#ভোরের_আলো
৩৪.
গাড়ীতে বসে অর্পিতার বাড়ির বাহিরের গেইটের সামনে লাগাতার হর্ণ বাজাচ্ছে আশফাক। গেইটের বাইরে বেরিয়ে এলো দারোয়ান টুনু।
– কে আপনে?
– গেটটা একটু খুলবেন প্লিজ। আমি ভেতরে যাবো।
– সেইটা তো আমিও বুঝবার পারছি। পরিচয় না দিলে তো ভিত্রে যাইতে দিমু না।
– আমি আবিদের বন্ধু। ও বিদেশ থেকে এসেছে শুনে ওর সাথে দেখা করতে এসেছি।
– আপনারে তো আগে কোনোদিন এই বাড়িতে আসতে দেখি নাই।
– আমিও এতদিন বিদেশ ছিলাম। তাই আসা হয়নি। গেটটা কি একটু খুলবেন? আমার খুব তাড়া।
– খাঁড়ান, খুলতাছি।
টুনু গেইটটা খুলে দিতেই গাড়ী নিয়ে বাড়ির সামনে চলে এলো আশফাক। পাশের সিটে থাকা কাবিননামাটা হাতে নিয়ে চলে এলো ভেতরে। বাসার সদর দরজাটা খোলাই ছিলো। ঘরে ঢুকতেই লিপি আর মিনুর মুখোমুখি হলো আশফাক। ওরা দুজন আশফাকের দিকে চমকে তাকিয়ে আছে। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে তারা চিনে না। তবে মানুষটাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে একরাশ চিন্তায় সে মানসিকভাবে প্রচন্ড রকমে বিধ্বস্ত হয়ে আছে। লিপি কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবে এমন সময় আবিদ এসে দাঁড়ালো ড্রইংরুমে। এগিয়ে এসে আশফাকের হাত চেপে ধরে বললো,
– তুমি এখানে কি করো?
– তুমি তখন কথা শেষ না করেই কলটা কেঁটে দিয়েছিলে। বিয়ের কথাটা,,,,,,
আশফাককে কোনো কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ওর হাত ধরে টানতে টানতে বাসার বাহিরে বের করে নিয়ে এলো আবিদ। বের হওয়ার সময় লিপিকে বলে গেলো দরজাটা আটকে দিতে।
আবিদের চোখে মুখে রাগ বিরক্তি স্পষ্ট। দাঁত মুখ শক্ত করে আশফাককে বললো,
– তুমি বাসায় এসেছো কেনো?
– তোমাকে কাগজ দেখাতে। আমাদের বিয়েটা কোনো নকল বিয়ে ছিলো না।
– কথাটা তো আমি বলিনি। তুমি নিজে বলেছো।
– হ্যাঁ, বলেছিলাম। কারণ আমি জানতাম না বিয়েটা আসলেই হয়েছে।
– নিজে বিয়ে করেছো আর নিজে জানো না বিয়ে হয়েছে কি হয়নি?
– আমি প্রথমে চেয়েছিলাম নকল বিয়ে করতে। আমার ছোট ভাইকে বলেছিলাম কাগজ রেডি করতে৷ ও আসল কাগজ রেডি করে নিয়ে এসেছে।
– ওয়েট, তোমার ছোট ভাই আসলো কোত্থেকে?
– ওকে আমি রাস্তায় পেয়েছি। তখন ও ছোট ছিলো। আমার কাছেই ও বড় হয়েছে।
– হুম, তারপর?
– ও আমাকে জানায়নি ও সত্যিই বিয়ের কাগজ রেডি করেছে। আমি অর্পিতাকে এগুলো বলার পর শুনেছি বিয়েটা রিয়েল ছিলো। পেপার নিয়ে এসেছি আমি। চাইলে তুমি চেক করে দেখতে পারো।
– আমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই এসব কাগজ দেখার। বিয়ে যদি হয়ে থেকে থাকে তাহলে আমার বোনকে ডিভোর্স দিয়ে দাও। তাহলেই তো হয়।
– ডিভোর্স কেনো দিবো?
– কেনো দিবে না?
– আমি আমার বউকে তালাক্ব দিবো না।
– তুমি তো ওকে বিয়েই করতে চাওনি। বিয়ের নাটক করে জাস্ট ইউজ করতে চেয়েছো। ইউজ তো করা শেষ তাই না? এখন আর কি দরকার আমার বোনকে? কোনো দরকার নেই। তোমার যা প্রয়োজন ছিলো তা তুমি পেয়েছো। এখন প্লিজ আমার বোনকে ছাড়ো।
– আমার তোমার বোনকে দরকার আবিদ।
– কথা কি একবারে কানে যায় না? তোমার মত মানুষের হাতে আমি আমার বোনকে দিবো না।
– ও এখন শুধু তোমার বোন না। ও এখন আমার ওয়াইফও। তোমার চেয়ে বেশি অধিকার কিন্তু এখন আমার।
– রাখো তোমার অধিকার। আমার বোনকে ফেলে যখন অন্য মেয়ের সাথে শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়েছিলে তখন আমার বোনের কথা মনে আসেনি?
-…………….
– মিথ্যুক! আমার বোনটা তোমার কারনে জিন্দা লাশ হয়ে ঘরে ঘুরছে। আমার বোনটা সারাদিন হাসিখুশি থাকতো। ঘরময় ছুটে বেড়াতো। আসার পর থেকে ওর মুখে একটু হাসিও আমি দেখিনি। সারাটাদিন ঘরের এককোনায় বসে থাকে। তোমার মত ছোটলোককে আমার বোন ডিজার্ভ করে না। শি ডিজার্ভস মাচ বেটার দ্যান ইউ। আমি নিজে দেখেশুনে আমার বোনকে বিয়ে দিবো। দরকার পড়লে কানা-খোঁড়ার সাথে বিয়ে দিবো। এটলিস্ট ওরা তোমার মত ক্যারেক্টারলেস তো হবে না।
– মাথা ঠান্ডা করে কথা বলো আবিদ। ও এখনও আমার ওয়াইফ। তুমি অন্য কারো সাথে ওর বিয়ে দিবে এই কথাটা আমার সামনে বলার আগে তোমার একবার হলেও চিন্তা করে নেয়া উচিত ছিলো।
– মাথা ঠান্ডা রাখতে বলছো? আমাকে মাথা ঠান্ডা রাখতে বলছো তুমি? মাথা আমার যথেষ্ট ঠান্ডা আছে তাই হাত পা সহি সালামতে নিয়ে এখানে দাঁড়িয়ে আছো। সাহস কি করে হয় আমার বোনকে বউ বলে দাবি করার? অর্পিতার কাছে কি এখনো কিছু পাওয়ার বাকি রয়ে গেছে? যা চেয়েছিলে সেটা কি অর্পিতা পূরণ করতে দেয়নি?
– আবিদ আমি ওকে ভালোবাসি।
– সিরিয়াসলি!
-…………..
– সিরিয়াসলি আশফাক ভাই! তুমি ওকে ভালোবাসো!
-………………
– একসাথে কয়জনকে ভালোবাসো তুমি?
– আমি শুধু তোমার বোনকেই ভালোবাসি।
– তাহলে সেদিন সকালে যেটাকে বাসায় নিয়ে এসেছিলে সেটা? সেটাকে ভালোবাসো না?
– না।
– তাহলে ঐ মেয়ের গায়ে হাত দিলে কিভাবে? ভালোবাসা ছাড়া একটা মেয়ের গায়ে হাত দেয় কারা তুমি জানো? যারা বেশ্যাপাড়ায় আসা যাওয়া করে তারা ভালোবাসা ছাড়াই সেক্স করতে জানে।
– ঐটা রাত্রি ছিলো।
– কে ছিলো?
– রাত্রি।
বিস্ময়ের শেষ সীমানায় পৌঁছে গেলো আবিদ। মাথার দুপাশ চেপে ধরে পাশে থাকা দোলনাটাতে বসে পড়লো সে।
– রাত্রি! ওর সাথে এতকিছুর পরও তুমি সম্পর্ক রেখেছো?
– ওর সাথে ইমোশোনাল কোনো এটাচমেন্ট আমার নেই।
– তুমি ওর জন্য কেমন পাগল ছিলে সেটা আমি জানি৷ সেই তুমি যদি বলো ওর প্রতি তোমার কোনো ইমোশনাল এটাচমেন্ট নেই সেটা আমি কোনোদিনই বিলিভ করবো না।
– বিলিভ মি আবিদ। সত্যিই তেমন কিছু নেই।
– তাহলে ওর সাথে সম্পর্কটা কিসের?
– ওকে আমি শুধু ইউজ করি। টাকার জন্য ও আমাকে ছেড়ে দিয়েছিলো। এখন ও ওর হাজবেন্ড ফেলে আমার কাছে আসে শুধু টাকার জন্য। শান্তি পাই আমি৷ মনের যন্ত্রণা কিছুটা হলেও কমে।
– আমার বোনকে তুমি কখনোই ভালোবাসো না। ভালোবাসলে অন্য কারো শরীরে স্পর্শ করতে পারতে না।
– আবিদ ওকে আমি ভালোবাসি। ভালোবাসাটা বুঝতে বড্ড দেরী হয়ে গেছে। মাইন্ড ডাইভার্ট করার জন্য রাত্রিকে বাসায় এনেছিলাম। ঐটা অনেক বড় ভুল ছিলো আমার।
– কিহ্? মাইন্ড ডাইভার্ট? তুমি কি ধরনের কথা বলছো তা কি তুমি আন্দাজ করতে পারছো? মাইন্ড ডাইভার্ট করার জন্য কেও মেয়ে মানুষ বাসায় আনে?
– আবিদ, ভাই আমার কথা শুনো। ভুল হয়ে গেছে আমার। আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি। নিজেকে শুধরে নিয়েছি। প্লিজ আমার সাথে এমন করো না।
– অর্পিতা সুইসাইড এটেম্পট নিয়েছে পাঁচদিন হলো। এই পাঁচদিনে তুমি আমার বোনকে ভালোবেসে ফেলেছো! নিজের ভুল বুঝতে পেরেছো! আবার নিজেকে শুধরেও নিয়েছো! ফাইজলামি করো? হ্যাঁ? লাইনছাড়া কথাবার্তা সেই কখন থেকে বলেই যাচ্ছো, বলেই যাচ্ছো। মাথা ঘুরাচ্ছে আমার তোমার কথা শুনে।
– তুমি কাগজটা একবার হাতে নিয়ে দেখো। প্লিজ। বিয়েটা সত্যিই হয়েছে। ও আমার বউ আবিদ।
আশফাকের হাত থেকে কাবিননামার কাগজটা নিয়ে কয়েকটা ছবি তুলে নিলো আবিদ। ছবিগুলো তার ল’ইয়ার বন্ধুর কাছে পাঠালো কাগজের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য। কাগজটা আশফাকের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,
-বাসায় যাও।
– আমি যাবো না। তুমি আগে বলো তুমি কি করতে চাচ্ছো?
– দেখো, অর্পিতাকে নিয়ে প্রচুর টেনশনে আছি। অনেকটা পথ জার্নি করে এসেছি। আমি আর তোমার উল্টাপাল্টা কথা নিতে পারছি না। প্লিজ বাসায় যাও।
– কথা শেষ করো আগে।
– আমি তো চলে যাচ্ছি না। আছি। তুমি যা বলেছো সব শুনেছি। একটারাত আমাকে ভাবতে দাও। কালকে বাহিরে কোথাও বসে ঠান্ডা মাথায় কথা বলবো। ঠিকাছে?
– অর্পিতার সাথে দেখা করবো।
– ঘরে মানুষ আছে। অর্পিতাকে নিয়ে ঘরের পরিস্থিতি এমনিতেই গরম। তুমি ওর সাথে দেখা করতে গেলে হাজারটা প্রশ্ন করবে৷
– ব্লকটা রিমুভ করতে বলো।
– আমি আপাতত অর্পিতার সাথে তোমাকে নিয়ে কোনো কথা বলতে চাচ্ছি না। ওকে একটু সুস্থ হতে দাও।
– ও কেমন আছে?
– ঐ যে বললাম আমার বোনকে জিন্দালাশ বানিয়ে ফেলেছো।
– শুনো, ওকে বলো আমি ভালো হয়ে গেছি৷ সব ঠিক হয়ে যাবে। ওকে ভালোমতো খাওয়াবা৷ অনেক ব্লিডিং হয়েছে তো। না খেলে কিভাবে হবে বলো?
– হুম। যাও।
– খেয়াল রেখো কিন্তু৷ আর আমরা আগামীকাল মিট করছি৷
– হ্যাঁ বিকেলে মিট করবো।
আবিদ ঘরে পা রাখতেই মা জিজ্ঞেস করলো,
– ছেলেটা কে ছিলো?
– আমার পরিচিত৷ বন্ধু হয়।
– কোনো সমস্যা? বেশ বিধ্বস্ত দেখাচ্ছিলো।
– হ্যাঁ, ঐ ব্যাক্তিগত সমস্যা আরকি।
কথাটা বলে সোফায় গা এলিয়ে দিতেই মেসেজ এলো বন্ধুর।
– হুম, কাগজ তো ঠিকই আছে। পুরোটাই ঠিক৷ কোনো সমস্যা নেই। কার কাবিননামা এটা?
সাথে সাথে সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালো আবিদ। দ্রুত পায়ে সায়েমের রুমে গেলো। দরজা আটকে দিয়ে সায়েমকে বললো,
– বিয়েটা সত্যি সায়েম।
– তাহলে এখন কি করবা?
– আশফাক ভাই এসেছিলো। অর্পিতাকে সে ছাড়বে না।
– এমন মানুষের কাছে বোনকে দিবো না আবিদ ভাইয়া।
– কে দিবে ওর কাছে? আমি কি দিবো নাকি?
– বাসা পর্যন্ত চলে এসেছে। চাচ্চু আর বড়মার কাছে তো বেশিদিন লুকানো যাবে না।
– আমরা সবাই কালকে ঢাকার বাইরে চলে যাচ্ছি। এখানে থাকলে ঘন্টায় ঘন্টায় উনি কল করবে। বাসায় প্রতিদিন চলে আসবে৷ এত প্রেশার নিয়ে বেশিদিন লুকাতে পারবো না। কালকে সকালের ফ্লাইটে আব্বু ইন্ডিয়া যাচ্ছে। আর আমরা যাবো সিলেট। সেখান থেকে কক্সবাজার, বান্দরবন। ২০ দিনের ট্যুরে যাবো৷ দূরে বসে শান্তিমতো প্ল্যান করা যাবে। উনাকে এত সহজে দূরে সরানো যাবে না। অনেক কাঠখড় পোঁড়াতে হবে সরাতে হলে।
– হুম।
– আর শোন, অর্পিতাকে জানানোর দরকার নেই বিয়েটা সত্যিই হয়েছে।
– ঠিকাছে। অর্পিতার এমন অসুস্থ শরীর নিয়ে এত জার্নি করাটা কি ঠিক হবে? তাছাড়া বড়মা তো রাজিও হবে না।
– সেটা আমি বুঝবো। আপাতত আমার বোনকে ঐ লোকের কাছ থেকে দূরে সরানো জরুরী।
(চলবে)
স্বপ্নে তোমাকে একদম নীলপরী দেখাচ্ছিলো। স্বর্গ থেকে মর্ত্যের বুকে নেমে আসা নীল পরী। খুব ইচ্ছে হচ্ছিল পরীটার হাতটা ছুঁয়ে দেখি। সুযোগই পেলাম না! তুমি ছুটছো তো ছুটছোই৷ আর আমি বোকা ঠায় দাঁড়িয়ে তোমাকে দেখেই যাচ্ছি। একবারও মুখ ফুটে বলতে পারিনি, দাঁড়াও অনু, আমায় একটু ছুঁতে দাও। তারপর ছুটতে ছুটতে তুমি ঘন কাশবনের মাঝে মিলিয়ে গেলে। আমার স্বপ্নটাও ভেঙে গেল। এ্যাই অনু, আসো না একদিন আমার বাস্তবে নীল পরী সেজে৷ তোমাকে দেখব, তোমার হাতটা ছুঁয়ে দেব। আসবে তুমি?
#মেঘের_আড়ালে_তুমি
বইটি অর্ডার করতে এবং বিস্তারিত জানতে ইনবক্স করুন ছাপাখানা প্রকাশনী পেইজে।