জেদ” পর্ব-২২

0
905

#জেদ(A Conditional LoveStory)
#পার্ট২২
#আফরিন_ইনায়াত_কায়া
.
.
জানালার ধারে চুপচাপ বসে আছি আমি ।চারদিক নিস্তব্ধ ।জানালার গ্রিলগুলো এখন বেড়ি জালের মত লাগছে।মনে হচ্ছে যেন কোন খাচায় আটকে আছি ।দম বন্ধ হয়ে আসছে ।প্রচন্ড কান্না পাচ্ছে কিন্তু কেন জানি কাদার ইচ্ছেটুকুও মরে গেছে এখন।নিজেকে কেমন অনুভূতিশূন্য মনে হচ্ছে।
টুপ করে এক ফোটা পানি গড়িয়ে পরল চোখ বেয়ে ।পেছন থেকে নার্স এসে ডাক দিলেন।
-Excuse me Ma’am .সকালের মধ্যে এই মেডিসিনগুলো এনে দিবেন ।
নার্স হাতে একটা ওষুধের লিস্ট ধরিয়ে দিয়ে চলে গেলেন।চারদিকে আবার সেই পিন পতন নিরবতা ছেয়ে গেল।কয়েক কদম এগিয়ে গিয়ে জানালার কাচে চোখ মেললাম।বাবার হাতে এখনো স্যালাইন লাগানো ।নার্স মাত্র এসে স্যালাইনের প্যাকেট চেঞ্জ করে দিয়ে গিয়েছেন ।এই নিয়ে বাবাকে তিনটে প্যাকেট স্যালাইন দেওয়া হল।কিন্তু বাবার অবস্থার কোন উন্নতি নেই।ডাক্তার বলেছেন মাইনর হার্ট এট্যাক ।তবে ডায়াবেটিস আর বিপি বেশি হওয়ার কারনে এখনো কিছু বলা যাচ্ছে না।বাবার মুখটা বেশ শুকিয়ে গেছে ।মা বাবার একটা হাত দুহাতে ধরে সেখানেই মাথা এলিয়ে ঘুমিয়ে গেছেন।বড্ড ক্লান্ত লাগছে তাকে।
আমি ওখান থেকে সরে এসে জানালার কাছে দাড়ালাম।ফোনটা ভাইব্রেট হচ্ছে। মধ্যে।ফোনটা হাতের মধ্যে ঝড় তুলে শান্ত হয়ে গেল।আমি জানি এটাই শেষ কল ছিল ।আরদ্ধ আর কল দিবে না।এতক্ষনে ও জেনে গেছে আমি কোথায় আছি কি করছি ।একটা কালো গাড়ি এসে মিনিট পাচেক আগে হাসপাতাল টহন দিয়ে গেছে।আমি কোথায় যাই কি করি প্রতিটা খবর ও জানে ।ছায়ার মত ওর নজর থাকে আমার উপর।সব কিছু জেনেই সে আমাকে কল দিয়েছে। এইবার ধরা আরদ্ধ ১৩৪ বার কল দিয়েছে । ৩৭টা ম্যাসেজ ।আমি কোনটারই জবাব দেই নি ।সত্যি বলতে ইচ্ছে করেই দেইনি ।আরদ্ধকে এই মুহুর্তে ফেস করার শক্তি নেই আমার ।লাস্ট কয়েকটা ঘন্টায় আমার জীবনে যেন একটা বড় ধরনের ঝড় বয়ে গেছে।যে ঝড়ের বিন্দুমাত্র পূর্বাভাস আমি পাইনি।সব কিছু যেন এক নিমিষেই লন্ডভন্ড হয়ে গেল এই ঝড়ে।
.
.
বিকেল পাচটায় অফিস শেষ করে বাসায় ফিরছি।গাড়ি থেকে নামার সময় আরদ্ধ পেছন থেকে হাট টেনে ধরল।আমি পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি ছেলেটা ছোট বাচ্চার মত মুখ ফুলিয়ে আছে।আমি হেসে জিজ্ঞেস করলাম
-কি হলো?
আরদ্ধ কিছু না বলে কপালে কপাল ঠেকিয়ে একটা ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে কাছে টেনে নিল।কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলল
-ইনা আমার লাইফে ভালোবাসা মানে শুধু তুমি।আমার যান্ত্রিক জীবনে তুমি ভালোবাসার ফুল ফুটিয়েছ ।আমি তোমাকে ছাড়া কখনো কাউকে ভালোবাসতে পারব না।
কথাটা বলেই আরদ্ধ আলতো করে আমার ঠোট দুটো মুখে পরে নিল।খুব যত্ন করে চুমু একে দিল ঠোটের কোনে।
বাসার পরিবেশ আজ কেন জানি বেশ থমথমে৷ কেউ কোন কথা বলছে না।বাসায় আসার পর থেকে বাবাকে একবারও দেখিনি।মাকে কিছু জিজ্ঞেস করলেই হ্যা না তে উত্তর দিয়ে এরিয়ে যাচ্ছে।হঠাত করে কি হল কে জানে।
রাত প্রায় ১১টা পার হয়েছে। আমি সব কিছু গুছিয়ে বসলাম আরদ্ধর সাথে একটা ডিজাইন ফাইনালাইজ করার জন্যে। দুইবার রিং হতেই ওপাশ থেকে আরদ্ধ বলে উঠল
-কাজ শেষ হল সব?
আমি জবাব দিব তার আগেই মা এসে রুমের দরজায় টোকা দিয়ে বলে গেলেন
– তোর বাবা তোকে ডাকছে।
আরদ্ধের কথার জবাব না দিয়ে
-I’ll call you back
বলে ফোনট কাটে দিলাম।
.
বাবা নিজের রুমে ইজি চেয়ারে বসে আছে।মা পাশের বেডে কাপড় গোছাচ্ছেন। আমি রুমে গিয়ে ছোট্ট করে নক করলাম
– বাবা ডেকেছ?
বাবা কোন ভনিতা ছাড়াই বললেন
– তুই কি জানতি অই ছেলের বাবা আহমেদ রেজান?
আরদ্ধর ফ্যামিলি ইনফরমেশন জানলে এরকম প্রশ্নের সম্মূখীন হতে হবে এটা আমার জানা ছিল আগে থেকেই।বাবা এসব জিনিসকে খুব বড় মনে করেন৷ তাই হঠাত এরকম প্রশ্নে অবাক হলাম না৷ আমি স্বাভাবিকভাবেই জবাব দিলাম
– জ্বি জানতাম।
– সব কিছু জানার পরেও ওই ছেলের সাথে তুমি সম্পর্ক রেখেছ?
-জ্বি।
-কেন?
-কারন ছেলেটা আমাকে ভালোবাসে।আমার কেয়ার করে৷ আমাকে সম্মান করে।
-কেন আমরা কী তোমাকে কেয়ার করিনি?যত্ন করে মানুষ করিনি?
-বাবা তুমি কোথাকার কথা কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?
-কোথাও নিয়ে যাচ্ছিনা। তুমি ভালো করেই জানো ওই ছেলের ফ্যামিলি ঠিক নাই।ওর বাবা ওর মাকে খুন করেছে।তারপরেও অই ছেলের সাথে তুমি কীভাবে সম্পর্ক রাখতে পার?
বাবার কথা শুনে যেন থমকে গেলাম আমি।কি বলব ভাষা খুজে পাচ্ছিনা। এদিকে বাবা বলেই চলছেন
-খালি পড়াশুনা করলে আর দেখতে সুন্দর হলেই মানুষ হওয়া যায় না।ফ্যামিলিটাই আসল।
বাবার সাথে তাল মিলিয়ে মাও বলে উঠলেন
– ওরা হাইক্লাস ফ্যামিলির ছেলে। ছোট থেকে আয়ার কাছে বড় হয়েছে।ওদের চরিত্রের কোন ঠিক ঠিকানা নেই।আজ এই মেয়ে তো কাল অই মেয়ে৷ বিয়ে করলেও দেখবি ব্যববসার নাম করে অন্য দেশে যায়ে মেয়েদের নিয়ে ফুর্তি করছে।জানতে পারবি তুই?
-জানলেও কি করবে? ডিভোর্স দিবে?আবার তো অই বাপের ঘাড়ে এসেই পড়বে। মানুষ কি বলবে?সমাজে তো মুখ দেখানো বন্ধ হয়ে যাবে।…..
বাবা মা দুই জনেই অনবরত বলেই চলছেন লাগামহীন ভাবে।আমার দুই চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি বেয়ে পরছে। ঠিক কতটা নিচু মানসিকতার হলে মানুষ এসব চিন্তা করতে পারে আমি জানি না।
-…….একটা কথা কান খুলে শুনে রাখ ইনা।আমি বেচে থাকতে অই ছেলের সাথে আমি কখনো তোর বিয়ে দিব না।তুই যদি অই ছেলেকে বিয়ে করতে চাস তাহলে আমার লাশ ডিংগিয়ে যেতে হবে৷
বাবার কথা শুনে যেন আমার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেল। নিজের কানকে বিশ্বাস হচ্ছে না। আমি চোখ তুলে শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলাম
-তাহলে কার সাথে বিয়ে দিবে?
বাবা কিছুটা দম নিয়ে বললেন
-আরাজের সাথে। ইমতিয়াজ সাহেব আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। উনি আমাকে বলেছেন “ভাই আপনার মেয়েকে আমি নিজের মেয়ের মত করে রাখব।”কোন সমস্যা হলে আমি নিজে গিয়েই সমাধান করে দিতে পারব।তোর বিয়ে হলে আরাজের সাথেই হবে।এটা আমার শেষ কথা।
– আমি আরদ্ধ ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারব না বাবা।বাবা আরদ্ধ অনেক ভালো ছেলে। আরদ্ধর ফ্যামিলি নিয়ে আমার মাথা ব্যাথা নেই। তাছাড়া ওর বাবা ওর মাকে খুন করেনি। ওটা এক্সিডেন্ট ছিল।
-চুপ কর।একদম মুখে মুখে তর্ক করবি না। তুই কি ভাবিস আমরা তোর বাপ মা হয়ে তোর খারাপ চিন্তা করব?কামাই করে খাওয়াস বলে তুই যা বলবি তাই হবে?
আমার কথা শেষ না হতেই মা গর্জে উঠলেন।আমাকে তারা কথা বলার কোন সুযোগ দিচ্ছেন না।আমার ভালোর চেয়ে বাবার জেদটাই বড় তার কাছে।মা অনবরত কথা শুনাচ্ছেন আমাকে।তার মাঝখানেই বাবা হঠাত করে বুকে হাত দিয়ে বসে পরলেন।আমি আর মা ছুটে গেলাম তার কাছে।বাবা বুকে হাত দিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছেন। আমি কাপাকাপা হাতে ফোন বের করে এম্বুলেন্সকে ফোন দিলাম।বাবা হাসফাস করতে করতে জ্ঞান হারালেন।
.
.
দিন তিনেক কেটে গেছে।এই তিনদিন আমার খাওয়া ঘুম কাজ সব কিছুই থমকে ছিল।মা বাসায় যেতেন। ঘন্টা খানেকের মধ্যে খাবার আর কাপড় নিয়ে ফিরতেন। আমি প্রতিটা মুহুর্তে বাবার বেডের পাশে বসে থাকতাম। আজ বাবাকে হাসপাতাল থেকে বাসায় আনা হল।ডাক্তার ডিসচার্জ দিতে নারাজ। কিন্তু বাবা হাসপাতালে থাকতে চান না। উনার বক্তব্য বাসাতে থাকলে উনি জলদি সুস্থ হবেন। শেষমেষ উনার জেদের কাছে হেরে ডাক্তার ডিসচার্জ দিতে বাধ্য হলেন। তবে উনি বার বার করে বলে দিয়েছেন যাতে বাবাকে কোন প্রকার স্ট্রেস যাতে না দেওয়া হয়। উনি যাতে সব সময় হাসি খুশি থাকেন।নাহলে পরের বার হয়তো আর তাকে ফিরে নাও পাওয়া যেতে পারে।
বাবাকে বাসায় পৌছে দিয়ে আমি ফ্রেশ হয়ে অফিসে চলে গেলাম।তিনদিনে বেশ কাজ জমে গেছে।বিকালের মধ্যে সব কাজ গুছিয়ে সন্ধ্যার আগে আগে বাসার জন্যে রওয়ানা হলাম।
.
.
মা এখনো আমার সাথে কথা বলছেন না। উনার সম্পূর্ন মনযোগ এখন বাবার দিকে৷হবেই না বা কেন!ভালোবাসার মানুষকে হারানোর কষ্টটা যে কি বেদনাদায়ক সেটা এই মুহুর্তে আমার থেকে ভালো কেউ জানে না।
ঘড়ির কাটায় রাত দুইটা বাজে।আমি জানালার ধারে বসে আছি। বাইরে থেকে হালকা বাতাস আসছে।কখনো বা গুমোট হয়ে যাচ্ছে।এই তিনদিনে আরদ্ধ একবারও কল দেয় নি। কিন্তু আমি জানি ও রাগ করে নেই।আমার প্রতিটা নিশ্বাসের খবর ও জানে।ফোনটা হাতে নিলাম। একবার রিং পরতেই ওপাশ থেকে ফোন তুলল সে।যেন জানতো ঠিক এই সময়েই আমি কল দিব তাকে।
– খেয়েছ তুমি?
আরদ্ধর কথার জবাব দিতে ইচ্ছে করছে না এখন। আমি আকাশের পানে চেয়ে বললাম
– গান শুনবে একটা?
আরদ্ধ কিছু বলল না। শুধু ছোট্ট করে হু বলল।
আমি চোখে পানি আটকিয়ে সুর ধরলাম…….
চলবে
{hear the song in Inayat’s voice 😌}

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here