘর থেকে সরানোর কথা বলবে কিন্তু মনেই ছিলো না।
“দাড়িয়ে আছো কেনো?নাকি ভাবছো আমাদেরও ওরকম পোজে একটা ছবি তোলা দরকার।”বলেই একটা দুষ্টু হাসি দিলো।সৃজার গা জ্বলে গেলো মনে হচ্ছে।
” এই অনেক বলেছেন।এখনি এ রুম থেকে যাবেন।আমার আপনাকে সহ্য হচ্ছে না।প্লিজ যান এখান থেকে।”বলেই এক আঙ্গুলে দরজাটা নির্দেশ করলো।
সাফওয়ান সাথে সাথে বেড থেকে উঠে সৃজার চোয়াল আকরে ধরলো এক হাতে।হাতের সিগারেটটা মেঝেতে ফেলে এক পা দিয়ে পিষতে শুরু করলো।দাঁতে দাঁত চেপে বললো
“আমি তোকে বলেছিলাম ডিভোর্স ছাড়া যেকোনো শাস্তি দিতে,তুই দিয়েছিস শাস্তি।এই রুমে থাকিস তা মেনে নিয়েছি।কিন্তু তুই অ্যাব্রোড কেনো যাবি?”
সৃজা সাফওয়ানের হাতটা ছাড়িয়ে গলায় ক্ষানিকটা জোর এনে বললো
“আপনি বলেছিলেন আমি যে শাস্তি দিবো সেটাই মেনে নিবেন।তাহলে জেনে রাখুন এটাই আপনার শাস্তি।”
সাফওয়ান কিছুটা থমকালো।বললো
“না তুমি যেতে পারবেনা।এখানে থেকেই পড়বে।ড্যাডকে না করে দিবে তুমি।”
“কেনো না করবো আমি?যেনো পরবর্তীতে আপনার রক্ষীতাদের বলতে সুবিধা হয় আমি মূর্খ।যাতে আপনি বলতে পারেন আমি আপনার স্টান্ডার্ডের না। ” সৃজার কথায় অভিমান স্পষ্ট।কিছুটা থেমে আবারো বললো
“নাকি আমার শরীরের মায়া ছাড়তে সমস্যা হবে আপনার?”
“সৃজা!!!এবার কিন্তু বেশি হয়ে যাচ্ছে।”
“কোনোটাই বেশি হচ্ছে না মি.সাফওয়ান চৌধুরী।আমি বিদেশ যাবোই।”
সাফওয়ান হার মেনে নিলো।শান্ত ভঙ্গিতে বললো
“বিদেশ থাকবে তো মাত্র পাঁচ বছর তারপর তো আমার কাছেই ফিরতে হবে তোমাকে।তাই যেতে দিচ্ছি।তাই বলে ভেবো না তুমি সাফওয়ানের নাগালের বাইরে।তোমার যেকোনো বিষয় তোমার আগে আমার জানা হয়ে যাবে।তাই সাবধান।”
চলবে…..