#সৃজা পর্বঃ২২ লেখিকাঃআরুনীয়া চৌধুরী ঘুম ভেঙে যাওয়ার পর সৃজা বোঝার চেষ্টা করলো সে কোথায় আছে।বাইরে অন্ধকার ছেয়ে গেছে।কিছুক্সণ বিছানার সরাসরি জানালার দিকে তাকিয়ে রইল।রুমটাও আবছা অন্ধকার।সাফওয়ান ওর পাশেই আধশোয়া হয়ে ফোন টিপছে।ফোনের আলোটাও হালকা।সৃজা খেয়াল করলো ওর হাত এতক্ষণ সাফওয়ানকে জড়িয়ে ধরে ছিল।বোধগম্য হতেই হাতটা সরিয়ে ফেললো। ফোনের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেই সাফওয়ান বললো “ঘুম ভেঙেছে তাহলে।যাও ফ্রেশ হয়ে নাও খেতে হবে।আমারও কিছু খাওয়া হয়নি।” সৃজা শাড়িটা ঠিক করে বিছানা থেকে নামল।সাফওয়ানের দিকে একবার তাকিয়ে ওয়াশরুমে গেলো। সাফওয়ান আর সৃজা খেয়ে নিল।প্রচন্ড খিদে আর ঘুমের মধ্যে ঘুমকে প্রাধান্য দিয়েছিল।এখন বুঝতে পারছে শরীর কি পরিমান দূর্বল হয়ে পরেছিল।খাবার না খেলে যেনো এনার্জি কোথায় হারিয়ে যায়।খেয়ে হাত দুটো ধুতে গেলো। ওয়াশরুম থেকে বের হতে সাফওয়ানকে আর দেখল না।বিছানায় একজন কিশোরী মেয়ে বসে আছে।বয়স ১৪ বা ১৫ র কাছাকাছি হবে।পরনে তার টপস আর স্কার্ট।আর দরজার পাশে ওর বয়সী আরেকটা মেয়ে তাকে ইশারা করছে কিছু।সৃজা তার পাশে বসলো। “তোমার নাম কি?আর তুমি আমার কি হও আমি কিন্তু জানিনা।” মুচকি হেসে বললো সৃজা। মেয়েটি যেনো সংকোচ কাটিয়ে উঠতে পারল।বললো “আমি সাফওয়ান ভাইয়ার মেজো মামার মেয়ে নোভা আর ওইযে বাইরে সে হচ্ছে বড় চাচ্চুর মেয়ে নাতাশা।তুমি আমার বউমনি।তোমাদের বিয়েতে তো গিয়েছিলাম।কিন্তু তোমার সাথে কথা বলতে পারিনি।” “কেনো?কথা বলতে পারোনি কেনো?” সৃজা অবাক হয়ে বললো। “বাহ্ রে পরদিনই আমার পরীক্ষা ছিল না।তাই বিয়েটা দেখেই তোমাকে বাড়ি আনার সাথে সাথে চলে এসেছি।” “ওহ আচ্ছা, আমার এতো সুন্দর সুন্দর কিউট কতগুলা ছোটবোন আছে জানতাম নাতো।নাতাশা ভেতরে আসো।”নাতাশা সংকোচ ঠেলে ভিতরে এসে নোভার গা ঘেসে দাড়ালো। “আর বলো না বউমনি ও ভয় পাচ্ছিলো।ভেবেছিল তুমি রাগ করবে।” “হায় আল্লাহ,আমি রাগ করবো কেনো?” “কি জানি?সানিয়া আপু তো আমাদের সাথে কথা বলে না কিছু বললে রাগ করে।তাই ভাবলাম.. ” তা কি ভাবলে আমিও রাগ করবো।আচ্ছা বাদ দাও আগামিকাল তোমরা দুজন আমাকে বাড়িটা ঘুরিয়ে দেখাবে।পারবে তো?” “আরে এটা কোনো ব্যাপার হলো।তোমাকে পুরো গ্রাম ঘুরিয়ে দেখাবো।” “আচ্ছা এখন নিচে যাই চলো।”নোভা আগে আগে চলে গেলো আর নাতাশা আমার পিছু পিছু আসছে।করিডর বেয়ে নিচে নামার আগেই একটা ছেলে বউমনি বলে ডাক দিলো।আমি নাতাশার দিকে তাকালাম ” উনি আমার বড় ভাই পাবেল,কলেজে পড়ে।তোমাকেই ডাকছে বউমনি।”সৃজা বললো “হ্যা বলো” “তোমাকে ডাকছে দাদু।সাফওয়ান ভাইয়া আর ফুপ্পিও সেখানে।” নাতাশাকে নিয়ে পাবেলের পিছু পিছু গেলাম।বিশাল খাটটার একপাশে গিয়ে দাড়ালাম।নোভা চলে গেছে।নানুমনি এখন কথা বলছে স্বাভাবিকভাবে।আমাকে দেখে কাছে ডাকলেন।ধীর পায়ে তার পাশে গিয়ে বসলাম।আম্মাকে কিছু ইশারা করলেন।আম্মা বললেন “এখনই কি প্রয়োজন এসব করার?তুমি সুস্থ হও তারপর নিজ হাতে দিও।” নানুমনি অসুস্থ শরীরেই এক প্রকার রাগ করলেন।বললেন “যা কইছি তাই করো।নাইলে আমি উঠমু এখন।” আম্মা অগত্যা নানুমনির আলমিরাটা খুলে একটা বাক্স বের করলেন।বক্সটা অনেক কারুকার্য খচিত,খয়েরি কালার।বাক্সের ভাজে ভাজে চিকন কালো রেখা পরেছে।নানুমনির সামনে এনে বাক্সটা খুললেন।পুরো বক্সটা গয়না ভর্তি।সব পুরোনো ডিজাইনের।আম্মাকে একটা হার ইশারা করে বললেন পরিয়ে দিতে।সৃজার কন্ঠনালীর চিকন হারটার উপরই ওইটা পরিয়ে দিলো আম্মা।আমার অস্বস্তি হচ্ছে।কোনোরকমে লজ্জা পাওয়া মুখে বললাম “এটার কি দরকার ছিল নানু?আমারতো অনেক আছে।” নানুমনি ফোকলা দাতেই হাসি দিলেন।বললেন ” না দিলেতো আমি শান্তি পাইতাম না বইন।তোরে তো কিছুই দেয়া হয় নাই।বিয়াতেও যাই নাই।তোর নানা মরার পর আর এই গায়ের বাইরে যাই নাই।ভাগ্যিস অসুখ করলো না হয় এই পুতলিটা তো দেখবার পাইতাম না।” “এভাবে কেনো বলছেন নানুমনি।আপনার অসুখ না হলেও তো আমরা আসতে পারি।” “হ কত আইছো তোমরা।আমার মাইয়াও তো আহে না দেখতে।” বলে আম্মার দিকে কঠোর দৃষ্টি দিলেন।আম্মা চুপ করে বসে রইলেন। সাফওয়ান হয়তো আমার অস্বস্তি বুঝতে পারল।ও জানে আমি ভারি গহনা পছন্দ করি না।একবার গয়না পরে গলার জায়গায় জায়গায় লাল ছোপ পরে গেছিলো।সাফওয়ান দেখে প্রচন্ড রেগে গেছিলো। বললো “নানীজান আমি এখন যাচ্ছি আবার পরে এসে দেখা করে যাবো।ঠিক আছে?তুমি রেস্ট নাও।” বলেই নানুর সামনেই আমার হাতটা ধরে বেরিয়ে আসলো।রুমে এসে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাড় করিয়ে গয়নায় হাত দিল।আমি বাধা দিয়ে বললাম “আমি পারবো।ছাড়ুন!বেশি আদিক্ষেতা দেখাতে হবে না।” তবুও সরল না।গয়নাটা খুলে টেবিলের উপর রেখে বললো “ডান।এবার যেতে পারো।” কথাটা শোনার সাথে সাথে বেরিয়ে এলো সৃজা।সিড়ি দিয়ে নিচে নামতে নামতে দেখলোএক পাশে রান্নাঘরের সামনের জায়গাটা জুড়ে সবজি,মাছ,মাংস কাটাকাটি হচ্ছে।বড় মামী সবটা খেয়াল করছে।আর তাড়া দিচ্ছে।ওনাকে খুবই ব্যস্ত দেখাচ্ছে।আমাকে দেখে বললেন “ওমা!নতুন বউ তুমি এখানে কেনো?কিছু লাগলে তুলিকে বলবে।এই তুলি কোথায় গেলি?”মুহূর্তেই তুলি এসে হাজির হলো। ” এই তুই থাকতে নতুন বউকে নিচে নামতে হলো কেনো?” সৃজা হতভম্ব হয়ে গেলো তার কথায়।এখানে তুলির দোষ কোথায়। “আসলে মামী আমি এমনিতেই নিচে এসেছি।কোনো প্রয়োজন হলে তুলিকে বলে নিবো।আপনি চিন্তা করবেন না।” “কি বলছো মা চিন্তা করবো না।তুমি হচ্ছো চৌধুরী বাড়ির রাণী। তোমার কোনো অসুবিধা হলে তোমার বড় মামা আমায় আস্ত রাখবেনা।এই তুলি যা নতুন বউয়ের আশে পাশেই থাকবে।” সৃজার অস্বস্তি এবার চরমে।তারা এমন কেনো?অগত্যা উপরে চলে আসতে হলো।নিজের রুমে যাওয়ার আগে দেখলো বামদিকের রুমটায় নোভা।সেদিকেই গেলো সে।দরজায় নক করলো। “আরে বউমনি আসো, ভিতরে আসো।নক করছো কেনো?” “তুমি এ রুমে থাকো।বাহ্ সুন্দর তো।” ” হ্যা এই রুমে আমি আর নাতাশা থাকি আর পাশের রুম তানভির ভাইয়ার।” “তানভির কে?” “বড় চাচ্চুর ছেলে।আজকে রাতেই আসার কথা।হয়তো রাস্তায় আছে।দাদু অসুস্থ তাই আসবে।” “কেনো এমনিতে আসে না?” নোভা কিছুটা মন খারাপ করে বললো “ভাইয়া ভার্সিটির প্রফেসর তাই ব্যস্ত থাকে অনেক।বাড়িতে বেশি আসেনা।” “ওহ আচ্ছা।” টিউলিপের কথা মনে পরে গেলো।বাড়িতে ঢোকার পর ওকে আর দেখিনি।তাই বললাম “টিউলিপ কোন রুমে আমাকে একটু নিয়ে যাবে?” “আরে বউমনি এভাবে বলছো কেনো।চলো এক্ষুনি নিয়ে যাচ্ছি।সানিয়া আপুর রুমেই আছে।এতক্ষণে হয়তো ঘুম থেকে উঠে গেছে।আমি কিন্তু ভিতরে ঢুকবো না।আপু রাগ করতে পারে।” নোভার পিছু পিছু যাচ্ছি আর ভাবছি বুবু ভেতর থেকে যতটা নরম বাইরে থেকে ততটাই শক্ত আবরণে ঢাকা।এ বাড়ির প্রায় প্রত্যেকেই তাকে ভয় পায়।কিন্তু এটা তো জীবন নয়।এরকম করে কতদিন থাকবে উনি। বুবু বিছানায় বসে কাজ করছে।পা গুলো বিছানায় ছড়িয়ে রাখা আর তার উপর ল্যাপটপ, চোখে চশমা।টিউলিপ পাশেই একটা পুতুল নিয়ে চুপচাপ বসে আছে।আমি নক করে ভিতরে ঢুকলাম।একবার দেখে নিয়ে ভিতরে আসতে বললো।আমাকে দেখা মাত্রই টিউলিপ দৌড়ে গলা জড়িয়ে ধরলো।বুবু কাজ করা অবস্থায়ই বললো “সৃজা নোভাকে একটু ডাকো তো।” সৃজা অবাক হলো।তবে নোভা বাইরে থাকায় শুনতে পেয়ে ধীরে ধীরে রুমে ঢুকলো। “আমায় ডাকলে আপু?” “হ্যা,টিউলিপকে একটু বাইরে নিয়ে যাও আমার সৃজার সাথে কথা আছে।” নোভা অনেক খুশি হলো।সে যেনো এর অপেক্ষাই করছিল। “ওকে নিয়ে যাও।অনেকক্ষণ হলো চুপচাপ বসে আছে। তোমার কাছে রেখো।আর কোনো আন হেল্দি ফুড যাতে না খায় সেটা দেখো।” “ওকে আপু” নোভা বেরিয়ে যেতেই আমাকে বসতে বললো।কোলের ফাইলটা সরিয় চশমাটা খুলে রাখল।মৃদু কন্ঠে বললো “সবাই যা বলবে তা ভালো না লাগলেও কেনো মেনে নিবে?তোমার এই ব্যাপারটা আমার পছন্দ না।তবে হ্যা শুনলাম তুমি নাকি মালয়েশিয়া যেতে চাও ফার্দার স্টাডির জন্য।”জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো। ” জ্বী বুবু আমি পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাড়াতে চাই।আমার স্বপ্ন পূরণ করতে চাই।” “শুনে খুশি হলাম।আমার সাপোর্ট সবসময় পাবে এক্ষেত্রে।তবে যা করবে ভেবে করবে।” সৃজা মৃদু স্বরে বললো “জ্বী” “আমি আগামিকাল ঢাকায় চলে যাবো টিউলিপ তোমার সাথে এখানেই থাকবে কিছুদিন।আশা করি তোমার কোনো সমস্যা হবে না।” “জ্বী না বুবু সমস্যা হবে না।তবে আপনিও কিছুদিন থাকতে পারতেন।” “আমার এতো সময় নেই। অফিসের অনেক কাজ পরে আছে।” সৃজার একবার বলতে ইচ্ছে করলো’এত কাজ করে কি করবেন।কিন্তু না বলে চুপ রইল। “ঠিক আছে এখন যেতে পারো।আমার কিছু কাজ বাকি আছে।” সৃজা মৃদু পায়ে বেরিয়ে গেলো।তার ভাবতেই অবাক লাগছে সানিয়া আজ নিজে থেকে তাকে উপদেশ দিয়েছে। রাত ৯টা না বাজতেই নিচে খাওয়ার ধুম পরে গেছে।বাড়ির পুরুষদের আগে খাওয়ার নিয়ম।ছেলেরা আগে খাচ্ছে।পরে আমরা মেয়েরা বসলাম।বিকেলে খাওয়ার কারণে পেট ভরা ভরা লাগছে।খাচ্ছি না দেখে মেজো মামী বললেন “কি হয়েছে সৃজা?খাবার ভালো হয়নি?” “না না খাবার ভালো।আসলে দুপুরের খাবারটা বিকেলে খাওয়ায় আর খেতে ইচ্ছে করছে না।” কতগুলো উৎসুক মুখ যেনো চুপ হলো।সৃজা কোনোমতো খেয়ে উপরে গেলো। _____________________ আজ ভোরের দিকেই সৃজার ঘুম ভেঙে গেলো।কাল রাতে সাফওয়ান আর ও একসাথে ঘুমালেও মাঝখানে কোলবালিস ছিল।সাফওয়ান অবসক হয়ে বলেছিল “তুমি আমাকে এটুকু বিশ্বাসও করো না?আমার কিছু করার ইচ্ছে হলে কোলবালিস দিয়ে আটকাতে পারবে মনে করছো?” সৃজা উত্তরে কিছু না বলে উল্টো পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পরেছিল।সকালে উঠে দেখে মাঝখানের কোলবালিশ গায়েব।সাফওয়ানের বলিস্ঠ হাতে সে বন্দি।কোনো মতো নিজেকে ছাড়িয়ে উঠে বসলো।ভাবনার মাঝেই করিডোর থেকে শব্দ শুনতে পেলো।কেউ তার চাপা রাগ ঝারছে কারো উপর।সৃজা শব্দ অনুসরণ করে সেখানে গেলো।সানিয়ার রুম থেকে শব্দ আসছে।একটা ছেলেও আছে রুমে।বুবুর কথাগুলো কানে আসছে “আর কি চাও তুমি আমার কাছে?আরো ৫ বছর আগে আমাদের মধ্যে সব শেষ হয়েছে।সব তুমি নিজ হাতে শেষ করেছিলে।এখন আবার কেন আসতে চাইছো তুমি।প্লিজ যাও এখান থেকে।” ছেলেটিও বলা শুরু করলো “বাহ্ এবার সব আমার দোষ।তোমার কি কোন দায় ছিল না?আমাদের সম্পর্ক থাকতেও তুমি অন্য ছেলের সাথে সম্পর্কে ছিলে… ” ব্যস চুপ কর তুমি।তোমার এই মিথ্যা কথা আমি নিতে পারছিনা।তবে হ্যা পাঁচ বছর আগে আমি না বললেও আজ বলতে বাধ্য হচ্ছি তুমি আসলে আমাকে ভালোই বাসোনি।ভালোবাসলে একবার আমাকে জিজ্ঞেস করতে সত্যিই কি অন্য কোন ছেলের সাথে আমার সম্পর্ক আছে?কিন্তু তুমি তা করোনি।” “আমি সেটাই বলছি সানিয়া আমি ভুল বুঝেছিলাম তোমাকে।পরে তো ভুল বুঝতে পেরেছি।তুমি কেনো ক্ষমা করে আবার আগের মতো হচ্ছো না।” “কোনোকিছুই আগের মতো হবে না তানভির ভাই।তুমি এখান থেকে যাও।” চলবে……