#ভোরের_আলো
২৩.
অর্পিতার হাত ধরে খাটের উপর বসে আছে আশফাক। মুখ থেকে আজ কোনো কথা বেরুচ্ছে না। অনুতাপের আগুনে জ্বলেপুঁড়ে ছাড়খাড় হয়ে যাচ্ছে ভেতরটা। আচ্ছা অর্পিতা কি সে তাপ অনুভব করতে পারছে?
– তোমার কি কোনো কারনে মন খারাপ?
– নাহ্।
– মিথ্যা বলছো কেনো?
– মিথ্যা বলতে যাবো কেনো?
– তোমার মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে তোমার মন খারাপ।
– আমাকে খুব ভালোবাসো তাই না?
– তোমার কি মনে হয়?
– জানিনা।
– তোমার এক কথাতেই বাবা মাকে ফেলে তোমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে গিয়েছি। আর তুমি বলছো কতটা ভালোবাসি তা তুমি জানো না? কতটা ভালোবাসলে একটা মেয়ে তার প্রেমিকের এক কথাতেই নিজের সমস্ত আপনজন ফেলে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যায়?
– হুম। বিশ্বাসও করো খুব তাই না?
– ছাগলের মতো প্রশ্ন করছো কেনো?
– আচ্ছা অর্পি, যদি কখনো জানতে পারো আমি তোমাকে ধোঁকা দিয়েছি তাহলে কি আমার প্রতি ভালোবাসাটা মরে যাবে? ঘৃনা করবে আমাকে?
– কি হয়েছে তোমার?
– উত্তর দাও।
– কি ধরনের ধোঁকা?
– যদি শুনো তোমার আমার বিয়েটা নাটক ছিলো?
– ধুর, কি বাজে কথা বলছো! তুমি কি কোনো কারনে টেনশন করছো? মন খারাপ?
– উত্তরটা দাও না প্লিজ।
– কি উত্তর দিবো? অবাস্তব প্রশ্নের উত্তর হয় নাকি?
-……………….
– আশফি? কি হয়েছে? এসব জিজ্ঞেস করছো কেনো?
– তোমাকে কি শেষবারের মতো একবার জড়িয়ে ধরতে পারি?
– শেষবার মানে?
– শেষবার মানে শেষবার। তোমাকে এখন যেসব বলবো এই কথাগুলো শোনার পর তুমি আর আমাকে ভালোবাসবে না। তোমাকে স্পর্শ করার অধিকারটুকু আমাকে আর দিবে না।
– দেখো, আমার কিন্তু কান্না পাচ্ছে। এসব ফাজলামি বন্ধ করো।
অর্পিতাকে খুব শক্ত জড়িয়ে ধরলো আশফাক। ইচ্ছে হচ্ছে পরীটাকে কলিজার ভেতর লুকিয়ে ফেলতে। অজানা কোনো কারনবশত ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে তার। গলা ফাটিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে৷ ভুলবশত কোনো এক পরী তার জীবনে চলে এসেছে। অনিচ্ছা বশতঃ ভুলটা এখন তাকে শোধরাতে হবে। সত্যিটা না বললে এই মেয়ে কখনোই তার পিছু ছাড়বে না। ভালোবাসি-ভালোবাসি বলে পিছুপিছু ঘুরতেই থাকবে। এমন ফুটফুটে মেয়ের জন্য কি রাজপুত্রের অভাব আছে নাকি? অহেতুক এমন পিশাচের পেছনে ছুটে সময় নষ্ট করার মানে হয়না। সে মনে প্রানে চায় অর্পিতা ভালো থাকুক। এমন কেও তার জীবনে আসুক যে তাকে পাগলের ভালোবাসবে।
নিজের বুক থেকে অর্পিতাকে সরিয়ে দিলো আশফাক। কাঁপা কন্ঠে অর্পিতাকে বললো,
– যা বলছি মনোযোগ দিয়ে শুনো। তোমাকে প্রথম যেদিন দেখেছিলাম সেদিন আরাফাতকে নিয়ে তুমি আর তোমার বান্ধবী কথা বলছিলে। আমি কি শুনেছি না শুনেছি ঠিক নেই। সেগুলো শুনে ধরে নিয়েছি তুমি ভালো না৷ ছেলে ঘুরিয়ে টাকা খাওয়া মেয়ে তুমি৷ আমার মেয়েমানুষের নেশা আছে। এই টাইপ মেয়েদের সাথে আমি প্রেম করি৷ কিছুদিন ঘুরি-ফিরি, টাকা উড়াই এরপর সেই মেয়ে বাদ। আবার আরেকটাকে ধরি৷ নিঃসন্দেহে চোখে আটকানোর মতো সুন্দরী তুমি। সেদিন তোমার ঐ কথাগুলো শুনে ডিসিশন নিলাম তোমার সাথে কিছুদিন প্রেম করবো। আমাকে কৌশিক, রিমন বহুবার বলেছে আমার ধারনা ভুল। আমি বিশ্বাস করিনি। নিজের কানকে কিভাবে অবিশ্বাস করতাম বলো? আমারও বহুবার খটকা লেগেছিলো তোমার আচরনে, হয়তোবা আমার ধারনা ভুল। তবু মনে একটা কথাই ঘুরতো আমি তো নিজ কানে শুনেছিলাম ঐ কথাগুলো বলতে। আর বিয়েটা আসলে নাটক ছিলো। তুমি আমার সাথে থাকতে রাজি হচ্ছিলে না তাই মিথ্যা নাটকটা সাজিয়েছি। আজকে সুমির সাথে দেখা হওয়ার পর জানলাম ঘটনা কি ছিলো। আমি কখনো কোনো ভালো মেয়ের ছায়ায় পা দেই না৷ ভুলবশত এবার……
সব শোনার পর মনে হলো তোমাকে অন্ধকার থেকে বের করা উচিত৷ এমনিতেই তোমার সাথে বড়সর অন্যায় করে ফেলেছি। তোমাকে অন্ধকারে রেখে আর অন্যায় করতে চাই না। তাই সবটা বলে দিলাম।
একনাগাড়ে কথাগুলো বলে দীর্ঘশ্বাস নিলো আশফাক। মনে হচ্ছে যেনো বুকের উপর থেকে মস্তবড় পাথর সরেছে। নিঃশব্দে কাঁদছে অর্পিতা। আপাতত নিজেকে বধির এবং বুদ্ধিশূন্য মনে হচ্ছে তার। আশফাকের বলা কথাগুলো সত্য না মিথ্যা সেসব নিয়ে বিবেচনা করার মতো ক্ষমতা এই মূহূর্ত্বে ওর নেই। অর্পিতার মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে খুব দ্রুত পায়ে বেরিয়ে এলো ওদের বাসা থেকে। স্তব্ধ হয়ে আশফাকের চলে যাওয়া দেখছে অর্পিতা।
মুখে কাপড় চেপে ফুঁপিয়ে কাঁদছে অর্পিতা। মুক্তার কপালের ভাঁজে বিরক্তির রেখা ফুঁটে উঠেছে।
– উনি বললো আর তুই বিশ্বাস করলি?
– না, আমি বিশ্বাস করিনি।
– তাহলে কাঁদছিস কেনো?
– ওর কিছু হয়েছে। ও বোধহয় আমার উপর কোনো কারনে রেগে আছে। রাগ করে কথাগুলো বলেছে।
– কি নিয়ে রাগ করবে?
– জানি না। আমি তো তেমন কিছু করিনি।
– যেটাই হোক। এগুলো কি ধরনের কথা বলে গেলো উনি?
– আমি ওর বাসায় যাবো।
– এখন?
– হ্যাঁ এখনই।
– পাগল নাকি? এতরাতে কোথায় যাবি তুই? চুপচাপ বসে থাক। কাল সকালে উনার সাথে দেখা করিস। কাল ভোরে মামা আর মামী তো কেরানীগঞ্জ যাবে ছোট খালার বাড়ি। উনারা বেরিয়ে গেলে তুই বের হবি।
– তুই যাবি আমার সাথে?
– নাহ্। তোদের মাঝে আমি যেয়ে কি করবো? আমি হলাম তৃতীয় ব্যাক্তি। নিজেদের মিমাংসা নিজেরাই করে নে। আর আপাতত ভাইয়াকে ফোন করিস না৷ উনাকে উনার মতো থাকতে দে। কাল সকালে একেবারে কথা বলিস। ততক্ষণে উনার মেজাজ কিছুটা কমে যাবে।
সারারাত দু’চোখের পাতা এক করতে পারেনি আশফাক। দম বন্ধকর পরিস্থিতিতে আটকে আছে সে। পুরো ঘর জুড়ে পায়চারী করেছে আর একটার পর একটা সিগারেট ফুঁকেছে। বাসায় রিমনটাও নেই৷ বন্ধুদের সাথে বেড়াতে গিয়েছে তিনদিন হলো। ও থাকলে নাহয় একটু কথা বলা যেতো। সময় যাচ্ছে সেই সাথে অস্থিরতাও বাড়ছে। এই মূহূর্ত্বে কারও একান্ত সান্নিধ্য প্রয়োজন।
সকাল সাতটা বাজে। রাত্রির নাম্বারে কল করলো সে। কলটা রিসিভ করে ঘুমঘুম কন্ঠে রাত্রি বললো
– হুউউউম…..
– এক্ষুনি ঘুম থেকে উঠো।
– ক্যান?
– বাসায় আসো।
– আমার জানটা কি আমাকে মিস করছে?
– দেখো, এত রসালো কথা শোনার মুড নেই। আসবে কি না বলো?
– উফফ! আশফাক, তোমার ঐ রাগী কন্ঠটা শুনলে একদম পাগল হয়ে যাই। তোমার গলায় কামড়ে ধরতে ইচ্ছে হয়।
– তুমি কি আসছো?
– হ্যাঁ। আসছি তো। এক্ষুনি আসছি। হাত মুখটা তো ধুতে দিবে নাকি?
(চলবে)