#সৃজা
পর্বঃ২০
লেখিকাঃআরুনীয়া চৌধুরী
আজ একটা নতুন সকাল শুরু হলো সৃজার জন্য।সবকিছুই তার জন্য নতুন।এই বেলকনিটা থেকে সূর্য দেখা যায় না যেমনটা সাফওয়ানের রুম থেকে দেখা যায়।তবুও এই রুমটা সৃজার পছন্দ।বেলকনির গাছগুলোতে পানি দিয়ে নিচে নামলো সে।
রান্নাঘরে গিয়ে কফির বক্সটা নামাতেই সৃজার শাশুড়ীর আগমন ঘটলো।সকালের নাস্তা কি হবে তাই বলতে এসেছে হয়তো।সৃজাকে কিচেনে দেখে কিছুটা অবাক হলেন।তবে মুখটা গোমড়া করেই রইলেন।অন্যদিন হলে বলতেন তুমি করছো কেনো?সেফকে বললেই হতো।তবে সৃজাও বলতো সামান্য কাজের জন্য তাকে না বলাই ভালো।আর তাছাড়া সৃজার নিজের কাজগুলো নিজের করতেই ভালো লাগে।এ বাড়িতে আসার পর কোনো কাজই তাকে করতে হয় না।
কাপের টুংটাং শব্দ শোনা যাচ্ছে কিচেন থেকে।সাফওয়ান এক্সারসাইজ করতে যাবে।ফ্রিজ থেকে ওয়াটার বোতলটা নিতে গিয়ে কিচেনে চোখ পরলো তার।সৃজাকে কিচেনে দেখেও না দেখার ভান করে চলে গেলো।এ পাঁচ বছর ওকে ছাড়া থাকার অভ্যাস করতে হবে।তাই এখন থেকেই নিজেকো সামলে নিচ্ছে।যদিও তার ভুলের কারনেই সৃজা তাকে এক প্রকার শাস্তি দিচ্ছে।তবুও এটাই বা কম কিসে, সবশেষেতো সৃজার ঠিকানা সাফওয়ানই।
নাস্তার টেবিলে নীরবতা ঠেলে ইমরান চৌধুরীর পিএস মো.কাদির এসেছে।তিনি মূলত সৃজার জন্যই এসেছেন।কিছু কাগজপত্র আছে যেগুলোতে সৃজার সাইন দরকার।আইএলটিএস করার জন্য আজকেই ফরম পূরণ করে পাঠাতে হবে।কাল থেকে ক্লাস করতে হবে।কাগজগুলো সাইন করে সৃজা উপরে চলে গেলো।পুরোটা সময় সাফওয়ান খাবারের দিকে মনোযোগ দিয়ে রেখেছিলো।
বিকেলের দিকে সৃজার জন্য রাখা স্যার আসলো পড়াতে।সৃজার খারাপ লাগলেও তাকে বললো আর পড়বেনা।সে বিদেশ যাবে পড়তে।মনে মনে ঠিক করে রাখলো কোর্স কমপ্লিট না করলেও বাবাকে বলে পুরো টাকাটাই স্যারকে দেয়ার কথা বলবে।স্যারের প্রতি সৃজার অন্যরকম এক মায়া জন্মেছে।তবে সেটা প্রণয়ের নয় ভাই-বোনের।সৃজার হয়তো ভাই নেই কিন্তু এই লোকটাকে ভাই বলতে তো সমস্যা নেই।
আমাদের মনের অজান্তেই কতজনের সাথে কতরকম সম্পর্ক গড়ে উঠে।সবই সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা।কারণ জীব সৃষ্টি করেছেন যিনি, মায়াও সৃষ্টি করেছেন তিনি।একটা মানুষ ভালো হোক আর মন্দ হোক একসাথে থাকতে থাকতে তার প্রতিও মায়া জন্মে যায়।এটা মানুষের স্বভাবজাত,বিশেষ করে মেয়েদের।মেয়েদেরকে সৃষ্টিকর্তা মায়া দিয়েই সৃষ্টি করেছেন হয়তো।
পরদিন সকালে সৃজা গাড়িতে করে কোচিং সেন্টারে পৌঁছালো।ড্রাইভার বলে গেলো সময়মতো এসে যেখানে দিয়ে গেছে সেখান থেকেই নিয়ে যাবে।আজ সৃজা শাড়ি পরেনি হালকা গোলাপি কালারের থ্রি-পিছ পরেছে,তবে তার মাঝে বৈবাহিক চিহ্ন হিসেবে শুধু নাকফুলটা রয়েছে।যদিও আজকাল সবাই ফ্যাশন হিসেবে এটা ইউজ করে থাকে।
অনেক খোজাখোজির পর নিজের কাঙ্ক্ষিত ক্লাসে ঢুকলো সৃজা।ক্লাসে ঢোকা মাত্রই সব নতুন মানুষের ভিরে নিজেকে অপরিচিত লাগছিলো সৃজার।দ্বিতীয় সারির একটা চেয়ারে গিয়ে বসলো সে।ক্লাসের বেশিরভাগ মেয়েই শার্ট জিন্স অথবা টপস জিন্স পরা।দেখেই মনে হচ্ছে তথাকথিত আধুনিকমনা ধনী ঘরের সন্তান।কিছু ছেলে রয়েছে যারা সৃজার দিকে তাকিয়ে রইলো।সৃজার মনে হলো হয়তো তার অন্যরকম বেশ-ভূষাই এর কারণ।কিন্তু কারণটা ছিলো ভিন্ন সৃজা যদি জানতো ছেলেগুলো তার রূপের প্রেমে পরেছে তাহলে হয়তো কখনোই তাদের দিকে তাকাতো না।
ক্লাস শেষ হতেই একটা ছেলে সৃজার পিছু পিছু আসা শুরু করলো।সৃজা প্রথমবার পিছনে তাকিয়ে কাউকে দেখলো না।দ্বিতীয়বার পিছনে তাকাতেই তার খুব নিকটে একটা ছেলেকে দেখলো।এতো কাছে হওয়ায় সৃজা কিছুটা পিছিয়ে গেলো।ছেলেটা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললো
“হাই আ’ম তামিম জোবায়ের।হোয়াট অ্যাবাউট ইউ?”
একেতো অপরিচিত, তার উপর সৃজাকে এক প্রকার ইচ্ছে করে ভয় দেখালো।সৃজার মনোক্ষুণ্ণ হলো এতে।নিজেকে ধাতস্থ করে বললো
“আপনার নাম জেনে আমি কি করবো?আর আমি অপরিচিত মানুষের সাথে কথা বলিনা।”
বলেই সৃজা চলে যাচ্ছিলো।ছেলেটা মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বললো
“পরিচিত হওয়ার জন্যইতো এসেছি।এখানে কোথায় থাকো?”
সৃজা কথাগুলো না শোনার ভান করে সকালে বলা ড্রাইভারের নির্দিষ্ট স্থানে দাড়ালো।ছেলেটা সেখানেও দাড়িয়ে কথা বলতে চাইলো।সৃজা এড়িয়ে গেলো।তার অস্বস্তি হচ্ছিলো।পরিচিত গাড়িটা দেখতেই তাড়াহুড়ো করে উঠে পরলো।ড্রাইভারকে বললো
“চলুন চাচা।” পরক্ষণেই নিজের পাশের সিটে তাকিয়ে আরো অবাক হলো সে।পাশে সাফওয়ান বসা সে এক ধ্যানে তাকিয়ে রয়েছে সৃজার দিকে।অফিসিয়াল গেটআপে কোলে ল্যাপটপ রাখা সাফওয়ানের।কিছুটা জানালার দিকে সেটে বসলো সৃজা।
গাড়িটা ছাড়তেই পিছনে তাকিয়ে ছেলেটাকে দেখলো সাফওয়ান।সে এতক্ষণ খেয়াল করেছে,একটা ছেলে সৃজার সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছে।আর সৃজাও এড়িয়ে গেছে।তবে তা বুঝতে না দিয়ে বললো
“ছেলেটা কে?আর তোমার সাথে কথা বলছিলো কেনো?”
কথাটা কর্ণগোচর হতেই সৃজা তেতে উঠলো দাতে দাত চেপে বললো
“আমার সাথে পরিচিত হওয়ার চেষ্টা করছিলো।কিন্তু ছেলেটা কে আপনি জেনে কি করবেন।নাকি সবাইকে নিজের মতো মনে করেন।” কথাটা কিছুটা আস্তেই বললো যাতে ড্রাইভারের কর্ণগোচর না হয়।
সাফওয়ান মাথার চুলে একবার হাত বুলিয়ে সৃজাকে বললো
“এক কথা বারবার বলো না।অযথা রাগিয়ে দিয়ো না।তবে এসব ছেলেপেলে থেকে একশো হাত দূরে থাকবে।”
সৃজা আর কথা বাড়ালো না।জানে কথা বললেই তার ডালপালা গজিয়ে এখানেই ঝগড়া শুরু হয়ে যাবে।তাই শান্ত থাকলো।তবে সাফওয়ান কিছুক্ষণ পর বললো
“তোমার হাতের চুড়ি কোথায়। দেখলে তো মনে হয় না বিবাহিত।এভাবে কি তুমি আমার থেকে দূরে যাওয়ার চিন্তা করছো?”কপাল কুচকে কতক্ষণ সৃজার দিকে তাকালো।
এই লোক বলে কি?মাথা খারাপ হয়ে গেছে।কোন কথা থেকে কোথায় যাচ্ছে।ওইদিন চুড়িগুলো খোলার পর আর পরা হয়নি।আর সে কিসব মনে করছে।মনে করলেই কি?এতে সৃজার কিছু আসে যায় না।সে নীরব থাকলো।
” কথা বলছো না কেনো?নাকি কাউকে পছন্দ হয়েছে আজ?ওই ছেলেটাকে পছন্দ হয়েছে তোমার?ওই ছেলেকে দেখলে মনে হয় একটা বখাটে,নিশ্চয় বাবা মায়ের থেকে টাকা নিয়ে নেশা ভান করে।এইসব ছেলে ভালো হয় না।”সাফওয়ান বোঝানোর চেষ্টা করছে সৃজাকে।
হায় আল্লাহ!!এই লোক কোথা থেকে কোথায় চলে যাচ্ছে।তবে কথাগুলো শুনে সৃজার রাগ না হয়ে হাসি পাচ্ছে।কিন্তু এবার আর চুপ থাকতে পারলো না।
“আপনি চুপ করবেন?এসব কি বলছেন?আর আমি কি বুঝি না আমার জন্য কোনটা ভালো কোনটা খারাপ।”
সাফওয়ান বিরবিরিয়ে বললো
“তুমি সবই বুঝো শুধু আমাকে বুঝো না।”
সৃজা জিজ্ঞেস করলো
“কিছু বললেন।”
“বলার তো অনেক কিছুই ছিলো কিন্তু তুমিতো শুনবেনা।”
কথাটা বলেই আবার ল্যাপটপে টাইপিং করা শুরু করলো।বাসায় পৌছা মাত্র সৃজা তাড়াতাড়ি নেমে পরলো। সৃজার একটা কানের দুল সিটে পরে রইলো সৃজা জানতেও পারলো না।কিন্তু যে দ্বিতীয় ব্যক্তিটা দেখতে পেলো সে তা নিজের পকেটে পুরে রাখলো যত্ন সহকারে।
সৃজা বাসায় ঢুকতেই টিউলিপ তাকে জড়িয়ে ধরলো।
“কি হয়েছে আমার মাম্মাটার?”
টিউলিপ আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করলো,সৃজা সেদিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো।সে এখন আর খাবেনা।সার্ভেন্ট পাশে এসে বললো
“দেখুন না ম্যাম খেতে চাচ্ছেনা।”
“তুমি যাও।এখন আর খাওয়ানো লাগবেনা।টিউলিপ আজ আমার সাথে খাবে।”
টিউলিপকে সাথে নিয়েই উপরের দিকে পা বাড়ালো সে।সাফওয়ান দূরে দাড়িয়ে তা দেখলো।কত সহজেই সে এই বাচ্চাটার মায়ের জায়গা দখল করেছে।টিউলিপ তার মামানি বলতে পাগল।এই বাচ্চাটাকে রেখে সে অন্য কোথাও যাবে কিভাবে।ভাবনাদের ঠেলে সে নিজের রুমে গেলো।
ছেলেকে এসময় বাসায় দেখে সাফওয়ানের মা খুবই অবাক হলেন।তবে সেই সাথে খুশিও হলেন।আজ নিশ্চয়ই বাসায় খাবে তার ছেলে।তাড়াতাড়ি সবকিছু রেডি করতে গেলেন তিনি।
দেখতে দেখতে প্রায় এক মাস কেটে গেলো।এভাবেই সাফওয়ানের সাথে লুকোচুরি করে তার দিন কাটছে।তবে তার শাশুড়ী এখন পুরো স্বাভাবিক ব্যবহার করে।সাফওয়ান প্রায় দিনই ওকে আনতে যায়।আর ওই ছেলেটাও সৃজার সাথে কিছুদিন কথা বলার চেষ্টা করে এখন হাল ছেড়ে দিয়েছে।
সৃজা এখন কোচিংএ যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে।সে সবসময়ই থ্রি পিছ পরে যায়।তবে সাফওয়ানের রাগের বশবর্তী হয়ে এখন হাতে চুড়িও পরতে হয়। এমন সময় দরজায় নক হলো।সৃজা অনুমতি দিলো আসার।একজন সার্ভেন্ট এসেছে।তড়িঘড়ি করে বললো
“ম্যাম বড় ম্যাম অসুস্থ হয়ে পরেছে আপনাকে ডাকছে।”
সৃজা কথাটা শোনামাত্র তার রুমে গেলো।দেখলো একজন সার্ভেন্ট ওনার লাগেজ গোছাচ্ছে আরেকজন তার মাথায় মালিশ করছে।বিধ্বস্ত অবস্থা তার।সৃজা যেয়ে তাকে ধরলো।বললো
“কি হয়েছে আম্মার?” সৃজার কথা শোনামাত্র তিনি হাতগুলো ধরে নিজের কাছে বসালেন।সৃজা,
“মা রেডি হয়ে নাও,গ্রামের বাড়ি যেতে হবে।আমার মায়ের অবস্থা বেশি ভালো না।বড় ভাই ফোন করে বললো,মা নাকি মৃত্যশয্যায়।”বলেই কাদঁতে লাগলেন।
কিছুক্ষণ পর আবার বললো
“মা বোধহয় এবার আমাদের ছেড়ে চলেই যাবে।সাফওয়ান আর ওর বউকে শেষবার দেখতে চায়।আমার সাফীটা তার চোখের মণি ছিলো।সাফওয়ানও তার নানীজানকে কম ভালোবাসেনা।”
সৃজা এই প্রথম ওনাকে কাদঁতে দেখলো।অবাক হলেও বুঝতে পারলো মায়ের জন্য সব সন্তানেরই আলাদা টান থাকে।সে টানেই উনি অসুস্থ হয়ে পরেছেন।মায়ের মৃত্যু সংবাদ সব সন্তানের জন্যই যেনো একটা অভিশাপ।
কথা না বাড়িয়ে রেডি হয়ে নিলাম।বাড়ির বউ হিসেবে এ দায়িত্ব পালন করতেই হবে।টিউলিপও যাবে।ওর জামাকাপড় গুলোও গুছিয়ে নিলাম।টিউলিপ আনন্দে আছে সে ঘুরতে যাবে।বাচ্চারা আসলেই সিরিয়াস বিষয় বোঝে না,যার জন্য তারা সবচেয়ে আনন্দে সময় পাড় করতে পারে।
রেডি হয়ে নিচে নামার আগে সাফওয়ান ফোন দিলো।ওর কিছু ড্রেস গুছিয়ে নিতে বললো।সময়টা এমন যে না ও করা যায় না।সৃজা শাশুড়ীর কাছে এসে তাকে নিজে থেকে ধরে গাড়িতে উঠালো।টিউলিপ একপাশে আর শাশুড়ী একপাশে মাঝখানে সৃজা বসে আছে।সামনের সিটে সৃজার শ্বশুরমশায়।সানিয়া আর সাফওয়ান অফিস থেকেই একসাথে যাবে।অফিসের জরুরি কিছু নিয়ম আছে যেগুলো পালন করতেই হবে।মানুষ মরে যাচ্ছে তারপরও তাদের নিয়ম শেষ হয় না।কি হবে এসব নিয়ম মেনে।
চলবে…..