#মন_গহীনের_গল্প
পর্ব-১৯
#রূবাইবা_মেহউইশ
💞
আতরমাখা ঘ্রাণের মতোই বাতাসে ভেসে আসছে বুনো কোন ঘ্রাণ। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলো রাইমা৷ পাহাড়ে সে আজই প্রথম এসেছে। কক্সবাজারে বহুবার আসা হয়েছে কিন্তু কখনো পাহাড়ে আসার সুযোগ পায়নি। আজই এসে নিজেদেরই বাড়ি পেয়ে ভীষন রকম আনন্দিত সে। সেই সাথে দু সপ্তাহ পর নির্জনকে কাছে পেয়েছে। আবার এই প্রথম তাদের একমাত্র ফুপিটিকেও দেখার সৌভাগ্য হলো। সব মিলিয়ে তার সময় চমৎকারভাবে গড়িয়ে যাচ্ছে। দিনের শেষ প্রহর চলছে তাই শীত শীত আবহাওয়া এখনই অনুভূত হচ্ছে খুব। মেহউইশ আজ রান্নাঘরে রেহনুমার সাথে আছে। রাইমাকে প্রথমবার দেখতে পেয়েই খুশিতে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিয়েছিলো সে। কে বলবে এই মেয়েটি তাদের বংশে তার পর দ্বিতীয় মেয়ে। জীবিত থাকা দুই জেনারেশনের প্রথম মেয়ে রেহনুমা আর দ্বিতীয় রাইমা। কে জানে রিশাদের আবার সন্তান হলে মেয়েই হবে কিনা তাহলে হয়তো রেহনুমা বংশের তৃতীয় মেয়েও দেখবে! এখানকার বাজারে তেমন কিছুই পাওয়া যায় না পন্যসামগ্রি আর এই অবেলায় কাউকে দূরে পাঠানোও মুশকিল। তাই রেহনুমা উকাচুংকে পাঠিয়ে কাছেই কোথা থেকে পোলাওচাল ,দুধ আনিয়েছে। আর ঘরে থাকা ড্রাইফ্রুটস সব মিলিয়ে পায়েস রাঁধবে বলে প্রস্তুতি নিচ্ছে ততক্ষণে মেহউইশকে বলা হলো ফ্রিজ থেকে গরুর মাংস বের করতে। রিশাদ আজ বাড়িতেই আছে নির্জনকে আনার পর থেকে তাই সেও একটু পরপর ঘর থেকে বাইরে এসে রাইমার সাথে কথা বলছে।রাইমা যেখানে বসেছিলো সেখান থেকে রান্নাঘরটা দেখা যায় স্পষ্ট । তিনদিকে আধখানা দেয়াল থাকায় রান্নাঘরে কে কি করছে সবটাই চোখে পড়ে করিডোর কিংবা ঘরের দরজা থেকে। রিশাদও আঁড়চোখে কয়েকবার তাকালো সেদিকে। মেহউইশ খুব মনযোগে কিছু একটা বাছাবাছি করছে। ডান পাশের গালে পড়ে আছে একগাছি অবাধ্য চুল। কাজের ফাঁকেই মেহউইশ হাত উঠিয়ে চুল গুলোকে কানের পিছে গুঁজে দিলো। হঠাৎ তার মনে হলো একজোড়া দৃষ্টি তাকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। আর তাই আচমকা চোখ তুলে সামনে তাকালো। নাহ, কেউ তাকিয়ে নেই সামনেই তো রাইমা,রিশাদ নির্জনকে নিয়ে কথা বলছে তার দিকে তো কেউ তাকিয়ে নেই। নিজের ভ্রম ভেবে আবার কাজে মন দিলো সে আর ওদিকে রিশাদ আবারো সুযোগ পেয়ে তাকিয়ে দেখছে তাকে। আজকে কি একটু অন্যরকম লাগছে মেয়েটাকে! হুম, অন্যরকমই তো। এলোমেলো চুলগুলো খোঁপায় বাঁধা, ওড়ানাটা আঁচলের মত করে কোমরে গুঁজে রেখেছে আর মুখের ভাব ভঙ্গি এমন যেন এই রান্নাঘরের একমাত্র গৃহিণী সে নিজেই। আমার ফুপু যেন তার অধীনে কাজ করতে এসেছে, ভাবটা এমনই মেয়ের! মনে মনে নিজেকেই যেন শুধালো রিশাদ। ঘোর অমানিশা কেটে পূর্ণিমার শশী আজ এই পাহাড়ের গায়ে ছাইরঙা গৌধূলিতেই নেমে এসেছে ধরনীতে। কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছে চারিধারে আর এই কুয়াশায় মন ভালো হয়ে যাচ্ছে রিশাদের। নীলিমা নামক কাটা আপাতত আগামী পনেরো দিনের জন্য মাথা থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। হাসিখুশি সময় কাটছে সবার। রেহনুমাও রান্নাঘর থেকে বাইরে একনজর দেখে মেহউইশকে বললেন, ‘মেহউইশ ঘরে তো মুড়ি আছে,চানাচুর, টমেটো, কাঁচামরিচ সবই আছে। তুমি কি মুড়ি মেখে দিতে পারবে একটু?’ হাসি হাসি মুখ করে মেহউইশ বলল, ফুপু সন্ধ্যে হয়ে গেছে প্রায়। তার চেয়ে বরং ভাজাপোড়া কিছু করে দেই?’
মেহউইশের কথাটা মনে ধরলো রেহনুমার পরক্ষণেই মনে পড়লো রিশাদ পছন্দ করবে না তেলেভাজা খাবার৷ তাই মুখটা মলিন করে বলল রিশাদ এসব খেতে চাইবে না। মেহউইশ শুনেও পাত্তা দিলো না কথাটাতে। রিশাদকে তার এখন আর ভয়ানক লাগছে না মোটেই। এই লোকটা ভয়ার্ত, দানবীয় আচরণ শুধু ছেলের দিকটা ভেবেই করেছে। এছাড়া অন্যান্য বিষয়ে খুবই নিস্পৃহ সে তা লক্ষ্য করেছে মেহউইশ। তাই ফুপুকে বলল, ‘তাদেরকেই জিজ্ঞেস করি?’ বলেই মেহউইশ রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে রাইমাকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘রাইমা, তুমি কি পাকোড়া খেতে পছন্দ করো?’
রাইমা কিছু বলতে যাবে তার আগে রিশাদই বলল, ‘সাথে চা দিলে ভালো হতো।’ যা জানার তা জেনে গেছে মেহউইশ আর রান্নাঘরে থাকা রেহনুমাও। হাসি মুখে মেহউইশকে ডাকলো রেহনুমা, ‘পাকোড়া বানাতে কি কি লাগবে?’
শীতে বারান্দায় বসে হাত ঘষতে ঘষতে অপেক্ষা করছে রিশাদ। পাকোড়া প্রায় হয়েই গেছে তাই রাইমা গেল চায়ের ট্রে আনতে। মেহউইশ ডুবো তেল থেকে পাকোড়া উঠিয়ে প্লেটে রাখতেই কানে এলো কেউ বাইরে থেকে রিশাদ রায়হান বলে ডাকছে। একটু পর উকাচুংয়ের গলাও শোনা গেল সাথে আনতুংও এসেছে। আজ সে সকালে কাজ করে চলে গিয়েছিলো এখন কি জন্য এলো? তবে রিশাদের নাম ধরে ডাকা ব্যক্তিটি বাংলা বলেছে সুন্দর উচ্চারণে। লোকটা পাহাড়ি নয় তা কন্ঠ শুনেই বোঝা গেল। রিশাদ ডাক শুনে বাইরে দাঁড়াতেই আনতুংয়ের গলা শোনা গেল, ‘এই সাহেবের বউ ছিলো লগে।’
মেহউইশ, রেহনুমা,রাইমা তিনজনই এবার বেরিয়ে এলো বাইরে। ‘এই সাহেবের বউ’ বলতে তো এখানে মেহউইশকেই বোঝানো হচ্ছে৷ বাইরে এসে সবাই চমকে গেল, আনতুংয়ের সাথে দুজন পুলিশ এসেছে। পুলিশ দেখে ভয়ে জমে যাচ্ছে মেহউইশ। সে কি করলো যার জন্য পুলিশ আসবে! রিশাদ এগিয়ে গিয়ে বলল সে রিশাদ, কি চাই তাদের এখানে? বাংলাভাষী পুলিশটা বলল গত সপ্তাহে এই এলাকায় একটা মাইক্রোবাস খাদে পড়ে মারাত্মক দূর্ঘটনা হয়েছে। আর সেই মাইক্রোবাসের সাথে ধাক্কা লেগে দুজন মহিলা আহত হয়েছে। ঘটনাটা আবার দেখেছে এই এলাকারই একজন বয়স্ক লোক। লোকটির মাধ্যমে আবার জানা গেল আহত হওয়া মহিলাদের সাথে একজনকে তিনি চেনেন। সেই একজন আনতুং আর তাই পুলিশ তাকে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করতেই সে জানালো বাকি দুজন কে কে। আসার পথে সেই প্রতিবেশী মেয়েটির সাথেও কথা বলে এসেছে তারা। বাকি রইলো মেহউইশ তাই এখন এখানে আসা। পুলিশ দেখেই তো মেহউইশের হাত পা ঠান্ডা হয়ে এসেছে। রিশাদ পুলিশের সাথে কথা বলে বুঝলো এটা সামান্য ইনকোয়ারি মাত্র। ভয়ের কিছুই নেই কিন্তু মেহউইশ কিছুতেই সামনে আসতে চাচ্ছে না। বাধ্য হয়ে রিশাদ করিডোরে উঠে তার বাহু ধরে টেনে আনলো পুলিশদের সামনে। আসার সময় ফিসফিস করে বলল, ‘ওরা শুধু জানতে চাইবে সেদিন রাস্তায় কি হয়েছিলো। এমন লুকিয়ে থাকতে চাইলে ধরে নিবে গাড়িটা তুমিই খাদেই ফেলেছো।’ শুকনো ঢোক গিলে মেহউইশ একবার রিশাদের দিকে তাকিয়েই শান্ত হয়ে দাঁড়ালো সবার সামনে। মনে মনে বলছে আমি তো এই লোকের বউ আমাকে কি পুলিশ নিতে পারবে? ভয়,ডর সব নিমিষেই পালিয়ে গেল যখন দেখল রিশাদ ঠিক তার পাশাপাশি দাঁড়িয়ে কঠিন স্বরে পুলিশদের বলল, ‘কি জানতে চান বলুন।’
রাতের খাবারের পর রাইমা অনেকক্ষণ চেষ্টা করলো মা’কে ফোন করার। কিন্তু এখানে নেটওয়ার্ক পাওয়া মুশকিল কল ঢুকতেই আবার কেটে যায়। পরপর অনেকবার ট্রাই করে না পেয়ে মেসেজ সেন্ড করলো। নেট পেলেই মেসেজ পৌঁছে যাবে সে আজ এখানেই থাকছে। আনন্দে আটখানা রাইমা, রেহনুমা দুজনেই৷ রাতভর আজ গল্প করে কাটাবে বলে ঠিক করেছে দুজনেই আর তা শুনে মেহউইশ বলল, আমি কি যুক্ত হতে পারি আপনাদের গল্পে? রাইমা বলতেই যাচ্ছিলো যাবে যুক্ত হওয়া কিন্তু রেহনুমা তার আগেই বলল, ‘নাহ। আমাদের পারিবারিক অনেক পুরনো কথা আছে বলার,শোনার।’ মেহউইশের মন খারাপ হলো কথাটা শুনে। ফ্যাকাশে মুখ করে একটুখানি হেসে বলল ওহ আচ্ছা! মেহউইশ চলে গেলেই রেহনুমা উঠে নিজের দরজা লাগাতে লাগাতে বলল, ‘ মেহউইশ আর রিশাদের মধ্যে কিছুই ঠিক নেই আমার মনে হয় এমনটা।তাদের একসাথে থাকাটাই বেশি জরুরি। যতবেশি সময় তারা পাশাপাশি থাকবে ততোটাই ভেতরকার রাগ,ক্ষোভ মেহউইশের মন থেকে দূর হবে। ভালোবাসা, ভালোলাগা না হলেও একটা অভ্যাস তৈরি হোক দুজনের ভেতর তাতেও জীবন একসাথে কাটিয়ে দেওয়া সহজ হবে।’ রাইমা চুপচাপ শুনলো ফুপির কথা৷ ফুপি কি জানে মেহউইশের সাথে দাদাভাইয়ের বিয়েটা কেমন করে হয়েছে! রাইমার ভাবনার কথা বাস্তব করে দিয়ে রেহনুমাই বলল, ‘আমাকে রিশাদ নিজেই বলেছে সব।কারো অসহায়ত্বকে নিজের শক্তি করা কখনোই সঠিক কাজ নয়। রিশাদ যা করেছে তা অন্যায়, খুব বড় অপরাধ। কিন্তু সেই অপরাধ মাফও হয় যদি অপরাধকারী নিজের অপরাধ বুঝতে পারে এবং তার প্রায়শ্চিত্ত করে। আর রিশাদ তো চাইছে নিজের ভুল শুধরে জীবনটাকে মেহউইশ আর নির্জনকে নিয়ে গুছিয়ে নিতে। কিন্তু এ পথে আবার রাশেদ ভাই আর নীলিমাই সব নষ্ট করতে উঠে পড়ে লেগেছে।’ রাইমা চুপচাপ কথা শুনছে আর গভীর মনযোগে ফুপুকে দেখছে। এই মহিলাটি তাদের রক্ত! চেহারা,নাক,মুখ এমনকি গায়ের রঙটাও একই রকম তাদের পরিবারের সবার। শুধু তার মা আর ভাবীরা অন্যরকম কারণ তারা অন্য বাড়ির।
নির্জন ঘুমাচ্ছে না আজ এখনও। এমনিতেই সে মাঝরাতে উঠে কান্না করে খিদে পেলে। আজ এখনও ঘুমাচ্ছে না বলে বিরক্ত হলো রিশাদ৷ এইটুকুনি বাচ্চা এখনি কেন এত রাত জাগবে! মেহউইশ মন খারাপ করে ঘরে ফিরে দেখলো রিশাদ ছেলেকে একবার কাঁধে ধরছে তো একবার পায়ে বালিশ রেখে তাতে রাখছে। মেহউইশকে ঘরে আসতে দেখে রিশাদের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। সে আর পারছে না তাই ভাবছিলো মেহউইশকে বলবে একটু যেন নির্জনকে কোলে নেয়। কিন্তু তার মুখের বিবর্ণতা চোখে পড়ায় আর কিছু বলল না। নিজেই বিছানা ছেড়ে নির্জনকে কাঁধে ফেলে ঘরময় পায়চারী করতে লাগলো। মেহউইশ অন্যমনস্ক হয়ে বিছানা গুছিয়ে চুপচাপ রিশাদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো । রিশাদ তার দিকে ভালো করে তাকানোর আগেই সে নির্জনকে টেনে নিলো রিশাদের কোল থেকে। কি হলো কে জানে সে নির্জনকে পায়ের উপর বালিশ রেখে শুইয়ে পা নাড়তে লাগলো। পাঁচ,দশ করে ঠিক পনেরো মিনিট পরই দেখলো নির্জন ঘুমিয়ে পড়েছে। রিশাদ ঘরে থাকা একটি চেয়ারে পা তুলে বসেছিলো নির্জনের ঘুমিয়ে পড়া দেখে সেও ঘুমাতে বিছানায় এলো। এ কি! মেহউইশ নিজেও শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে নির্জনের পাশে। রিশাদ কম্বলটা ভালো করে ছড়িয়ে দিলো মেহউইশের আর নির্জনের উপর। নিজেও শুয়ে পড়লো পাশে। ঘুমন্ত মেহউইশের মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে গেল কোমরে শীতল স্পর্শ পেয়ে। শিউড়ে উঠলো গা মেহউইশের চোখ দুটো ভয়ার্ত চাহনি নিয়েই তাকালো সামনে৷
চলবে
(কালকে আপনাদের এত এত মন্তব্য আর ভালোবাসা পেয়ে আমি সত্যই বিমোহিত। আর সবার মন্তব্যে রিশাদকে এত পরিমাণ চাওয়া দেখেও অবাক। ভালোবাসা সবার জন্য সবাই ভালো থাকবেন। ইয়ে মানে বলছিলাম কি,, গল্প শেষে রিভিউ পাওয়ার আশা কি রাখতে পারি?)