ভোরের_আলো পর্ব-১৩

0
822

#ভোরের_আলো
পর্ব-১৩

– খুব ব্যস্ত?
– নাহ্, ঐ তো হাত ধোয়ানোর টাকা নিয়ে ঝগড়া করছিলাম।
– ঝগড়াও করতে জানো?
– হুম, জানি।
– আমার সাথেও করবে?
– হ্যাঁ করবোই তো। সকাল বিকাল খুন্তি হাতে নিয়ে ঝগড়া করবো।
– তাহলে কি আমার আগেভাগেই তোমার রাস্তা থেকে কেঁটে পড়া উচিত?

“তোমার রাস্তা থেকে কেঁটে পড়া উচিত” কথাটা শোনা মাত্রই অর্পিতার মনে হচ্ছে ওর কলিজা ধরে কেও টানা হেঁচড়া করছে। ও জানে এটা আশফাক দুষ্টুমি করে বলেছে। তবু একটা অজানা ভয় লাগছে। মুখে মিথ্যে হাসির ছোঁয়া এনে বললো,

– হুম, সময় থাকতে কেঁটে পড়ুন। নয়তো কষ্টের সীমা থাকবে না।
– শত কষ্ট পেতে রাজি আছি, তুমি শুধু আমার হাতটা ধরে রেখো।

মন থেকে মূহূর্ত্বেই ভয়টা কেটে গিয়ে খুশি জায়গা করে নিয়েছে। মিথ্যে হাসির জায়গায় সত্যিকারের হাসিটা জায়গা করে নিয়েছে ঠোঁটের কোনে।

– শুনতে পাচ্ছো?
– হু,,, হুম।
– কথা বলছো না যে?
– শুনতে ভালো লাগছে। তাই কিছু বলছি না।
– তোমার খোপার বেলিগুলো আমাকে খুব করে টানছে। ইচ্ছে হচ্ছে বেলিগুলোতে নাক ডুবাই। একটা আবদার রাখবে?
– হুম।
– তোমার খোঁপা থেকে একটা বেলির মালা তুমি আমাকে আজ গিফট করবে।
– আজ? কিভাবে সম্ভব?
– সম্ভব।
– কিভাবে?
– সেটা তুমি ভালো জানো। তোমার ভালোবাসার মানুষ এই প্রথম তোমার কাছে কিছু চেয়েছে। এখন তুমি দিবে কি দিবে না সেটা তোমার ইচ্ছা।
– অবশ্যই আমি দিতে চাই। অলরেডি পৌনে দশটা বাজে। আপনি এত রাতে এখানে আসবেন?
– আমি আসবো কে বললো? তুমি নিজে আমার বাসার সামনে এসে দিয়ে যাবে।
– আমি? এতরাতে কিভাবে আসবো?
– তা তো আমি জানি না।
– কাল দেই?
– বাসি ফুল আমি নিবো না।
– কাল তাজা ফুলই আপনাকে গিফট করবো।
– আমি তোমার খোঁপার ফুল চেয়েছি।
– কাল নাহয় খোঁপায় ফুল জড়িয়ে আসবো। সেখান থেকে আপনাকে একটা মালা না, সবকয়টা মালা দিয়ে দিবো।
– আমি আজ চেয়েছি।
– এতরাতে কি বলে আপনার ওখানে যাবো? আম্মু একশটা প্রশ্ন করবে।
– আম্মুকে কিভাবে ম্যানেজ করবে সেটা তোমার ব্যাপার।
– ভালো ঝামেলায় পড়লাম।
– আবদারটাকে খুব ঝামেলা মনে হচ্ছে? তাহলে থাকুক। লাগবে না।
– এই না,,,, আমি সেটা বলিনি।
– আচ্ছা, আমি আর এই ব্যাপারে কথা বলতে চাচ্ছি না৷ যেটা সম্ভব না, সেটা নিয়ে কথা না বলাই ভালো।
– আপনি রাগ করবেন না প্লিজ।
– আচ্ছা, তাহলে বাসায় যেয়ে ফ্রেশ হও। এরপর কল দিও।
– আপনি,,,,,,

অর্পিতার কথা না শুনেই কলটা কেঁটে দিলো আশফাক। মনের ভিতর খচখচ করছে অর্পিতার। মানুষটা রাগ করেছে৷ কন্ঠস্বরে অভিমান স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছিলো। দরজা ঠেলে ভিতরে গেলো অর্পিতা। চারদিকে চোখ ঘুরিয়ে মুক্তাকে খুঁজছে সে। এককোণার টেবিলে পাখি আর মুক্তা বসে আছে। খুব দ্রুত গতিতে সেদিকটাতে এগিয়ে গেলো অর্পিতা।

– মুক্তা একটু আয় তো, তোর সাথে কথা আছে।
– কি রে? টেনশনে আছিস মনে হচ্ছে?
– আরে আয় না।
– এখানেই বল।
– তুই আয়।
– সমস্যা নেই। পাখি জানে সব।

ভ্রুঁ কুঁচকে পাখির দিকে তাকালো অর্পিতা।

– তুই জানিস কিভাবে?
– মুক্তা আপা বলছে।
– খবরদার কথা যেনো অন্য কারো কানে না যায়।
– আমি আমার চুল খুব ভালোবাসি। আমি জানি কারও কাছে এই কথা বললে আপনে আমার মাথা কামায়া দিবেন।

মন খারাপের মাঝেও হেসে ফেললো অর্পিতা। চেয়ার টেনে মুক্তার পাশে বসলো।

– আমরা এখন বাসায় যাবো।
– কেনো?
– উনি আমার কাছে ফুল গিফট চেয়েছে। আমার খোঁপা থেকে একটা বেলির মালা। উনাকে আজই এটা দিতে হবে। এমনিতে তো আর বের হতে পারবো না। মিথ্যা কথা বলবো আম্মুকে। কাল সকালে প্রফেসরকে জরুরী একটা এ্যাসাইনমেন্ট জমা দিতে হবে। এ্যাসাইনমেন্ট পুরোটা তৈরী হয়নি। একটু বাকি আছে। বাসায় যেয়ে আজ রাতেই কমপ্লিট করতে হবে।
– তারপর?
– এ্যাসাইনমেন্টের কথা বললে আম্মু না করবে না। এখান থেকে সোজা উনার বাসার সামনে যাবো৷ ফুলটা উনাকে দিয়ে আমাদের বাসায় চলে যাবো। আজকে রাতটা থাকবো। কাল দুপুর নাগাদ আবার ফুপ্পির বাসায় চলে যাবো।
– রিস্ক হয়ে যাবে না?
– কিচ্ছু হবে না। তুই চল।
– আপা আমিও যামু।
– তুই কেনো যাবি?
– দুলাভাইরে দেখতে চাই।
– পরে দেখিস।
– আপা,,, আপা রাইতে ঘুম হইবো না। আমারে নিয়া যান আপা।
– আচ্ছা। আগে আম্মুর সাথে কথা বলে আসি।

আত্মীয়দের সাথে কথা বলছে অর্পিতার মা। অর্পিতা সুযোগ খুঁজছে কখন মা কে আড়ালে ডেকে নিয়ে কথাগুলো বলবে। পিছন থেকে মেয়ের কাঁধে হাত রাখলেন অর্পিতার বাবা।

– কি রে? মা কে কিছু বলতে চাস?
– হ্যাঁ। প্রফেসর কল করেছিলো৷ কাল এ্যাসাইনমেন্ট জমা দিতে হবে। পুরোটা কমপ্লিট হয়নি। আজ রাতে কমপ্লিট করে কালকের মধ্যে জমা দিতেই হবে।
– এখন যাবি? আগে কমপ্লিট করিসনি কেনো?
– আরো পাঁচদিন সময় ছিলো হাতে। কিছুক্ষণ আগে বললো উনি পরশু থেকে ১৫ দিনের ছুটি নিচ্ছেন। তাই কালই জমা দিতে হবে।
– এটা কেমন কথা? হুট করে বললেই কি এ্যাসাইনমেন্ট জমা দেয়া যায় নাকি?
– কি করবো বলো? এটা প্রফেসরের নিজস্ব ব্যাপার।
– কাল তো বৌভাত। সন্ধ্যার আগে তোর ফুপ্পির বাসায় উপস্থিত থাকতে হবে কিন্তু।
– হ্যাঁ, হ্যাঁ থাকবো। এ্যাসাইনমেন্ট জমা দিয়ে দুপুর নাগাদ চলে আসবো।
– আচ্ছা, একটু পর যা। শিলাকে বোধহয় এখনি বিদায় দিবে। ওকে বিদায় দিয়ে এরপর যা।

মা কে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে শিলা। অর্পিতা হাতের আঙুলে শাড়ি পেঁচাচ্ছে আবার প্যাঁচ খুলছে। প্রচন্ড অস্থিরতা কাজ করছে ওর মাঝে। কতক্ষণে শিলা বিদায় হবে আর কতক্ষণে আশফাকের মুখোমুখি যেয়ে দাঁড়াবে। শিলার সাথে এত ভালো সম্পর্ক, আজ মানুষটা পরের বাড়ি চলে যাচ্ছে অথচ এই নিয়ে নূন্যতম মাথাব্যথা নেই অর্পিতার। মনে হচ্ছে যেনো প্রিয়জনদের প্রতি যতসব আবেগ ছিলো সমস্ত আবেগ ঐ লোকটার কাছে ট্রান্সফার হয়ে গেছে। শিলা এগিয়ে এসে অর্পিতার মাথায় হাত বুলাচ্ছে আর বলছে,
– আমাকে খুব মিস করবি তাই না রে?
– না,,,, হ্যাঁ করবো।
– আমিও করবো৷ শোন আমাদের কিন্তু প্রতিদিন কথা হবে।
– হ্যাঁ,,,, হ্যাঁ হবে। আর দেরী করো না। অনেক রাত হয়েছে। ভাইয়া ওয়েট করছে।

অর্পিতা আর মুক্তাকে জড়িয়ে ধরে ভয়ানক কান্না জুড়ে দিয়েছে শিলা। সেইসাথে মুক্তাও যোগ দিয়েছে। আর অর্পিতার কান্নার বদলে গরম লাগা শুরু হয়েছে। এসির মাঝেও অস্থির রকমের গরম লাগছে। নিজের আচরণে নিজেই অবাক হচ্ছে অর্পিতা। এই মূহূর্ত্বে ওর তো কান্না করা উচিত ছিলো। অথচ কান্না তো আসছেই না, উল্টো মন চাচ্ছে শিলাকে টেনে হিঁচড়ে গাড়িতে তুলে শিগগির বিদায় করতে।

গলির মুখে গাড়ি দাঁড় করিয়ে আশফাকের বাসার নিচে অপেক্ষা করছে অর্পিতা। গাড়িতে মুক্তা আর পাখিকে বসিয়ে এসেছে। কোনোমতে গায়ে একটা গেঞ্জি দিয়ে নিচে নেমে এসেছে আশফাক।

– তাহলে তুমি এলে?
– হুম এসেছি। প্রথম উপহার দিতে এসেছি।
– আম্মুকে ম্যানেজ করতে ঝামেলা হয়নি?
– নাহ্, আব্বুকে ম্যানেজ করেছি। আব্বু আম্মুকে ম্যানেজ করে নিবে।
– একাই এসেছো?
– নাহ, মুক্তা আর পাখি এসেছে।
– কোথায় ওরা?
– গাড়িতে।
– গাড়ি কোথায়?
– গলির শুরুতে।
– এখানে নিয়ে আসলেই তো হতো।
– নাহ্, ড্রাইভার আছে। দেখলে ঝামেলা হতো।
– ভয় পাও খুব?
– একটু আধটু।
– আমার বেপরোয়া প্রেমিকা পছন্দ।
– মানে?
– আমাকে ভালোবেসে সব করতে পারবে এমন কাওকে পছন্দ।

খোঁপা থেকে ফুলের মালা খুলতে খুলতে অর্পিতা বললো,

– প্রেমের সবে শুরু। রাত এগারোটা বাজে৷ একটা মেয়ে বাবা মা কে মিথ্যা কথা বলে আপনার জন্য এতরাতে আপনার বাসার সামনে এসে হাজির হয়েছে। এটাকে আপনি কি বলবেন?
– তাহলে ড্রাইভারকে জানাতে ভয় পাচ্ছো কেনো?
– সময় বুঝে কাজ করতে পছন্দ করি। কই? আপনার হাতটা দেখি।

অর্পিতার দিকে হাত এগিয়ে দিলো আশফাক। ফুলের মালাটা আশফাকের হাতে পড়িয়ে দিতে দিতে বললো,

– আমি নিজের সবটা উজাড় করে ভালোবাসতে জানি। যারা নিজের সবটা উজাড় করে ভালোবাসে তারা বেপরোয়াই হয়। আর আমি আপনাকে নিজের সবটা উজাড় করে দিয়েই ভালোবাসতে শুরু করেছি।

কথাটা বলেই গাড়ির দিকে এগুচ্ছিলো অর্পিতা। আশফাক পিছন থেকে ডাক দিলো।

– অর্পিতা, আমাকে তুমি করে বললে খুশি হবো।

প্রত্যুত্তরে কিছু বললো না অর্পিতা। আশফাকের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিয়ে চলে গেলো।

গাড়ির কাছাকাছি যেতেই অর্পিতা দেখলো পাখি গাড়ির বাহিরে দাঁড়ানো। অর্পিতাকে দেখা মাত্রই পাখি ছুটে এসে বললো

– দুলাভাই তো দেখতে একশো-একশো। চাচী দেখামাত্রই বিয়ার জন্য রাজি হয়া যাবে।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here