ভোরের_আলো পর্ব-৫২

0
956

#ভোরের_আলো
৫২.

বিয়ে বাড়ির কিছুসংখ্যক মেহমান গতকাল বৌভাত শেষে রাতেই চলে গিয়েছে। আর বাকি মেহমানগুলো আজ সকালে চলে গিয়েছে। বাসার পরিবেশ আবার আগের অবস্থায় ফিরে এসেছে। বিকেলের দিকে ডক্টরের কাছে যাওয়ার কথা ছিলো। অর্পিতা খাটের এককোনায় গোঁ ধরে বসে আছে ডক্টরের কাছে সে যাবে না৷ কয়েকদফা বলেও কেও রাজি করাতে পারেনি ওকে৷ আশফাক চুপ করে অর্পিতার খাটের এক কোনায় বসে সবার ওকে হসপিটালে পাঠানোর পীড়াপীড়ি দেখছে। সেইসাথে অর্পিতার মুখটাও বেশ ভালো করে লক্ষ্য করছে। প্রচন্ড বিরক্তি ভর করেছে মেয়েটার চোখেমুখে। ক্রমশ কপালের ভাজগুলো বেড়েই চলছে। একটা পর্যায়ে সবাইকে থামিয়ে দিলো আশফাক। বললো,

– আচ্ছা আজকের মত বাদ দেই৷ ওর বোধ হয় ভালো লাগছে না। দুই একদিন পর নাহয় যাওয়া যাবে। অসুবিধা নেই।

আশফাকের কথায় থেমে গেলো সবাই। রুম ছেড়ে এক এক করে সবাই বেড়িয়ে এলো। রুম থেকে সবশেষে বেড়িয়েছে অর্পিতার চাচী৷ যাওয়ার আগে দরজাটা হালকা করে লাগিয়ে দিয়ে গেছে৷ অর্পিতা তাকিয়ে আছে দরজাটার দিকে। আশফাক লক্ষ্য করছে এই দরজা আটকানোটা অর্পিতার বিশেষ পছন্দ হচ্ছে না৷ উঠে গিয়ে দরজাটা খুলে আবার বিছানায় এসে বসলো সে। আশফাকের দিকে তাকিয়ে আছে অর্পিতা৷ মুচকি হেসে আশফাক বললো,

– তুমি পছন্দ করছিলে না তাই দরজাটা খুলে দিলাম।
– তোমাকেও তো আমার পছন্দ হয় না৷
– আমাকে চলে যেতে বলছো?
– হ্যাঁ বলছি।
-তোমার সামনে না আসলে খুশি হবে তুমি?
– অনেক বেশি হবো। তোমার কথাবার্তা শুনলে গা জ্বলে আমার আশফাক। যতটা সম্ভব দূরে থাকো আমার কাছ থেকে প্লিজ।

চুপচাপ বিছানা ছেড়ে উঠে গেলো আশফাক। ঘর থেকে বের হতেই দেখতে পেলো ডাইনিংরুমে বসে লিপি আর মিনু চা খাচ্ছে। লিপি কে উদ্দেশ্য করে বললো,
– মা আমি আজকে আসি।
– ওমা কেনো?
– একটু কাজ ছিলো?
– অর্পি কিছু বলেছে?
– না চাচী। ও কিছু বলেনি।
– তাহলে?
– কাজ ছিলো একটু।
– কৌশিকের আম্মু ফোন করেছিলো। উনারা আসছে এ বাসায়। রাতে তো ডিনারের আয়োজন করছি। তুমি চলে যাবে কেনো?
– যেতে হবে মা। আমি অারেকদিন সময় নিয়ে আসবো।

মায়ের গলার আওয়াজ পেয়ে নিজের রুম থেকে বেরিয়ে এলো আবিদ। আশফাকের হাত ধরে বললো,
– কি হয়েছে? চলে যাবে কেনো?
– কাজ আছে৷
– তোমার নাটক আমি বুঝি। তুমি এখানে এসেছিলে হসপিটাল যাবে বলে। তোমার কাজ সব সেড়েই এসেছো। এখন অযথা মিথ্যা কথা বলে এখান থেকে যেতে চাচ্ছো।
– সিরিয়াসলি আমা…..
– চুপ থাকো। আমি জানি তুমি অর্পিতার কথা শুনে চলে যাচ্ছো।
– দেখো ও কিছুদিন একটু একা থাকুক। ওর মাথাটা একটু ঠান্ডা হোক। আমি পরে আসবো।
– এসেছো যেহেতু না খেয়ে যেতে পারবে না৷ রাতে খাওয়া দাওয়া করে এরপর যাবে। চলো ছাদে যাই৷ ব্যাডমিন্টন খেলে আসি।
– হুমম,,,, তা করা যায়।
– উপরে চলো। এই সায়েম,,,, র‍্যাকেট চারটা নিয়ে উপরে আয় তো।

অর্পিতাদের ড্রইংরুমে বসে আছেন কৌশিকের বাবা মা আর ভাইয়ের বউ। কৌশিক গেছে ছাদে আবিদদের সাথে খেলতে। কৌশিকের মায়ের পাশেই মাথানিচু করে বসে আছে অর্পিতা৷ আজ দুপুরের পর কৌশিককে ফোনে অর্পিতার এ্যাবোরশনের কথা জানিয়েছিলো আশফাক। কৌশিকের কাছ থেকেই কথাগুলো জেনেছেন রাজিয়া। পৃথিবীতে আবারো আরেকটা কুলাঙ্গার জন্ম দিতে চাই না কথাটা খুবই অপছন্দ হয়েছে রাজিয়ার৷ আশফাকের সন্তান বলেই কি কুলাঙ্গার হয়ে গেলো? আশফাক অন্যায় করেছে ঠিকাছে কিন্তু কেনো মানুষটা এমন হয়ে গেছে সে কথা না জেনেই এমনটা বলা তো উচিত হয়নি। সে তো আর জন্মগতভাবে এমন কুলাঙ্গার ছিলো না বা কারো অতি আদরে এমন কুলাঙ্গার হয়নি। যা হয়েছে যতটুকু হয়েছে মানুষের কাছ থেকে অবহেলা পেয়ে ধাক্কা খেয়ে এমন হয়েছে। এতদিন আশফাককে বকেছে বেশ করেছে। ও যা করেছে ওকে আরো শাস্তি দেয়া উচিত। কিন্তু সেই জের ধরে বাচ্চাকে শেষ করার তো মানে হয়না। আপাতত রাজিয়ার মনে হচ্ছে আশফাকের অতীতটা ওর সামনে আনা উচিত। এতে যদি ঘৃনাটা কিছু হলেও কমে। ঘৃনা মনে জমে থাকলে কখনো এই সংসারে মন তো বসবেই না, আবার বাচ্চাটাকে কখন কি করে ফেলে বলাও যায় না৷ এখানে আসার আগেই মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে এসেছেন অর্পিতাকে আশফাকের কথাগুলো বলবেন। প্রায় আধাঘন্টা ড্রইংরুমে বসে গল্প করার পর অর্পিতাকে বললেন,

– চলো অর্পিতা তোমার রুমে যাই। তোমার সাথে আলাদা একটু গল্প গুজব করি।

অর্পিতার মনে প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে এত মানুষ ছেড়ে আলাদা ওর সাথে বসে কি গল্প করতে চান উনি? পরক্ষণেই প্রশ্নগুলো খানিক সরিয়ে রেখে কৌশিকের মায়ের সাথে নিজের রুমে এলো অর্পিতা৷

একটা বালিশ পিঠের পিছনে দিয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসলেন রাজিয়া। অর্পিতার দিকে তাকিয়ে বললেন,

– তোমাকে একজনের গল্প শোনাবো।
– কার গল্প আন্টি?
– গল্পটা শুরু করি। বুঝে যাবে কার গল্প বলছি।
– হুম।
– আমাদের এলাকাতে একজন লোক ছিলো৷ বেশ প্রভাবশালী বলতে পারো। টাকা পয়সার অভাব ছিলো না৷ আমাদের এলাকাতেই বাড়ি ছিলো তিনটা৷ ঢাকার আশপাশে আর উনার গ্রামের বাড়িতে অনেক জায়গা সম্পত্তি ছিলো৷ কাজ টাজ করতেন না৷ বাড়িভাড়া তুলে, জমি পুকুর ভাড়ার টাকা দিয়ে চলতেন আরকি। মাসশেষে অনেক টাকা উঠতো। বউ বাচ্চা নিয়ে খেয়েপড়ে মাস শেষে বেশ অনেকগুলো টাকাই পড়ে থাকতো। সেজন্য আর কাজ কর্ম করতো না আরকি। উনার আবার ঘুরাঘুরির নেশা ছিলো। প্রায়সময় একাই ঘুরতে যেতেন বিভিন্ন জায়গায়। সংসারী পুরুষ ছিলেন না তেমন একটা। বাহিরে নেশা ছিলো বেশি৷ তো একবার কক্সবাজার গিয়েছিলেন বেড়াতে। সেখানে একদল ছেলেমেয়েরাও গেলো ঘুরতে। ওরা সবাই কাজিন ছিলো। সেই কাজিনদের মধ্যে একটা মেয়েকে ভদ্রলোকের নজরে আটকালো। অসম্ভব সুন্দরী ছিলো৷ বয়স তখন কত হবে ওর? ১৭-১৮ হবে হয়তো। এরবেশি না। মেয়ের সব কাজিনদের চোখ আড়াল করে সেই মেয়ের সাথে ইশারায় ভাব জমিয়ে নিলো৷ ভাইও দেখতে বেশ সুন্দর ছিলো৷ মেয়েটাও কম বয়স্ক। বুঝোই তো ঐ বয়সে সবকিছুতেই একটা মানুষের ভালো লাগা কাজ করে। মেয়েটারও ভালো লেগে গেলো উনাকে। কোনো এক ফাঁকে ঠিকানা আদান প্রদান হয়ে গেলো। সেই সাথে বাসার ল্যান্ডফোনের নাম্বারও। মেয়েটার বাসা ছিলো ডেমরার ওদিকটাতে৷ এরপর থেকে প্রায়ই চিঠি আদান-প্রদান চলতো। লুকিয়ে ফোনে কথা চলতো৷
– প্রেম শুরু হয়ে গেলো?
– হ্যাঁ। তাও যেনোতেনো প্রেম না। একদম মুভি স্টাইলের প্রেম। লুকিয়ে বাহিরে দেখা সাক্ষাৎ করতো। রাগারাগি হলে ঐ লোক আবার মেয়ের বাসার সামনে সারারাত বসে থাকতো৷ আরো কত কি শুনেছি!
– লোকটা না বিবাহিত?
– হুম। দুটো ছেলেও ছিলো।
– মেয়ে জানতো এসব?
– না। মেয়ে এসব কিছুই জানতো না।
– কুকুর একটা। তারপর?
– মেয়ের বাসার কেউই জানতো না। দুজন বান্ধবী আর ছোট ভাই ছাড়া মেয়ে আর কাউকেই এই কথা বলেনি। এরমাঝে নাকি ঐ লোকের সাথে কয়েকদফা মেয়েটার শারীরিক সম্পর্ক হয়েছিলো৷ অবিবাহিত অবস্থায়ই মেয়েটা প্রেগন্যান্ট হয়ে যায়। এরপর কাউকে কিছু না জানিয়ে বাসা থেকে মেয়েটা পালিয়ে যায় উনার হাত ধরে। কুমিল্লা চলে গিয়েছিলো উনারা৷ সেখানে বাসা নিলো৷ নতুন বউ নিয়ে ঐ বাসায় উনি থাকা শুরু করলো৷
– আগের বউ?
– ছিলো।
– জানতো এসব?
– উহুম।
– তাহলে কুমিল্লা গিয়ে যে থাকতো কিছু বলতো না?
– বাসায় বলেছিলো কি ব্যবসা নাকি শুরু করেছে তাই কুমিল্লা থাকছে।
– বউ বিশ্বাস করে নিলো?
– না করার তো কোনো কারন ছিলো না। মেয়ে মানুষের নেশা বা মেয়েদের দিকে অন্য নজরে তাকানো এসব কখনোই আগের বউয়ের নজরে পড়েনি। অবিশ্বাস করবেটা কিভাবে?
– হুম তারপর?
– প্রতিসপ্তাহে দুদিনের জন্য ঢাকা আসতেন। বাকি সময়টুকু কুমিল্লাতেই থাকতেন। পরে দ্বিতীয় বউয়ের ঘরেও একটা ছেলে হলো। মেয়ে ততদিনেও বাবার বাড়ি যায়নি৷ যে বান্ধবী আর ভাই ওর কথা জানতো তাদের সাথে শুধু যোগাযোগ ছিলো। আস্তে আস্তে ঐ লোক আবার আগের ঘরের প্রতি ঝুঁকতে লাগলেন। মন স্থির হতে লাগলো উনার। উড়ুক্কু ভাবটা একেবারেই উধাও হয়ে গেলো। পরের বউয়ের প্রতি প্রেম কমতে থাকলো৷ তখন উনি ঢাকা থাকতেন সপ্তাহে পাঁচদিন৷ কুমিল্লা থাকতেন এক দুইদিন। বলতে পারো পরের বিয়েটা করেছিলেন উনি নেহাৎ শখের বশে৷ শখ মিটে গেছে তাই প্রেমও শেষ হয়ে গেছে৷ ছোট ছেলেটার প্রতিও বিশেষ টান ছিলো না উনার। বছরচারেক যাওয়ার পর হঠাৎ একবার উনার বড় ছেলেটা কিভাবে যেনো তিনতলার ছাদ থেকে পড়ে গেলো৷ মাথায় ব্যাথা পেয়েছিলো খুব৷ ডক্টররা তো বলেছিলো বাঁচবে না। বাঁচলেও নাকি স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারবে না৷ আল্লাহর রহমত ছিলো বাচ্চার উপর৷ বেঁচেও ছিলো, তিনমাস পর একদম পুরোপুরি সুস্থ হয়ে গেলো৷ ছেলেটার এক্সিডেন্ট হওয়ার পর থেকে ঐ ছেলের মাঝেই লোকটার দুনিয়া আটকে গেলো। এমন একটা অবস্থা, ওর থেকে দুনিয়া শুরু ওর মাঝেই দুনিয়া শেষ। বড় ছেলে ছাড়া চোখে আর কাউকে দেখতো না৷ ছোট বউয়ের কাছে যাওয়া একদম বন্ধ করে দিলো৷ টাকা পয়সাও বন্ধ। এদিকে মেয়ের ঘরে খাওয়ার কিছু নেই। বাসা ভাড়া জমে গেছে অনেক টাকা। কোনোভাবেই হাজবেন্ডের সাথে মেয়ে যোগাযোগ করতে পারছে না। লোকটা ঢাকার বাসার যে ঠিকানা দিয়েছিলো বাসার সেই ঠিকানা ছিলো ভুয়া। পরে কোনো কূল কিনারা না পেয়ে মেয়ের ছোটভাই বাচ্চাসহ বোনকে মেয়ের বাবার বাসায় নিয়ে এলো।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here