#ভোরের_আলো
পর্ব-১৪
শাড়ি পাল্টে ফ্রেশ হয়ে মাত্রই রুমে এলো অর্পিতা। প্রচন্ড ক্লান্ত লাগছে। একটু ঘুমানো দরকার৷ দুইরাত ঘুম হয়নি। একে তো বিয়ে, তারউপর আশফাক নামক লোকটা ওর ঘুমের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছিলো। মাথার চুলটা আঁচড়ে মাত্রই গা এলিয়েছে অর্পিতা, ঠিক তখনই কল এলো ওর ফোনে। বালিশের সাইড থেকে হাত বাড়িয়ে ফোনটা নিতেই স্ক্রিনে অপরিচিত নাম্বার দেখতে পেলো। এত রাতে কে ফোন করলো? খানিকটা অবাক হলো অর্পিতা৷ কে হতে পারে সেই চিন্তা করতে করতেই কলটা রিসিভ করলো।
– হ্যালো,,,,,,,,
– অহনা, আমি দেশে এসেছি।
ওপাশের মানুষটা আরাফাত। “দেশে এসেছি” কথাটা শুনেই হুড়মুড় করে শোয়া থেকে উঠলো অর্পিতা৷ মনে হচ্ছে যেনো ১০০০ ভোল্টের শক লেগেছে গায়ে।
– দেশে এসেছো মানে?
– তোমার ঠিক এই কন্ঠটা শোনার জন্যই না জানিয়ে এসেছি। প্রচন্ড অবাক হচ্ছো তাই না?
– অবাক হওয়াটা কি স্বাভাবিক না?
– আমি তো চাচ্ছিলামই তুমি অবাক হও। একরাশ বিস্ময়ভরা কন্ঠে আমাকে জিজ্ঞেস করো, ” তুমি দেশে এসেছো?” হা হা হা,,,,,,
– এখনই দেশে এলে কেনো? তোমার না দুসপ্তাহ পর আসার কথা?
– তুমি খুশি হওনি?
– না,,,, হুম,,, হ্যাঁ হয়েছি। কিন্তু এখনই কেনো?
– তোমাকে বিয়ে করতে এসেছি।
অর্পিতার এবার মনে হচ্ছে কলাগাছের ভেলায় বসে মাঝসমুদ্রে ভাসছে। একে তো না বলে এসেছে। কত কি প্ল্যানিং করতে হবে। কিছুই প্ল্যান করা নেই। তারউপর আবার বিয়ের সুর তুলছে। অন্যদিকে সবেমাত্র আশফাকের সাথে সম্পর্ক শুরু। ইচ্ছে হচ্ছে আশফাক, আরাফাত সব ছেড়েছুঁড়ে ফোন-টোন অফ করে জঙ্গলে চলে যেতে৷ সব ঝামেলা একসাথে এসে মাথার উপর ভর করেছে। এত ঝামেলা সামাল দেয়া সম্ভব নাকি!
– এই মেয়ে,,,,,
– হুম,,,,,,
– বিয়ের কথা শুনে খুব ইমোশনাল হয়ে গেছো তাই না?
– তুমি আজ পর্যন্ত আমাকে দেখোইনি। না দেখেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলে বিয়ে করবে?
– তোমাকে ভালোবাসি পাগলি। দেখাদেখির কিচ্ছু নেই।
– আমি যদি পঙ্গু হই? অন্ধ হই? বা দেখতে কুৎসিত?
– পঙ্গু হলে কোলে নিয়ে ঘুরবো। অন্ধ হলে তোমার হাত ধরে রাখবো। আর তোমাকে আমি আমার নজরে দেখবো। যে নজরে ভালোবাসা থাকে সে নজরে কুৎসিত কি আর সৌন্দর্য্য কি?
– এতোটা ভালোবাসার কারন?
– তুমি ভালোবাসার সূক্ষ্ম সুতায় আমাকে বেঁধে নিয়েছো। না ভালোবেসে থাকি কি করে বলো?
– কোথায় উঠছো?
– কোথায় আবার? আমার বাসায়।
– বাসার সবাই জানে তুমি যে দেশে আসছো?
– হ্যাঁ সবাই জানে।
– আমার কথা কি বাসার লোকেরা জানে?
– ভাবী আর আমার ছোট বোনটা জানে।
– মুরুব্বীরা তো কেও আমার কথা জানে না। তাহলে বিয়েটা করবে কিভাবে?
– কাজী অফিসে।
– কেনো?
– লুকিয়ে বিয়ে করার খুব শখ।
– শখ নাকি বিয়ের খবরটা আড়াল করতে চাচ্ছো?
– সন্দেহ করছো?
– নাহ্, সন্দেহ করবো কেনো? এমনি জিজ্ঞেস করলাম আরকি।
– তুমি কি বিয়েতে রাজি না?
– অবশ্যই রাজি। বলো তো এখনই চলে আসি বিয়ে করতে।
– নাহ। আমি কাল কাজী অফিসে গিয়ে কি কি লাগবে সব জেনে তোমাকে জানাচ্ছি কবে বিয়ে করবো।
– ঠিকাছে।
– তোমাকে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে খুব।
– হুম। দেখবে তো। বিয়ের দিন।
– হুম, বিয়ের দিন। আমি তোমাকে কাজী অফিসেই দেখতে চাই। আমার বউয়ের হাত ধরতে চাই৷ প্রেমিকার না।
– জলদি খবর নাও। বিয়ের কথা শুনে ওয়েট করতে ইচ্ছে হচ্ছে না। এক্ষুনি বিয়ে করে নিতে ইচ্ছে হচ্ছে।
– করবো তো,,,,, খুব জলদি।
-অপেক্ষায় রইলাম। সাবধানে বাসায় যাও। পৌঁছে আমাকে একটা ফোন করো।
– ঠিকাছে।
আরাফাতের কলটা কেটে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো অর্পিতা। মাঝেমাঝে মিথ্যা নাটক করতে যেয়ে বড্ড হাঁপিয়ে যায় ও।
রাতুলের সাথে কথা বলে মাত্রই রুমে এলো মুক্তা। ওকে দেখার সাথেসাথেই অর্পিতা বললো,
– একটা ঝামেলা হয়ে গেছে।
– কি?
– আরাফাত দেশে এসেছে।
– এখনই?
– হুম।
– দু’সপ্তাহ পর আসার কথা ছিলো না?
– হ্যাঁ।
– তাহলে? এখন কি করবি? দেখা করার কথা কিছু বলেছে?
– দেখা থাক দূরের কথা। বিয়ে করবে বলছে। সে আমাকে কাজী অফিসে প্রথম দেখতে চায়।
– তোর ঝামেলা অর্ধেক তো এখানেই শেষ হয়ে গেলো।
– কিভাবে?
– ঐসব হোটেল রুম, কল গার্ল ম্যানেজ করা খুবই কষ্ট ছিলো। বিয়ের ব্যাপারটা খুবই সহজ।
– কিভাবে?
– দেখ, সুমি আপুকে লোকটা এতদিন ধরে ঘুরাচ্ছে আগামী বছর বিয়ে করবো এই কথা বলে। এমন করে লোকটা চারটা বছর পার করেছে। এই লোকটার আশায় বসে থেকে আপু অন্য কোথাও বিয়েও করছে না। আপু যখন হাতেনাতে দেখতে পাবে উনি তোকে বিয়ে করার জন্য রেজিস্ট্রি পেপারে সাইন করছে তখন আপুর মগজে কিছু ঢুকবে। তখন ও বিশ্বাস করবে লোকটা আসলেই ওকে ভালোবাসে না৷
– রেজিস্ট্রি না করে যদি শুধু শরীয়াহ মোতাবেক বিয়ে করতে চায়?
– সমস্যা নেই। তুই তো আর সত্যিই বিয়ে করছিস না। কাজী যখন বিয়ে পড়ানো শুরু করবে ঠিক তখনই সুমি আপুকে সামনে হাজির করবো।
– আমিই যাবো?
– যাবি। সমস্যা কি? উনি তো আর তোকে চিনেনা।
– হুম সেটাও কথা।
– নিশিকে ফোন কর। আরাফাত যে দেশে আসছে এটা কি ওদের বাসার লোকজন জানে কি না জিজ্ঞেস কর।
– দাঁড়া, জিজ্ঞেস করি।
নিশার নাম্বারে ডায়াল করলো অর্পিতা। তিনবার রিং হওয়ার কল রিসিভ করলো সে।
– হ্যাঁ, অর্পি বল।
– আরাফাত দেশে এসেছে।
– কবে?
– তোরা কিছু জানিস না?
– নাহ্।
– সুমি আপু?
– ও জানলে তো আমিও জানতাম।
– উনার বাসার লোকজন?
– ঐ বাসার লোকজন জানলে তো এই বাসায়ও খবর চলে আসতো।
– হুম, তা অবশ্য ঠিক। তবে উনি তো বললো বাসায়ই নাকি উঠবে।
– বাসায় আসলে তো টের পাবোই। আমার রুমের বরাবরেই উনার রুমের জানালা।
– খেয়াল রাখিস তাহলে।
– হ্যাঁ।
– শোন তোর সাথে আরও কথা আছে। কাল সকালে বাসায় আসতে পারবি?
– কখন?
– যত দ্রুত আসতে পারিস।
– নয়টা?
– ঠিকাছে।
– আসবি কিন্তু। জরুরী কথা।
– হ্যাঁ,,,,, হ্যাঁ আসবো।
– আচ্ছা, রাখি।
নিশির কলটা কাটার সাথে সাথেই আশফাকের কল এলো। রিং বাজতে না বাজতেই কল রিসিভ করে নিলো অর্পিতা।
– এতরাতে কার সাথে কথা বলছিলে?
আশফাকের প্রশ্নে হচকচিয়ে গেলো অর্পিতা। কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,
– আপনাকে কে বললো কথা বলছিলাম?
– তিনবার কল করেছি। ব্যস্ত দেখাচ্ছিলো। তারমানে কথাই বলছিলে।
– কিন্তু আমার ফোনে তো ওয়েটিং অপশন অন করা।
– তা তো আমি জানি না। যা দেখেছি তাই বললাম। যাই হোক, কারো সাথে ফোনে বোধহয় ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছিলে। কাছের কেও হবে হয়তো।
– হ্যাঁ, নিশি। আমার বান্ধবী।
– আমি তো জিজ্ঞেস করিনি কার সাথে কথা বলছিলে।
– আপনার কথায় সন্দেহের সুর পাচ্ছি তাই বললাম।
– নাহ্ তেমন কিছু না৷ শুনো, একটা কথা শোনার জন্য ফোন করেছিলাম।
– কি?
– ভালোবাসি বলো।
– ভালোবাসি।
– প্রতিরাতে ঘুমানোর আগে কথাটা আমি শুনতে চাই।
ঠোঁটের কোনে মুচকি হাসির রেখা ফুটে উঠেছে অর্পিতার৷ চিন্তার মাঝেও খানিকটা স্বস্তি মিলছে মনে।
– হুম বলবো।
– বলেছিলাম তুমি করে বললে খুশি হবো।
– হুম বলবো।
– কবে থেকে?
– এটা ঠিক জানি না। কথা বলতে থাকি। একটা সময় আপনা আপনিই মুখ দিয়ে তুমি চলে আসবে।
– অপেক্ষায় রইলাম তুমি শোনার জন্য।
কলটা কেটে দিয়ে রিমনের দিকে মুখ বাঁকিয়ে একটা হাসি দিলো আশফাক। বেশ তাচ্ছিল্যের সুরে বললো,
– খুব ভালো মেয়ে না রে রিমু?
– মানে?
– কোনো ভালো ঘরের মেয়ে এতরাতে একটা ছেলের বাসার সামনে একা চলে আসবে না। তাও বলতে গেলে আমি অপরিচিত। ও আমাকে কতটুক চিনে? কথা বলছিলো অন্য ছেলের সাথে। এখন আমাকে শোনাচ্ছে বান্ধবীর সাথে কথা বলছিলো। মিথ্যুক একটা।
– বাসার সামনে তো তুমিই আসতে বলেছো।
– বলেছি। আমি বললেই কি আসতে হবে নাকি? ভালো মেয়েরা এতরাতে পুরোনো প্রেমিকের কাছেই ছুটে যায় না। আর আমি তো তার সদ্য প্রেমিক।
কথা বাড়াতে ইচ্ছে হচ্ছে না রিমনের। আশফাকের কথার উত্তরে কিছু না বলে সোফা ছেড়ে নিজের রুমে চলে এলো৷ কে ভালো কে খারাপ সেসব সময় হলেই জানা যাবে। এখন আশফাককে এসব বুঝিয়ে লাভ নেই।
(চলবে)
-মিম