এক_প্রহরের_খেলা মোর্শেদা হোসেন রুবি ১৮

#এক_প্রহরের_খেলা
মোর্শেদা হোসেন রুবি

১৮||

বেশ কয়েকবার চেষ্টা করার পর অবশেষে লাইন মিললো। রাজন নিজেই ফোন ধরেছে। আজাদের কণ্ঠ পেয়েই সে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বলল, ” আমার কোন দোষ নেই বস। লিটনের লোকজন যে আমাকে ফলো করে এ পর্যন্ত এসেছিল তা আমি পরে টের পেয়েছি। কিন্তু আপনাকে সতর্ক করার কোন সুযোগই পাইনি। তার আগেই ওরা আপনার পাশে অদিতিকে দেখতে পেয়ে এলোপাতাড়ী গুলি ছুঁড়ছিলো। হয়ত মেয়েটাকে মারতে চাচ্ছিলো ওরা। বস আপনার কোন ক্ষতি হয়নি তো।”
-” নাহ্, স্রেফ একটা গুলি লেগেছে। ”
-” কী বলেন বস? এখন কী অবস্থা আপনার।? ”
-” ভালো। আচ্ছা, এসব কথা বাদ থাক। এবার আমার দুটো কাজ করে দে।”
-” জি, বলেন বস।”
-” বস না, আজাদ ভাই বল।”
-” জি, বস্ মানে আজাদ ভাই।”
-” তোর কাছে অদিতির মোবাইল আছে না ? ”
-” জি বস…? ইয়ে মানে ভাই। ”
-” সেখানে ভি বাটন প্রেস করে ভেলিয়া আন্টি বের কর। তারপর সেই ভেলিয়া আন্টির নম্বরটা আমাকে…!”
-” বস্…ইয়ে আজাদ ভাই। লিটনের লোকজন আমার পকেট সার্চ করে অদিতিরটা সহ আমার মোবাইলও নিয়ে গেছে। বলে তোর বস টাকা দিলে ফেরত পাবি। বস, আমার ষাট হাজার টাকা দামের মোবাইল। শালারা ভাইগিরির ইজ্জত মারসে। শালা ছিঁচকে পকেটমার। ”
-” কী বলিস, অদিতির মোবাইল ওদের কাছে ? ”
-” জি, ভাই।”
-” ওহো..!” আজাদ এবার বেশ চিন্তায় পড়ে গেলো। চিন্তিত ভঙ্গিতে অদিতির দিকে তাকাতে দেখলো অদিতি নির্নিমেষে ওকেই দেখছে। আজাদকে তাকাতে দেখে দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলো অদিতি।
-” ভাই, আপনি এখন কোথায় ? এদিকে সবাই টেনশন করতিসে ? ”
-” এক মিনিট…!” বলে ফোন কান থেকে সরিয়ে অদিতির দিকে অসহায়ের মত তাকালো আজাদ, ” অদিতি, আপনার মোবাইল নেই। লিটনের লোকজন নিয়ে গেছে। কী করবেন এখন ? ”
অদিতি হতাশ চোখে তাকাল। কিছু না বলে হাত ওল্টালো সে। আজাদ ফোনটা ফের কানে ঠেকিয়ে বলল, ” আচ্ছা, রাজন, রুমকির কোন খোঁজ পাওয়া গেছে জানিস ? ”
-” জি ভাই। আপনার কাজিন সকালেই ফিরে এসেছে। সে হয়ত আজই তার স্বামীর সাথে ঢাকার বাড়ীতে ফিরে যাবে। তাগের বাড়ীতে বিরাট ধুম পড়েছে।”
-” অহ্, তাই নাকি ? যাক, খুব ভালো। ওর স্বামীর নাম্বারটা যোগাড় করতে পারলে আমার নাম্বারে সেভ করিস তো। লোকটার সাথে কিছু কথা বলা দরকার। ”
-” আচ্ছা, দেখি। যোগাড় করা যায় কিনা।” বলে কল কেটে দিলো রাজন। আজাদ ফোন বন্ধ করতে গিয়ে সন্তর্পনে দীর্ঘশ্বাস চাপতেই শুনল অদিতি বলছে,
-” মন খারাপ মনে হচ্ছে ?”
-” কেন? ” আজাদ চমকে তাকালো। অদিতির কণ্ঠটা যেন বিদ্রুপাত্মক শোনালো ওর কানে।
-” না মানে রুমকি বরের সাথে ফিরে যাচ্ছে আর আপনি আমার বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছেন।”
-” শোধ নিচ্ছেন তাই না ? ” আজাদ কোনো কিছু না ভেবেই হেসে ফেলল কিন্তু অদিতি রেগে গিয়ে বলল, ” কিসের শোধ ? ”
-” তখন আমি ঐসব বলেছি বলেই তো এসব বলছেন।”
-” জি, না। সেসব কিছু না। আপনি নিজেই বলেছেন রুমকি আপনার মায়ের ইচ্ছা। এখন আবার ওর স্বামীর নম্বর চাইছেন। অদ্ভুত না ? ”
-” না অদ্ভুত না। কারণ ওর স্বামীকে ফোন করব স্যরি বলার জন্য আর আমার অংশের না-দাবী নামা তাকে কুরিয়ার করব এবং ঐ জায়গার দখল ছেড়ে দেব আমি। এগুলো তো রুমকির সাথে আলোচনা করা যাবে না। সে হয়তো আমার ফোনই ধরবেনা। তারচে বড় কথা আমি নিজেই ওকে ফোন করবো না।”

অদিতি কিছু না বলে তাকিয়ে রইলো চুপচাপ। এরপর মৃদুস্বরে বলল, ” হঠাৎ এতোটা বদলে গেলেন কী করে।”
-” জানি না। ভালোলাগাগুলো হঠাৎ করে আপনা হতেই মন্দলাগায় রূপ নিয়েছে। আমি নিজে থেকে কিছু করিনি। আপনা থেকেই যা হবার হচ্ছে।” বলেই আজাদ ব্যস্ত ভঙ্গিতে ঘড়ি দেখে বলল, ” প্রায় ছ সাত ঘন্টা যাবৎ আমরা দুজনেই না খেয়ে আছি। সামনে দীর্ঘ একটা রাত আর লম্বা সফর। একটা হোটেলে থামা উচিত আমাদের। কী বলেন ? ”

অদিতি ঘোর কাটিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে মাথা ঝাঁকালো, ” জি, তা তো উচিত কিন্তু এখানে হোটেল কোথায়?”
-” এখানে নেই। তবে মাইল খানেক গেলে একটা বাজার পাবো আমরা। ওখানে হোটেল সহ অনেক কিছুই পাওয়া যাবে। আমার মোবাইলের চার্জও শেষের দিকে। একটা পাওয়ার ব্যাঙ্ক দরকার। আরো কিছু টুকিটাকি।” বলেই নিজের হিপ পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করল আজাদ। লিটনের কাটা চেকটা ভাঁজ করে রাখা। কিন্তু এটা খরচ করার ইচ্ছে নেই ওর। ওর টাকাটা ওকেই ফেরত দেবে আজাদ। কিন্তু কিভাবে সেটা এখনও ঠিক করেনি।”

মাইল দেড়েক আসার পরই একটা বাজারমত জায়গা পড়ল। আজাদ ওকে বসিয়ে রেখে বাইরে বেরুল। ওর ইচ্ছে সে নিজে আগে দেখে এসে পছন্দ হলে তারপরেই অদিতিকে নিয়ে যাবে। এটা বলেই বেরুলো সে।
অদিতি ড্রাইভিং সিটে বসে মন দিয়ে বাইরের দোকান পাট দেখতে লাগলো। জায়গাটা ওর জন্য নতুন। এর আগে এদিকটায় কখনো আসেনি। সারি সারি দোকানপাট। সব্জির দোকান থেকে শুরু করে সেলুন, মাংসের দোকান, ফোন ফ্যাক্স ফটোকপি সহ সবরকমের দোকানই আছে এখানে। দেখতে দেখতেই অদূরে একটা ভাঙাচোরা সাইনবোর্ডের ওপর হঠাৎ চোখ আটকে গেল অদিতির। সাইনবোর্ডের দিকে তাকিয়ে থাকতে গিয়ে কয়েক সেকেন্ডকে কয়েক যুগ মনে হলো যেন। স্টিয়ারিং এ হাত রেখে ঠোঁট মুড়ে ভাবতে লাগল এবার। দুচোখ বন্ধ করে মাথাটা স্টিয়ারিং এ ঠেকাল। যোগবিয়োগ কষে সিদ্ধান্ত নিতে মাত্র তিন মিনিট সময় নিলো অদিতি। আর তারপরই ছোঁ মেরে ড্যাশবোর্ডের উপর রাখা রিভলবারটা চট করে নিজের পার্সে পুরে নিলো। ঠিক একই সময়ে আজাদ উঁকি দিল গাড়ীর জানালায়। রীতিমত চমকে গিয়েছিলো অদিতি। ধরা পড়া ভঙ্গিতে হাসলেও আজাদ ওর ভ্যাবাচ্যাকা ভাবটুকু ধরতে পারলো না। হয়ত বাইরের উত্তেজনায় এদিকে মন দেবার সময় পায়নি। সে বাম হাতের ইশারায় অদিতিকে ডাকলো, ” অদিতি, আসুন। এখানে ভালো একটা হোটেল পাওয়া গেছে। আর বোরকাটা দিয়ে নিজেকে কভার করে নিন। প্রচুর আজেবাজে লোকজন এখানে। বাজার তো…!”
অদিতি নিকাবের আড়াল থেকেই দ্বিতীয়বার তাকালো আজাদের দিকে। ওর মুখের উপর এখন পাতলা ফিনফিনে কালো পর্দা দেয়া। পার্সটা আঁকড়ে ধরে গাড়ী থেকে নামলো সে। আজাদের পেছন পেছন হোটেলের ভেতর গিয়ে ঢুকলে আজাদ ওকে পর্দা ঘেরা একটা ছোট্ট কেবিন দেখিয়ে দিলে অদিতি নিঃশব্দে সেখানে প্রবেশ করল। ছোট্ট একটা টেবিলে মুখোমুখি দুটো চেয়ার। অদিতি বসতে গিয়েও থেমে গেল।
-” আমি একটু ফ্রেশ হতে চাচ্ছি। এখানে মেয়েদের বাথরুম নেই ? ”
-” আছে তো মনে হয়। চলুন, দেখিয়ে দিচ্ছি।”
-” না না। আপনাকে আসতে হবেনা। আপনি এখানেই বসুন। আমি একাই পারবো। তাছাড়া বাইরে তো কত মেয়ে দেখলাম।” বলে অদিতি পার্স সাথে নিয়েই বেরুল।
আজাদ ততক্ষণে মোবাইলে মনোযোগী হয়ে পড়েছে। মা ফোন করেছে। তার কণ্ঠে ক্ষোভ ঝরে পড়ছে যেন,” তুই এসব কী শুরু করেছিস বলবি ? ”
-” কেনো, কী করেছি আমি ? তাছাড়া কিছু করলে তো রুমকি বাড়ী ফিরতো না। শুনেছো তো সে যে বাড়ী ফিরেছে ? ”
-” রুমকির কথা কে বলছে। তুই নাকি রুমকির স্বামীর সাথে কথা বলে ওকে তোর অংশ দিয়ে দিবি? ”
-” কে বললো এসব ? রাজন? ” আজাদ বিস্মিত। রাজনকে তো সে এটা খুলে বলেনি। রাজন বুঝলো কিভাবে !
-” সে ছাড়া আর কে ? এসবের মানে কী বলবি ? ”
” মানে কিছুই না। কিন্তু এইমুহূর্তে তোমাকে এতকথা ফোনে বোঝাতে পারবো না মা। ঐ জায়গা নিয়ে আমার এমনিতেও কোন আগ্রহ নেই। তাছাড়া আমি সবকিছু অন্যরকম করে ভাবতে শুরু করেছি। আমার অংশটা আমি আবদুল্লাহ মামার জন্য ছেড়ে দিতে চাই।”
-” কিন্তু কেন ? এই বাজারে ঐ জায়গার দাম কত তুই জানিস ? ”
-” জানি। এও জানি জায়গাটা নানু আমাকে আর রুমকিকে দিয়েছিলো এক ঘাটে ভেড়াবার জন্য। ভাগ্য আমাদের দুই ঘাটে বেঁধেছে কাজেই ঐ জায়গা আমি এমনিতেও ছেড়ে দিতাম। মনে করো রুমকির বিয়েতে এটা গিফট করলাম।”
-” তোর কী হয়েছে বলতো। এরকম ছন্নছাড়াদের মত কথা বলছিস কেন ? ”
-” কারণ আমি ছন্নছাড়া। রাখি মা, তোমার সাথে এ নিয়ে পরে কথা বলবো।” বলে ফোনটা কেটে দিতেই বুকটা হঠাৎ ছ্যাঁৎ করে উঠল আজাদের। নিজের নির্বুদ্ধিতার জন্য মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে হলো। গোলাকার ধাতব একটা নল ওর পেছন দিয়ে পিঠে ঠেকিয়েছে কেউ। আর সেটা যে পিস্তলের তা আজাদের চেয়ে ভালো কেউ জানবে না। নলটার চাপে শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত নামলো। একচুল না নড়ে স্থির বসে রইল আজাদ।
ঘাড় না ফিরিয়েই রূঢ় স্বরে বলল, ” কে তুমি ? ” বলে দ্বিতীয় দফায় চমকে উঠল অদিতির অন্যরকম কণ্ঠ শুনে।
একটা কণ্ঠ ফিসফিসিয়ে বলছে, ” আমি অদিতি। একচুল নড়লে পিঠ ঝাঁঝরা করে দেব আজাদ মুনতাসির। তোমার পুরো নাম আমি আগেই জেনেছি। য়্যু আ’ আন্ডার আরেস্ট। ”
আজাদের বিস্ময় এবার মাত্রা ছাড়ালো। বোধকরি বাজ পড়লেও এতোটা ঘাবড়াতো না। তবু সে ঐ ভাবেই সহজ সুরে বলতে চেষ্টা করলো, ” অদিতি কী হচ্ছে এসব ? ফান করার জায়গা এটা নয়।”

-” শাট আপ। ফান না কী তা শ্বশুরবাড়ী ঢুকলেই টের পাবে। স্ট্যান্ড আপ। খবরদার চালাকির চেষ্টা না।” বলে ধাতব নলটা আধা ইঞ্চি প্রায় দাবিয়ে দিলো মেরুদন্ডের পাশ দিয়ে। আজাদ দ্রুত ভাবতে চেষ্টা করছে। কিন্তু মাথা কাজ করছে না। শ্বশুরবাড়ী মানে কী ! হাজত ? তারমানে অদিতি পুলিশের ইনফরমার ? নাকি সে লিটনের চর ? কোনটা? নাহ্, মাথাটা হ্যাং হয়ে গেছে। অদিতির নির্দেশ মেনে রোবটের মত বাইরে চলে এলো আজাদ।

রাত এখনও পুরোপুরি নামেনি। চারিদিক আঁধার করে এলেও এদিকটায় বাজার বলে দোকানপাটের আলোয় চারপাশ উজ্জ্বল হয়ে আছে। অদিতি আসলে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে ওকে ! আজাদ কোন প্রশ্ন না করে শান্ত ভঙ্গিতে হেঁটে চলল। অদিতি বোরকার ভেতর দিয়ে পিস্তল ঠেকিয়েছে ওর পিঠে। তাই বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই। দেখলে মনে হবে দুজন মানুষ একসাথে হেঁটে যাচ্ছে।

মুখ তুলে ছাদের নিচে আটকানো সাইনবোর্ডটা আরেকবার দেখে নিশ্চিত হলো অদিতি। তারপর কাঠের দরজা ঠেলে ঢুকে পড়বার আগে আজাদকে নলের গুঁতা দিতেই সে আগে প্রবেশ করলো। পেছনে অদিতি। রুমটায় একটা বড় টেবিল। তাতে বেশ কিছু কাগজপত্র। চেয়ারের পেছনে যে লোকটা বসে আছে তার বয়স পঞ্চাশের কিছু ওপরে হবে। কাঁচাপাকা দাড়ী। পান খাওয়া লাল মুখ। সাদা পাঞ্জাবী পরে বসে কী যেন লিখছেন। অদিতিদের দেখে তাকালেন। ইশারায় চেয়ার দেখিয়ে বসতে বললে অদিতি সন্তর্পনে পিস্তল সরিয়ে ব্যাগে রেখে দিয়ে একটা চেয়ারে বসলো। আজাদ বিস্ময় তখনো কাটেনি উল্টো বেড়েছে। সে একবার মুখ ঢাকা অদিতিকে আরেকবার সাদা পাঞ্জাবী পরা লোকটাকে দেখলো। লোকটা ঘরের এককোণে পানের রস ফেলে বললেন, ” সাক্ষী কই ? ”
আজাদ বিভ্রান্তের মত তাকিয়ে রইলো অদিতির দিকে। পুরো ব্যপারটা বুঝতে তার মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মত লাগলেও বিশ্বাস হচ্ছিলো না। আর তখনই প্রশ্নটা শুনলো, ” আপনার হাত তো বন্ধ। সই করবেন কিভাবে ? ”

আজাদ অদিতির দিকে তাকিয়ে এবার মৃদু স্বরে বলল, ” যেভাবে পারব সেভাবেই করব। না পারলে বাম হাত দিয়ে। তাতেও কাজ না হলে আঙ্গুলে কালির ছাপ দিয়ে করবো । চলবে?” সাদা পাঞ্জাবির দিকে তাকালো আজাদ। মাথার ভেতরটা হালকা লাছে ওর। স্বপ্ন দেখছে না তো। এক্ষুণি গাড়ীর ঝাঁকুনি তে ঘুমটা ভেঙ্গে যাবেনা তো !

-” আচ্ছা, ঠিকআছে। বসেন।”
নতুন ফর্ম বের করে তাতে লিখতে শুরু করলেন সাদা পাঞ্জাবী পরা লোকটা। আজাদ সেসব দেখছেনা। সে দেখছে অদিতিকে। যদিও তার আপাদমস্তক কালো কাপড়ে ঢাকা। দেখাই যাচ্ছেনা মেয়েটাকে। ঐ ছাইচাপা আগুনের খবর কেবল আজাদই জানে। যার আঁচ একটু আগেও টের পেয়েছে আজাদ। আর অদিতি ! সেই যে মুখ নামিয়েছে তার আর মুখ তোলার নাম নেই।

সাক্ষী যোগাড় হলো কাজী অফিস থেকেই। একজন কাজী সাহেবের ছেলে আরেকজন সেই অফিসেরই স্টাফ। সইসাবুদ শেষে স্থানীয় মওলানা দোয়া কালাম পড়ে বিয়ে পড়ালেন। তারপর নাতিদীর্ঘ মুনাজাত শেষে বরবধূকে দোয়া করে বিদায় নিলেন তিনি। আজাদ নিজেই পকেট থেকে টাকা বের করে পিয়ন ছেলেটাকে দিয়ে বাজারের সবচে ভালো মিষ্টিটা আনিয়ে সবাইকে দিতে বলল। এই সময়টুকুর মধ্যে অদিতি একটা কথাও বলেনি কবুল আলহামদুলিল্লাহ বলা ছাড়া। এমনকি তাকায়নি পর্যন্ত। সম্পূর্ণ কাজ শেষ হলে আজাদ নিজেই বললো, ” অনেক খিদে পেয়েছে।”
অদিতি চমকে তাকালে আজাদ বললো, ” একটু আগে যেখানে খেতে গিয়েছিলাম সেখানেই চলো যাই ? ”

অদিতি বাধ্য মেয়ের মত মাথা নাড়ল। দুজনে কাজী অফিস থেকে বেরিয়ে ফের আগের হোটেলটাতে ঢুকল তবে আগের কেবিনটা খালি পেলো না। অন্য এক দম্পতি ওটা দখল করে বসেছে। আজাদ বলল, ” এক কাজ করলে কেমন হয়। খাবার প্যাকেট করে নিয়ে গাড়ীতে বসে খাই চলো। এখানে খোলা টেবিলে তুমি মুখ তুলে খাবে কিভাবে? ”

আজাদের অনায়াসের তুমি ডাক অদিতিকে ক্ষণে ক্ষণে বিহ্বল করে দিচ্ছিলো। সে এবারও মাথা নাড়লে আজাদ দুজনের জন্য খাবার আর পানি কিনে গাড়ীতে চলে এলো। অদিতি ড্রাইভিং সিটে উঠে বসলে আজাদ অপর পাশ দিয়ে উঠে বসল। গাড়ীর দরজা বন্ধ করার সাথে সাথেই চারপাশের কোলাহলমুখর পরিবেশটা হঠাৎ করই নিরব হয়ে গেল। আজাত খাবারের প্যাকেটটা ড্যাশবোর্ডের উপর রেখে এবার অদিতির দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। অদিতি এখনও মুখের ওপর থেকে পর্দা সরায়নি। এত লজ্জা সে কাকে পাচ্ছে ! আজাদকে ? একটু আগেই তো আজাদের আত্মা উড়িয়ে দিয়েছিলো আর এখন ভয় পাওয়া দেখানো হচ্ছে !

আজাদ কপট গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ” রিভলবারটা কোথায় ? ”
-” জি….? ব্যাগে।” শান্ত ভঙ্গিতে উত্তর দিলো অদিতি।
-” ব্যাগে তো বুঝলাম। ওটা তোমাকে কেন দিয়েছিলাম, নিজেকে সেইফ করার জন্য।”
-” আপনাকে মারার কথাও তো বলেছিলেন। বলেছিলেন বেঁচে থাকার ইচ্ছে মরে গেছে।”

আজাদ খানিক চুপ থেকে এবার হা হা করে হেসে উঠতে গিয়েই হাতের ব্যথায় কুঁকড়ে গেলে অদিতি দ্রুত নিকাব তুলে বললো, ” কী হলো। এতো জোরে হাসে কেউ? ”
-” আমার যে পাগলের মত হাসতে ইচ্ছে হচ্ছে…!”

অদিতি একহাতের টানে নিকাব খুলে ফেলে বলল, ” সব ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিতে নেই।”
-” তুমি দিলে যে? ”
-” এটা আমার ইচ্ছের চে বেশী প্রয়োজন। অস্বীকার করব না।”
-” তারমানে আমাকেও শাহানের মতো বেছে নিয়েছো শুধু নিজের নিরাপত্তার স্বার্থে? ” আজাদের কণ্ঠে ওটা অভিমান না অস্বস্তি বোঝা গেলো না।

অদিতি মাথা নাড়ল, ” জি না, ঠিক এমনটা না। তবে আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি এমনটাও বলোবো না কারণ এতো অল্প সময়ে কাউকে বোঝা যায় না। আসলে আপনার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ।”
-” কৃতজ্ঞতা প্রকাশের নমুনা কী এই? ”
-” কেন, আমাকে পছন্দ নয় আপনার ? ” চিরল চিরল চোখের পাপড়ী মেলে দিয়ে জানতে চাইল অদিতি।
আজাদ সেদিকে তাকিয়ে ঘোরলাগা কণ্ঠে জবাব দিলো, ” এখন না বললেই বা কী। গলায় তো ঘন্টা বাঁধা পড়েই গেলো।”
-” ওহ্, তাহলে আমি ঘন্টা ? ” অভিমানে গাল ফোলালো অদিতি। বলল,” আমার তো মনে হয়েছিলো আমাকে আপনি পছন্দ করেন।”
-” এটা আসলে তোমার একার না। এটা সব মেয়েদের একটা কমন সমস্যা। কেউ একবারের জায়গায় দুবার তাকালো কী দুটো নরম কথা বললো, ব্যস্ তারা ধরেই নেবে ঐ ছেলে ওর জন্য পাগল।”

অদিতি আহত চোখে তাকালো। আজাদ সেটাকে পাত্তা না দিয়ে বললো, ” নাও কী আর করা। পিস্তল ঠেকিয়ে বিয়ে করিয়েছ। এখন মুখে তুলে খাইয়ে দাও।”

অদিতি ম্লান মুখে ড্যাশবোর্ডের ওপর থেকে খাবারের ব্যাগটা টেনে নিয়ে প্যাকেটগুলো খুলতে আরম্ভ করে দিলো। আজাদকে ফোনে ব্যস্ত দেখে আলগোছে চোখের কোণটা বাম হাতের তর্জনী দিয়ে মুছে নিতেই আজাদ চট করে তাকালে অদিতি মুখ ঘুরিয়ে নিলো। আজাদ কিছু না বলে ফোনে মন দিলো।
-” হ্যালো মা ? ইয়ে, একটা কথা বলার জন্য ফোন দিলাম। আমি আসলে ইয়ে, মানে বিয়ে করে ফেলেছি।” বলে অদিতির দিকে তাকালো। অদিতি প্রতিক্রিয়াহীন। সে একমনে খাবারের প্যাকেট থেকে স্ট্যাপলারগুলো আলগা করায় ব্যস্ত।
-“বউ আমার পাশেই। কথা বলবে..?” বলতেই অদিতি দ্রুত মাথা নাড়লে আজাদ চোখ পাকিয়ে নিঃশব্দ ধমক দিলে অদিতিকে ফোনটা হাতে নিতে হলো। মৃদু স্বরে সালাম দিলে ওপাশ থেকে আজাদের মা বললেন, ” নাম কী তোমার? ”
-” জি, অদিতি।”
-” হিন্দু নাকি? ”
-” জি না। মুসলমান।”
-” অ…! তা তোমার বাবা কী করে ? ”
-” আমার বাবা মা নেই? ”
-” বলো কী ? এতিমখানা থেকে তুলেছে নাকি তোমাকে? ”
-” জি না। আমার মামা আছে। তার কাছেই আমি মানুষ। নাম বললে হয়ত চিনবেন। উনি একজন এমপি। ”
-” তাই নাকি? তা মা তোমার লেখাপড়া কদ্দুর ?”
-” জি, অনার্স পার্ট ওয়ান পরীক্ষা দিয়েছি।”
-” তোমার মামা-মামীককে জানিয়েছো ? ”
-” জি, জানাবো।”
-” দেখো, আমার ছেলের উপর যেনো দোষ না আসে বাবা। তা তোমার নানা বাড়ি কোথায়? বাবা-মা’র অংশ কিছু পাওনি ? ”
এ পর্যায়ে আজাদ ফোন টেনে নিয়ে নিল, ” মা আমি রাখি। আমরা এখন কুয়াকাটার দিকে যাচ্ছি। ওখানে রুম বুক করে তোমাকে ফোন দেব। আর হ্যাঁ, কাউকে আমার অবস্থান জানিয়োনা আবার। আমি এই ক’দিন ঝামেলামুক্ত থাকতে চাই। রাখি মা, দোয়া করো আমাদের জন্য।” বলে ফোন কেটে দিলো আজাদ।

অদিতি ততক্ষণে ওর প্যাকেট খুলে ড্যাশবোর্ডের ওপর সাজিয়ে দিয়েছে। আজাদ থমথমে মুখে বলল, ” এসব কী? ”
-” আপনার খাবার।”
-” বাম হাতে খাবো ? ”
– ” ওহ্…!” অদিতি ব্যস্ত হলে আজাদ গেট খুলে নেমে পড়ল। অদিতি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল সেদিকে। পরক্ষণেই পেছনের গেট খুলে রেখে সামনে এসে খাবারের প্যাকেটগুলো একে একে পেছনে নিয়ে সিটের ওপর রাখলো আজাদ। তারপর সামনের ডোর লক করে অদিতির পাশের দরজায় এসে ওর জানালায় টোকা দিলে অদিতি ডোর আনলক করল। আজাদ ডাকলো, ” এসো।”
অদিতি কোন প্রশ্ন না করে চুপচাপ নেমে এলো। আজাদ ওর পেছন দিয়ে দরজা বন্ধ করে দ্রুত হাতে পেছনের দরজা সসম্মানে মেলে ধরলে অদিতি বিনা বাক্য ব্যয়ে তাতে উঠে বসল। দুম করে দরজা আটকে ওপাশ দিয়ে ঘুরে নিজে উঠে বসল আজাদ। স্বস্তির একটা শব্দ করে বলল, ” ডার্ক গ্লাসের গাড়ী বানানোর আইডিয়াটা কার জানিনা। আজ তাকে আমার অন্তর থেকে দু’আ দিতে ইচ্ছে করছে ।”

অদিতি খাবারের প্যাকেট খুলতে গিয়েই টের পেল আজাদ ওর পাশে এসে গা ঘেঁষে বসেছে। অদিতির হঠাৎ বুক ঠেলে কান্না পেলো। খাবারটা একপাশে সরিয়ে রেখে একরকম ঝাঁপিয়েই পড়ল আজাদের বুকে। ওর কাঁধে মুখ গুঁজতেই ব্যথায় কঁকিয়ে উঠল আজাদ। তারপরেও নবপরিণীতাকে ছাড়ল না। এক হাতেই টেনে নিলো নিজের কাছে। অদিতির ঝরঝরে মসৃন চুলে নাক ডুবিয়ে বলল,” পিস্তলটা এতোবড় উপকার করবে জানলে তোমাকে আরো আগে কিডন্যাপ করতাম।”

======

গাড়ী ছুটে চলেছে কুয়াকাটার দিকে। আজাদ ইচ্ছে করেই সমুদ্রপথে বঙ্গোপসাগর দিয়ে চট্টগ্রাম যাবার পরিকল্পনা করেছে। সেখান থেকে রাঙামাটি। তার মতে এভাবে যাত্রা যেমন সংক্ষিপ্ত হবে তেমনি কষ্টও কম হবে। ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়ক ধরে যাবার ঝক্কির সামনে এই ক্ষুদে টয়োটা যথেষ্টই অপ্রতুল। সে তুলনায় ট্রলারে বা ফেরী করে গেলে অন্তত জার্ণির ধকল অনেকখানিই লাঘব হবে। তাছাড়া অদিতির চেহারা এই একদিনেই শুকিয়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে আজাদের। চোখের নিচে কালি পড়ে সুন্দর মুখটা মলিন দেখাচ্ছে। ওর কষ্ট আরো বাড়িয়ে দেবার কোনো মানে হয়না। সে নিজে ড্রাইভ করলে ব্যপারটা ভিন্ন ছিলো। একটা মেয়ের পক্ষে অতগুলো পথ গাড়ী চালিয়ে যাওয়া রীতিমত শাস্তিই বটে। সেকারণেই পরিকল্পনা বদলেছে আজাদ।

পথে একজায়গায় থামতে হলো ওদের। অদিতির বিরতি প্রয়োজন। ইতোমধ্যেই আজাদ তার ক্ষতস্থানের জন্য একটা গ্রহনযোগ্য ব্যখ্যা তৈরী করে নিয়েছে। পথে কেউ অনাবশ্যক কৌতুহল প্রকাশ করলে তাকে বলা হবে রোড এক্সিডেন্টে আহত হয়েছে। অদিতির যদিও আপত্তি ছিলো এই কৈফিয়তে কিন্তু আজাদ যুক্তি দেখিয়েছে, ঘটনাটা তো পথ চলতেই ঘটেছে তাহলে রোড এক্সিডেন্ট বলতে সমস্যা কোথায় ? অবশেষে অদিতিকে আজাদের যুক্তি মেনে নিতে হয়েছে।
বিরতির পথ হোটেলগুলোতে ওরা বসেনি। আজাদ একাই গিয়ে খাবার কিনে এনে গাড়ীতে পেছনের সিটে বসে খেয়ে নিয়েছে।
একপর্যায়ে ওরা কুয়াকাটা পৌঁছুলে যাত্রাবিরতি নিলো। হোটেলের রেজিস্টার বুকে আজাদ গর্বের সাথে বাঁ হাতে লিখলো মি এন্ড মিসেস মুনতাসির।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here