মন গহীনের গল্প পর্ব-১৭

0
1150

#মন_গহীনের_গল্প
পর্ব-১৭
#রূবাইবা_মেহউইশ
💞

‘হাওয়ায় ভেসে একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছে দেহটা’ এমনই অনুভূতি। রিশাদের বাজু চেপে তারই বুকের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেহউইশ। শার্টের খোলা বোতামটাতেই চোখ থেমে আছে। বোতামখানা লেগে থাকলে কি এমন সমস্যা হতো! এত ফর্সা বুকটা এভাবে উন্মুক্ত রেখে কোন নারীকে এত কাছে থেকে আকর্ষিত করাটা অন্যায়।মনে মনে প্রমাদ গুণছে মেহউইশ। যার কোলে চড়ে সে গন্তব্যে ফিরছে তারই নগ্ন বুকে কু দৃষ্টি! ভাবতেই তো ভয় লাগা উচিত যা ভয়ংকর এই লোকের হাতের একেকটা থাপ্পড়৷ চোয়ালের দাঁত মাড়ি সবই তো নাড়িয়ে দিয়েছিলো এই লোকটা। ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘরে পৌঁছে গেছে তারও খেয়াল নেই। রিশাদ তাকে বিছানায় আধশোয়া করে বসিয়ে দিলো । আনতুং প্রতিবেশী মেয়েটাকে পৌঁছে দিতে মেয়েটার সাথে গেল। রাস্তায় যখন তারা দূর্ঘটনায় পড়ে তখন রাস্তা ফাঁকা ছিলো। দ্বিতীয় গাড়িটা নিচে থেকে শুধু রিশাদেরই আসছিলো তা দেখে আনতুংও হাতে ইশারা করলো গাড়ি থামাতে যেমনটা মেহউইশ করছিলো কিছুক্ষণ আগে। রিশাদ দূর থেকেই খেয়াল করেছে রাস্তায় দু’জন বসে আছে। যতটুকু বোঝা গেল তারা ব্যাথা পেয়েছে। সামনে এসে গাড়ি থামাতেই চোখে পড়লো খয়েরী আর সাদার মিশেলে সেলোয়ার-কামিজ পরা মেহউইশকে। জ্ঞান নেই পরে আছে নিথর দেহটা। পাশেই আছে পাহাড়ি অন্য মেয়েটি সেও পায়ে ব্যথা পেয়েছে মেহউইশের চেয়েও বেশি অথচ মেয়েটির চেতনা আছে। রিশাদ মেহউইশকে টেনে কোলে তুলে নিতেই আনতুংকেও ইশারা করলো মেয়েটিকে ধরে গাড়িতে বসাতে। আনতুংও তাই করলো গাড়ির পেছনের সিটে মেয়েটিকে নিয়ে বসলো। রিশাদ গাড়ি ঘুরিয়ে চেনা হাসপাতালের দিকে এগোলো। সারাপথ সে কোন রা করেনি আনতুংও রিশাদের গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলার সাহস পায়নি। হাসপাতালে এনে ঘন্টা দুই পার করে তবেই জ্ঞান ফিরলো মেহউইশের অন্যদিকে প্রতিবেশী মেয়েটির ট্রিটমেন্ট শেষে তারা আরো আগেই বাড়ি চলে গেছে।মেহউইশের জ্ঞান ফেরার পরও রিশাদ কথা বলেনি৷ সে চুপচাপ মেহউইশকে কোলে তুলে নিয়ে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে গাড়িতে বসালো। ড্রাইভ করলো, বাড়ি ফিরলো, আবারও কোলে তুলে ঘরে নিয়ে এলো। এত সময়ে মেহউইশ কত কি ভেবে বসলো। রিশাদ হাসপাতালের বিল না দিয়ে এলো কেন? কেউ তাকে আটকালোও না! আবার তাকেই কোন প্রশ্ন করলো না কেন! ধুর মেহউইশ তুই কি চাস এই দানব এখন তোকে পা ভাঙার দায়ে দুটো থাপ্পড় লাগাক! নিজেই নিজেকে বকতে লাগলো মেহউইশ এসব বলে।

-‘পায়ের কি হাড় ভেঙে গেছে?’ ফুপুর কথা শুনে দরজার দিকে তাকালো মেহউইশ। রিশাদ ফুপুর কোল থেকে নির্জনকে নিয়ে দু হাতে বুকে জড়িয়ে ধরেছে।বুকের ভেতরে তোলপাড় যা ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে মুখটাকেই মলিন করে দিয়েছে। এখন আর রিশাদকে দানব কিংবা ভয়ংকর বলে মনে হচ্ছে না তার। দিনভর রাগ আর ক্ষমতার মুখোশ পরে থাকা লোকটাকে এই মুহূর্তে খুব সাধারণ দুঃখী পিতা বলে মনে হচ্ছে । ফুপুর কথার জবাবে রিশাদ বলল, ‘সামান্য ফ্র্যাকচার ঠিক হয়ে যাবে দু একদিন রেস্টে থাকলেই। এক্সিডেন্ট আসলে অন্য মেয়েটির হয়েছে তা দেখেই ইনি জ্ঞান হারিয়ে বেকায়দায় পড়ে মচকেছে।’ রিশাদের কথা শুনে কপাল কুঁচকে এলো মেহউইশের৷ লোকটা কি ব্যঙ্গ করে কথা বলল, আশ্চর্য! যত যাই হোক চোখের সামনে এত বড় দূর্ঘটনা সে তো হাসপাতালে থেকেও কখনও দেখেনি৷ আবার মনে পড়লো হাসপাতালে রোগী আসে এক্সিডেন্ট তো আর হাসপাতালে হয় না।ফুপু এসে পাশে বসলেন, মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন কিছুক্ষণ আবার গরম পানির সেকও দিলেন। কিন্তু রিশাদ আর একবারও ঘরে আসেনি। রাতের খাবার ফুপু ঘরে দিয়ে নির্জনের দরকারি জিনিসপত্র এসে নিয়ে গেলেন। রাতে নাকি রিশাদ নির্জনকে নিয়ে ফুপুর ঘরেই ঘুমাবে আর ফুপু মেহউইশের সাথে। আনতুং আজ আর আসবে না সে তার বাড়িতেই থাকবে।

সকাল সকাল আজকাল খান বাড়িতে কেউ জাগে না৷ আগে রিশাদ উঠতো ভোরে তারপর দৌড়াতো,ব্যায়াম করতে এখন সে নেই৷ জেবুন্নেসানামাজ পড়েন আজকাল নিয়মিত কিন্তু ফজর নামাজের পর আর ঘর থেকে বের হন না৷ একেবারে নাস্তার জন্যই নয়টায় বের হন৷ ততক্ষণে রিহান স্কুলে আর রাইমার ক্লাস থাকলে কলেজে যায়। বাড়ির চেহারা আগের চেয়ে অনেকটাই বদলে গেছে। কাজের লেকগুলো নিজেদের খেয়ালখুশি মত রান্না করে খায়৷ জেবুন্নেসা একন আর কাউকে কড়া কথা শোনান না। আজ সকালে রাইমা রিশাদকে কল দিয়ে কথা বলছিলো জেবুন্নেসা শুনতে পেয়ে দৌড়ে এলেন মেয়ের সামনে।

‘রিশুর সাথে কথা বলছিস?’ খালার বলা কথা ফোনের ওপাশে রিশাদের কানে গেল৷ হঠাৎ একরাশ প্রশান্তি মনজুড়ে আনন্দিত পাখির মত পাখা মেলল। বহুদিন পর সে খালার মুখে সেই আদুরে নাম শুনলো নাকি বহুবছর পর!

-আমাকে ফোন দে কাল সাপের বাচ্চা। আমার সাথে লুকোচুরি শুরু করেছিস চৌদ্দ গুষ্টি মিলে তাই না! প্রত্যেকটাকে দেখে নিবো আমি। জেবুন্নেসা রাইমাকে বকতে বকতে তার হাত থেকে ফোনটা এক প্রকার কেঁড়েই নিলো।

-‘রিশাদ তুই কোথায় আছিস বাবা নির্জন কেমন আছে? তোর ব্যাংক একাউন্ট বা অন্য কোন ওয়ে থাকলে বল আমি এক্ষুনি টাকা পাঠাবো তোকে। আমি সব জানি ওই কালসাপ আবার তোর সাথে কিছু করেছে। সত্যি করে বল বাবা তুই ঠিক আছিস তো?’ জেবুন্নেসা একদমে বলতে লাগলেন। রিশাদ চুপচাপ শুনে গেল সব। বহুদিন পর মনে হলো ইনি তার সৎ মা নয়। খুব কাছের কেউ ; মায়ের বোন খালা যে মা সমান তা যেন খালার এই দুশ্চিন্তা করা দেখেই আজ মনে হচ্ছে। সকল চিন্তা এবার এক নিমেষেই যেন হালকা হয়ে গেল।

– ‘আমার টাকা লাগবে না। রাইমা বলল আপনি ডিভোর্সের জন্য এপ্লাই করেছেন৷ এই বয়সে ব্যাপারটা আপনাদের জন্য ভালো হলেও রাইমা আর রিহানের জন্য ক্ষতিকর। মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, সামাজিকভাবেও বাড়ির বাইরে অস্বস্তিতে পড়বে।’

কথা শেষ করে রিশাদ কল কেটে দিলো৷ জেবুন্নেসা হতাশ হলেন রিশাদ তাকে নির্জনের কথা কিছুই জানায়নি মন খারাপ হয়ে গেল ভাবতেই। রাইমা পাশ থেকে বলল, ‘ তোমার পেটের সন্তান কি আমরা নাকি দাদাভাই?’

-‘কেউ না’ বলেই জেবুন্নেসা ধীর পায়ে নিজের ঘরে চলে গেলেন। রাইমা দাঁড়িয়ে থেকে চেয়ে রইলো মায়ের যাওয়ার পথে। অদ্ভুত লাগে মাকে খুব তার। মা টা তাদের দু ভাইবোনকে সবসময় কালসাপের বাচ্চা বলে বাবাকেও কালসাপ বলে।কিন্তু দাদাভাইকে তিনি কখনোই এমন বলেন না অবশ্য সামনাসামনি কথা হলে বরাবরই বাঁকা কথা শোনাতেন। আর ফুপি! ফুপিকেও মা কাল নাগিনী বলে লুকিয়ে লুকিয়ে বকেন। এমন কেন তাদের মা সবসময়ই উল্টো আচরণ করেন? কই তার আশেপাশের আর কারো মা তো এমন করেন না। সে বোঝে বাবার মায়ের সম্পর্কের মাঝে কোন ঝামেলা আছে কিন্তু সেটা কি! আজকাল ডিভোর্সের জন্যও উঠেপড়ে লেগেছে তারা আর এজন্যই রাইমা দাদাভাইকে ফোন করেছিলো। কিন্তু তার কথা শুনে দাদাভাই কি রিয়াক্ট করলো তা সে জানতেই পারলো না।

আজকে রিশাদ অফিসে যাওয়ার আগেই মেহউইশ ঘুম থেকে উঠেছিলো। রিশাদ বের হওয়ার আগে হাতে একটা বড়সড় বক্স রেখে গেছে। অন্যদিকে মুখ রেখেই বলেছে, ‘পা নিয়ে হাটতে পারলে বিছানা ছেড়ে এগুলো সব ট্রাই করে দেখে নিও। আনফিটেডগুলো আলাদা করে রেখো ফেরত পাঠানো হবে।’ মেহউইশ বক্সে কি আছে তা নিয়ে ভাবার আগে তার ভাবনায় এলো রিশাদের কি কিছু হয়েছে? গতকাল থেকে তার আচরণে এত শীতলতা কেন? এটা কি ঝড়ের পূর্বাভাস নাকি সত্যিই কোন পরিবর্তন! ভাবনা শেষ হওয়ার আগেই তার ফোন বাজলো মা কল দিয়েছে। রিসিভ করতেই কানে এলো মিহাদের উচ্ছ্বসিত কন্ঠ৷ সে আজ নতুন স্কুলে যাবে । তার ভর্তি কনফার্ম হয়েছে সে ওখানকার খুব বড় এক স্কুলে ভর্তি হয়েছে। নতুন ব্যাগ,জুতা,ইউনিফর্মও নাকি রেডি৷ মিহাদ ফোন মায়ের হাতে দিতেই এবার কানে এলো মায়েরও আনন্দিত কন্ঠ৷ রিশাদ সব ব্যবস্থা করে দিয়েছে তাদের জন্য৷ কোন কিছুরই কমতি নেই। মেহউইশের সকল রাগ রিশাদের প্রতি হওয়া ঘৃণা সব উধাও হয়ে গেল একমুহূর্তের জন্য। এখন যা মনে রয়ে গেছে তা শুধু ইভানকে হারানোর যন্ত্রণা৷ এই যন্ত্রণার জন্য হলেও রিশাদকে কখনোই সে পুরোপুরি ক্ষমা করতে পারবে না৷ বক্সটার দিকে তাকিয়ে একটুও ইচ্ছে হলো না খুলে দেখার। পায়ের ব্যথা একটুও অনুভব না হওয়ায় ঘর ছেড়ে বাথরুমে গেল। ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করতে গেলে দেখতে পেল ফুপু নির্জনকে রোদে নিয়ে বসে আছেন৷ মেহউইশকে দেখে হাসিমুখে জানতে চাইলেন পায়ের অবস্থা। তারপরই বললেন রিশাদ যে কাপড় অর্ডার করেছে তা যেন চেক করে। লজ্জায় লাল হয়ে গেল মেহউইশের মুখ। ছিহ, কি নির্লজ্জ লোক ফুপুকেও বলেছে কিসব অর্ডার করেছে! বদলোক, অসভ্যের শেষ এই লোক। বিরক্তি আর লজ্জা নিয়েই খাওয়া শুরু করলো সে। একটা রুটি খেতেই মনে হলো আজকে রিশাদ তার দিকে তাকায়নি একবারও। কেন মনে হলো তা জানে না শুধু মনে হলো লোকটা তাকে একরকম ইগনোর করে গেল!

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here