ভোরের_আলো পর্ব-২৫

0
1011

#ভোরের_আলো
২৬.

অর্পিতাকে গাড়িতে শুইয়ে কৌশিককে ফোন করলো রিমন। অসম্ভব অস্থির দেখাচ্ছে ওকে। অস্থিরতায় হাত কাঁপছে। অর্পিতার রক্তমাখা হাতের দিকে তাকালেই হাতের কাঁপুনিটা যেনো আরো বেড়ে যাচ্ছে৷ বেসামাল রকমের রক্ত বেরুচ্ছে হাত থেকে। সে এরকম বিদঘুটে পরিস্থিতির মুখোমুখি কখনোই হয়নি। কিভাবে কি সামাল দিবে সেটাও ভেবে পাচ্ছে না। আপাতত এতটুক উপস্থিত বুদ্ধি মাথায় এসেছে কৌশিককে ফোন দিতে হবে।

ওপাশ থেকে ফোন রিসিভ করেছে কৌশিক।

– কি রে? খবর কি তোর?
– ভাইয়া…..
– তোর গলা কাঁপছে কেনো? কোনো সমস্যা?
– অর্পিতা সুইসাইড এটেম্পট নিয়েছে। বাম হাতটা একদম….. কি বলবো! প্রচুর ব্লিডিং হচ্ছে। এত ব্লিডিং হলে তো হসপিটাল নিতে নিতে মরে যাবে। কানন ভাই কি আছে এখন হসপিটালে?
– সুইসাইড এটেম্পট কেনো!
– পরে বলছি। অর্পিতাকে এখন কোন হসপিটালে নিবো?
– ভাইয়া এখন বাসায়ই আছে। আমি হসপিটালে নিয়ে আসছি ওকে। তুই দ্রুত হসপিটালে নিয়ে আয়।

ফোনটা কেঁটে দিয়ে রিমন নিয়ে ছুটলো হসপিটালের দিকে।

মাত্রই গোসল সেড়ে বেরিয়েছে কানন। বিছানায় বসে ম্যাগাজিন পড়ছে তার বউ শিফা। বেশ হন্তদন্ত হয়ে ভাইয়ের ঘরে এলো কৌশিক।

– ভাইয়া হসপিটাল চলো।
– কেনো?
– একটা ইমারজেন্সি কেইস আছে। বোধহয় রগ-টগ কেটে ফেলেছে। তোমাকে লাগবে। চলো।
– কে কেটেছে?
– আশফাকের বউ।
– ও বিয়ে করলো কবে?
– করেছে। বেশিদিন হয়নি।

বেশ কৌতুহল নিয়ে শিফা কৌশিককে জিজ্ঞেস করলো,

– কার কথা বলছো? ঐ যে ১০-১২ দিন আগে মার্কেটে একটা মেয়ের সাথে যে আশফাককে ঘুরতে দেখেছি ও?
– হ্যাঁ।
– কি বলো! এত সুন্দর মেয়েটা! কি হলো বলো তো? সুইসাইড এটেম্পট কেন নিলো?
– জানি না। ভাইয়া জলদি কাপড়টা পাল্টাও। ওর নাকি এক্সেস ব্লিডিং হচ্ছে।
– এক কাজ কর। আশফাককে বল হাত কিছু একটা দিয়ে বাঁধতে৷
– হ্যাঁ,,,,, হ্যাঁ বলছি।

বাসার সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে আশফাকের নাম্বারে কল করলো কৌশিক। পরপর তিনবার কল করার পরও ওপাশ থেকে কেও রিসিভ করলো না। তৃতীয়বারের কলটা কাটতেই ওপাশ থেকে আশফাকের কল আসলো কৌশিকের ফোনে। বেশ ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে কথা বলছে আশফাক,

– ফোন করেছিলি কেন?
– শোন, অর্পিতার হাতটা বেঁধে ফেল।
– কার হাত বাঁধবো?
– অর্পিতার।
– বাঁধবো মানে?
– আরে ওর তো এক্সেস ব্লিডিং হচ্ছে। হাতটা না বাঁধলে ঝামেলা হয়ে যাবে।
– কিসের ব্লিডিং?
– কিসের ব্লিডিং মানে? অর্পিতা না হাত কাটলো?

আশফাক কপালে হাত রেখে শুয়ে ছিলো। ওপাশ থেকে, ‘ অর্পিতা না হাত কাঁটলো’ শুনতেই শোয়া থেকে উঠে বসে পড়লো। বুকে ধুক করে উঠলো তার। কয়েক সেকেন্ডের জন্য মনে হলো হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে গেছে।

– কখন কাটলো?
– তুই কোন জগতে আছিস ভাই?
– আমি তো কিচ্ছু জানি না।
– রিমন আমাকে পাঁচ সাত মিনিট আগে কল করে বললো। অর্পিতাকে ও হসপিটাল নিয়ে যাচ্ছে। আমি ভাইয়াকে নিয়ে হসপিটাল যাচ্ছি। যদি রগ কেটে থাকে তাহলে তো সার্জারী ডক্টর লাগবে। রিমন ফোন করে বললো ভাইয়াকে নিয়ে যেতে।

মুখ থেকে কোন কথা বেরুচ্ছে না আশফাকের। জিহ্বায় জড়তা কাজ করছে। চোখের কোনে পানি ছলছল করছে। বেশ চেঁচিয়ে ওপাশ থেকে কৌশিক বললো,

– তোর বউ মরে যাচ্ছে। তুই কোন দেশে মরতে গিয়েছিস? বউয়ের কোন খোঁজ নেই? হসপিটাল আয় এক্ষুনি।

কলটা কেটেই কোনোমতে ড্রেসিংটেবিলের উপর থেকে গাড়ীর চাবি আর ওয়ালেটটা নিয়ে বাসা থেকে ছুটতে ছুটতে বেরিয়ে গেলো আশফাক। অর্পিতার কাছে এক্ষুনি যেতে হবে।

অপারেশন থিয়েটারের বাইরে কৌশিক আর রিমন বসে আছে। পাশের চেয়ারেই পড়ে আছে রিমনের রক্তমাখা শার্ট। কৌশিকের ফোন পেয়ে হাতের কাছে কোনো কাপড় না পেয়ে নিজের গায়ের শার্টটা খুলে অর্পিতার হাতে বেঁধে দিয়েছিলো। ও.টি.-তে নেয়ার পর নার্স শার্টটা খুলে রিমনের হাতে দিয়ে গেছে। রিমন কতটা ঘাবড়ে আছে সেটা তার মুখ দেখেই স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। রাগ, ঘৃনা, দুশ্চিন্তা সমস্ত কিছু একসাথে ভর করেছে ওর মাথায়। নিজেকে বেশ হিতাহিত জ্ঞানশূন্য মনে হচ্ছে৷ রিমনের মুখ দেখে কিভাবে কি হয়েছে সে কথাটা জিজ্ঞেস করার ইচ্ছেটা মরে গেছে কৌশিকের। বেচারার হাল নাজেহাল হয়ে আছে। এই মূহূর্ত্বে সেসব কথা জিজ্ঞেস করে বিরক্ত করার নূন্যতম ইচ্ছে নেই কৌশিকের৷ পরিস্থিতি খানিকটা স্বাভাবিক হলে নাহয় জিজ্ঞেস করা যাবে।

ও.টি.-র সামনে এসে দাঁড়িয়েছে আশফাক। চোখ বন্ধ করে দেয়ালে মাথা হেলান দিয়ে বসে আছে রিমন। কৌশিক কারো সাথে ফোনে ব্যস্ত। রিমনের পাশের চেয়ারেই পড়ে আছে রক্তমাখা শার্ট। গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে যেয়ে শার্টটা হাতে তুলে নিলো। রক্তমাখানো জায়গা গুলো হাতড়ে দেখছে সে। নিজের অজান্তেই মুখ থেকে বেরিয়ে এলো,

– এগুলো আমার অর্পিতার রক্ত তাই না?

আশফাকের কন্ঠ পেয়ে চোখ মেলে তাকালো রিমন। চোখে ঘৃনার আগুন জ্বলজ্বল করছে। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো সে। দাঁত কিড়মিড়িয়ে বললো,

– এখানে কি? হ্যাঁ? কি দেখতে এসেছো?
– অ….অর্পিতা কোথায়?
– মরার রাস্তা দেখিয়ে দিয়ে এখন জিজ্ঞেস করছো অর্পিতা কোথায়? মরে গেছে ও। শুনেছো? মরে গেছে। যাও বিদায় হও।
রিমনের চেঁচামেচি শুনে কৌশিক ফোন কেটে দিয়ে ওদের দিকে এগিয়ে এলো।

– কি ব্যাপার রে আশফাক? তুই কোথায় ছিলি? আর অর্পিতা সুইসাইড এটেম্পট নিলো কেনো?

শার্টটা বুকে আঁকড়ে ধরে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে আশফাক। কৌশিককে উত্তর দেওয়ার মত সাহস আপাতত তার নেই।

– কি বলবে ও? মুখ আছে বলার?
– হয়েছেটা কি সেটা তো বলবি?
– রাত্রিকে বাসায় এনেছে। কুকাজ করছিলো। অর্পিতা এসে নিজ চোখে কুকাজ দেখেছে। একজন বউ যদি তার হাজবেন্ডকে অন্য মেয়ের সাথে ইন্টিমেট হওয়ার মোমেন্টে দেখতে পায় তাহলে কি ঐ মেয়ের মনের অবস্থাটা কি হতে পারে একবার ভেবে দেখো।
– সিরিয়াসলি আশফাক?
– আমি গতকাল ওকে সব সত্যি বলে দিয়েছি। ওকে এটাও বলেছি বিয়েটা নকল ছিলো। আমার ধারনার বাইরে ছিলো ও সকাল সকাল বাসায় এসে হাজির হবে। আমি তো ভেবেছিলাম এ জীবনে ও আমার ছায়া পাড়াবে না।
– কিসের নকল বিয়ে হ্যাঁ? কোনো নকল বিয়ে হয়নি। অর্পিতা তোমার ধর্মমতে বিয়ে করা বউ। রেজিস্ট্রির কাগজটাও রিয়েল ছিলো। আমি নিজে সব ঠিক করেছি।
– তোকে না বলেছিলাম নকল…..
– আমি তোমার মত হারামী না। বিয়ে আমার কাছে বিয়েই। এখানে নকলের কি আছে শুনি? আমার ধারনা ছিলো তুমি পাল্টে যাবে। তুমি হচ্ছো কুকুরের লেজ। এ জীবনে তুমি ঠিক হবে না। অমানুষ….
– তোকে আমি বলেছিলাম আশফাককে বিয়ের আসল খবরটা বলে দে। তুই বলিসনি কেন?
– বললে কি হতো শুনি? ও কি শুধরে যেতো? কখনোই না। কতটা গিল্ট ফিল হচ্ছে বলে বুঝাতে পারবো না। কেন গেলাম এদের বিয়ে করাতে। কেন ওকে এই লোকের আসল রূপ জানাইনি। নিজের ভাইয়ের ভালো ভাবতে গিয়ে পরের মেয়ের ক্ষতি করলাম।
– আমাদের বিয়েটা কি সত্যিই হয়েছিলো?
– হ্যাঁ হয়েছিলো। জীবনের চরম পাপ করেছি তোমার সাথে ওকে বিয়ে দিয়ে। এই মেয়ে যদি এখন মারা যায় কোনোদিন নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না। কোনোদিনও না। ইচ্ছে হচ্ছে নিজের মাথা দেয়ালে ঠুকে নিজেই মরে যাই। কি বিভৎস একটা পরিস্থিতিতে ছিলাম! উফফ! ফ্লোরে ওর তাজা রক্ত গড়িয়ে যাচ্ছিলো। গাড়ির সিট ভিজে গেছে রক্তে। চোখের সামনে তরতাজা একটা মানুষ মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কৌশিক ভাই কি যে একটা অবস্থায় পড়েছিলাম কাওকে বলে বুঝাতে পারবো না।

চেয়ারে বসে পড়লো আশফাক। শার্টটাকে খুব শক্ত করে বুকে আঁকড়ে রেখেছে সে। চোখের সীমানা পেরিয়ে কান্নাগুলো গাল বেয়ে নিচের দিকে নামছে। আশফাকের হাত থেকে শার্টটা ছিনিয়ে নিয়ে রিমন বললো,

– শার্ট ছাড়ো। নাটক আমার সহ্য হয় না৷ লোক দেখানো কান্না আমার সামনে কাঁদতে আসবা না। যাও, বের হও এখান থেকে। এখানে তোমার কোনো কাজ নেই। মেয়েটা শুধু বেঁচে ফিরলেই হয়। নিজে দায়িত্ব নিয়ে তোমাদের ডিভোর্স করাবো। ওর মতো মেয়ের ভালোবাসা পাওয়ার নূন্যতম যোগ্যতা তোমার নেই। শুধু এতটুকু মাথায় রেখো বহুবছর আগে একটা মেয়ে তোমার সাথে অন্যায় করেছিলো। আর আজ তুমি এরচেয়ে বড় অন্যায় করেছো একটা নির্দোষ মেয়ের সাথে, যে তোমাকে নিজের সবটা উজাড় করে দিয়ে ভালোবেসেছে। তোমার এটাকে আসলে অন্যায় বলা চলে না। পাপ করছো তুমি, পাপ।

দুহাতে মুখ চেপে ফুঁপিয়ে কাঁদছে আশফাক। কৌশিক নির্বিকারভাবে দেয়ালে হেলান দিয়ে আশফাকের দিকে তাকিয়ে আছে। এই মূহূর্ত্বে কাকে কি বলা উচিত সেসব কিছু মাথায় আসছে না। আশফাকের কান্না নেহাৎ ন্যাকামি ছাড়া অন্য কিছু মনে হচ্ছে না রিমনের। দেখতে অসহ্য লাগছে। তাই সে নিজেই সেখান থেকে সরে খানিকটা দূরে যেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

অপারেশন থিয়েটার থেকে একজন নার্স বেরিয়ে এসে বললো,

– এখানে কৌশিক কে?

কৌশিক এগিয়ে যেয়ে বললো,

– আমি।
– কানন স্যার বলেছেন দুই ব্যাগ ও পজিটিভ ব্লাড ম্যানেজ করতে।
– আপনাদের স্টকে নেই?
– না। গতরাতেই শেষ হয়ে গেছে।

রিমন এগিয়ে এসে বললো,

– আমার ও পজিটিভ। আমি দিতে পারবো।
– তুই তো দুই ব্যাগ দিতে পারবি না।
– সমস্যা নেই। পরিচিত ছয় সাতজন আছে।
– আমারও তো ও পজিটিভ।
– লাগবে না তোমার রক্ত। তুমি দূরে থাকো। অর্পিতার মানুষের রক্তের প্রয়োজন। তোমার মত জানোয়ারের না।

করুন দৃষ্টিতে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে আশফাক। নার্সের পিছন পিছন রিমন যাচ্ছে রক্ত দেয়ার জন্য। এক এক করে ফোন দিয়ে পরিচিতদের হসপিটালে আসতে বলছে সে।
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here