জেদ” পর্ব-২৪

0
920

#জেদ(A Conditional LoveStory)
#পার্ট২৪
#আফরিন_ইনায়াত_কায়া
.
.
-ইনায়াত কায়া ,পিতা আব্দুল বারেক আপনার বিবাহ আরাজ ইবনে ওয়াসিম পিতা ইমতিয়াজ ইবনে ওয়াসিম এর সাথে দেনমোহর দশ লাখ একটা ধার্য করা হয়েছে।আপনি কি এই বিয়েতে রাজী ?বলেন কবুল ।
আমি চুপচাপ বসে আছি।মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না ।গলার মধ্যে যেন অজস্র কাটা বাসা বেধে আছে।বুকের ভেতরে চলছে রক্তক্ষরন।আমাকে চুপ থাকতে দেখে কাজী সাহেব আবার বলে উঠলেন
-বলেন মা কবুল।
আশেপাশের মানুষ মুখ চাওয়াচায়ী করছে।যদিও মানুষ বলতে দুই ফ্যামিলির যত সামান্য আত্মীয় ছাড়া কেউ নেই।তবুও বিয়ের পিড়িতে বসে কন্যার মত পাল্টানোর ঘটনা নেহায়েতে নেক্কারজনক আমাদের সমাজে।মা পিছন থেকে আমাকে খোচা দিয়ে বললেন
-কি রে ?কবুল বল।
.
ঠিক এই সময়টার জন্যে আমি অনেক অপেক্ষা করেছিলাম ।শুধু আমিই কেন প্রতিটা মেয়েই বিয়ে নিয়ে কত স্বপ্ন সাজিয়ে রাখে।কত ইচ্ছা ,কত শখ থাকে এই দিনটাকে ঘিরে ।ঠিক আমিও ভেবেছিলাম একদিন আমারও বিয়ে হবে এমন একজনের সাথে যাকে আমি খুব ভালোবাসব।যে আমার জন্যে নিজের সবটা উজার করে দিবে।গা ভর্তি গয়না আর ভারী শাড়ী পরে আমি বিয়ের পিড়িতে বসব।আমার বর মুগ্ধ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকবে।অপেক্ষায় থাকবে ঠিক কখন আমি লাজুক লাজুক স্বরে কবুল বলব ।অসংখ্য মানুষের ভীড়ে সে আমাকে নিজের করে নিয়ে যাবে।
হ্যা সব কিছুই ঠিক ছিল।একটা মানুষ যে আমাকে ভালোবাসে নিজেকে উজাড় করে,আমার সবকিছুতেই যার অধিকার ,যে সর্বদাই আমার দিকে মুগ্ধ পানে তাকিয়ে থাকে ।কিন্তু বাবার ছোট্ট একটা জেদ আমার সব স্বপ্ন সব পাওয়াকে ধুলোয় মিশিয়ে দিল।
.

বাবা চেয়েছিল ধুমধাম করে বিয়ে আয়োজন করতে ।একমাত্র মেয়ের বিয়ে বলে কথা ।আত্মীয় স্বজনের একটা বড় সড় লিস্ট এনে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বাবা বললেন
-লিস্ট টা চেক কর তো !বিয়েতে কোন কোন মেহমান আসবে তার লিস্ট ।দেখ কেউ বাদ পরেছে কিনা ।তোর বন্ধুদের নাম ও দিয়ে দিস।
বাবা একদফা কাগজটাতে চোখ বুলিয়ে আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন।আমি তখন পশ্চিম আকাশে সন্ধ্যা তারার ডুবে যাওয়া টিমটিম আলো দেখতে ব্যস্ত ।আকাশের লালা আভা মুখে যাচ্ছে ক্ষানিকক্ষন হলো।আবার আবার কাগজটা নাড়ীয়ে বলল
-কি হল? নে!
আমি কোন ভাবান্তর দেখালাম না ।মাথা না ঘুরিয়ে বললাম
-কাজে সাহেব আর সাক্ষি মিলিয়ে যাতে দু পক্ষে জন দশেকের বেশি না আসে।না হলে আরাজের জন্যে হয়তো অন্য পাত্রী খুজতে হবে।
-দেখ ইনা বাড়াবাড়ি করিস না ।তুই আমার একমাত্র মেয়ে ।বিয়েতে আত্মীয় স্বজন এলাকাবাসীকে দাওয়াত না দিলে লোকে কি বলবে !আমার একটা মানসম্মান আছে।তাছাড়া বিয়ে তো শুধু তুই করছিস না ।আরাজও করছে।তার তো শখ আল্লাদ আছে নিজের বিয়ে নিয়ে।
-লোকে কি বলবে সেটা নিয়ে চিন্তা করা তোমার কাজ বাবা আমার না।সমস্যা যখন তোমার সমাধানও তুমিই করবে আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিবে না।আমি যা বলেছি সেটাই আমার শেষ কথা।
-বাবা কিছু বলতে গিয়েও বললেন না।রাগে ফুসতে ফুসতে চলে গেলেন।
.
.
পাত্রপক্ষ বিয়ের জন্যে দামী গয়না আর ভারী কাজের বেনারসী পাঠিয়েছে।সকাল সকাল সব কিছু নিয়ে ঘরে আসলেন মা।নিজ থেকেই বলে উঠলেন
-আত্মীয় স্বজন কাউকেই বিয়ের দওয়াত করতে দিলি না।মানুষ বলে কি!পড়াশুনা করিয়ে এত বড় করেছি এতটুকু সেন্স নাই ।এই ভাবে লুকায় বিয়ে দিলে এলাকাবাসী কানাঘুষা করবে নিশ্চয়ই মেয়ের কোন সমস্যা আছে।আমাদের মান সম্মানের চেয়ে তোর জেদটাই বড়??ছোট থেকে নিজের মনমানি চালিয়ে এসেছিস…….
মা ঘর গোছাতে গোছাতে নিজ থেকেই বলে যাচ্ছেন কথা গুলো।আমার সেদিকে খেয়াল নেই।আমি বিছানায় শুয়ে কুরআন শরীফের আয়াত দেখছি ।আরদ্ধ একটা সব সময় বলত
-ইনা লাইফ হচ্ছে পাজেলের মত ।যেখানে ঢুকলে মনে হয় এখান থেকে বের হওয়ার কোন রাস্তা নেই ।নেই কোন দরজা।কিন্তু মানুষের লাইফে কখনো একসাথে সব রাস্তা বন্ধ হয়ে যায় না ।একটা না একটা রাস্তা আল্লাহ সব সময় খোলা রাখেন।আমাদের শুধু দরকার সঠিকভাবে আল্লাহকে অনুসরন করে সেই দরজাটা খুজে বের করা।আল্লাহ তার বান্দাদেরকে অনেক ভালোবাসেন।যদি কখনো মন খারাপ থাকে,নিজেকে একা মনে হয় টুক করে কুরআন টা নিয়ে বসে যাবে।দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।
-কিরে কথা কানে যাচ্ছে না?কিছুক্ষন পর তোর বিয়ে।নামাজের পর পরেই বরযাত্রী চলে আসবে তুই এখনো নবাবজাদির মত শুয়ে আছিস?উঠ এখন রেডি হয়ে নে।
মার কথা শুনে আমি উঠে বসলাম।এই ক দিনে নিজের একটুও যত্ন নেওয়া হয় নি।যদিও আমার যত্ন আমি কখনোই নিতাম না ।নিত আরদ্ধ ।আয়নার সামনে গিয়ে দাড়াতেই হালকা চমকে গেলাম আমি।চুল উষ্ক খুশক।চেহারার অবস্থা মলিন।চোখ গুলো কালো কোটতে ঢুকে গিয়েছে।মা পেছনে অনবরত বলেই চলছেন।হঠাত করে কেদে উঠলেন তিনি
-কত শখ ছিল মেয়ের ধুমধাম করে বিয়ে দিব ।আত্মীয় স্বজন আসবে।দশজনে হাত তুলে দোয়া করবে।পোড়া কপাল আমার ।….
-মা বাইরে গিয়ে কাদো ।আমি রেডী হব এখন ।
আমার কথা শুনে মা চুপ হয়ে গেলেন ।একরাশ রাগ আর অভিমান নিয়ে তিনি বের হয়ে গেলেন।আমি রুমের দরজা লাগিয়ে আবার বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম।
দুপুরের দিকে বাবা একবার এসে দরজায় টোকা দিয়ে বলে গেলেন
-কি রে ইনা রেডি হস নি?বরযাত্রী চলে আসছে প্রায় ।রেডি হয়ে নে জলদি ।
আমি উঠে একবার বিয়ের শাড়িটাতে হাত বুলালাম ।
.
.
বরযাত্রী এসেছে প্রায় মিনিট দশেক হয়েছে।মা এসে দরজায় নক করছেন ।আমি চুপচাপ উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলাম।মা আমাকে দেখেই সেকেন্ড কয়েক হা করে তাকিয়ে থাকলেন।আরাজের দেওয়া কোন কিছুই আমি পরিনি।আমার পরনের শাড়ীটা আরদ্ধ আমাকে জন্মদিনে গিফট করেছিল।গয়না বলতে আরদ্ধের দেওয়া পেন্ডেন্ট যেটা সব সময় আমার গলায় ঝোলানো থাকে আর দু কানে ছোট দুটো ইয়ারিং ব্যাস এই শেষ ।চোখে হালকা কাজল +ঠোটে ন্যুড লিপস্টিক ।আমাকে দেখে মা গর্জে উঠলেন।
-কি শুরু করছিস তুই?তোকে বিয়ের শাড়ি দিয়ে গেলাম।তুই ওটা না পরে এটা কি পরেছিস?এখনো রেডি হস নি কেন তুই?
-আমি রেডি মা চলো ।
-ইনা কি শুরু করলি?তুই এই কাপড়ে বিয়ে করবি?
-মা পূর্নবয়স্ক মেয়েকে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোড় করে বিয়ে দেওয়াটা ইসলামে হারাম ।আমি চাইনা বিয়েটা হারাম হয়ে যাক একটা শাড়ীর জন্যে।চলো ।
মাকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়েই আমি সেখান থেকে চলে এলাম।
বলা বাহুল্য আমাকে দেখে আরাজের পুরো পরিবার আর আত্মীয় সবার চোখ কপালে উঠেছে।তারা সবাই বেশ আড়ম্বর আর যাক জমকের সাথেই এসেছেন।আরাজকে বেশ যত্ন করে বর সাজানো হয়েছে।আমি চুপচাপ গিয়ে বিয়ের পিরিতে বসে পড়লাম।আরদ্ধর সাথে কাটানো দিন গুলো ,একসাথে মিশে থাকা মুহুর্তগুলো ,তার বাহুডোরে আবদ্ধ হয়ে থাকার অনুভুতি গুলো,তার ঠোটের উষ্ম স্পর্শ আর তার ভুবন ভুলানো মায়াবী হাসি সব কিছুই এক এক করে ভেসে আসছে চোখের সামনে।আমার ভালোবাসাকে তুচ্ছ করে কাজি আমার বিয়ের সম্মতি নিয়ে চলে গেলেন।হয়তো আরদ্ধ আর ইনার পথ চলা এই পর্যন্তই ছিল।
বাবা ওপাশে সোফায় আরাজের পাশে বসে আছেন।আমাকে চুপ থাকতে দেখে গর্জে উঠলেন
-ইনা সময় যাচ্ছে।কবুল বলো তাড়াতাড়ি ।
বাবার কথা শুনে আমি মাথা নাড়ালাম।কাজী সাহেব মাশাল্লাহ বলে আমার সই নিয়ে চলে গেলেন।ওপাশ থেকে আরাজ কবুল বলে উঠল ।বাবা আর ইমতিয়াজ আংকেল গলাগলি করলেন ।তাদের বন্ধুত্ব আজ নতুন সম্পর্কে রুপ নিল ।আর হাওয়ায় মিলিয়ে গেল আমার অনুভূতিগুলো ।……
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here