#এক_কাপ_ঠান্ডা_কফি! [পর্বঃ-০২]
#সাজু_ভাই_সিরিজ।
– সাব্বির তার বাবাকে কল দিয়ে বললো, মেয়েটা তো বেঁচে আছে বাবা। জীবন্ত মেয়েকে এভাবে নদীতে ফেলে দেওয়া কি ঠিক হবে?
সাব্বিরের কথা শুনে চমকে ওঠে তার বাবা। তিনি বললেন,
– তুই অপেক্ষা কর আমি একটু স্যারের সঙ্গে কথা বলে দেখি কি করতে বলে।
– তাড়াতাড়ি করো বাবা, আমার হাতপা কাঁপছে, আজকে মনে হচ্ছে কোনো বিপদে পড়বো।
– সাহস নিয়ে অপেক্ষা কর।
কল কেটে দিয়ে সাব্বির সেই মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। বস্তা থেকে সম্পর্ক দেহটা সে বের করেছে, কোথাও ছুরি বা গুলির আঘাত নেই। তবে মাথা আর হাত দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে অনেক।
– পানি, পানি।
মেয়েটা পানি খেতে চাচ্ছে। নিস্তব্ধ এই ফাঁকা ফ্ল্যাটের মধ্যে অনেকটা ভয় পেয়ে গেল সাব্বির। সে জানে মেয়েটি মরেনি, আর সেজন্য তার ভয় হচ্ছে বেশি। মানুষ মৃত ব্যক্তির চেয়ে জীবিত ব্যক্তি বেশি ভয় করে কেন?
সাব্বির সত্যি সত্যি পানি এনে মেয়েটার মুখের মধ্যে ঢেলে দিল। বউয়ের সাজে সজ্জিত মেয়েটা বেশ সুন্দর লাগছে সাব্বিরের কাছে।
সাব্বিরের মোবাইল বেজে ওঠে। সাব্বির রিসিভ করে অন্য রুমে চলে গেল, তার বাবা কল দিয়েছে।
– হ্যাঁ বাবা বলো।
– সাব্বির শোন, আমি স্যারের সঙ্গে কথা বলেছি। স্যার বলেছেন যে মেয়েটাকে পুরোপুরি মেরে ফেলতে হবে।
– কি বলছো বাবা? লাশ গুম করার কাজ করি তাই বলে খুন করতে হবে?
– আরে তার বিনিময়ে অনেক টাকা পাবো। তুই আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শোন। মেয়েটাকে মেরে ফেল, তারপর তাড়াতাড়ি কাজটা কর তাহলে হয়তো এটাই আমাদের শেষ কাজ। কারণ খুন করার বিনিময়ে অনেক টাকা পাবো তাহলে আমাদের আর কাজ করতে হবে না।
– ঠিক আছে বাবা, তাহলে আমি তাই করবো।
বাবার সঙ্গে কথা শেষ করে আবারও মেয়েটার কাছে এলো সাব্বির। আর সাব্বিরের চোখ তখন কপালে উঠে গেছে, কারণ মেয়েটা এখন সুস্থ স্বাভাবিক ভাবে বসে আছে।
সাব্বিরকে দেখেই মেয়েটা বললো,
– আমি কোথায় ভাইয়া? এটা কোন যায়গা?
– এটা উত্তর বাড্ডা, ঢাকা।
– আমাকে এখানে কে নিয়ে এসেছে? আর সেই লোকগুলো কোথায় যারা আমাকে বিয়ে বাড়ি থেকে তুলে এনেছে।
সাব্বির ভাবনার মধ্যে পড়ে গেল। সে ভেবেছিল ক্লান্ত মেয়েটাকে সে খুব সহজেই মেরে ফেলবে। কিন্তু এখন তো মেয়েটা সুস্থ মানুষের মতো বসে আছে তাহলে কীভাবে মারবে? যদিও মেয়েটার মাথা আর হাত দিয়ে এখনো রক্ত বের হচ্ছে।
– কি হলো, বলেন না কেন? আপনি কে?
– “আমি সানি।”
ইচ্ছে করে নিজের আসল নামটা গোপন করলো সাব্বির। এমন একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে এটা তার কল্পনার মধ্যে ছিল না। একবার ভাবলো যে বাবার কাছে কল দিয়ে তাকে এখানে আসতে বলবে।
– আমাকে এখানে কে নিয়ে এসেছে?
– জানি না।
– জানি না মানে? আপনিও কি ওদের সাথে মিলে আমাকে খুন করতে চান?
খুনের কথা শুনে ঘাবড়ে গেল সাব্বির। সামান্য কাশি দিয়ে বললো,
– আমি কেন আপনাকে খুন করবো? আপনাকে তো আমি চিনিই না, এখানে আমার একটা বন্ধু থাকতো। আমি কিছুক্ষণ আগে তার কাছে এসে দেখি সে বাসায় নেই। আর আপনি এভাবে বস্তার মধ্যে পড়ে আছেন।
– আপনার বন্ধু বাসায় নেই তাহলে আপনি ফ্ল্যাটে প্রবেশ করলেন কীভাবে? কথাটা শেষ করেই মেয়ে টা মাথা ঘুরে পড়ে গেল আবারও।
– সাব্বির বললো, আপনি চাইলে আমি আপনার জন্য ডাক্তার নিয়ে আসতে পারি। আর সবচেয়ে ভালো হয় যদি আমার সঙ্গে হাসপাতালে যেতে পারেন।
মেয়েটা কোনো জবাব দিল না। মনে হচ্ছে অজ্ঞান হয়ে গেছে, সাব্বির পাঁচ মিনিটের মতো সেখানে দাঁড়িয়ে রইল। কোনো ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে এখন হিমসিম খাচ্ছে সে, মেয়েটার দিকে তাকিয়ে তাকে আর খুন করতে ইচ্ছে করছে না। এতো সুন্দর পৃথিবী, আর এই পৃথিবী থেকে এমন একটা সুন্দরী মেয়েকে সে বিদায় করবে এটা ভাবতে পারে না।
কিন্তু সাব্বির জানতেই পারলো না যে এই ফ্ল্যাটে এখন সে আর ওই মেয়েটা ছাড়া অন্য আরেকজন উপস্থিত আছে। যে মানুষটা তাদের কার্যক্রম সব মনোযোগ দিয়ে দেখছে। আর লোকটা লুকিয়ে আছে রান্না ঘরের পাশেই বাথরুমের উপরে যে ছোট্ট ফলছাদ থাকে সেখানে।
সাব্বির ও মেয়েটার কথা শুনে লোকটা তার স্থানে খানিকটা ঢুকে গেল। তারপর মোবাইল বের করে একটা মেসেজ টাইপ করে সেন্ট করে দিল।
মিনিট খানিক পরেই সাব্বিরের মোবাইলে তার বাবার নাম্বার দিয়ে কল এসেছে। সাব্বির মোবাইল নিয়ে আবারও বেলকনিতে চলে গেল।
– কিরে তুই নাকি মেয়েটাকে এখনো খুন করিস নাই?
– খুন করেছি বাবা।
– মিথ্যা কথা বলিস না সাব্বির। মেয়েটা তোর সঙ্গে কথাও বলেছে আর তুইও কথা বলেছিস।
– তুমি জানলে কীভাবে?
– চুপ কর! সাব্বির শোন, তুই এখনই ওই বাসা থেকে বের হয়ে যাবি। মেয়েটাকে খুন করার কাজ অন্য কেউ করবে, তাই নিজেকে বাঁচাতে তুই তাড়াতাড়ি ওখান থেকে চলে আয়৷
– বাবা মেয়েটা খুব ভালো মনে হয়, আমার দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। তোমার দিকে যদি তাকাতো তাহলে তুমিও মায়ায় পড়তে, এমন এক মেয়েকে মারা যায় না।
– নিজের বিপদ ডেকে আনিস না সাব্বির, ওরা যদি জানতে পারে তাহলে তোকেও মেরে ফেলবে।
– আমরা দুজন মিলে তো অনেক খারাপ কাজ করলাম বাবা। আজকে নাহয় মেয়েটাকে বাঁচিয়ে একটা ভালো কাজ করবো, তুমি চলে আসো বাবা। তারপর দুজন মিলে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করাবো, সে বেঁচে গেলে তার পরিবারের সবাই খুব আনন্দ পাবে।
– এক চড় মেরে তোর ভালো হবার স্বপ্ন বের করে দেবো হারমজাদা, তুই জানিস ওই বাসার মধ্যে আরেকটা লোক আছে। আর সে তোর সবকিছু নজর রাখছে।
সাব্বির অবাক হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে কলটাও কেটে গেছে, হয়তো তার বাবার মোবাইলে ব্যালেন্স ফুরিয়ে গেছে। সাব্বির কলব্যাক করার প্রয়োজন দেখলো না, সে তাড়াতাড়ি মেয়েটা যেখানে ছিল সেখানে গেল।
আর সেখানে গিয়েই সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা পেল।
——
একদিন আগে বিয়ে বাড়িতে কাজি সাহেবের মৃত্যুর পরে যখন পুলিশ এসেছিল তখনকার কিছু ঘটনা।
মংলা থানার ভারপ্রাপ্ত দারোগা সাহেব এসে সবার কাছে প্রথমে পুরো ঘটনা শুনলেন। তারপর তিনি সবার আগে মাহিশার বাবার সঙ্গে কথা বলার জন্য তাকে সামনে ডাকলেন।
আকস্মিকভাবে এই অপ্রত্যাশিত ঘটানোর জন্য তিনি খুবই মানসিক কষ্ট পেয়েছেন। এতকিছুর আয়োজন করে নিজের দ্বিতীয় মেয়ের বিয়ে ঠিক করেছেন। আর বিয়ে না হতে এমন গজব এসে পড়েছে তাই খুবই মর্মাহত।
– দারোগা বললো, আপনার মেয়ের কারো সঙ্গে কোনো সম্পর্ক ছিল? মানে বিয়ের আগে সচারাচর প্রেম ভালোবাসা যা হয় আরকি।
– আমি জানতাম না। আমাকে কখনো বলেনি, আমি বিয়ে ঠিক করে তাকে যখন বললাম তখন সে কোনো কথা বলে নাই। তার ব্যবহারে বোঝা গেছে সে বিয়েতে রাজি আছে।
– কাজি সাহেব আসার পরে তাকে নাস্তা শরবত খেতে দিয়েছে কে? যেহেতু বিয়ের পরে খাবারের কথা ছিল তাই নিশ্চয়ই কাজি সাহেব একা একা আগে খান নাই।
– সবাইকেই একসঙ্গে নাস্তা করতে দেওয়া হয়েছে তাই কে কাকে দিয়েছে তা তো জানি না।
– আপনার কাউকে সন্দেহ হচ্ছে? কেউ কি এমন ছিল যে আপনার মেয়ের বিয়ে না হোক এমন প্রত্যাশা করে।
– তেমন কেউ তো নাই।
– মেহমানদের জন্য যাবতীয় নাস্তা পরিবেশন করেছে কে কে এবং সেগুলো তৈরি করেছে কারা সবাইকে আমার সামনে উপস্থিত করুন।
মাহিশার বাবা চলে গেলেন ভিতরে, দারোগা তখন পাত্রের বাবাকে ডাকলেন। লোকটা এতক্ষণে মনে হয় চলে যেত কিন্তু সে যেতে পারছে না। ছেলের বিয়ে তাই সেখানে এরকম দুর্ঘটনা কোনদিনই কাম্য ছিল না তার।
– দারোগা বললো, মেয়েটা পালিয়ে গেছে কিংবা কিডন্যাপ হয়েছে। এখন যদি মেয়েটা ফিরে আসে বা তাকে উদ্ধার করা হয় তাহলে আপনি আপনার ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেবেন।
– চুপচাপ।
– আপনার পরিবারের সবাই রাজি ছিল তো? মানে কেউ কি ছিল যে বিয়েতে অমত।
– দুলাভাই।
পিছন থেকে বলে উঠে পাত্র হামিদুর রহমান, সে একটু বেশিই কষ্ট পাচ্ছে। ঝামেলা সৃষ্টি না হলে এতক্ষণে বিয়ে শেষ করে তারা খুলনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিতে পারতো। আর সেখানে গিয়ে স্বামী স্ত্রী প্রবেশ করতো ফুলে ফুলে সজ্জিত ঘরে।
– কার দুলাভাই? আপনার? দারোগা বললো
– জ্বি আমার দুলাভাই এই বিয়েতে রাজি ছিল না। এমনকি তিনি এখানেও আসেননি, কারণ তার অপছন্দের মেয়েকে আমি বিয়ে করতে এসেছি।
– চুপ করো তুমি! পারিবারিক বিষয় নিয়ে এসব কেন বলছো? ধমকের গলায় বললো পাত্রের বাবা।
– ছেলেটা বললো, যেহেতু আমার শশুর বাড়ির বিষয় সেহেতু এটাও পারিবারিক বাবা।
– এহহহ, মেয়ে খুন করে নাগরের সঙ্গে পালিয়ে গেছে আর বোকা ছেলে এখনো শশুর বাড়ি বলে দাবি করে।
দারোগা বললো,
– আপনারা কথা বন্ধ করুন, যতটুকু জিজ্ঞেস করি ঠিক ততটুকু জবাব দিবেন।
তারপর পাত্রের দিকে তাকিয়ে বললো, আপনার দুলাভাই কোথায় থাকে?
– খুলনাতে।
– আপনাদের বাসাও তো খুলনা শহরে তাই না?
– জ্বি।
কাজি সাহেবের লাশ ময়নাতদন্তের জন্য পাঠিয়ে দেবার আগে আশেপাশের বেশ কিছু ছবি তুলে নিলেন দারোগা সাহেব। যারা যারা নাস্তা দেবার দায়িত্বে ছিল তাদের সবার কাছে জিজ্ঞেস করেও তেমন কিছু বের করা গেল না। বিয়ে বাড়ির সকল মানুষের নাম লিস্ট সংগ্রহ করার হুকুম দিয়ে তিনি থানায় চলে গেলেন।
——-
সাব্বির অবাক হয়ে দেখলো সেই অজ্ঞান মেয়েটা কে কেউ একজন গলা কেটে দিয়েছে। তার গলা দিয়ে দরদর করে রক্ত বের হচ্ছে, হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল সাব্বির।
সাব্বিরের মোবাইলে কল এলো, তার বাবা কল দিয়েছে আবারও। সাব্বির রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে বললো,
– মেয়েটা মারা গেছে তো তাই না?
– হ্যাঁ বাবা, কিন্তু?
– কোনো কিন্তু নেই। তুই এখন তাড়াতাড়ি লাশটা ওখান থেকে সরানোর ব্যবস্থা করো। আর রক্তের দাগ এসবের কথা চিন্তা করতে হবে না, তুই লাশ নিয়ে বের হলেই অন্য কেউ গিয়ে সব পরিষ্কার করবে।
সাব্বির আর কথা বাড়াতে পারলো না, এতক্ষণে সে ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে। কারণ সে বুঝতে পেরেছে সত্যি সত্যি এখানে কেউ আছে। আর সে যদি তার নিজের কাজ না করে তাহলে নিজেই হয়তো মারা যাবে। মৃত্যুর কথা স্মরণ করে সাব্বির দ্রুত লাশটা কীভাবে নিয়ে বের হবে সেটা ভাবতে লাগলো।
—–
উক্ত ঘটনার দুই দিন পর৷
শহীদ হাদিস পার্ক, খুলনা।
এখনো সূর্য ওঠেনি, সারারাত ঘুমাতে পারেনি বলে ফজরের আজানের সঙ্গে সঙ্গে বাসা থেকে বের হয়ে মসজিদে গেছিল সাজু ভাই। নামাজ পড়েই সোজা চলে এসেছে এই পার্কে, হাঁটাহাঁটি করার অভ্যাস থাকলেও আজকে এসেছে এমনিতেই।
প্রিয় বন্ধু সজীবের মৃত্যুর পর থেকে সবচেয়ে বড় আঘাত পেয়েছে সাজু। সজীবের মৃত্যু মাস খানিক পেরিয়ে গেলেও এখনো স্বাভাবিক হতে পারে নাই সে। সপ্তাহ খানিক আগে রকি চলে গেছে জাপানে, সেখানেই জব করবে। সজীবের মৃত্যুর আগ থেকে সবকিছু ঠিক ছিল, তাই বন্ধুর মৃত্যুর পরপরই চলে গেছে সূর্য উদয়ের দেশ জাপান।
বাবা ও ছোটমা, বোন চলে গেছে লন্ডনে। সাজুকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল কিন্তু সে যায়নি। মা-বাবার ইচ্ছে ছিল সাজুকে একটা ভালো মেয়ে দেখে বিয়ে দিবেন। কিন্তু হলো না। বেশ কিছুদিন গ্রামের বাড়ি থেকে চারদিন আগে এসেছে খুলনায়। পুরনো সেই খালিশপুরে স্মৃতি, আর চার বন্ধু মিলে আড্ডা দেবার প্রতিটি স্থানে ঘুরে বেড়ায় সারাদিন।
সাজু হয়তো কোনদিনই কল্পনা করেনি একটা সময় তাকে খুব একা হতে হবে। হ্যাঁ ভেবেছিল ঠিকই কিন্তু সেটা মৃত্যুর পর, বেঁচে থাকতে এভাবে একাকী হবে সেটা জানা ছিল না তার।
লন্ডন থেকে আসার পরে রামিশার সঙ্গে তার কথা হয়েছে মাত্র দুবার। একবার গতকাল রাতে আর আরেকবার মাস খানিক আগে। রামিশার বান্ধবী কাজলের মাধ্যমে রামিশার নতুন নাম্বার সংগ্রহ করে গতকাল রাতে কল করেছিল সাজু ভাই। তারপর আর ঘুমাতে পারেনি সারারাত।
রাত দশটার দিকে কাজল কল দিয়ে রামিশার নতুন নাম্বার দিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে সাজু ভাই কল দিয়েছিল।
– হ্যালো, কে বলছেন?
– আমি সাজু৷
– ওহ্ আচ্ছা, কেমন আছেন? আর আমার নতুন নাম্বার কোথায় পেয়েছেন?
– যোগাড় করলাম, তোমার কি অবস্থা? আমার সঙ্গে কথা বলো না কেন?
– একটু ব্যস্ততা আর পারিবারিক সমস্যার মধ্যে আছি তাই কারো সঙ্গে তেমন যোগাযোগ নেই।
– কিন্তু তাই বলে নাম্বার পরিবর্তন করে ফেলেছ অথচ একটু জানালে না। কেন?
– বললাম তো, সবার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে একটু একা থাকতে চাই।
– আমার সঙ্গে ও?
– হ্যাঁ।
– এভাবে কথা বলো কেন?
– আমি এমনই, কেন সমস্যা হচ্ছে?
– না সমস্যা হবে কেন। তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে তুমি আমার প্রতি খুব বিরক্ত। তোমাকে কল দিয়ে মনে হয় অনেক বিরক্ত করে ফেলেছি।
– হ্যাঁ করেছেন, তো কি করবেন? দেখুন সাজু ভাই মানুষের দিন সবসময় সমান যায় না। সময়ের সঙ্গে মানুষ পরিবর্তন হয়ে যায়, সময় বদলে যায়, মানুষ বদলে যায়, পরিস্থিতি বদলে যায়।
– বুঝতে পেরেছি।
– মেলা মেলা ধন্যবাদ, আপনার কথা আপনাকে ফিরিয়ে দিলাম।
– আমি যদি মাঝে মাঝে কল করি তাহলে?
– দিয়েন সমস্যা নেই, সময় পেলে অবশ্যই কথা বলতে চেষ্টা করবো।
– তোমার কি হয়েছে জানতে পারি?
– কিছু না।
– সত্যি বলো।
– বললাম তো কিছু নেই, আর হলেও সেটা আমি বলতে চাই না।
– কিন্তু আমি শুনতে চাই, বলো বলছি।
– আমি কি বাধ্য? আপনার কি মনে হয় আপনার কথা শুনতে আমি বাধ্য?
বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ রইল সাজু ভাই। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।
– না বাধ্য নয়।
– সেটাই, যেহেতু আমি আপনার সব প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য নই সুতরাং আমি যেটা বলবো না বলেছি সেটা আর জিজ্ঞেস করবেন না।
– ঠিক আছে।
– অনেক রাত হয়ে গেছে, ঘুমাবো শুভরাত্রি।
সাজু ভাই নিজেও শুভরাত্রি বলে কল কেটেছিল কিন্তু রাতটা শুভ হয়নি। সারারাত তার চোখে ঘুম ছিল না, কেন এমন হলো সেই উত্তর তার নেই।
” কিছু মনে করবেন না, আপনার নামটা জানতে পারি আমি? ”
ভাবনা বন্ধ করে সামনে তাকিয়ে দেখে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুখভর্তি হাসি, সাজুর দিকে তাকিয়ে আছে।
– রিহানুল ইসলাম।
– আর কোনো নাম নেই?
– কেন?
– আপনাকে দেখে আমার খুব পরিচিত একটা মানুষের কথা মনে পড়ছে। যদিও আমি তাকে কোনদিনই দেখিনি কিন্তু আমি কল্পনার মাঝে তার একটা ছবি এঁকেছি। সেটা আপনার মতো? আর সে হচ্ছে সাজু ভাই, গোয়েন্দা একজন।
অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল সাজু। মেয়েটার কথার মধ্যে রহস্য আছে, একটা মানুষ তাকে নাকি কল্পনা করে দেখেছে। এমনিতেই সাজু জানে তার পিছনে শত্রু আছে, তাকে খুন করার জন্য কোনো এক অজ্ঞাত দল চেষ্টা করছে। মেয়েটা তাদের দলের কেউ নয় তো?
আগে থেকে চিনেন হয়ত কিন্তু বানিয়ে বানিয়ে একটা ইমোশনাল কথা বলে চমকে দিতে চাইছে।
– আপনার ধারণা ঠিক, আমার পুরো নাম হচ্ছে রিহানুল ইসলাম সাজু। সাজু ভাই হিসেবে কিছু কিছু মানুষ আমাকে চিনেন।
– সত্যি বলছেন? আপনিই সাজু ভাই?
– জ্বি। আপনার নাম?
– মিথিলা ইসলাম পুতুল। সবাই আমাকে পুতুল বলে ডাকে, আপনিও পুতুল বলে ডাকবেন।
– আচ্ছা।
– আমি না বিশ্বাসই করতে পারছি না সাজু ভাই আমার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মনে হচ্ছে যেন এখনই অজ্ঞান হয়ে যাবো।
সাজু কিছু বলার আগেই চুপ করলো। অপরিচিত আরেকটা লোক এসে তাদের সামনে দাড়িয়ে আছে। লোকটা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে দেখে সাজু ভাই বললেন,
– কিছু বলবেন?
– আপনি গোয়েন্দা সাজু ভাই?
– জ্বি, কিন্তু আপনি?
– আমার নাম বদিউল আলম রিংকু। আপনার কথা আমি গতকাল রাতে আমার এক বন্ধুর কাছে শুনেছি।
– আপনার বন্ধুর নাম?
– শরিফুল ইসলাম, তার সঙ্গে মনে হয় আপনার চট্টগ্রাম পতেঙ্গা থানায় পরিচয় হয়েছে।
চট্ করে মনে পড়লো সাজু। সেবার ওই মামলায় তার বন্ধু সজীবকে জেলে যেতে হয়েছে। অথচ আজ সজীব কবরে, সাজুর মনটা আবারও খারাপ হয়ে গেল।
– সাজু বললো, জ্বি চিনতে পেরেছি তাকে।
– আমি একটা মিথ্যা মামলায় অভিযুক্ত হয়ে যাচ্ছি সাজু ভাই। আমি সেজন্যই কিছু পরামর্শের জন্য গতকাল আমার বন্ধুকে কল করেছিলাম। সে বললো আমাদের বাগেরহাটেই একজন মানুষ আছে সে সত্যটা বের করতে পারবে। আমি ভেবেছিলাম আজকে আপনাদের বাগেরহাট যাবো।
– আপনার মামলাটা কেমন?
– আমার স্ত্রীর ছোটভাই বিয়ে করবে। তার জন্য মেয়ে পছন্দ করা হয়েছে, কিন্তু সবার কাছে ভালো লাগলেও আমার কাছে ভালো লাগে নাই। আমি সেটা শুধু প্রকাশ করেছিলাম, তারপর আমি হলাম সবার চোখে ভিলেন। জিদ করে বিয়ে বাড়িতেও গেলাম না, আর সেই বিয়ে বাড়িতে ঘটেছে একটা নতুন ইতিহাস।
– কিরকম?
বিয়ে বাড়ির সেই পাত্র আনিসুলের দুলাভাই বদিউল আলম রিংকু তখন বিয়ে বাড়ির যতটুকু জানেন সবটা বললেন। যদিও এসব তিনি অন্যের কাছে শুনেছেন, তবুও সবটা বললো।
ঘুমের যন্ত্রণায় মাথাব্যথা শুরু করেছে আগেই বুঝতে পেরেছে সাজু ভাই। তাই রিংকু সাহেবের কথা শুরুর সঙ্গে সঙ্গে মোবাইল বের করে রেকর্ড চালু করে রেখেছেন। মনোযোগ হারিয়ে গেলে পরে যেন শুনতে পারেন তাই এই ব্যবস্থা।
– সাজু বললো, আমি সামান্য অসুস্থ তাই এখন আমি বাসায় যাবো। আপনি আমার ফোন নাম্বার রাখুন, বিকেল বেলা আবার এখানে এসে কল দিবেন।
বদিউল আলম মাথা নেড়ে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করলেন। তার মুখে তৃপ্তির হাসি, মনে হচ্ছে তিনি যেন অনেকটা সস্তি পাচ্ছেন।
হঠাৎ করে সাজু দেখতে পেল, লাল টিশার্ট পরা একটা লোক পার্কের বাহির থেকে সরে যাচ্ছে। লোকটা এতক্ষণ তাদের দিকেই তাকিয়ে ছিল। সাজু ভাই পার্ক থেকে দ্রুত বের হয়ে গেলেন।
বাহিরে আসতেই হঠাৎ করে নিজের সঙ্গে পুতুল নামের মেয়েটাকে হাঁটতে দেখলো। এতক্ষণ ধরে মেয়েটির কথা স্মরণ ছিল না, মেয়েটার সকল কিছু সন্দেহের মনে হচ্ছে।
– পুতুল বললো, আপনি কোথায় যাবেন?
– রয়েলের মোড়, আপনি?
– আমার বাসা সোনাডাঙা। চলুন তাহলে আপনার সঙ্গে রয়েলের মোড় গিয়ে সেখান থেকে অটোতে করে চলে যাবো।
ভ্রু কুঁচকে গেল সাজুর,
– আমার সঙ্গে যেতে হবে কেন?
– গেলে কি এমন ক্ষতি হবে? আচ্ছা ঠিক আছে যাবো না, কিন্তু বিকেলে আপনার সঙ্গে দেখা করতে ঠিকই চলে আসবো। একটা কথা বলবো?
– কি কথা?
– ওই লোকটার কথা রেকর্ড করলেন কেন?
– মানে আপনি দেখে ফেলেছেন?
– জ্বি। তবে কৌতূহল নিয়ে জানতে চাই।
কিছু না বলে চুপচাপ রিক্সাতে উঠে গেল সাজু। মোবাইল বের করে রিংকু সাহেবের রেকর্ডটা সে পাঠিয়ে দিল ঢাকায় সাইফুল ইসলামের কাছে। রেকর্ডটা পাঠিয়ে আরেকটা মেসেজ দিলেন,
” অনেকদিন ধরে নাকি সাজু ভাইয়ের কোনো খোঁজ পাচ্ছেন না? এই নিন নতুন মামলার রহস্য পাওয়া গেছে, আপাতত এতটুকু লিখে রাখুন। যদি মামলা হাতে নেই তাহলে বাকিটা আপনাকে জানাবো, আপনি লিখে ফেলবেন। ”
——
বাসায় ফিরে সাজু ভাই অনেকক্ষণ ধরে গোসল করলেন। তারপর ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে সাইফুল ইসলাম দুবার কল দিয়েছিল। সাজু ভাই কলব্যাক করলেন,
– কেমন আছেন সাজু ভাই?
– ভালো, আপনি কেমন আছেন?
– জ্বি ভাই অনেক ভালো আছি, আপনার দেয়া রেকর্ড শুনলাম। বিয়ে বাড়িতে নিশ্চয়ই বিশাল কোনো ঝামেলা হয়েছে, তবে আমার মনে হয় সবার আগে মাহিশা মেয়েটাকে খুঁজে বের করতে হবে।
– আমি এখনো ভাবিনি, বিকেলে ভালো করে কথা বলে যদি ভালো লাগে তাহলে মংলা যাবো।
– ঠিক আছে জানাবেন কিন্তু।
– হ্যাঁ অব….
কথাটা শেষ করতে পারলো না সাজু ভাই। জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে চোখ আটকে গেল তার। পার্কের বাহিরে লাল টিশার্ট পরা লোকটা দাঁড়িয়ে আছে এখানে। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লোকটা এই বাড়ির দিকে তাকিয়ে আছে।
এমন সময় তার মোবাইলে ওয়েটিং এ আরেকটা কল আসলো। সাইফুল সাহেবের কল কেটে দিয়ে ওই কলটি রিসিভ করলো সাজু।
– কে বলছেন?
– সাজু ভাই আমি পুতুল, সকালে পার্কে দেখা হয়েছে মনে আছে?
– আপনি আমার নাম্বার পেলেন কীভাবে?
– রিংকু সাহেবকে যখন নাম্বার দিয়েছেন তখনই তুলে রেখেছি।
সাজু ভাই মোবাইলে কথা বলছে আর বাহিরের সেই লোকটার দিকে তাকিয়ে আছে। পুতুল আর ওই লোকটার মধ্যে কোনো কানেকশন নেই তো?
——-
কেমন হয়েছে অবশ্যই গঠনমূলক আলোচনা করে জানাবেন। খুশি হবো।
[ কমবেশি অনেকেই জানেন যে আমার লেখা একটা গল্প দিয়ে নাটক তৈরি হয়েছে। ছোটপর্দার অভিনেতা তৌসিফ মাহবুব ও তাসনিয়া ফারিন অভিনয় করেছেন সেই নাটকে।
নাটকের নাম ” তৃপ্তি তোমার জন্য ” প্রচারিত হবে আগামী ২১ তারিখে বাংলাভিশন চ্যানেলে রাত নয়টায়। ]
চলবে…
লেখাঃ- মোঃ সাইফুল ইসলাম।