#ভোরের_আলো
২৯.
কাঁধে কারও স্পর্শ পেলো আশফাক। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই দেখতে পেলো কৌশিক দাঁড়িয়ে।
‘বাহিরে চল’ কথাটা বলেই আশফাকের হাত ধরে টানতে টানতে অবজারভেশন রুমের বাহিরে নিয়ে এলো। তিনতলার করিডোরের শেষ মাথায় আশফাককে নিয়ে এসে বললো,
– অর্পিতার বাবা মা এখানে এসে গেছে। উপরে উঠছে। বাসায় যাবি, চল।
– কেনো?
– উনারা তোকে এখন দেখলে ঝামেলা হতে পারে।
– কিসের ঝামেলা? কোনো ঝামেলা নেই। উনাদের মেয়ে আমাকে বিয়ে করেছে। আমার পুরো হক্ব আছে আমার ওয়াইফের কাছে থাকার। আমি যাবো না।
– হ্যাঁ, ও তোর ওয়াইফ। তোর অধিকারও আছে ওর কাছে থাকার। তবে এখন না ভাই। প্লিজ! দেখ সন্তান বাবা মা কে না জানিয়ে বিয়ে করেছে এটা প্রতিটা মা-বাবার জন্য খুবই কষ্টের৷ এমনিতেই উনাদের মেয়ের কি একটা অবস্থা। তারউপর যদি শুনে মেয়ে উনাদের ফেলে বিয়ে করে ফেলেছে তাহলে উনাদের হাল কি হবে ভেবে দেখ তো? অর্পিতার মা-বাবা তো তোরও বাবা- মা হয় তাই না?
-…………….
– ওর যখন জ্ঞান ফিরবে তখন যদি ও শুনে ওর মা বাবা বিয়ের খবর জানে তখন ওর উপর আরো চাপ পড়বে। এমনিতেই তোকে নিয়ে ও প্রচুর স্ট্রেসড। ওকে এসব বাড়তি প্যাড়া দিস না আশফাক। যাক না আরও কয়টাদিন। এরপর নাহয় অর্পিতার সাথে কথা বলে ওর বাসায় প্রস্তাব পাঠাবো। ওর ফ্যামিলিকে শোনানোর প্রয়োজন নেই তোরা লুকিয়ে বিয়ে সেড়ে ফেলেছিস।
– যদি আমার কাছে বিয়ে দিতে রাজি না হয়?
– পরেরটা পরে দেখা যাবে৷
– আমার যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না৷ আমি এখানেই থাকি৷ ওদিকে যাবো না।
– কথা বুঝিস না কেনো?
ঐ তো রিমন এসেছে। এই তোর ভাইকে বুঝা তো।
– কি বুঝাবো?
– অর্পিতার বাবা-মা আসছে। ওকে বলছি এখান থেকে চলে যেতে। ও রাজি হচ্ছে না।
– এত দরদ দেখাতে হবে না। যাও, বাসায় যাও।
– আচ্ছা, রিমন মাথা ঠান্ডা কর। আশফাক নিজের ভুলটা বুঝতে পেরেছে।
– কোনটাকে ভুল বলছেন আপনি? এটা অন্যায় ছিলো। জেনে বুঝে অন্যায় করেছে ও৷ কি? কি আছে ঐ মেয়ের মাঝে? বারবার ঐ মেয়ের কাছে কেনো যায়?
– আচ্ছা, এগুলো আমরা বাসায় যেয়েও শুনতে পারবো। আগে এখান থেকে যাওয়াটা জরুরী।
– অনেক নাটক করেছো। চলো। বাসায় চলো।
– আমি কোনো নাটক করছি না।
– ঠিকাছে নাটক করছো না। এখন বাসায় চলো। অলরেডি নিজের ঘরে আগুন ধরিয়ে বসে আছো। ঐ আগুন কিভাবে নিভাবে সেটা ভাবো। আপাতত অন্যঘরে আগুন না লাগালেও চলবে। চলো।
দুজন দুপাশ থেকে আশফাককে ধরে নিচে নিয়ে যাচ্ছে। আশফাকের মন সায় দিচ্ছে না। তবু যেতে হচ্ছে অর্পিতার ভালোর কথা ভেবে।
– ও হাত কাটলো কেনো রে মুক্তা?
– আমি জানি না মামী।
– মিথ্যা বলবি না।
– আমি সত্যিই জানি না।
– তুই সাজগোজ করে কোথায় গিয়েছিলি?
– নিশির সাথে বাইরে ছিলাম। অর্পিতারও যাওয়ার কথা ছিলো। যাওয়ার আগ মূহূর্ত্বে বললো যাবে না। কয়েকবার জোরাজোরি করেছি যাওয়ার জন্য। ও ক্ষেপে যাচ্ছে দেখে আর কিছু বলিনি। আমি আমার মত বেরিয়ে এসেছি।
– মন খারাপ ছিলো?
– রেগে ছিলো বেশ।
– জিজ্ঞেস করিসনি কি হয়েছে?
– হুম করেছি তো। কিন্তু কিছু তো বললো না।
– আমার মেয়েটা নিশ্চিত বড় কোনো কষ্ট পেয়েছে। আর নয়তো এমন করার মানুষ ও না।
– কি এমন কষ্ট লিপি? বাবা কি ওর কোনো কিছুর অভাব রেখেছি? কখনো সমস্যা হলে আমি কি সলভ করিনি? এবারের সমস্যার কথা কি আমাকে বলা যেতো না?
– জ্ঞান ফিরেছে?
– হুম। ঘুমাচ্ছে এখন।
– ওকে দেখা যাবে এখন?
– জানি না। নার্স বা ডক্টরের কাছ থেকে পারমিশন নাও।
– আবিদকে ফোন করেছিলাম৷ দেশে আসার জন্য পাগল হয়ে গেছে।
– হুম, সায়েম ফোন করেছিলো। আবিদ ভাইয়াও ফোন করেছিলো। আমাকে বললো, ছোট মামী, সায়েম আর আবিদ ভাইয়া দেশে আসবে।
– টিকিট কিনে ফেলেছে?
– না, আমাকে যখন কল করেছে তখন টিকিট কিনতে যাচ্ছে।
বাসার ড্রইংরুমে বসে আছে আশফাক, রিমন আর কৌশিক। একরাশ বিরক্ত ছেয়ে আছে ওদের দুজনের মুখে৷ মাথায় হাত রেখে চোখ বন্ধ করে বসে আছে আশফাক। মুখ খুললো কৌশিক,
– সবই বুঝলাম। অর্পিতা ভালো মেয়ে, তুই ওর ভালো চেয়েছিস তাই ওর কাছে সমস্ত সত্যি কথা বলে বিদায়-টিদায় নিয়ে চলেও এসেছিস। খুবই ভালো কথা। তুই নিজের মুখেই বলছিস ওর প্রতি তুই উইক হয়ে গিয়েছিলি। বেশ কিছুদিন ধরেই নাকি ওর প্রতি টান টাও বেশ তোড়জোড় নিয়েই টের পাচ্ছিলি। তাহলে আজকে সকালে রাত্রিকে বাসায় এনেছিস কি খেয়ে? মদ-টদ খেয়েছিলি? হুঁশ জ্ঞানে ছিলিনা তাই অর্পিকে ভুলে রাত্রিকে তোর স্মরণ হয়েছে?
– না৷ শুধু সিগারেট খেয়েছি সারারাত ধরে। অন্যকিছু খাইনি।
– তাহলে রাত্রিকে আনলি কিভাবে? অর্পিতাকে নিয়ে তোর এত ফিলিংস, রাত্রিকে বাসায় ডাকার সময় ফিলিংস কোথায় ছিলো তোর?
– আমি চাচ্ছিলাম অন্যদিকে মনযোগ ঘুরাতে যাতে অর্পিতাকে ভুলতে পারি৷ আমি চাচ্ছিলাম না ওর প্রতি আমার আকর্ষণটা আরো বাড়ুক। এই ঘটনার ইতি এখানেই হোক। ওর প্রতি মায়া আরও বাড়তে থাকলে আমি কখনোই ওর কাছ থেকে দূরে সরতে পারতাম না।
– এতটা সাধু হওয়ার কারন আমাকে এক্সপ্লেইন করবে প্লিজ! ও তোমাকে পাগলের মতো ভালেবাসে। একটাসময় রাত্রিকে তুমি যতটা ভালোবাসতে তার চেয়েও বেশি। রাত্রির চলে যাওয়া তুমি মেনে নিতে পারোনি। ওর হাজবেন্ডের সাথে তুমি ওকে এতটা ক্লোজলিও দেখনি। জাস্ট পাশাপাশি বসে থাকতে দেখেছো, হাত ধরে গল্প করতে দেখেছো। আর সবচেয়ে বড় কথা রাত্রি তোমাকে ছেড়ে এরপর তোমার ভাইকে বিয়ে করেছে। একসাথে দুটো সম্পর্ক কিন্তু তখন ও একসাথে কন্টিনিউ করেনি। এটাই তুমি মানতে পারোনি৷ কতটা ভুগেছো মনে পড়ে তোমার? আর এখানে অর্পিতার সাথে রিলেশন থাকা অবস্থায় তুমি অন্য মেয়ের সাথে জড়িয়ে ছিলে। ওকে এটাও বলেছো বিয়ে নকল ছিলো। আর ও আজ নিজ চোখে সকালে দেখলে তুমি রাত্রিকে,,,,,, কাপড়চোপড় ছাড়া,,,,,, কি ভয়ানক অবস্থা! উফফ! ওর মনের অবস্থাটা একটাবার তুমি অনুভব করতে পারছো? নিজেকে দিয়েই উপলব্ধি করে দেখো তো।
দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো আশফাক। খানিকটা নড়েচড়ে বসলো।
– যেহেতু ওর প্রতি মায়াটা উপলব্ধি করতে পারছিলে, সত্যিটা একদম স্পষ্ট তোমার সামনে ছিলো তাহলে কেনো ওকে ছাড়ার কথা মাথায় আনলে। কি প্রয়োজন ছিলো? তুমি কি চাইলে পারতেনা ব্যাপারটাকে পজিটিভলি দেখতে? হ্যাঁ, তোমার বাবা মায়ের সাথে সম্পর্ক নেই। ওর বাবার মত এত টাকা তোমার নেই। জীবনে অনেক খারাপ কাজ করেছো। সমস্ত কিছু একপাশে রেখে তুমি কি পারতেনা ব্যাপারটা এভাবে চিন্তা করতে অর্পিতা তোমাকে ভালোবাসে। ও সব জেনেই তোমাকে ভালোবাসে৷ তোমার বাবা মায়ের পরিচয় ছাড়াই তোমাকে বিয়ে করে নিয়েছে। তোমার কি ধারনা ওর ফ্যামিলি তোমার কাছে বিয়ে দিতে রাজি না হলে ও ওর বাবা মায়ের কথা মেনে নিতো? কখনোই না। ও এক কাপড়ে তোমার কাছে চলে আসার মেয়ে। সবকিছু ভুলে ওর সাথে কি নতুন করে বাঁচার একটু ইচ্ছেও তোমার হলো না?
– সত্যি কখনে চাপা থাকে না। কোনো না কোনোদিন ও জানতো আমি এত মেয়ের সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছি।
– হ্যাঁ, হয়তো জানতে পারতো। কিন্তু লোকমুখে কানে শোনা আর নিজ চোখে নগ্ন অবস্থায় নিজের হাজবেন্ডকে অন্য মেয়ের সাথে দেখার মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য। অন্যের কাছে শুনলে ও বিশ্বাস নাও করতে পারতো। যদি বিশ্বাস করতোও তবু এতটা কষ্ট পেতো না। ওকে সামলানো যেতো। কিন্তু ও আজ যা দেখে গেলো সেটা কিভাবে ধামাচাপা দিবে? তোমার বর্তমান অবস্থা যা দেখতে পাচ্ছি তা দেখে তো মনে হচ্ছে ও তোমার কাছে ফিরে না আসলে মারা যাবে তুমি। এই ঘটনার পর ও তোমার কাছে ফিরবেও না৷
– ও আমার বিয়ে করা বউ। চাইলেই ও চলে যেতে পারে না।
– এটা কোনো সামান্য ঘটনা ছিলোনা। তোমাকে ছাড়তে চাওয়াটা খুবই যৌক্তিক। নিজের চতুর্দিকে আগুন ধরিয়ে ফেলেছো৷ আগুনের একপাশে তুমি অন্যপাশে অর্পিতা। এই আগুন কিভাবে নিভাতে পারবে তা আমি জানি না। দেখো, এই আগুনে পুঁড়ে নিজেই না আবার জ্বলেপুঁড়ে ছাই হয়ে যাও!
(চলবে)