ভোরের_আলো পর্ব-৩১

0
1400

#ভোরের_আলো
৩১.

অর্পিতার রুমের বাহিরের কোরিডোরটাতে পায়চারী করছে আশফাক। মুক্তা আর পাখি বসে আছে। রাত সাড়ে দশটার দিকে পাখি ফোন করে জানালো আমজাদ সাহেবের প্রেশার বেড়েছে। ফোন পাওয়ার সাথে সাথেই লিপি বেরিয়ে গেলেন বাসার উদ্দেশ্যে। বাসায় যেয়েই পাখিকে পাঠিয়ে দিলেন হসপিটালে মুক্তাকে সঙ্গ দিতে। আশফাক ফোন করেছিলো মুক্তাকে অর্পিতার খোঁজ নিতে। হসপিটালে অর্পিতার মা বাবা কেউ নেই শুনে ছুটে চলে এলো হসপিটালে। আজকে রাতটা এখানেই কাটাবে সে।

– আশফাক ভাই, আপনি ভিতরে যেয়ে বসুন।
– ও ঘুমুচ্ছে।
– হ্যাঁ তো সমস্যা কোথায়? আপনি তো আর কথা বলছেন না যে ওর ডিস্টার্ব হবে। তাছড়া বেডটা একটু বড় সাইজেরও৷ আপনি চাইলে ওর পাশে শুয়ে কিছুক্ষণ ঘুমাতে পারেন। আপনার চেহারার দিকে তাকানো যাচ্ছে না৷ চোখজোড়া বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছে। একদিনেই কেমন একটা কালচে ভাব চলে এসেছে মুখটাতে। কতক্ষণ শুয়ে রেস্ট করুন।
– না, আমি ঠিকাছি।
-খেয়েছেন কিছু?
– গলা দিয়ে খাবার নামছে না।
– খাচ্ছেনও না। রেস্টও নিবেন না৷ পরে তো আপনিই অসুস্থ হয়ে যাবেন।
-…………..
– অর্পি ঘুমিয়েছে অনেকক্ষণ হলো। সেই সাতটার দিকে একটু চোখ মেলে আবার পাঁচ মিনিট পরই ঘুমিয়ে গেছে। এখন বাজে পৌনে একটা। যেকোনো সময় ঘুম ভাঙতে পারে। আপনি ওর সামনে থাকলে ভালো হয়।

মুক্তা খুব জোরাজোরি করছিলো ভিতরে যেয়ে বসার জন্য। বারবার কানের কাছে এককথা শুনতে ভালোও লাগছিলো না। তাই ভিতরে চলে এসেছে সে।

– আপা, আপনি এই কথা কইলেন ক্যান?
– কোন কথা? অর্পি আপার সাথে শুইয়া থাকার কথা?
– সমস্যা কোথায়?
– আবিয়াতা অবস্থায় এক বিছানায় থাকবে এটা কেমুন কথা?
– ওরা বিয়ে করে ফেলেছে?
– ওমা! কবে করলো?
– ১৭ দিন হলো।
– সবাইরে রাইখা বিয়া কইরা ফেললো?
– হুম।
– কামডা ঠিক হয়নাই৷ চাচা চাচী জানলে খুব কষ্ট পাবে।
– কারো কাছে বলিস না।
– নাহ, তা বলমু না। তবে একটা কথা।
– কি?
– ছোট থেইকা অর্পি আপারে দেখতাসি৷ শক্ত মনের মানুষ। সহজে কোনো কিছু আপারে কাবু করতে পারে না। তাহলে আপা শিরা কাটলো ক্যান? দুলাভাইর সাথে কিছু হইছে তাই না?
-…………….
– দুলাভাইর মুখ দেখছেন আপনি? কেমন কাঁচুমাচু খাইতাছে? মুখ দেইখা মনে হইতেছে কোনো অপরাধ করছে।
– বাদ দে পাখি। ওদের হাজবেন্ড ওয়াইফের সমস্যা, ওদেরকেই সলভ করতে দে। আমরা সেসব নিয়ে না ভাবি।

অর্পিতার মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে আছে আশফাক। প্রচন্ড অস্বস্তিতে ভুগছে সে। অর্পিতাকে রেখে দূরে বসেও থাকতে পারছে না। আবার মুখোমুখিও হতে ইচ্ছে হচ্ছে না লজ্জায়। অর্পিতার যখন ঘুম ভাঙবে তখন ওর সামনে দাঁড়াবে কি করে? কি বলবে অর্পিতাকে? ফের কখনো কি অর্পিতা ওকে নিজের সবটা উজাড় করে ভালোবাসতে পারবে নাকি সারাটাজীবন শুধু ঘৃনাটুকুই বয়ে বেড়াবে?

– অস্বীকার করবি না সায়েম। তুই সব জানিস। অর্পিতার এমন কোনো সিক্রেট নেই যেটা তুই জানিস না।
– তুমি যা ভাবছো সেসব কিচ্ছু না ভাইয়া। ওর কারো সাথে এ্যাফেয়ার নেই। হতে পারে অন্য কিছু ঘটেছে।
– অর্পি তোরও বোন। আমার একার না। মেয়েটা আজকে মরতে গিয়েছিলো। যদি মরে যেতো তাহলে কি হতো বল? একটা মানুষ কতটা ডিপ্রেসড থাকলে সুইসাইড করতে চায়? অর্পিতা এতখানি ডিপ্রেশনে চলে গেছে অথচ তুই এর কিছুই জানিস না? সুইসাইড করার চিন্তাটা নিশ্চয়ই একদিনেই পর মাথায় আসেনি। নিশ্চিত বেচারী বেশকিছুদিন ধরেই কোনো বিষয় নিয়ে কষ্ট পাচ্ছিলো। দেখ, যা জানিস বলে দে। ও যে আবারও এমন কিছু ঘটাবে না তার কোনো গ্যারান্টি নেই। কোনো সমস্যা যদি থেকে থাকে তাহলে তো সেটা সলিউশন করতে হবে তাই না?

অনেকক্ষণ যাবৎ আবিদকে মিথ্যা বলেই যাচ্ছে সায়েম। আর পেরে উঠতে পারছে না। অর্পিতার নিষেধাজ্ঞা ছিলো তাই এতক্ষণ মুখ খুলেনি৷ এখন মনে হচ্ছে বলে দেয়া উচিত। সত্যিই তো, কোনো সমস্যা থেকে থাকলে সেটার সমাধান জরুরী৷ সায়েমের মনে হচ্ছে আত্মহত্যার চেষ্টাটা আশফাক কেন্দ্রীক৷ যদিও সত্যিটা পুরোপুরি জানা নেই। তবু সব ব্যাপার খোলাসা করে একটা সমাধান দরকার। তাছাড়া আশফাকের কথা ফ্যামিলিতে জানালে সমস্যা কোথায়? এমন তো না যে অর্পিতা ছোট মেয়ে। ওকে বিয়ে দিলে সংসার করতে পারবে না৷ অথবা আশফাক বেকার। বিয়ে করে বউকে খাওয়াতে পারবে না। সমস্যা তো তেমন কিছুই না৷ তাহলে বাসায় জানাতে কি সমস্যা? সায়েমকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে বেশ বিরক্ত আবিদ। সায়েমের রুম ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলো সে মূহূর্ত্বে পিছু ডাকলো সায়েম।

– ভাইয়া…. অর্পিতার একজনের সাথে এ্যাফেয়ার আছে।

থমকে দাঁড়ালো আবিদ। ঘুরে তাকিয়ে বললো

– আমি তো জানতাম তুই সব জানিস। তাহলে এতক্ষণ মিথ্যা কেনো বললি?
– জানোই তো আমরা কখনো আমাদের সিক্রেট কাউকে বলি না।
– অন্য সময় আর এখনকার হিসেব আলাদা।
– তুমি এখানে বসো। আমি সব বলছি।

বেডরুমের দরজাটা আটকে দিয়ে বিছানায় এসে বসলো আবিদ।

– কতদিন ধরে চলছে এই কাহীনি?
– বেশি না। এইতো পাঁচমাসের কাছাকাছি।
– ছেলে কি ওর সেইম এইজ নাকি?
– আরে নাহ, যথেষ্ট বয়স আছে উনার। ৩২ বছর।
– ছেলে তো তাহলে আমার চেয়ে আরো ২ বছরের বড়। ওর সাথে ১৩ বছরের ডিফারেন্স। এত পার্থক্যে কিভাবে কি?
– আমিও শোনার পর একটু অবাক হয়েছিলাম। ছবি দেখে যা বুঝলাম উনার বয়স চেহারা দেখে বুঝার উপায় নেই৷ দেখলে মনে হয় ২৪-২৫ বছর। আমি আর অর্পিকে এটা নিয়ে কিছু বলিনি। যার নজরে যাকে ভালো লাগে। এখানে বয়সের পার্থক্যে আর কি আসে যায়?
– ছেলে কি করে?
– এক্সপোর্ট ইমপোর্টের বিজনেস।
– বাবা কি করে? ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড কেমন?
– ওগুলো জানি না। একটা ছোট ভাই আছে জানি। আর কিছু জানি না।
– থাকে কোথায়?
– শান্তিনগর। নিজের ফ্ল্যাট আছে। সেখানে থাকে।
– ছবি আছে?
– হ্যাঁ আছে তো৷ দেখবা?
– দেখা তো।

স্ক্রিনে ভেসে উঠা মুখটা অতি পরিচিত একটা মুখ৷ এই মানুষটাকে দেখার কথা স্বপ্নেও ভাবেনি আবিদ৷ রীতিমতো ভূত দেখার মত চমকে আছে সে।

– উনার সাথে অর্পির রিলেশন চলে?
– হ্যাঁ।
– তুই সিওর?
– সিওর হবো না কেনো? দুজনের একসাথে তোলা কত ছবি দেখলাম!
– শেষমেষ অর্পিতা উনার সাথে? সিরিয়াসলি?
-কেনো? কি সমস্যা?
– অনেক সমস্যা। হিসেবছাড়া সমস্যা৷ আমি উনাকে স্কুল থেকে চিনি৷ এক স্কুলে পড়েছি আমরা৷ দুই ব্যাচ সিনিয়র ছিলো। অমায়িক একজন মানুষ ছিলো। সহজ সরলের শেষ পর্যায়ের মানুষ ছিলো উনি৷ আগে যতটা না সহজ সরল ছিলো এখন ঠিক ততটাই নষ্ট হয়ে গেছে। কত মেয়ের সাথে এই ছেলের রিলেশন আছে তুই জানিস? শুধু রিলেশন না। সবকয়টার সাথে ফিজিক্যালি ইনভলভড এই ছেলে। অর্পিতা কি দুনিয়াতে কি আর কোনো ছেলে পায়নি? এই ছেলেই কি দুনিয়াতে অবশিষ্ট ছিলো? যা সন্দেহ করছিলাম তাই হলো। প্রেমে ছ্যাঁকা খেয়ে সুইসাইড এটেম্পট নিয়েছে ও।

হতভম্ব হয়ে আবিদের কথাগুলো শুনলো সায়েম। অবিশ্বাসের ঘোরে তলিয়ে যাচ্ছে সে৷ কিছুক্ষণ চুপ থেকে এরপর বললো,

– ঠিকঠাক বলছো তো? এই ছেলে কিন্তু আমাদের বোনজামাই৷ এরসাথে আমাদের বোনের ভবিষ্যৎ জড়িয়ে আছে৷ নাও তো, ছবিটা আরেকবার দেখো ভালোমত৷ তোমার বোধহয় ভুল হচ্ছে।
– বোনজামাই মানে?
– ওরা বিয়ে করেছে ১৬ দিন হলো।

বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো আবিদ। কান দু’টো যেনো বন্ধ হয়ে আসছে। মাথার দুপাশ চেপে ধরে রেখেছে দুহাত দিয়ে।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here