#ভোরের_আলো
৩২.
অর্পিতাকে গতকাল বিকেলে হসপিটাল থেকে বাসায় আনা হয়েছে। আজ সকালে দেশে ফিরেছে আবিদ। সাথে এসেছে সায়েম আর সায়েমের মা মিনু। দুপুরে খাওয়া শেষে অর্পিতার ঘরে এসেছে আবিদ আর সায়েম৷ মা আর চাচী অন্যরুমে ঘুমুচ্ছে৷ বাবা ইসলামপুরে৷ ফিরে আসতে সন্ধ্যা হবে৷ আবিদের মতে অর্পিতার সাথে বিস্তারিত কথা বলার এটাই উপযুক্ত সময়৷ আপাতত আশফাকের ব্যাপারটা সে বাসায় জানাতে চাচ্ছে না। মা সজাগ থাকাকালীন সময়ে কথা বলে বিশেষ সুবিধা করা যাবে না। বারবার এসে উঁকিঝুঁকি দিবে ঘরে কি চলছে দেখার জন্য। ঘরে ঢুকেই দরজা আটকে অর্পিতার মুখোমুখি বসলো আবিদ।
– তোর আর আশফাক ভাই সম্পর্কে সব জেনেছি।
মাথা নিচু করে বসেছিলো অর্পিতা৷ আবিদের কথায় চমকে গিয়ে মাথা তুলে তাকালো।
– আমিও ঠিক এভাবেই চমকে গিয়েছিলাম সায়েমের মুখে আশফাক ভাইয়ের সাথে তোর সম্পর্কের কথা শুনে।
– আশফাককে ভাই ডাকছিস কেনো? চিনিস নাকি ওকে?
– তুই যতটুক চিনিস তারচেয়ে দ্বিগুন আমি চিনি।
– কিভাবে?
– একস্কুলে পড়তাম। দুই ব্যাচ সিনিয়র ছিলো।
– ওহ্।
– ওর অতীত জানিস? বা বর্তমান?
– কিসের অতীত বর্তমানের কথা বলছিস?
– আশফাক ভাইয়ের আড়ালে আরেকজন আশফাক আছে। সেটা কি জানিস?
– হুম জানি।
– তাহলে ওর অতীত শুনে ইমোশনাল হয়ে গিয়েই বিয়েটা করেছিস নিশ্চয়ই? বর্তমান জানলে তো লাত্থি মেরে চলে আসবি।
– ওর কোনো অতীত আমি জানি না। তবে বর্তমান জানি৷
– বর্তমান জেনেও বিয়ে করলি?
– আমাদের কোনো বিয়ে হয়নি।
অর্পিতার কথায় চমকে উঠলো মুক্তা আর সায়েম। মুক্তা বেশ উৎকন্ঠা নিয়ে বললো,
– বিয়ে হয়নি মানে?
– হয়নি মানে হয়নি। সবকিছু নাটক ছিলো।
– নাটক কিভাবে হয়? বিয়ের সময় আমি নিজে দাঁড়িয়ে ছিলাম।
– হ্যাঁ, তাইতো। বিয়ে হয়নি মানে কি? আমিও তো তখন তোদের সাথে ভিডিও কলে ছিলাম। সবকিছু তো ঠিকঠাক মতোই ছিলো।
– আশফাক নিজে আমাকে বলে গেছে বিয়েটা হয়নি।
– অর্পি,,,,, ঠিক করে বলতো আশফাক ভাইয়ের সাথে তোর আসলে কি হয়েছে? উনাকে হসপিটালে আমি কয়েকদফা জিজ্ঞেস করেছি। উনি একটা উত্তরও দেননি।
মুক্তার প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলো না অর্পিতা। জানালার দিকে মুখ ঘুরিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে।
অর্পিতার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে আবিদ। দু’গাল বেয়ে পানি ঝড়ছে তার বোনের। মনের ভিতর অনেক কথা লুকিয়ে রেখেছে মেয়েটা। কেনো লুকিয়ে রেখেছে সেটার নিশ্চিত কারন আবিদের জানা নেই৷ তবে আপাতত দুটো কারন আন্দাজ করতে পারছে। প্রথমত, জীবনের সবচেয়ে বাজে ভুল সিদ্ধান্ত হচ্ছে আশফাক৷ সম্পর্কের চারমাসের মাথায় বিয়েও করে ফেলেছে। বিয়ের ১৬ দিনের মাথায় এটাও জানা হয়ে গেছে বিয়েটা নকল। সব মিলিয়ে বেশ বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে গেছে সে। তাই হয়তো লজ্জায় কাউকে কিছু বলতে চাচ্ছে না৷
দ্বিতীয়ত, হতে পারে অর্পিতা যতটুক সমস্যার কথা শোনাচ্ছে, সমস্যা আসলে ততটুক না। সমস্যা আরো বড় যেটা কাওকে বলা সম্ভব না।
তবে ঘটনা যাই হোক না কেনো পুরো গল্পটা তো শুনতেই হবে। অর্পিতার কাছে এগিয়ে এসে ওর হাতটা চেপে ধরলো আবিদ।
– অর্পি আমি সব শুনতে চাচ্ছি। ঘটনা যাই হোক না কেনো আমি সব জানতে চাই৷ তুই বেঁচে থেকেও মরে গেছিস। আমার দেখতে ভালো লাগছে না। আমরা সবাই তোকে কতটা ভালোবাসি সেটা কি তোর কোনো আন্দাজ আছে? কোথাকার কোন ছেলের জন্য তুই এভাবে নিজেকে শেষ করে দিবি? আমাকে বল। তোর ভাই তো মরে যায়নি। নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো তোর সমস্যা সমাধান করার।
-………….
– তুই কি আমাকে বলতে ভয় পাচ্ছিস বা লজ্জা লাগছে?
-…………..
– নির্দ্বিধায় বলে ফেল। আমি তো বললাম ঘটনা যেমনই হোক না কেনো আমি শুনবো৷ এই কথা আমাদের চারজন পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকবে।
আবিদের গলা জড়িয়ে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো অর্পিতা।
– ও একটা অমানুষ। বাজেভাবে ঠকিয়েছ আমাকে। তুই জানিস আমি ওকে কত ভালোবাসতাম? অথচ ও আমার ভালোবাসাটাকে পা দিয়ে পিষে দিলো। ও শুধু আমার ইমোশনটাকে ইউজ করেছে৷ পাগলের মতো ভালোবেসেছি ওকে। বিশ্বাস করেছি ওকে। মানুষ এত মিথ্যা কথা কিভাবে বলে রে ভাইয়া? এত নিখুঁত! এত সুন্দর সাজানো-গোছানো! কিভাবে সম্ভব? আমি বুঝতেই পারিনি ওর প্রতিটা কথা মিথ্যা ছিলো। আমাকে বলেছিলো ওর সাথে ওর বাসায়………
– থামলি কেনো? বল। বলেছি তো ভাইয়া সব শুনবো।
– ও….. ও ইন্টিমেট হতে চাচ্ছিলো। আমি না করেছিলাম। বিয়ের আগে এসব আমি করতে চাইনি৷ তখনও মাথায় আসেনি সম্পর্কের চারমাসেই যে মানুষটা এসব প্রস্তাব দেয় সে কি করে ভালো হয়? সে মানুষ কখনোই ভালো হয় না। কখনোই না। আমি ওর মাঝে এতটাই ডুবে ছিলাম যে এই সহজ কথাটা আমার মাথাতেই এলো না। এরপর ও বিয়ে করবে বললো। আর আমিও রাজি হয়ে গেলাম। তোদের সবাইকে রেখেই বিয়ে করেও নিলাম। স্বপ্নের দুনিয়ায় ভেসেছি আমি। হেসেছি, খেলেছি, ঘুরে বেড়িয়েছি৷ স্বপ্নগুলো শেষ ভাইয়া। মানুষটা টেনে হিঁচড়ে আমাকে সেই দুনিয়া থেকে মাটিতে ফেলে দিয়েছে।
– এখন সে কি চাচ্ছে? তোর কাছ থেকে বিদায় নিতে?
– বিদায় তো সে নিয়েই নিয়েছে। খুব সুন্দর করেই বিদায় নিয়েছে। সেদিন রাতে বারোটার পর ফোন করে বললো বাসায় আসবে। আমি যেনো ডিম ভুনা আর ডাল ভুনা করি। শেষবারের মত আমার হাতের রান্না খেতে চায়। রান্না করলাম। আসলো, খেলো এরপর বলে আমাদের বিয়ে নাকি নকল। আমাকে নিয়ে কি একটা মিসআন্ডাস্ট্যান্ডিং হয়েছে। তাই এসব ড্রামা করেছে। আমাকে ভালো জানলে নাকি কখনোই আমার দিকে হাত বাড়াতো না৷ আমাকে বললো ওকে ভুলে যেতে। যা হয়েছে সব ভুলে যেতে৷ আমি ওর চেয়ে ভালো ছেলে পাবো। এসব ভুংভাং বুঝিয়ে চলে গেলো। আমি ওর একটা কথাও সেদিন বিশ্বাস করিনি। পরদিন সকালেই ছুটে গিয়েছিলাম ওর বাসায়৷ যেয়ে দেখলাম আরেক মেয়ের সাথে ওর বেডরুমে,,,,,, একজনের গায়ে ছিটেফোঁটা কাপড় আছে আরেকজনের গায়ে কিছুই নেই।
– আর তুই সেসব দেখে বাসায় এসে সুইসাইড এটেম্পট নিয়ে নিলি?
– নিজেকে জগতের সবচাইতে নোংরা মনে হয়। একটা নোংরা পুরুষের স্পর্শ লেগে আছে এই শরীরে৷ যে হাত দিয়ে লোকটা আরো বহু মেয়ের গায়ে হাত দিয়েছে৷ নিজের এত বড় ভুল সিদ্ধান্তটা মানতে পারছিলাম না৷ গলার কাছে নিঃশ্বাস ঠেঁকে গিয়েছিলো। আসলে কি জানিস ভাইয়া, আমি নিজেও প্রতারক। তোদের সাথে প্রতারনা করেছি৷ তোদের না জানিয়ে ওকে বিয়ে করতে গিয়েছি৷ তোদের ভালোবাসার মূল্য না দিয়ে ওকে ভালোবেসেছি৷ ওকে নিয়েই নিজের জগত সংসার তৈরী করতে চেয়েছি। দেখ তো, উপরওয়ালা একদম হাতেনাতে আমার শাস্তিটুকু বুঝিয়ে দিয়েছেন৷ যাকে ভালোবেসেছি সেও প্রতারক। সেও আমার ভালোবাসার মূল্য দেয়নি৷ হিসাব বরাবর।
– সত্যিই আশফাক ভাই এসব করেছে অর্পি?
– মিথ্যা বলে লাভ কি? ওকে কতটা ভালোবেসেছি সেটা তো তুই জানতি।
– তাহলে উনি যে হসপিটালে এসে পড়ে থাকতো সেটা কেনো? তুই এইকাজ করেছিস শুনে সে তো মরে যায় অবস্থা।
– আমি জানি না।
– জানার প্রয়োজনও নেই। আজকের পর থেকে এই বাসায় কেও ঐ মানুষকে নিয়ে ভাববে না৷ ধরে নে ঐ নামের কেও অর্পির জীবনে কখনো আসেইনি৷ শোন অর্পি, জানি এসব ভুলতে কষ্ট হবে। তবু ভুলতে হবে৷ আশফাক ভাই মানুষ হিসেবে মন্দ না৷ আমি উনাকে চিনি৷ উনি একটা সময় খুবই ভালো মানুষ ছিলেন৷ কিছু ঘটনার কারনে উনি এখন খারাপ হয়ে গেছে৷ খারাপ বলতে, অন্য সব ঠিক আছে৷ কিন্তু ক্যারেক্টার একেবারে শেষ। কত মেয়ের সাথে রিলেশন আছে তা হিসেবছাড়া৷ এখন উনি ভালো মানুষ বা অতীতে উনার ক্যারেক্টার এমন ছিলো না, উনার পাস্ট খুব খারাপ ছিলো এজন্য এমন হয়ে গেছেন এসব ভেবে তো আমি আমার বোনকে এমন একটা লোকের হাতে তুলে দিতে পারিনা যার সকাল কাঁটে এক মেয়ের হাত ধরে রাত কাঁটে আরেক মেয়ের হাত ধরে। যদি বেকার হতো বা পারিবারিক কোনো পরিচয় না থাকতো তাহলেও কোনো সমস্যা ছিলো না৷ ওর সাথে চোখ বন্ধ করে বিয়ে দিতাম। কারন ফিন্যান্সিয়ালি সাপোর্ট দেয়ার এ্যাবিলিটি আমাদের আছে। ওর ফ্যামিলিতে কেও না থাকলেও সমস্যা ছিলো না৷ আমরা তো আছি৷ আমরা ওকে নিজের করে নিতাম। কিন্তু ক্যারেক্টার প্রবলেম আমরা কিভাবে সলভ করবো? ভালো হয়েছে বিয়েটা নকল ছিলো৷ ভেবে দেখ তো, যদি বিয়েটা সত্যিই হতো তাহলে তোর কি অবস্থা হতো? তোর চোখের সামনে তোর হাজবেন্ড মেয়ে মানুষ নিয়ে ঘুরতো আর চারদেয়ালের মাঝে দমবন্ধ হয়ে মরতি তুই৷ প্রতিটা মানুষই জীবনে ছোটখাটো ধাক্কা না খেলে হয় না। শক্ত হওয়ার জন্য এমন ছোটখাটো ধাক্কার প্রয়োজন আছে৷ এখন তো বুঝলি দুনিয়াতে সবাই তোর মত সহজ সরল না। সবাই তোর মত করে ভালোবাসতে জানে না। দুনিয়াতে মুখোশধারী বহু লোক বাস করে যাদের আমরা না চিনেই মন দিয়ে বসি। তুই উনার চেয়ে আরো বহুগুনে ভালো ছেলে ডিজার্ভ করিস। নিজেকে আয়নায় দেখেছিস কখনো? তোর জন্য ছেলেদের লাইন লেগে যায়। তোর কিসের কমতি আছে দেখা তো? ভাইয়া তোর জন্য আরো ভালো ছেলে এনে দিবো। বাদ দে এসব। স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা কর।
-………………
– তোর ফোনটা কোথায়?
অর্পিতার ফোনটা আবিদের দিকে এগিয়ে দিলো মুক্তা। আশফাকের সমস্ত ম্যাসেজ, ওর সাথে তোলা সব ছবি ডিলিট করে দিচ্ছে আবিদ। আশফাকের নাম্বারটাও ব্লক করে দিয়েছে।
– আশফাক ভাইয়ের দেয়া কোনো গিফট থাকলে সেগুলো বের কর।
– ওগুলো দিয়ে কি করবা?
– পুঁড়বো। আমি চাইনা উনার কোনো স্মৃতি এই ঘরে থাকুক। এগুলো বারবার চোখের সামনে ঘুরঘুর করতে থাকলে অর্পিতার উনাকে ভুলতে কষ্ট হবে।
(চলবে)