ভোরের_আলো পর্ব-২২

0
990

#ভোরের_আলো
২২.

– স্কুল লাইফ থেকে আরাফাত ভাইয়ের সাথে সম্পর্ক ছিলো সুমি আপুর৷ আপু তখন নাইনে পড়ে আর ভাইয়া অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে। পাশাপাশি বিল্ডিংয়ে থাকতো৷ সে সুবাদেই পরিচয়। দুই পরিবারের মধ্যে বন্ডিং খুব ভালো ছিলো। শুরু থেকেই দুই ফ্যামিলি জানতো ওদের কথা। কারও কোনো আপত্তিই ছিলো না। আর সুমি আপু যে আরাফাত ভাইকে কি পরিমান ভালোবাসতো সেটা তোমাকে বুঝাতে পারবো না। আরাফাত ভাই অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার আগ পর্যন্ত সব ঠিকঠাক ছিলো৷ তখন আপু এইচ এস.সি কমপ্লিট করে অনার্সে ভর্তি হওয়ার প্রিপারেশন নিচ্ছে। কথা ছিলো বছর দুয়েক পর ভাইয়া এসে ওকে বিয়ে করবে। আনুষ্ঠানিক ভাবে আংটিও পড়িয়ে গেছে। আত্মীয় স্বজন, এলাকার লোকজন সবাই জানতো ওদের বিয়ের কথা। ভাইয়া ওখানে যাওয়ার পর থেকে পাল্টে যেতে লাগলো৷ আপুকে ঠিকমত সময় দিতো না৷ ব্যস্ততার অযুহাত দেখাতো। আপু সব অযুহাত মেনেও নিতো৷ নিশিদের এক কাজিন থাকে অস্ট্রেলিয়া। সে একদিন নিশিকে কল করে বললো, ভাইয়াকে নাকি মেয়েদের সাথে ঘুরাফেরা করতে দেখা যায়। দুইদিন মেয়েদের নিয়ে বারে ঢুকতে দেখেছে। মেয়ের ড্রেসআপ ভালো ছিলো না। বারে ঢুকার সময় নাকি মেয়েকে লিপকিসও করেছে। এগুলো সুমি আপু তো বিশ্বাস করেইনি, উল্টো ঐ ছেলেকে ইচ্ছামত গালিগালাজ করেছে। নিশিদের ফ্যামিলির কেওই তখন বিশ্বাস করেনি। এরপর দুবছর শেষ হলো, চার বছর, ছয় বছর শেষ হলো। উনার বিয়ে করার কোনো খবর নেই। এদিকে আপুর বয়স বাড়ছে। নানা মানুষ নানা কথা বলতো। আরাফাত ভাই কোনো না কোনো অযুহাত দেখাতোই। সবসময়ই বলতো এ বছর না সামনের বছর বিয়ে করবো। আপুর ফ্যামিলি তখন বুঝে গিয়েছিলো আরাফাত ভাইয়ের মাঝে ঘাপলা আছে। নিশির ভাই ভালোমতো খোঁজ নিলো। জানতে পারলো উনাকে এখন মেয়েলোকের নেশায় পেয়েছে। দিব্যি মেয়েদের নিয়ে আমোদ করে বেড়ায়। সুমি আপুকে এসব বহুবার বুঝিয়েছে। আপু বুঝেনি। উল্টো ভাইয়ার সাথে রাগ করে তিনবছর আপু কোনো কথা বলেনি। মোটকথা আরাফাত ভাই ছাড়া সুমি আপু কিচ্ছু বুঝতো না৷ আরাফাতে আসল রূপটা হাতেনাতে দেখানোর জন্য নাটক সাজিয়েছিলাম। ওর সাথে ফোনে প্রেম করেছি কয়েকমাস। এমনভাবেই প্রেমে ডুবেছিলো যে আমাকে না দেখেই অস্ট্রেলিয়া থেকে দেশে চলে এসেছে আমাকে বিয়ে করবে। শিলা আপুর বিয়ের তিনদিন পর সে দেশে এলো। এর দুদিন পর বিয়ে করবে বলে ঠিক করলো৷ পান্জাবী পায়জামা পড়ে একদম জামাই সেজে এসেছিলো। আমিও লাল শাড়ী পড়ে গিয়েছিলাম। কাবিনের কাগজে সাইন করতে যাবে এমন সময় সুমি আপুকে নিয়ে নিশি ঢুকলো কাজী অফিসে। ব্যস, যা বুঝার আপু বুঝে গিয়েছে। তুমি জানো ছয়টা বছর সুমি আপু উনার ফিরে আসার কত অপেক্ষা করেছে। কত মিনতি করেছে এটলিস্ট ১০ দিনের জন্য হলেও যেনো দেশ থেকে ঘুরে যায়৷ আরাফাত ভাই ওর কথা কানেই নেয়নি। অথচ আমার সাথে জাস্ট পাঁচ মাসের পরিচয় ছিলো। চেনা নেই জানা নেই চলে এলো আমার জন্য এই দেশে। ভেবেছিলাম সুমি আপু কাঁদতে কাঁদতে শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু ও একফোঁটা চোখের পানিও ফেলেনি। কিন্তু ভিতরে ভিতরে একদম শেষ হয়ে গেছে। সুমি আপু আরাফাত ভাইকে তেমন কিছুই বলেনি। শুধু একটা কথাই জিজ্ঞেস করেছিলো,

সম্পর্ক রাখতে চাচ্ছিলে না সেটা বললেই পারতে। এভাবে আমাকে মিথ্যা স্বপ্নে কেনো ডুবিয়ে রেখেছিলে?
উত্তরে উনি বললো,

সম্পর্কটা গলার কাঁটা হয়ে গেছে। বাবা মায়ের কারনে তোমাকে ছাড়তেও পারছি না, তোমাকে নিয়ে থাকতেও চাচ্ছি না৷ তোমার প্রতি এখন কোনো টান আসে না সুমি।
– মুখ ফুটে বললেই পারতে। সরে দাঁড়াতাম৷ যাই হোক, ভালোই হলো। সব খোলাসা হয়ে গেছে। কাঁটা আর গলায় নিয়ে ঘুরতে হবে না।

সেদিনের পর থেকেই আপু অসুস্থ ছিলো তিনমাসের মতো। মাসখানেক হলো কিছুটা সুস্থ। তবুও মাঝেমাঝে হুটহাট অসুস্থ হয়ে যায়।
-…………………
– মানুষের জীবনটা বড্ড বিচিত্র আশফি। পরম প্রিয় মানুষগুলো ধোঁকা দেয়ার আগে একটাবারও ভেবে দেখে না, যারা তাদের ভালোবাসে বিশ্বাস করে তারা কি আদৌ ধোঁকাটা নিয়ে আর বেঁচে থাকতে পারবে? হ্যাঁ নিশ্বাসটা হয়তোবা চলবে কিন্তু মনটাতো মরে যাবে।
-…………………
– আশফি?
-……………..
– এই আশফি?
– হু,,,,, হুমম?
– কোন ভাবনায় ডুবে আছো?
– কিছু না৷ ইয়ে,,,,, অর্পি আমি তোমাকে রিকশা ঠিক করে দিই। তুমি বাসায় চলে যাও। আমার একটা জরুরী কাজ আছে। হঠাৎ মনে পড়ে গেলো। এক্ষুনি যেতে হবে।
– ওহ্। আচ্ছা, সমস্যা নেই। আমি যেতে পারবো।

রাত সাড়ে বারোটা। রাস্তায় উদ্ভ্রান্তের মতো হাঁটছে আশফাক। একের পর এক সিগারেট ফুঁকেই যাচ্ছে। অবশেষে অর্পিতা নামক গোলকধাঁধার সমাধান হলো। কিন্তু মনটা স্থির হলো না। অস্তিরতা দশগুন বেড়ে গেছে। মাথার দু’পাশে চিনচিন ব্যাথা হচ্ছে। সম্পর্কের ইতি এখানেই ঘটাতে হবে। মেয়েটা ওকে ভালোবাসে। সত্যিই ভালোবাসে৷ দিন যাবে, মায়া বাড়বে। আশফাক চায়না ওর প্রতি অর্পিতার মায়াটা আরো বেড়ে যাক। যা হওয়ার হয়েছে। দুনিয়াতে কয়টা মেয়ে ভার্জিন থাকে? সেসব কোনো ব্যাপার না। অর্পিতা আরও অনেক ভালো মানুষ পাবে। সে কোনোদিক দিয়েই অর্পিতার যোগ্য না। নিজের ঘুটঘুটে অন্ধকার জগতে এই মেয়েটাকে টেনে আনার মানেই হয়না। অর্পিতাকে ওর জীবন থেকে সরাতে হবে। কষ্ট হবে তার। অনেক কষ্ট। তাতে কি? কষ্ট তো জীবনে আর কম পায়নি। কষ্ট হজম করে অভ্যস্ত সে। প্রতিটা কষ্টের মত এটাও নাহয় হজম করে নিবে। নিজের সুখের জন্য অন্য কারো জীবনটা নষ্ট করার মানে হয় না।

গাড়ির কাছাকাছি এগিয়ে গেলো আশফাক। অর্পিতার নাম্বারে ডায়াল করলো সে।

– কোথায় তুমি? সেই সাড়ে নয়টা থেকে কল করেই যাচ্ছি অথচ তুমি রিসিভই করছো না। খুব ব্যস্ত?
– অর্পিতা?
– হুম?
– বাবা মা কোথায়?
– এইতো কিছুক্ষণ আগেই ওদের রুমে গিয়েছে ঘুমানোর জন্য।
– ডিম আছে বাসায়?
– আছে তো।
– মসুর ডাল?
– হুম আছে।
– ডিম আর ডাল ভুনা করো। তোমার হাতের ডিম ভুনাটা খুব ভালো হয়। খুব ক্ষুধা লেগেছে। তোমার হাতের রান্না খাবো।
– আমার এখানে আসবে?
– হুম। আসছি। রাস্তায় আছি।
– ঠিকাছে।

কলটা কেটে দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো আশফাক। গলার মাঝখানে কিছু একটা আটকে আছে৷ বোধহয় অনুশোচনা বোধটা দলা পাকিয়ে গলায় ঠেকে আছে৷ অথবা কষ্টগুলো দলা পাকিয়ে গলায় ঠেকেছে। শেষবারের মতো একজন পরীর পাশে বসে কিছু সময় কাটাতে চায় সে৷ অর্পিতা নামক পরী। পরীটাকে আগলে রাখতে ইচ্ছে হচ্ছে খুব। কিন্তু সাধ্য যে নেই। পরীকে বুকে আগলে রাখার সাধ্য কি পিশাচের আছে?

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here