মন গহীনের গল্প পর্ব- ২৬

0
1029

#মন_গহীনের_গল্প
পর্ব -২৬
#রূবাইবা_মেহউইশ
💞

পাতা ঝরার মৌসুম, ত্বকের পানি শূন্যতাও বুঝি হয় এই মৌসুমটাতেই! বিরক্তিমাখা স্বরে বলল মেহউইশ। মাত্রই আয়নার সামনে বসে লোশন মাখছিলো হাতে সে। পাহাড়ের বুকে আজ সন্ধ্যেটাই যেন খুব ধীরে নামলো। কারণ কি? মেহউইশ কি আজ মনে মনে রিশাদের বাড়ি ফেরার অপেক্ষা করছিলো একটুখানি! হয়তো করেছিলো তাই তার সময়ের এত ব্যবধান অনুভব হচ্ছে। সেই যে তিশমাকে দেখলো তখন থেকেই বিড়বিড় করে কথা বলছে। রিশাদকে বকছে আবার নিজেকেও বকছে কেন আজ সে রিশাদকে ভাবছে এত! যেখানে খুশি যাক ওই লোক, যার কাছে থাকুক তার কি! ওই নায়িকার কোলে বসে থাকুক গে সে কেন ভাববে এসব! বলেই আয়নায় তাকিয়ে নিজেই নিজেকে ভেংচি কাটলো। হঠাৎ মনে হলো দরজার কপাট নড়েছে। চকিতেই তাকালো সে কিন্তু নাহ, দরজায় কেউ নেই। ঠান্ডার তীব্রতা বাড়ার আগেই নির্জনকে গরম কাপড় পরাতে হবে। আয়নার সামনে থেকে সরে গেল মেহউইশ। ঘরে হেয়ার ড্রায়ার আছে সেটা দিয়েই প্রতিদিনকার মত নির্জনের কাপড় গুলোকে হালকা একটু গরম করে তাকে পরাতে লাগলো। বাইরে থেকে রেহনুমার গলা শোনা গেল এ ঘরেই আসছে সে।

‘রিশাদ, তোর কফি হয়ে গেছে এই নে,,,’ বলে ঘরে ঢুকতেই সে দেখলো ঘরে রিশাদ নেই।
‘রিশাদ কই?’

‘হোটেলে’ মেহউইশ জবাব দিলো।

‘আবার গেল! তো কফি চাইলো কেন?’ বোকা বনে গেল যেন রেহনুমা।

‘আবার গেল মানে? বাড়িই তো আসেনি।’

‘একটু আগেই তো এলো।’

‘ফুপি কফি হয়েছে?’ বলতে বলতেই রিশাদ এসে ঘরে ঢুকলো।রেহনুমা কফি তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘ জিরিয়ে নাও। তারপর আমার ঘরে একটু এসো।’ রেহনুমা কফির মগটা দিয়েই বেরিয়ে যাচ্ছিলো রিশাদ তাকে থামিয়ে দিলো।

‘ফুপি একটু দাঁড়াও আমার একটু কথা আছে।’

‘কথা আমারও আছে কিন্তু আগে তুমি কফি খাও,ফ্রেশ হও তারপর। ততক্ষণে আমি রাতের খাবারের ব্যবস্থা করি।’

আঁড়চোখে মেহউইশ বারকয়েক রিশাদের দিকে তাকালো। আজ কোট পড়ে গিয়েছিলো কিনা বাড়ি থেকে তার জানা নেই৷ কিন্তু এখন উলের গলাবন্ধ সুয়েটার পড়ে আছে। চমৎকার তো এই সুয়েটারটা! এমন একটা সুয়েটার সে দেখেছিলো কোরিয়ান এক্টর লি মিন কে সেম সুয়েটার কিন্তু সেটা কচি লেবু রঙের ছিলো আর রিশাদেরটা পাকা বুড়িয়ে যাওয়া লেবুর হলদে রঙ। আরে বাহ্ মেহউইশ তুই তো খুব ভালো রঙ চিনিস! বলেই মেহউইশ মনে মনে নিজেকে বাহবা দিলো। এদিকে রিশাদ কফি শেষ করে কাপড়ও বদলেছে তার সেদিকে খেয়াল নেই। কুয়াশায় ঘেরা অন্ধকারে হিম বাতাসে দূর থেকে ভেসে আসছে তিতিরপাখির ডাক৷ এ রাতেও তিতির ডাকে! মেহউইশ ভুলেই গেছে আজ সারা বিকেল সে বকে বকে রিশাদের পিন্ডি চটকেছিলো। রিশাদ মুখ হাত ধুয়ে কাপড় ছেড়ে পুনরায় গরম কাপড় পরে মেহউইশের মুখোমুখি বসলো। হতচকিত মেহউইশ রিশাদের এমন কান্ড দেখে কিন্তু কিছু বলল না। তারা এমনিতেও কথাবার্তা স্বাভাবিকভাবে একদিনও বলেনি। প্রয়োজনের বাইরে তো নয়ই। নির্জন হাত পা ছুঁড়ে রিশাদের দিকে গা এলিয়ে দিচ্ছে বারবার তা দেখে সে ছেলেকে একটানে কোলে তুলে নিলো। কপালে,মুখে অনবরত কয়েকটা চুমু খেয়ে মেহউইশের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমরা কাল সকালে কক্সবাজার চলে যাবো।’ মেহউইশ চুপচাপ শুনলো কিন্তু কোন প্রতিত্তোর করলো না৷ রিশাদ আবার বলল, ‘আমরা হয়তো তিন মাস থাকবো সেখানে তাই প্রয়োজনীয় সব জিনিস নিয়ে যেতে হবে ইনফ্যাক্ট সেখানে আমরা ছোট খাটো একটা সংসারই গড়ে তুলবো।’ এতক্ষণে মেহউইশের স্বাভাবিক চেতনা অস্বাভাবিক হলো। তার চক্ষু দুটোই অতি মাত্রায় বড় হলো। আশ্চর্যজনক ভাবে তার বন্ধ মুখ ‘হা’ হয়ে গেল। সন্ধ্যে থেকে লাগা শীতটা এবার যেন উত্তেজনায় একদমই কেটে গেল৷ সে অনুভব করলো তার শীতল নাক আর কান দুটো ধীরে ধীরে গরম হয়ে যাচ্ছে। এটা কি সত্যি! এ জীবনে সে কখনো পাহাড়,সমুদ্র দেখতে পারবে কিনা তা নিয়ে বরাবরই ভাবতো আর মন খারাপ করতো৷ কিন্তু একি! গত বিশ,বাইশ দিন ধরে সে পাহাড়ে থাকছে এখন কিনা আবার কক্সবাজারে? ভাবতেই মনে মনে শিহরণ জাগছে। চমকপ্রদ জীবন তাকে আরো কত কত চমক দিবে আল্লাহ জানে! খুশিতে একবার মনে হলো সে রিশাদকে একটু জড়িয়ে ধরবে আবার মনে হলো বাড়াবাড়ি হবে। দরকার কি এসব ঢংয়ের? লোকটা তো নিজ স্বার্থে নিয়ে যাবে নিশ্চিত। কি অসভ্য বিয়ে করেছে এখন হানিমুন করার জন্য আবার কক্সবাজারে নিয়ে যেতে চায়? হানিমুনের কাজ তো বদমাশ তুই আগেই করেছিস আর কি চাস! মেহউইশের বিষ্মিত মুখের ভাব এবার বদলে গিয়ে রাগী রাগী মনে হলো। রিশাদ অপলক তাকিয়ে আছে মেহউইশের দিকে আর মেহউইশের আদল বারবার পরিবর্তন হচ্ছে তা দেখছে। নির্জন মুখে অদ্ভুতরকম শব্দ করছে কিছু আবার সোজা বসবারও চেষ্টা করছে। মেহউইশের হুঁশ এলো সে রিশাদের মুখোমুখি বসা তাই উঠে গেল বসা থেকে নিঃশব্দে।

‘যা বললাম আশা করি মাথায় ঢুকেছে। ফুপিকে একটু পরই জানাবো। তোমার যা যা নেওয়ার গুছিয়ে নাও। নির্জনের কাপড়চোপড়, খেলনা, খাবার সেগুলো আমি গুছিয়ে নিবো।’ রিশাদ কথা শেষ করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। মেহউইশ ভাবনায় পড়লো এবার কি নেবে কি নেবে না! একদিকে মুক্তি নির্জনের কাজ লোকটা নিজেই করবে।

জেবুন্নেসা আবার চলে গেছে বাপের বাড়ি৷ তার নিজের নামে যে সম্পত্তি আছে তার বাবার বাড়িতে তাই দিয়ে সে তার খরচ চালাতে পারবে কিন্তু সমস্যা হলো রিহান,রাইমাকে নিজের কাছে নিলে সম্ভব হবে না কিছু। দামী স্কুল,কলেজে পড়ে তারা সে খরচ বহন করে কত বছর ঠিকঠাক চলবে ধারণা নেই। তবে তার নিজের গাড়িটা বিক্রি করলে যা টাকা আসে তা ব্যাংকে ডিপোজিট রাখা যাবে আবার একটা চাকরি করলে হয়তো একদমই টাকা পয়সায় হিমশিম খাবে না। কিন্তু! এখানেও কথা থাকছে তার বয়স নিয়ে। চল্লিশ পেরিয়েছে বয়সটা আবার চুলেও দু, একটা রঙবদল হয়েছে৷ এ বয়সে সরকারি চাকুরি তো দূর বেসরকারীতেও সুযোগ কতটুকু পাবে সন্দেহ৷ বাগানে বসে বসে এসবই ভাবছে সে সেই সন্ধ্যে থেকে। ঢাকায় শীত নেই নেই করেও গত দু দিনে ভালোই ঠান্ডা পড়েছে। বৃষ্টিও হয়েছে একটু আধটু আর তাতেই গায়ে পশম কাঁটা দিয়ে উঠছে। এ বাড়িতে একমাত্র ভাইয়ের ছেলে মেয়েরা কেউ থাকে না। জেবুন্নেসা এসেছে বলে তার ভাই অনেক খুশি৷ বড় ভাই আর ভাইয়ের বউ আর তাদের কিছু চাকর বাকর নিয়েই সংসার। ছেলে,মেয়ে সবাই বিদেশে স্যাটেল আর তাই বাবা মাকে মাসে মাসে দু হাত ভরে টাকা পাঠায় তারা, যা তার ভাইয়ের আর ভাবীর জন্য অনেক। রিহান এলে তার মামা খুব খুশি হয় কিন্তু রিশাদ আসে না এখানে। জেবুন্নেসা ভাবছে ভাইকে বলে রিহানের কোন একটা ব্যবস্থা করা দরকার তারপর রাইমাকে না হয় নিজের কাছে এনে রাখবে। বড় হয়ে যাচ্ছে মেয়েটা কিন্তু বিয়ের সময় হলে রিশাদ আর তার বাবাকেই লাগবে বেশি। দোটানায় ভুগছে জেবুন্নেসা ছেলে মেয়ের ভবিষ্যত নিয়ে যেখানে নিজেরই বসতি নড়বড়ে হয়ে গেল সেখানে তাদের জন্য কি করা উচিত বুঝে পায় না৷

ফুপুর ঘরে ঢুকতেই রিশাদকে তার ফুপু প্রশ্ন করে, ‘ মেয়েটা কি শুধু তোমার বন্ধুই?’

‘কোন মেয়েটা!’

‘ভিডিও কলে যাকে পরিচয় করালে।’

‘ওহ, তিশমা! তোমাকে তো বললামই আমার বান্ধবী সে।’

‘এত ফালতু মেয়ে তোমার বান্ধবী হয় কি করে বুঝি না’ বলেই রেহনুমা নিজের বিছানার কম্বলটা ছড়িয়ে দিলো। রিশাদ খাটে উঠে কম্বলের নিচে পা ঢুকিয়ে বসতে বসতে বলল, ‘ ফালতু বলছো কেন ফুপু? ও খুব ভালো মেয়ে।’

‘ভালো না ছাই! একটা সালাম পর্যন্ত দিতে পারে না ঠিকঠাক । আর ওই মেয়ে এত গায়ে পড়া কেন?’ রেহনুমার চোখ,মুখ কু্ঁচকানো দেখে রিশাদ বেশ অবাক হলো। সে নির্জনের আঙ্গুল নিজের আঙ্গুলে পুরে খেলতে খেলতে জিজ্ঞেস করলো,’কি হয়েছে ফুপু? তিশমা সত্যিই ভালো মেয়ে। ‘

‘থাক ভালো হোক কি মন্দ তা আমি আর জানতে চাচ্ছি না। আমি তোমার সুন্দর একটা পরিবার দেখতে চাই,আগেও চাইতাম যা আগে হয় নি। মেহউইশ খুব ভালো মেয়ে আর সে সংসার করবে মন দিয়েই তুমি যদি সৎভাবে সঙ্গ দাও।’

‘এসব বলছো কেন ফুপু ?’

‘কারণ, তোমার ওরকম অন্য মেয়েদের সাথে মেলামেশা তার খারাপ লাগতে পারে৷ বিয়েটা তো তুমি ভদ্রভাবে করোনি তাই না!’ এ পর্যায়ে রেহনুমার কথার ধরণ বদলে গেছে৷ কন্ঠস্বরও ভারী লাগলো রিশাদের, মনে হলো ইনি সত্যিই খান বাড়ীর মেয়ে তা কথা দিয়েই বুঝিয়ে দিচ্ছেন। রক্তের তেজস্বীভাব ফুটে উঠছে তার কথাতেই৷ রিশাদের হাসি পেল খুব ফুপুর রাগ দেখে।

‘ মেয়েটা তোমাকে ভালো না বাসলেও তোমার সংসার করবে। তোমার ছেলেকে তো খুব যত্ন করেই আগলে রাখছে সময়ের সাথে সাথে তোমারও শুভাকাঙ্ক্ষী হয়ে তোমায় আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাইবে৷ তাই বলি সময় থাকতে নিজের আমানত যত্ন করে নিজের কাছে ধরে রাখা শেখো নইলে মরচে পড়তে সময় লাগবে না।’ রিশাদ সব শুনে এ ব্যাপারে আর কথা বলল না। তার ধারণা হয়ে গেছে ফুপু কি চান। এবার তার বলার যা সে বলল, ‘ ফুপু আমরা কাল থেকে হোটেলে থাকবো, তুমি।’

‘কেন?’

আমরা মাত্র দুই কি তিন মাস থাকবো তারপরই ফিরে আসবো এখানে৷

‘ভালো কথা যাও।আগেও তো ঢাকায় থাকতে আবার এই সিজনে হোটেলে৷ কিন্তু মেহউইশ আর নির্জনকে মাঝেমধ্যে নিয়ে এসো আমার কাছে ভালো লাগবে আমার৷’

‘আমার কথা বুঝতে পারোনি মনে হয়! আমি বলেছি তুমিও যাবে।’

সবার কাপড়চোপড় গুছিয়ে বিছানায় যেতে যেতে রাত প্রায় বারোটা বাজলো শীতের রাত যতোই বড় হোক না কেন ঘুমিয়ে আশ মেটে না প্রায় বেশিরভাগ মানুষেরই৷ মেহউইশ তো এমনিতেই ঘুম কাতুরে। রিশাদ ঘুমানোর প্রস্তুতি নিয়ে আলো নেভাতে গেলে দেখলো মেহউইশ আলাদা কম্বলে। জেবুন্নেসারা চলে যাওয়ার পর আর এ ঘরে মেহউইশের আলাদা কম্বল আর আনার ইচ্ছে ছিলো না। একই কম্বলে বেশ লাগছিলো সবাই একসাথে ঘুমাতে। রিশাদ নিজের কম্বল সরিয়ে একপাশে রেখে দিলো। ঘুমন্ত নির্জনকে মেহউইশের দিকে চাপিয়ে নিজেও একটু আগালো তারপর চুপচাপ মেহউইশের কম্বলে ঢুকে নির্জনসহ মেহউইশকে জাপটে ধরলো। এবার ঠিক আছে! উষ্ণতা এবার তিনজনকেই ছাপিয়ে যাবে। কিন্তু মেহউইশ কি তা হতে দেয়! তার চোখে এখনও ভাসছে তিশমার মুখ। ওই সুন্দরী, অপ্সরা রিশাদের গা ঘেঁষে কি করছিলো। বিড়বিড় করে সে অনুচ্চ স্বরে বলতে শুরু করলো, ‘লুচ্চামার্কা বেডা বাইরে মাইয়া দিয়া পোষায় না? আবার আমার গায়েও হাত দেয়।’ মেহউইশ যা বলেছে প্রতিটি কথায়ই রিশাদের কানে পৌঁছেছে। সে নিজের হাতটা মেহউইশের গা থেকে ধীরে ধীরে সরিয়ে নিলো। আলতো করে নির্জনকে বুকে নিয়ে নিজের কম্বল জড়িয়ে নিলো। মেহউইশের মুখটা মলিন হয়ে গেল, ফুঁপিয়ে কান্না উঠে এলো বুক থেকে। দূর থেকে ভেসে আসছে বাঁশির সুর । সেই সুরে কান্নামাখা আর্তনাদ যেন কত অভিমান নিয়ে হারিয়ে গেছে কারো প্রিয়জন । হুতুমের ডাকে চমকে উঠছে পাতার গায়ে লুকিয়ে থাকা কাঁচপোকারা, রাতের ঘুম তাদের হারিয়ে গেছে । বড্ড শূন্যতা রিশাদকে এই মধ্যরাতে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে,অভিমানের পাল্লা মেহউইশের মনে তার অজান্তেই তাকে ঘিরে ফেলছে।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here