পাহাড়ে মেঘের ছায়া পর্ব-২৯

0
912

উপন্যাসঃ পাহাড়ে মেঘের ছায়া
পর্ব – ২৯
(নূর নাফিসা)
.
.
২৯.
নাফিসা গোসল করে আজ নীল শাড়িটা পড়েছে। যোহরের নামাজ আদায় করে আয়নার সামনে এসে দাড়ালো। মুখে হালকা ক্রিম দিলো, চিকন করে কাজল টানা দিলো, ঠোঁটে হালকা লাল লিপস্টিক লাগালো, কানের ছোট দুল খুলে স্টোনের দুল পড়লো, মেলা থেকে কিনে দেওয়া সেই লাল চুড়িগুলো পড়লো। ঘন কালো লম্বা চুল বাকা সিতি করে উন্মুক্ত করে রাখলো। হাতের ঝাকায় লাল চুড়ি গুলো একটু নড়তেই ঝুমঝুম শব্দ হলো। নাফিসা মুচকি হেসে আলমারি খুলে মেঘের জামাকাপড় নাড়াচাড়া করতে লাগলো।
মেঘ রুমে এসে পা রাখতেই ঝুমঝুম শব্দ পেলো। আলমারির দিকে তাকাতেই দেখতে পেল নীল পরি আলমারিতে কিছু খুজছে। ঝুমঝুম শব্দ কিসের! মেঘ দরজা চাপিয়ে আস্তে আস্তে হেটে নাফিসার কাছে এলো। পেছন দাড়িয়ে দুহাত নাফিসার পেটে রেখে চুলের ঘ্রাণ নিতে লাগলো! নাফিসা সাথে সাথে কেপে উঠলো! প্রথমে ভয় পেয়ে গেলেও এখন বুঝতে পেরেছে এটা মেঘ! হঠাৎ এমন করে আক্রমণ করার কোনো মানে হয়! কাপা কাপা কন্ঠে বললো,
– গোসল করবেন না?
মেঘ তাকে আরও চেপে ধরে চুলের ঘ্রাণ নিতে নিতে বললো,
– সকালে একবার বলেছো, সেটার পানিশমেন্ট তো দিতে পারিনি এখন একসাথে দিবো দুইটা!
নাফিসা ভুলেই গিয়েছিলো! সে চোখমুখ কুচকে দ্রুত বললো,
– গোসল করবে না? বাথরুমে যাও আমি জামাকাপড় নিয়ে আসি।
– উহুম আগে পানিশমেন্ট, বাকি সব পরে।
কথাটা বলে মাত্রই নাফিসাকে তার দিকে ঘুরিয়ে সে হতবাক হয়ে আছে! নাফিসা এখনো চোখ বন্ধ করে আছে! মেঘ কি করবে বুঝতে পারছে না! এ কাকে দেখছে সে! এমনিতেই তো তার প্রতি সে দুর্বল! এখন তো তাকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করছে মেঘা! আচমকাই তার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো অন্যরকম কিছু শব্দ!
– “মুগ্ধ করেছে রূপ, সে তো বহুদিন আগেই!
হারিয়েছি তোমাতে, দেখেছি যখন শাড়িতে!
এখন আবার হারিয়েছি, কোন অজানা পৃথিবীতে!
মৃগ ন্যায় চোখের কাজল টানা,
দিয়েছে মোর হৃদয় গহীনে হানা!
গালে পড়া টোল আর ওষ্ঠের রক্তজবা,
বারবার বাধ্য করবে আমায় ফেলতে থাবা!
প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য, সবটাই কি শুধু রমনীর জন্য?”
মেঘের মুখের খই ফুটতে শুনে নাফিসা অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলো সামনে দাড়ানো মানবের দিকে! সৃষ্টিকর্তা সকল মধু কি তার সুরেই দিয়েছে! সকল অজানা শব্দ গুলো কি তার মুখেই দিয়েছে! মেঘ উৎফুল্ল হয়ে বললো,
– মেঘা পাগল করে দিবে তুমি আমায়!
মেঘ দু’হাতে নাফিসার মাথা কাছে টেনে কপালে ভালোবাসার পরশ দিতে ভুলেনি! মেঘের স্পর্শে নাফিসার মনের কথা,
– পাগল তো আমি হয়ে যাচ্ছি মেঘ! তোমার প্রতিটি উক্তিতে, প্রতিটি স্পর্শে পাগল হয়ে যাচ্ছি!
মেঘের মুখে মুচকি হাসি আর নাফিসার মুখে লজ্জা! দৃষ্টি সরিয়ে আলমারি থেকে মেঘের লাল শার্ট আর কালো জিন্স বের করে হাতে নিতেই মেঘ সেগুলো নিয়ে খাটে রাখলো। নাফিসাকে কাছে টেনে ইশারা করলো শার্ট খুলে দেয়ার! মেঘের শরীরের ঘ্রাণ নাফিসাকে আরও বেশি আনমনা করে দেয়! এই ঘ্রাণে কখনো তৃপ্তি আসে না তার! দুইটা বোতাম খুলতেই চোখ বন্ধ করে বাকিগুলো খুললো সে। মেঘ পলকহীন তার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ বন্ধ করেই মেঘের গা থেকে শার্ট সরালো। মেঘ এখনো তাকে বেধে রেখেছে তাই সে বললো,
– এভাবে তাকালে আমার অসস্তি বোধ হয়!
– আম্মি কি বাসায় নেই?
– উহুম।
– কোথায়?
– খালামনির কাছে গেছে। বিশেষ প্রয়োজনে নাকি ডেকেছে খালামনি।
– গোসলটা আরেকটু পরে করলে কি হতো তোমার!
– সকালে রান্না করেছি, খাবার নষ্ট হয়ে যাবে।
মেঘ নাফিসাকে ছেড়ে দিয়ে খালি গায়ে বের হতে হতে বললো,
– এতো বাহানা কেন খুজো। সবকিছুর অভ্যাস বানিয়ে দিবো তোমার এবং অতি শীঘ্রই।
নাফিসা পিছুপিছু এসে বাথরুমে জামাকাপড় দিয়ে গেলো। দুজন একসাথে খাবার খেয়ে ঘরে তালা ঝুলিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছে।
চা বাগান থেকেই শুরু করেছে যাত্রা । সবুজের মাঝে নীল পরিকে দাড় করিয়ে প্রকৃতির সৌন্দর্য ক্যামেরা বন্দী করেছে মেঘ। মেঘার সাথে প্রেমালাপ করতে করতে পাহাড়ি রাস্তা পাড়ি দিয়ে গমন করেছে পান বনের দিকে। সাদা আর গোলাপি রঙের চারটা বনফুল একটা বড় পান পাতায় নিয়ে নাফিসার হাতে ধরিয়েছে মেঘ। নিজের হাতে কিছু লতা নিয়ে পেচিয়ে পেচিয়ে সেটার পুরত্ব বাড়িয়েছে। সাথে বেধে দিয়েছে কিছু পান পাতা আর সরু সরু পাহাড়ি ঘাস। নাফিসার হাত থেকে বনফুল গুলো নিয়ে সেগুলোও লতার সাথে বেধে দিলো। কদম ফেলছে আর এসব উপকরণ কুড়াতে কুড়াতে মেঘ খুব সুন্দর একটা ব্যান বানিয়ে ফেললো। নাফিসা মেঘের সাথে গল্প করতে করতে খুব মনযোগ দিয়ে বুঝতে চেষ্টা করছিলো মেঘ কি করছে! ব্যানটা দেখে সে উৎফুল্ল হয়ে মেঘের দিকে তাকাতেই মেঘ মুচকি হেসে ব্যানটা নাফিসার মাথায় পড়িয়ে দিলো। পকেট থেকে ছোট সাদা ঘাসফুল বের করে নাফিসার ফুটানো নাকের ছিদ্রে পড়িয়ে দিলো। নাফিসার কদম ফেলা থেমে দৃষ্টি শুধু মেঘকেই দেখছে! মেঘ তার দৃষ্টিতে মুগ্ধ হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– কি দেখো এমন করে?
– কোন রূপক এসে থেমেছে আমার কাছে,
দৃষ্টির অগোচরে, প্রতিনিয়ত রঙিন করছে আমার ক্ষুদ্র ভুবন।
তাই দৃষ্টি নিক্ষিপ্ত হয় শুধু তার পানে!
মেঘ মুচকি হেসে বললো,
– আরও কিছু গড়েছি আমি, সেটা কি মেঘা জানে?
– কি?
– আর একটু অপেক্ষা, মিসেস।
মেঘ পকেট থেকে রুমাল বের করে নাফিসার চোখে বেধে দিলো। হাত ধরে আস্তে আস্তে হেটে একটা জায়গায় এসে থামলো মেঘ। চোখের বাধন খুলে দিয়ে দুকদম পিছিয়ে দাড়ালো মেঘ। নাফিসার দৃষ্টি সামনে! তার চোখের সামনে ঝুলছে মোটা লতে তৈরি দোলনা। দোলনাটা বনফুল আর পাতায় সজ্জিত! চোখের অশ্রু বাধ মানছে না তার! আর কতো সুখ এনে দাড় করবে তার সামনে! সে কি এতো সুখের উপযুক্ত? সে কি আগলে রাখতে পারবে মেঘকে! পেছনে ফিরে ঝাপসা চোখে খুজতে লাগলো মেঘকে। তিন কদম পেছনে মেঘ দাড়িয়ে! মেঘা এক কদম ফেলার সময়ে তিন কদম পাড় হয়ে ঝাপটে পড়লো মেঘের বুকে! বাহুডোরে বাধতে সময় নেয়নি মেঘ! চোখের পানি বৃষ্টি হয়ে ঝরছে মেঘের বুকে! মেঘ দু’হাতে মাথা তুলে চোখের পানি মুছে বললো,
– ঝর্না তো পাথর টিলায় আছড়ে পড়বে, সেটা আমার বুকে কেন?
বৃষ্টি তো ভুবন ভিজিয়ে নতুন রূপ দান করবে, সে মানবকে ভেজাচ্ছে কেন?
স্রোতধারা তো সমুদ্রে গড়াবে, সেটা মেঘের বুকে কেন?
এই পাগলী, দোল খাবে না দোলনায়?
নাফিসা মুখে হাসি ফুটিয়ে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দিলো। মেঘ তাকে নিয়ে দোলনায় উঠালো। মেঘা বসতেই মেঘ ধাক্কা দিয়ে দোলাতে লাগলো। ফটোশুট করতে মিস হয়না মেঘের। মাথায় লতাপাতা ও ফুলের ব্যান, পড়নে নীল শাড়ি, হাতে লাল চুড়ি, নাকে স্বর্নের জায়গায় পাহাড়ি ঘাসফুল, ওষ্ঠে অপূর্ব হাসি নিয়ে দোলছে লতায়! এ যে এক অপ্সরী নেমে এসেছে পান বনে!
মেঘ মুগ্ধ হয়ে দেখছে তার মেঘাকে! মেঘা দোলনায় বসে থেকে বললো,
– এটাতে কি দুজন বসা যাবে না?
– বসা যাবে, তবে দোল খাওয়া যাবে না। দোলনা ছিড়ে এই পাতালতার ঝোপে ছিটকে পড়লে খবর হয়ে যাবে!
নাফিসা একপাশে চেপে শুকনো মোটা ডালটায় জায়গা করে মেঘকে ডাকলো।
– বসুন এখানে।
মেঘ ব্রু কুচকে তাকালো আপনি ডাক শুনে! নাফিসা লজ্জা পেয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে বললো,
– বসো এখানে।
মেঘ তবুও যাচ্ছে না! নাফিসা এদিকে তাকিয়ে বললো,
– আমি কি এখন নেমে যাবো?
– জ্বি? আমাকে কিছু বলছেন?
নাফিসা মুখ গোমড়া করে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো। মেঘ ঠোঁটের এক কোনায় হাসি ফুটিয়ে নাফিসার কাছে এলো। নাফিসা খালি জায়গায় হাত দিয়ে রেখেছে যাতে মেঘ না বসতে পারে। মেঘ তার হাত ছুটিয়ে সেখানে বসে পড়লো। একহাত নাফিসার পেছনে রেখে জড়িয়ে ধরলো। নাফিসা সরাতে গিয়েও ব্যর্থ! আরও শক্ত করে চেপে ধরেছে। নাফিসার কাধে থুতনি রেখে তাকিয়ে আছে মেঘ। নাফিসা তবুও অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। মেঘ একপায়ে মাটিতে ভর দিয়ে ঠেলে ঠেলে দোলনা হালকা করে দোলাচ্ছে। নাফিসা এখনো রাগ করে আছে তাই মেঘ বললো,
– রাগলে লাগে ভিষণ ভালো,
হাসলে তুই, ছড়ায় আলো।
কাদলে হিংসে করে ঝর্ণা,
শশী মুগ্ধ হয় তা দেখে, ওহে পাহাড়ি কন্যা!
নাফিসা সেদিকে ফিরেই নিশব্দে হেসে উঠলো। মেঘ অন্যহাতেও পেটের উপর দিয়ে নাফিসাকে জড়িয়ে ধরলো। দু’হাতের মধ্যে এখন নাফিসা বন্দী আর মেঘের থুতনি নাফিসার কাধে। মেঘ গান ধরলো,
হয়তো শুরু নয়তো ইতি
শত রঙের প্রজাপতি
উড়ছে দেখো আকাশ পানে
আমি সঙ্গী হবো তাদের
তোমায় নিয়ে……
গাইবো না গান তুমি হীনা
কাটাবো না প্রহর তোমায় বিনা
পায়ে পায়ে হাটবো দুজন,
সোনালী রোদ্দুরে
তোমায় নিয়ে……
আমার একটাই অভিমানী তুমি
জানিতো ভুল ছিলাম আমি
শুধরে নিবো তা ক্ষণে ক্ষণে
আমি ভিজবো শ্রাবণ মেঘের দিনে
তোমায় নিয়ে……
হয়তো শুরু নয়তো ইতি
শত রঙের প্রজাপতি
উড়ছে দেখো আকাশ পানে
আমি সঙ্গী হবো তাদের
তোমায় নিয়ে……
নাফিসা মুগ্ধ হয়ে মেঘের কণ্ঠে গান শুনছিলো। হঠাৎ করেই দুজনে লতাপাতার উপর থেতলে পড়লো! কি থেকে কি হয়ে গেছে কেউই বুঝতে পারছে না! কয়েক সেকেন্ড স্তব্ধ হয়ে একে অপরের দিকে তাকিয়ে একপর্যায়ে দুজনেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো! লতার সৃষ্ট দোলনা ছিড়ে পড়ে গেছে তারা! বেশ কিছুক্ষণ তারা হাসলো একপর্যায়ে মেঘ মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে নাফিসার হাসি দেখতে লাগলো। মেঘকে তাকিয়ে থাকতে দেখে নাফিসার হাসি আস্তে আস্তে বিলীন হয়ে গেলো। মেঘ জিজ্ঞেস করলো,
– ব্যাথা পেয়েছ তুমি?
– উহুম।
মেঘ দাড়িয়ে নাফিসাকে উঠতে সাহায্য করলো। পোশাকের ময়লা ঝেড়ে পরিষ্কার করে নিলো। ঝর্ণার ধারে কিছুক্ষণ হেটে দুজন সেই সমতল পাহাড়ের দিকে এলো সূর্যাস্ত দেখার জন্য। সূর্যাস্তের পরপর তারা পাহাড় থেকে নেমে গেলো। মেঘ কিছু একটা ভেবে আম্মিকে কল করলো। আম্মি বাসায় এসেছে কিনা জিজ্ঞেস করতেই আম্মি বললো তিনি আজ আসবে না। কাল বিকেলে আসবেন। মেঘ কল কেটে ফোন পকেটে রাখলো। নাফিসার হাত ধরে হেটে কিছুটা পথ অতিক্রম করে বিধু চাকমাদের দোকানে এসে দুকাপ চা অর্ডার করলো। নাফিসা বললো,
– এখন চা অর্ডার করার প্রয়োজন ছিলো! বাসায় ফিরতে হবে না? আম্মি বাসায় নেই।
– বাসায় ফিরে কি করবে?
– রান্না বসাতে হবে না!
– একবেলা চা খেয়ে কাটাতে পারবে না?
– আমি পারবো, তুমি খাবে না?
মেঘ মুচকি হেসে বললো,
– উহুম। বসো।
মেঘের কথায় নাফিসা বেঞ্চিতে বসলো। চা এলে দুজন একসাথে চায়ের কাপে চুমুক দিলো। শীতকাল খুব নিকটে। সন্ধ্যা হতেই ঠান্ডা পড়ে। এই হালকা ঠান্ডা পরিবেশে প্রিয় মানুষের সাথে রাস্তার ধারে বেঞ্চিতে বসে মাটির কাপে গরম চায়ে চুমুক দেওয়ার মাঝে আছে অন্যরকম প্রেমানুভূতি! ভাবতেই শিহরণ বয়ে যায় সর্বাঙ্গে! কবু তৃপ্তি মিটবে না এই অনুভূতির! মেঘের সাথে পরিচয় হওয়ার পর থেকে নাফিসার মনে কতো রকমের অনুভূতির জন্ম হয়েছে সেটা তার নিজেরও জানা নেই! কোনটা তার স্বীকৃতিতে কোনটা জোরপূর্বক।
– মেঘা..
– হুম?
– সেদিন তোমার সাথে একটা মেয়ে ছিলো জলাশয়ের পাশে। মেয়েটি কে?
– খালামনির ছোট মেয়ে দিয়া।
– অহ। খালামনির ছেলেমেয়ে কতজন?
– দুইটা মেয়েই শুধু। বড় মেয়ে পৃথা চাকমা আর ছোট মেয়ে দিয়া চাকমা । পৃথা আপুর বিয়ে হয়ে গেছে আর ও ছোট।
– অহ, আচ্ছা।
আর একটু গল্প করতে করতে চা শেষ করলো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here