সবটা অন্যরকম♥ পর্ব-৪২

0
496

সবটা অন্যরকম♥
#পর্ব_৪২
Writer-Afnan Lara
.
দিবা রুটি বানাতে বানাতে বললো”এই শাড়ীটাকে তোমার পুড়িয়ে ফেলা উচিত ছিল।যে ব্যাক্তি শাড়ীটা দিয়েছেন তাকে আমি দেখিনি।তার অস্তিত্ব আমার জীবনে নেই
তার কারণে আমার জীবন মাঝপথে এসে থমকে আছে
আর আমি কিনা তার দেওয়া উপহার নিজের কাছে রাখবো?”
.
-দেখ মা,এরকম রাগ করে না।শাড়ীটা সাদাত দিয়েছে তো কি হয়েছে?শাড়ীটা তো তোর মা পরেছিলো। সেটা মনে করে তুই তোর কাছে শাড়ীটা রেখে দে নাহয়
.
দিবা চুপ করে আছে।খালামণির কথার উত্তরে আর কিছুই বললো না সে
আহনাফ জগিং শেষে বাসায় ফেরার সময় ওর ফোনে কল আসলো জিসানের
-কিরে কি খবর তোর?
.
-খবর চওড়া!!কাল যে ভার্সিটিতে নবীণ বরণ অনুষ্ঠান সেদিকে তোর খবর আছে?
.
-ওমা!সেটা তো আমি জানিই।এটা আবার ব্রেকিং নিউজ হিসেবে বলছিস কেন?
.
-তুই কি তোর সেই কালা পোশাকই পরে আসবি নাকি একটু লুক পাল্টাবি?
.
-হুম!ভাবতে হচ্ছে।বাকিরা কি পরবে?
.
-সবাই বাঙালী স্টাইলে আসবে বস!
.
-ওকে ডান।আহনাফ তাহলে বাঙালী স্টাইলেই আসবে

দিবা নাস্তা বানিয়ে সেসব টেবিলে এনে এনে রাখছিলো
কলিংবেলের আওয়াজ শুনে এবার গেলো দরজা খুলতে
দরজাটা খুলতেই আহনাফ দিবার চোখে চোখ রেখে সাথে সাথে চোখ নামিয়ে নিলো
আস্তে করে দিবার পাশ কেটে চলে গেলো সে
দিবার গায়ের থেকে গরম তাপ আসছে
কারণ সে এতক্ষণ রান্নাঘরে কাজ করছিল
ঘেমে একাকার হয়ে গেছে ওর সারা শরীর।যা গরম পড়ছে আজকাল
আহনাফ থেমে গিয়ে বললো”যাও ফ্যানের নিচে বসো”
.
এটা বলেই সে চলে গেলো
.
মিনি ও ওর পিছু পিছু ড্যাং ড্যাং করে চলে যাচ্ছিলো
দিবা নিচু হয়ে মিনির পেট ধরে ওকে উঁচু করে বললো”কি?আমাকে আর চিনেন না আপনি?নতুন একজনকে পেয়ে আমাকেই ভুলে গেছেন?”
.
-মিঁয়াও!মিঁয়াও
.
-হ্যাঁ বুঝেছি।যা এখন।খাবার আমার সাথে পাবি
.
মিনিকে ছেড়ে দিয়ে দিবা নিজের রুমে এসে ফ্যানটা চালু করে বসলো।তার পাশেই ঐ শাড়ীটা রাখা
লাল রঙের তার উপর হলুদ রঙের বুনোফুল সুতো দিয়ে বানানো
সম্পূর্ন শাড়ী জুড়ে গুটিগুটি সেই ফুল
যেন বনের মধ্যে বসে চিত্রকর শাড়ীটার ডিজাইন বানিয়েছেন
দিবা শাড়ীটাতে হাত বুলিয়ে নিলো
আহনাফ দরজায় দুইবার টোকা দিয়ে বললো”হ্যাঁ!এই শাড়ীটাই পরিও”
.
দিবা কপাল কুঁচকে বললো”কেন পরবো?”
.
-কাল ভার্সিটিতে নবীণ বরণ অনুষ্ঠান আছে।সবাই বাঙালী সাজে আসবে।তুমি এই শাড়ীটা পরিও।”ভাল্লাগবে”
.
দিবা চুপ করে রইলো
হ্যাঁ ও বললো না আবার না ও বললো না
আহনাফ তার রুমে এসে দিবার সাথে মিলিয়ে নিজের লাল পাঞ্জাবিটা খুঁজে রাখলো।কাল ওর সাথে মিলিয়ে যাবে সে

-মা প্লিস!চলো আমরা খুলনাতে যাই।জাস্ট একবার আমি মৌসুমীকে দেখতে চাই।বুকে হাহাকার করে এক নজর ওকে দেখার জন্য
.
-আমি এমন অসুস্থ শরীর নিয়ে যেতে পারবো না।তুই গেলে যা।তবে এতবড় শহরে ওকে পাবি কোথায়?
.
-জসিমের পরিবারের খোঁজ আমি জানি।একজন অপরিচিত হয়েও পরিচিতর অভিনয় করে নাহয় ঠিকানাটা নেবো ওদের থেকে
তবে কাল তো ভার্সিটিতে অনুষ্ঠান
সেটা শেষ হলে নাহয় খুলনার জন্য রওনা হবো
.
-আচ্ছা যদি ওকে পাস তো আমায় একটা ফোন করিস।নিজের এত বড় ভুলের জন্য ক্ষমা চাইবো ওর কাছে।
হয়ত ক্ষমা চাওয়া বোকামি।কারণ আমি যা করেছি তার ক্ষমা নেই
মৌসুমীর মনে যে অভিমান আছে সেটা আমার কারণেই আছে
সেদিন আমি মানা করে দেওয়ায় তে দুইটা জীবন নষ্ট হয়ে গেছিলো
.
সাদাত জানালার গ্রিল ধরে সেটাতে মাথা ঠেকিয়ে চুপ করে আছে

সকালের নাস্তা সেরে আরিফ মা বাবাকে নিয়ে মণিতার শ্বশুর বাড়ির জন্য রওনা হয়েছে
আর মিনি,দিবাকে নিয়ে আহনাফ ও বেরিয়েছে
.
পথে দিবাও চুপ ছিল আর আহনাফ ও
তারা একটা কথাও বলেনি একে অপরের সাথে
দিবার চুপ থাকার কারণ হলো তার মাথায় ঘুরঘুর করছে বাবার দেওয়া শাড়ীটার ছবি
সেটাকে ফেলে দিয়ে পুরোনো স্মৃতি মুছে দেবে নাকি সেটা পরে কাল ভার্সিটিতে গিয়ে বাবার স্মৃতিকে আগলে রাখবে ওসব ভাবছিল সে
আহনাফের চুপ থাকার কারণ হলো সে এত সাহসী হওয়ার পরেও কেন দিবার চোখে চোখ রাখতে পারছে না।দু মিনিটের জন্য ও কেন তাকিয়ে থাকা সম্ভব হয় না
.
জন্টুদের বাসায় এসে আহনাফ দিবাকে হারিয়ে ফেলেছে
মানে দিবা বাইক থেকে নেমে চলে যাওয়ার পর কোথায় যে উধাও হয়ে গেলো।তাই আহনাফ ওকে খুঁজছে
তখন আসার পর থেকে এক ঘন্টার বেশি সময় হয়ে গেলো অথচ এখনও ওর মুখটাও দেখলো না সে
দিবা জন্টুদের বাসার ছাদে এসে একা একা বসে আছে
অবশ্য একেবারেই একা নয়।মিনিও আছে
ছাদ ফাঁকা পেয়ে এখানে এসে বসেছে দিবা
ডেকোরেশন বাসার সামনের খোলা জায়গায় হওয়াতে ছাদ গোটা খালি
মিনি এই ছাদটাতে একটা ফুলগাছ ও দেখতে না পেয়ে দিবার ওড়না নিয়ে খেলছে চুপচাপ
আহনাফ ওর মায়ের কাছেও দিবাকে পেলো না।হাঁপিয়ে গেছে সে
এদিক দিয়ে আদনানের কিছু বন্ধুরা ওকে ঝাপটে ধরে দুনিয়ার সব গল্প শুনিয়ে যাচ্ছে
আদনান দিবাকে ছাদে যেতে দেখেছিল।বেশ কিছুক্ষন হওয়ার পরেও দিবা আসছে না দেখে সে নিজেই গেছে দেখতে।দিবাকে ছাদের কোণায় একা বসতে দেখে সেও পাশে এসে দাঁড়ালো।দিবা আদনানের উপস্থিতি টের পেয়েছে
তাও কিছু বলছে না।শেষে আদনানই বললো”মন খারাপ?তার কার কি আমি?”
.
দিবা বললো”নাহ”
.
-তাহলে?
.
-কিছু না
.
দিবা উঠে চলে যেতে নিতেই আদনান আবারও বলে উঠলো”বিয়ে না করো অন্তত ফ্রেন্ড বানিয়ে ও তো রাখতে পারো”
.
-আমি একাই ভালো আছি
.
কথাটা বলার পর দিবা আহনাফকে সামনে দেখতে পেলো।ওকে দেখার পর তার ঠোঁটের কোণায় হাসি ফুটে উঠেছে
হেসে দিয়ে দিবা বললো”যদি একজন সঙ্গীর প্রয়োজন হয়ে থাকে আমার, তবে সেই সঙ্গী আমায় নিজ দায়িত্বে খুঁজে নেবে।আমার আর যেচে খুঁজার দরকার নাই”
.
আহনাপ দিবার কথা শুনে মুচকি হাসলো
কথাটা যে দিবা ওকেই মিন করে বলেছে তা ও বেশ বুঝতে পেরেছে
কিন্তু আদনান কিছুই বুঝলো না।মিনি দিবার পিছু পিছু চলে গেলো।আদনানের প্রতি তার এত টান নাই
যা টান আছে তার ৬০% দিবার জন্য।৩০% আহনাফের জন্য আর বাকি ৫% আরিফ,ও বাকি ৫% আনাফের জন্য
.
আহনাফ ও আসছে এদিকেই। দিবার সামনে এসে দাঁড়িয়ে ওর পথ আটকিয়ে বললো”কোথায় ছিলে?তোমায় কত খুঁজছিলাম আমি জানো?”
.
দিবা হাত ভাঁজ করে বললো”কেন খুঁজছিলেন?”
.
আহনাফের মুখের কথাই হাওয়া হয়ে গেছে এবার।মুখটা আটকে সে দিবার দিকে অসহায় লুক নিয়ে তাকিয়ে আছে
দিবা হেসে দিয়ে বললো”থাক আর বলতে হবে না।আমি বুঝি”
.
আহনাফ মুখ খুলে বললো”কি বুঝো?”
.
-ঐ যে আমায় কেন খুঁজছিলেন।থাক আর ঘটা করে কারণ বলতে হবে না।আপনার চোখ মুখই আমাকে ক্লিয়ার করে সব জানিয়ে দেয়

আহনাফ কথাটাকে আর ঘাটলো না।পরে যদি দিবা সত্যি কথাটা বলে দেয় তখন তো সে না ও করতে পারবে না আবার হ্যাঁ বললেও বিপদ
দিবাকে এত ভয় কেন পাচ্ছি?
.
-আমাকে এত ভয় পান কেন আপনি?এতদিন তো খুব কড়া করে কথা বলতেন।আমি বরং এতদিন আপনাকে ভয় পেতাম আর হুট করে দুদিনেই আপনার চেহারার ভাবগতি পাল্টে গেলো?যাকে পছন্দ করতেন না তার সাথে বসে তার হাতটাকেই খোঁচাচ্ছেন ইদানিং
ইন্টারেস্টিং!
.
-না মানে ও কিছু না।মা ডাকছে তোমায়।অনেকক্ষণ দেখছে না তো তাই
.
দিবা ঘাঁড় ঘুরিয়ে বললো”আপনি নিজ থেকে খুঁজছিলেন না?”
.
আহনাফ হাঁটা বন্ধ করে ফেলেছে
দিবা ব্রু নাচিয়ে বললো”জানি!এটার উত্তর দিতেও আপনার হার্টবিট বেড়ে যাওয়ার মতন অবস্থা তৈরি হয়ে যাবে।থাক আর প্রশ্ন করছি না।তবে একটা কথা!!আমায় সত্যিটাই বলবেন।কখনও মিথ্যে বলবেন না
ধোকা জিনিসের রেশ কতদূর থাকে তা আমায় দেখলেই বুঝতে পারবেন।আমি তার জলজ্যান্ত একটা প্রমাণ।ধোকার ফল!”
.
আহনাফ গম্ভীর গলায় বললো”ওসব কঠোর অতীত।তোমার মায়েরই সেটার প্রতি ঘৃনা রাখা খাটে।তুমি ওসব মনে করে কেন নিজেকে কষ্ট দিচ্ছো?”
.
-আমার খাটে না??আমি ঐ ধোকার সাথে সম্পৃক্ত নই?
.
-না সেটা বলিনি।
.
-বাদ দিন।আপনি বুঝবেন না।যার সাথে ঘটে সেই বুঝে।
.
-আমি বলিনি যে বুঝি না কিংবা বুঝার চেষ্টা করি না।তোমায় জাস্ট স্ট্রেস আউট থাকতে বলছি কারণ তুমি ভালো মোমেন্টেও কষ্ট পাও শুধুমাত্র সেই অতীত মনে করে
.
-চাইলেও ভুলতে পারি না কি করবো বলুন?
.
-থাক ভুলতে হবে না।যাও মায়ের সাথে গিয়ে খেতে বসো
আমি লেগ পিসের ব্যবস্থা করি
.
দিবা ভ্রু কুঁচকে বললো”আমি লেগ পিস খাই না”
.
আহনাফ ফিসফিস করে বললো”তোমার জন্য নয় বালিকা।আমার ব্রো মিনির জন্য”
.
দিবা ফিক করপ হেসে দিয়ে বললো”ব্রো?”
.
-হ্যাঁ তা নয়ত কি?ওটা শুধু মিনিকেই খাওয়াবে।তুমি নিজেও খাবে না।
.
বৌভাত শেষ হতেই আহনাফরা একেবারে বাসায় ফিরে এসেছে
দিবাকে বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে আহনাফ তার ডিউটি করতে চলে গেছে আর দিবা মিনিকে নিয়ে বাসার দিকে গেছে।
রাত এগারোটা পর্যন্ত দিবা অপেক্ষা করলো আহনাফের
অথচ আগে এরকম অপেক্ষা সে করত না।মাথায় আনতোই না আহনাফের জন্য অপেক্ষা করার কথা
আজ কেন যেন মন চাইলো অপেক্ষা করা দরকার
সোফায় বসে অপেক্ষা করতে করতে দিবা সোফাতেই ঘুমিয়ে পড়েছে
বারোটার দিকে আহনাফ বাসায় ঢুকলো চাবি দিয়ে লক খুলে।ভিতরে ডুকতেই দিবাকে দেখতে পেলো সে
দিবা হাত ভাঁজ করে তার উপর মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে
ডাইনিং টেবিলে দুটো প্লেটে খাবার ঢেকে রাখা।তার মানে সে এখনও খায়নি,মিনি সামনের সোফাতে ঘুমায়
আহনাফ আস্তে আস্তে নিজের রুমে গেছে ফ্রেশ হতে
হালকা আওয়াজ কানে আসতেই দিবা উঠে পড়লো ঘুম থেকে
চোখে পানি নিয়ে ছুটে আসলো আহনাফকে খাবার এগিয়ে দেবে বলে
আহনাফ মুখ ধুয়ে আসলো এদিকে
দিবা এ পাশে বসেছে আর আহনাফ ওপাশে
দুজনেই খাবারের প্লেটে হাত রেখে চুপ করে আছে।খাচ্ছে না
দিবা মাথা তুলে বললো”খান না।অনেক রাত হয়েছে।আবার ঘুমাবেন কখন?”
.
-আমার জন্য হঠাৎ ওয়েট করলে। তাও না খেয়ে?
.
দিবা মুখে একটা লোকমা পুরে চুপ করে আছে।কথার উত্তর ও দিচ্ছে না। খাবারটাও গিলছে না
.
আহনাফ বললো”থাক,উত্তর দিতে হবে না।উত্তর জানি আমি।আপনাকে এত কষ্ট করার দরকার নেই”
.
দিবা বাম হাত দিয়ে চুলগুলো কানের পেছনে গুজে দিয়ে বললো”আমার কথা আমাকেই ফিরিয়ে দিচ্ছেন?”
.
-কি করবো বলো।তুমিও যে আমার মতন শুরু করেছো।

খাওয়া শেষ করে দিবা প্লেট গুলো রান্নাঘরে এসে ধুয়ে ধুয়ে রাখছিলো
আহনাফ পাশের দেয়ালে হেলান দিয়ে বললো”ছাদে যাবে?”
.
দিবা প্লেট সাজিয়ে রেখে হাত মুছতে মুছতে বললো”কেন?”
.
-একটু চাঁদের আলো খেতাম
.
-চাঁদের আলো খাওয়া যায়?
.
-হা করলে যদি হাওয়া খাওয়া যায় তবে চাঁদের আলোতে হা করলে চাঁদের আলো ও খাওয়া যাবে
.
-টেস্ট কেমন হবে জানেন?আগে খেয়েছেন কখনও?
.
-একবার খেয়েছিলাম।টেস্ট কেমন যেন।চিবানোর সময় মনে হয় কিছুই নাই মুখে।
.
-হাহা!!
.
-আমি দরজা খুলছি।মিনিকে একজায়গায় রেখে আসো।নাহলে পিছু নিয়ে ছাদে পৌঁছে যাবে।হারিয়েও যেতে পারে
চলবে♥

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here