#ধূসর_রঙে_আকাশ
#পর্ব_২২
লিখা: Sidratul Muntaz
নীলাভ্র বিষণ্ণ মুখে পদ্মপুকুর পার্কটায় বসে আছে। তার কপালে সূক্ষ্ম চিন্তার ভাজ। পার্কের এই জায়গাটা নীলাভ্রর খুব পছন্দ। এখানে রিম্মির সাথে তার প্রথম কথা হয়েছিল। সাইবোর্ডের মাধ্যমে আলাপ। তারপর থেকে ওদের সবাই চেনে। ওরা এখানে এসে বসলে প্রায় মানুষই তাকিয়ে থাকে। এইযে নীলাভ্র এখন বসে আছে। অনেকেই ওর দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে। প্রায় সবার চোখেই কৌতুহল। কৌতুহলের কারণটা অবশ্য নীলাভ্র জানে। সবাই নীলাভ্রর পাশে রিম্মিকে খুঁজছে। রিম্মি এখনো আসেনি। একটু পরেই আসবে। নীলাভ্রর হাতে রিম্মির সেই শর্তের চিঠিটা। রিম্মি আসলেই নীলাভ্র ওর কাছে জবাব চাইবে। এখন আর রিম্মি-নীলাভ্র লিখে লিখে কথা বলে না। পার্কে এসে ওরা চুপচাপ বসে থাকে। কেউ জানতেও পারেনা নিরবতার আড়ালে দু’জন অবিরত কথা বলে যাচ্ছে। সেই শব্দ কেউ শুনতেও পায়না। বিষয়টা দারুণ ইন্টারেস্টিং।
নীলাভ্রর পুরনো দিনের কথা খুব মনে পড়ছে। প্রায় তিনমাস আগে, রিম্মিকে পাওয়ার জন্য পরিবারের সাথে কত যুদ্ধ করতে হয়েছিল তাকে। প্রথমে তো নীলাভ্রর বিয়ে ঠিক হয়েছিল রিম্মির বড়বোন অন্তরার সাথে। তোহার নিখোঁজ হওয়ার কিছুদিনের মাথায় নীলাভ্র অনেক অগোছালো হয়ে যায়। সারাখন একটা অপরাধবোধ ওকে ভিতর থেকে কুড়ে কুড়ে খায়। রাতে ঘুমালেও তোহার আর্তনাদ শুনতে পেতো। মাঝরাতে দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গেলে নীলাভ্র নামায পড়তো। আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ জানাতো তোহা যেন সুরক্ষিত থাকে। নীলাভ্রর এহেন কান্ডকারখানা দেখে বিচলিত হয়ে পড়েন মারুফা ইয়াসমিন। উনার ধারণা হয় নীলাভ্র তোহার প্রেমে পড়েছে। যে মেয়ে কাউকে কিছু না বলে হুট করে নিখোঁজ হয়ে যেতে পারে সেই মেয়ের প্রেমে পড়া কোনো কাজের কথা নয়। হতে পারে মেয়েটার চরিত্রে দোষ ছিল। নিশ্চয়ই কোনো ছেলের সাথে ইটিশ-পিটিশ করেছে তারপর হয়তো সেই ছেলে তুলে নিয়ে গেছে। অথবা মেয়েটাই হয়তো স্বেচ্ছায় কোনো ছেলে নিয়ে পালিয়েছে। মারুফা তোহার বিষয়ে অনেক খোঁজ-খবর নিয়েছেন। এলাকার অর্ধেক ছেলে তোহার জন্য পাগল। সে মহল্লার সেরা সুন্দরী। আর মারুফা ইয়াসমিনের ধারণা সুন্দরী মেয়েদের চরিত্র কখনো ভালো হয় না। নীলাভ্রকে এসব কথা বললেই সে রেগে যেতো। একদিন রাতে সময় করে মারুফা ছেলের ঘরে আসলেন। নীলাভ্র তখন লাইট নিভিয়ে শুয়ে ছিল। মারুফা লাইট জ্বালাতেই নীলাভ্র চোখমুখ কুচকে বিরক্তি নিয়ে উচ্চারণ করল,
” কি সমস্যা ভাবী? একবার বলেছি না আমার ক্ষিধে নেই?”
মারুফা এক কোমরে হাত রেখে শক্ত হয়ে দাড়ালেন। নীলাভ্র চোখ খুলে মাকে দেখেই থতমত খেল। হৃৎপিন্ডে শীতল স্রোত প্রবাহিত হচ্ছে। মাকে সে দারুণ ভয় পায়। এটাকে ঠিক ভয় বলা যায় না, বলা যায় সমীহ করা। নীলাভ্র উঠে বসতে বসতে নরমগলায় বলল,
” আম্মা, তুমি ক্যান কষ্ট করে আসতে গেলে? আমাকে ডাকলে আমিই যেতাম।”
মারুফা বসতে বসতে বললেন,” অসুবিধা নেই। তোমার কি হয়েছে? শরীর খারাপ? রাতে খাবে না কেন?”
” ক্ষিধে নেই তাই খাবো না। শরীর ভালো আছে।”
” সারাদিন কোথায় কোথায় ঘুরো? তোমাকে তো আজ-কাল খুঁজেও পাওয়া যায়না। ”
নীলাভ্র মাথা নিচু করে বলল,” কাজ থাকে।”
” কি এমন কাজ করো তুমি? এসব আলতু-ফালতু কাজ করে তো লাভ নেই কোনো। তোমার সেমিস্টার ফাইনাল এক্সাম কবে?”
” এক্সাম তো শেষ। ”
” রেজাল্ট কবে?”
” এখনো জানিনা।”
” রেজাল্টের অপেক্ষা করতে হবে না। তার আগেই কিছু একটা করার চেষ্টা করো। চাকর হয়ে মানুষের চাকরি করা মানে সহজ কথায় কামলা খাটা। এসব আমার পছন্দ না। আমি চাই তুমি নিজে থেকে কিছু করবে। যেমন নিররাস ব্যবসা করছে। তুমি তো চাইলে ওর ব্যবসাতেও হাত লাগাতে পারো। দুই ভাই মিলে একসাথে কাজ করবে। এটাই ভালো নয় কি?”
” ভাইয়ার বিজনেস আমার পছন্দ না। সব ঘুষের টাকায় তৈরী।”
” সেই ঘুষের টাকাই তো বসে বসে উড়াচ্ছো তুমি।”
নীলাভ্র চুপ। মারুফা বললেন,
” আচ্ছা তুমি কি ওই মেয়েকেই বিয়ে করতে চাও?”
” কোন মেয়ে?”
” পাশের বাড়ির তোহা। নিখোঁজ হলো যে।”
” কি আশ্চর্য কথা বলছো আম্মা। আমি তোহাকে কেন বিয়ে করবো? ও আমার ছোটবোনের মতো। আর তুমি কি ছোটবেলায় দেখোনি ওকে? হাফপ্যান্ট পড়ে আমাদের বাসায় ঘুরতো। সেই পিচ্চি মেয়েটাকে আমি কিভাবে বিয়ে করতে পারি?”
” তাহলে ওকে খুঁজে বের করা নিয়ে তোমার এতো মাথাব্যথা কেন? নাওয়া-খাওয়া পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছো ওই মেয়ের জন্য। ”
” ছোটবেলা থেকে একসাথে বড় হয়েছি আম্মা। হঠাৎ করে মেয়েটা নিখোঁজ হয়ে গেল। খারাপ তো লাগবেই।”
” ব্যাপারটা যদি শুধু খারাপ লাগা হয় তাহলে ঠিকাছে। কিন্তু এর চেয়ে বেশি হলে সমস্যা আছে।”
” কি সমস্যা?”
” তিলোত্তমা কিছু বলেনি তোমাকে?”
” কি বলবে?”
” আমি তোমার বিয়ে ঠিক করেছি। কাল শুক্রবার, তুমি অবশ্যই বাসায় থাকবে। আমরা মেয়ে দেখতে যাবো।”
নীলাভ্রর মনে হলো মাথার ভেতর একশোটা কাঁচের গ্লাস ঝনঝন শব্দ করে ভেঙে পড়ছে। সেই তীক্ষ্ণ শব্দে মাথাটা ধরে আসল। মারুফা কথা শেষ করে এক মুহুর্তও দাঁড়াননি৷ উঠে চলে গেছেন। এর অর্থ উনি নীলাভ্রর কোনো মতামত জানতে চান না। অদ্ভুত! এখনো মাস্টার্সের রেজাল্ট দেয়নি যে ছেলের, যে এখনো মায়ের কাছে ভেজা বিড়াল হয়ে থাকে, সকালে বাসা থেকে বের হওয়ার আগে ভাইয়ের কাছে যার হাত পাততে হয় সেই ছেলে নাকি বিয়ে করবে? পৃথিবীতে এমন কোন বাবা আছে যে নিজের মেয়েকে একটা বেকার ছেলের হাতে তুলে দিতে রাজি হয়েছে? ব্যাপারটা একবার দেখতে হয়। নীলাভ্র চলে গেল তিলোত্তমার কাছে। তিলোত্তমা জানালো রিম্মির বড়বোন অন্তরার সাথে ওর বিয়ে ঠিক হয়েছে। নীলাভ্র তখন তিলোত্তমাকে বলে সে অন্তরাকে না রিম্মিকে বিয়ে করতে চায়। তিলোত্তমা যেন এ বিষয়টা নীলাভ্রের মাকে বুঝিয়ে বলে।তিলোত্তমা হাসতে হাসতে বলল,
” আচ্ছা তুমি কি পাগল দেবরমশাই? বড়মেয়েকে রেখে ছোটমেয়েকে ওরা তোমার কাছে কেন বিয়ে দিতে রাজি হবে? তাছাড়া রিম্মিও তো স্বাভাবিক না। মা কখনো একটা বোবা মেয়েকে তোমার বউ হিসেবে মেনে নিবে না। এসব চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো। কালকে আমরা অন্তরাকে দেখতে যাচ্ছি। যদি পছন্দ না হয় তাহলে বিয়ে করবে না, সিম্পল! কিন্তু আমার ধারণা মেয়ে তোমার অবশ্যই পছন্দ হবে। মেয়ে অনেক সুন্দর। ”
তিলোত্তমা একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে বেডরুমে চলে গেল। নীলাভ্রর মনে যে ক্ষীণ আশা ছিল সেটাও নিভে যায়। মায়ের মুখের উপর সে কথা বলতে পারবে না। কিন্তু রিম্মিকে ছাড়াও তো থাকতে পারবে না। সেদিনরাতেই নীলাভ্র প্রাচীর টপকে রিম্মিদের বাসার পেছনের বাগানে যায়। তারপর রিম্মিকে আসতে বলে। রিম্মি বারান্দা দিয়ে দড়ি নামিয়ে সেই দড়ি বেয়ে বেয়ে নিচে আসে। এই দৃশ্য দেখে নীলাভ্রর হার্ট অ্যাটাক হওয়ার মতো অবস্থা হয়। রিম্মিকে কয়েক মুহুর্তের জন্য স্পাইডার ম্যানের ফিমেল ভার্সন স্পাইডার ওমেন ভাবতে ইচ্ছে করে। রিম্মি নিচে এসেই নীলাভ্রর মস্তিষ্কে সিগন্যাল পাঠালো,
” এতোরাতে কেন এসেছো?”
নীলাভ্র একটু রোমান্টিকতা দেখাতে বলল,” তোমাকে অনেক দেখতে ইচ্ছে করছিল।”
রিম্মি মৃদু হেসে বলল,” মিথ্যে বলছো কেন? আসলে তো এসেছো ট্র্যাপে পড়ে। অন্তরা আপুকে বিয়ে করতে চাও না। তাই আমার হেল্প নিতে এসেছো।”
নীলাভ্র আশ্চর্য হওয়ার ভান করে বলল,” এই তুমি মানুষ না অপশরী? বলার আগেই আমার মনের কথা কিভাবে বুঝে ফেলো?”
রিম্মি সামনের চুল কানে গুজে মাথা নিচু করে হাসলো। নীলাভ্র রিম্মির একহাত নিজের বুকের কাছে নিয়ে বলল,
” আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না রিম্মি। এই বিয়েটা আমাদের আটকাতে হবে। তুমি তনিমা আন্টির সাথে কথা বলতে পারবে না?”
” লাভ নেই। মা কখনো রাজি হবে না। তোমাকে খুব পছন্দ করে মা।”
” আমিও আন্টিকে খুব পছন্দ করি। উনার মেয়ের জামাই হতে অসুবিধা নেই। কিন্তু বড়মেয়ের জামাই না, ছোটমেয়ের জামাই হতে চাই।”
” আমি চাই না এতোরাতে কেউ আমাদের একসাথে দেখে ফেলুক। তুমি যাও নীলাভ্র।”
” তাহলে বিয়ের ব্যাপারটা? কালকেই কিন্তু আমরা মেয়ে দেখতে আসবো। আর আমার আম্মা যে চীজ, যদি অ্যাংগেজমেন্ট করিয়ে ফেলে? তখন কিন্তু আমাদের আর কিচ্ছু করার থাকবে না।”
রিম্মি হি-হি করে হেসে ফেলল। বলল,” মাকে এতো ভয় পাও কেন?”
নীলাভ্র কিঞ্চিৎ লজ্জা পায় এই প্রশ্নে। ইতস্তত ভঙ্গিতে বলল,
” ভয় পাওয়ার কি আছে? আমি আসলে মায়ের মুখের উপর কথা বলতে পারিনা। এটা সম্মান। ভয় পাওয়া না।”
” টেনশনের কিছু নেই। কালকে তুমি স্বাভাবিকভাবেই সবার সাথে আপুকে দেখতে আসবে। আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি, বিয়ে হবে না।”
” কি বুঝে গ্যারান্টি দিচ্ছো?”
” সেটা কালকেই জানতে পারবে। এখন যাও।”
নীলাভ্র ঠায় দাড়িয়ে রইল। রিম্মি মস্তিষ্কের মাধ্যমে বলল,
” কি হলো যাচ্ছো না কেন?”
নীলাভ্র ভীত গলায় বলল,” তুমি নিশ্চিত তো? বিয়ে হবে না?”
” একদম নিশ্চিত। তুমি শুধু কালকে বাসায় ঢোকার সময় ফোনের রেকর্ডারটা অন করে রাখবে। তাহলেই হলো।”
রিম্মি একথা বলে চলে যাচ্ছিল। নীলাভ্র ওর হাত ধরে আবেশী কণ্ঠে বলল,
” রিম্মি একটা…”
নীলাভ্র নিজে থেকেই থামলো। কিছুদিন আগে রিম্মিকে কিস করতে গিয়ে ঘুষি খেয়ে হাসপাতালে কাইত হওয়ার ঘটনাটা মনে পড়ছে। এ সম্পর্কে বাসায় এক্সকিউজ দিয়েছিল বাইক থেকে পড়ে এক্সিডেন্ট। কিন্তু আসল ঘটনা শুধু রিম্মি-নীলাভ্রই জানে। নীলাভ্র রিম্মির হাত ছেড়ে দিল। হতাশ গলায় বলল,
” আচ্ছা যাও।”
রিম্মি আবার একটু হাসলো। তারপর টুক করে নীলাভ্রর গালে আলতো একটা চুমু দিয়ে চোখের পলকে ভ্যানিশ হয়ে গেল। নীলাভ্র বিমূঢ় হয়ে প্রায় দশমিনিট ওখানেই দাড়িয়ে ছিল৷ সে কখনো কল্পনা করেনি রিম্মি এরকম করবে। খুশিতে ইচ্ছে করল পদ্মপুকুরের জলে ডুব দিয়ে মরে যেতে।
পরদিন নীলাভ্র বাড়ির সবাইকে নিয়ে ঠিকই গেছিল অন্তরাকে দেখতে৷ রিম্মির কথামতো মোবাইল রেকর্ডারও অন রেখেছিল। পরে অন্তরা আর নীলাভ্রকে যখন আলাদা কথা বলতে দেওয়া হয়, অন্তরা জানায় সে বিবাহিত। এই কথা শুনে নীলাভ্রর হাত থেকে পানির গ্লাস পড়ে যায়। বিস্ময়ে দুই ঠোঁট আলাদা করে গোল গোল চোখে তাকিয়ে থাকে। কয়েক মুহুর্তের জন্য ঘরটা হয়ে পড়ে শব্দহীন। অন্তরা তারপর পুরোপুরি ঝেড়ে কাশলো। অস্ট্রেলিয়ান বয়ফ্রেন্ডের সাথে তার সম্পর্ক প্রায় আটবছরের। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ছেলে খ্রিস্টান। তাই ওরা পরিবারের অমতেই বিয়েটা করেছিল৷ কোনো ধর্মীয় রীতি মেনে না। শুধু রেজিস্ট্রি ম্যারেজ। তনিমা সন্দেহ করেন অন্তরা হয়তো কারো সাথে লিভিং রিলেশনশীপে আছে। তাই দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন। তনিমার ইচ্ছে তিন মেয়েকেই দেশী পাত্রের কাছে বিয়ে দিবেন। নীলাভ্র সবকিছু শুনে জোরে একটা নিঃশ্বাস ছাড়ল। ভাগ্যিস রেকর্ডারটা অন ছিল। নাহলে আম্মাকে এসব বিশ্বাস করাতে ভীষণ বেগ পেতে হতো। অন্তরা কাঁদতে কাঁদতে নীলাভ্রর কাছে সাহায্য চায় যেন সে কোনোক্রমে বিয়েটা আটকায়। নীলাভ্র রুমাল বের করে আগে কপালের ঘাম মুছল। তারপর সান্ত্বনার বাণী শুনানোর মতো বলল,
” টেনশন করবেন না৷ আমি সব ম্যানেজ করে নিবো।”
নীলাভ্র এতো সহজে রাজি হয়ে যাবে অন্তরা চিন্তাও করেনি। খুশির তীব্রতায় নীলাভ্রর গলা জড়িয়ে ধরে একটা চুমুও দিয়ে ফেললো অন্তরা। সেটা নীলাভ্রর জীবনের সবচেয়ে বাজে অভিজ্ঞতা ছিল। রাগে তেতে উঠে নীলাভ্র রুক্ষ গলায় বলন,
” ছিঃ, এটা কি করলেন আপনি? বিয়েই ভাঙবো না যান।”
অন্তরা আতঙ্কে জড়োসড়ো গলায় বলল,” সরি সরি এক্সায়েটমেন্ট কন্ট্রোল করতে পারিনি। ভুল হয়ে গেছে। কিছু মনে করবেন না প্লিজ।”
বাসায় এসে প্রায় পঞ্চাশবারের মতো গাল ধুয়েছিল নীলাভ্র। এতোবার ঘষামাজার কারণে গালের চামড়া কিছুটা পাতলাও হয়ে গিয়েছিল। এখনো সেই কথা মনে পড়লে গা শিউরে উঠে। কি ভয়ংকর! অন্তরার মামলা ডিসমিস করতে খুব একটা অসুবিধা হয়নি। রিম্মিই অর্ধেক কাজ সহজ করে দিয়েছিল৷ কিন্তু ঝামেলা হয় আবার রিম্মিকে নিয়েই। মারুফা যখন রিম্মি আর নীলাভ্রর সম্পর্কের কথা জানতে পারেন তখনি অগ্নিমূর্তি রূপ ধারণ করেন। এই নিয়ে বাসায় ঝড়-তুফান হয়। তারপর আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়৷ মাও মেনে নিতে থাকেন। সবই আসলে রিম্মির এক্সট্রা-অর্ডিনারী গুণের জন্য। নীলাভ্রর ভাবনায় চিড় ধরে রিম্মির আগমনে। রিম্মি প্রথমেই প্রশ্ন করল,
” কি সিদ্ধান্ত নিলে?”
নীলাভ্র রুষ্ট গলায় বলল,” এসব কি রিম্মি? আমরা কেন সারাজীবন নিঃসন্তান থাকবো? তোমার কি ফিজিক্যাল কোনো প্রবলেম আছে? আমার আছে? তবুও কেন?”
রিম্মি শান্ত ভঙ্গিতে হাসল। নীলাভ্র অধৈর্য্যের ন্যায় বলল,
” একটা বাচ্চার জন্য মানুষ কত হা হুতাশ করে জানো? বাচ্চা হলো ব্লেসিংস। আল্লাহর তরফ থেকে বিশেষ উপহার। আর আমাদের জীবনে সেই উপহারটা আসবে না? কেন রিম্মি?”
রিম্মি নিশ্চুপ। কি উত্তর দিবে সে? কোনো উত্তর তো নেই!
আমীরের হাতে বড় একটা তলোয়ার। চোখেমুখে ভয়ানক হিংস্রতা। মুখের হাসিটাও বিদঘুটে দেখাচ্ছে। সেই নিদারুণ হাসির শব্দে যেন সারা ভুবন কাঁপছে। তোহা বন্দী পাখির মতো ছটফট করতে থাকে। তার পাশে নিয়াজ অসহায় মুখে দাঁড়ানো। আমীর আকস্মিকভাবে তলোয়ার নিয়ে তেড়ে আসছে। তোহা চিৎকার দিতে চায়। কিন্তু অদ্ভুতভাবে মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হয়না। তোহা আমীরকে বুঝাতে চায়, নিয়াজ সম্পর্কে সে যা বলেছে সব মিথ্যে। নিয়াজ নির্দোষ। কিন্তু তোহা একটা শব্দও উচ্চারণ করতে পারে না। আমীর নির্মমভাবে নিয়াজের ঘাড় থেকে মাথাটা আলাদা করে দিল। রক্ত ছিটকে পড়ে তোহার চেহারায়। তোহা চিৎকার দিয়ে ঘুম থেকে জাগলো। ওর ঠোঁটের নিচে, নাকের ডগায়, গলায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। গলা শুকিয়ে খা খা করছে৷ হাত-পা ভীষণরকম কাঁপছে। খুব ভয়ানক দুঃস্বপ্ন দেখেছে সে। এই সময়টা স্বপ্ন দেখার জন্য সবথেকে বাজে সময়। সকাল ছয়টার থেকে বারোটা পর্যন্ত তোহা যত স্বপ্ন দেখে সব সত্যি হয়। কিন্তু এই স্বপ্নটা কি আসলেই সত্যি হবে? তোহা বিছানা থেকে দ্রুতপায়ে নামলো। একগ্লাস পানি ঢকঢক করে গিললো। আচ্ছা আমীর কোথায়? তোহা খেয়াল করল আমীর বাসায় নেই। সাথে সাথে বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল। তোহার আতঙ্কের তীব্রতা বেড়ে দশগুণ হয়ে যায় যখন ধাম ধাম শব্দে কেউ দরজা ধাক্কানো শুরু করে। তোহা কম্পিত কণ্ঠনালি নিয়ে প্রশ্ন করল,
” কে? কে এসেছে?”
পূরবীর কণ্ঠ শোনা যায়,” তোহা আমি পূরবী। দরজাটা খোল। একটা খারাপ সংবাদ আছে।”
তোহার হৃৎপিন্ডে তুখোড় ধাক্কা অনুভব হয়। খারাপ সংবাদ মানে? তোহা তাড়াহুড়ো করে গেল দরজা খুলতে। পূরবী হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
” সর্বানাশ হয়েছে তোহা। নিয়াজের কথা মনে আছে তোর? ছেলেটার অবস্থা ভালো না। বামপায়ের লিগামেন্ট ছিড়ে যা-তা অবস্থা হয়েছে। আপাতত বাংলাদেশ মেডিকেলে ভর্তি আছে। একটু আগেই নীলাভ্র ভাই এসে খবর দিয়ে গেল। আমি এখন হসপিটালে যাচ্ছি। তুই যাবিনা?”
তোহা স্তব্ধ হয়ে কথাগুলো শুনল। ওর চোখে বিস্ফোরণ। মাথার শিরা দপদপ করছে। দাঁড়িয়ে থাকা যাচ্ছে না। স্বপ্নে যা দেখেছিল তা কত ভয়ানকভাবেই না সত্যি হয়ে গেল। তোহার সারা শরীর কাঁপছে। অনেকটা ব্লেন্ডার মেশিনের মতো। পূরবী ভ্রু কুচকে তোহাকে এসে ধরল। বিচলিত গলায় বলল,
” এই তোহা, তুই এমন করছিস কেন? কি হয়েছে?”
এরই মাঝে আমীর দরজায় এসে উপস্থিত হয়। পূরবী আমীরকে দেখেই বলল,
” ভাইয়া দেখুন না, তোহা জানি কেমন করছে।”
আমীর একহাতে তোহাকে নিজের কাছে টানলো। তোহা অজ্ঞানের মতো আমীরের বুকে লুটিয়ে পড়ে। আমীর কঠোর ভঙ্গিতে বলল,
” তুমি যাও। ওকে আমি দেখছি।”
পূরবী বলল,” আসলে ভাইয়া, আমি তোহাকে নিয়ে যেতে এসেছিলাম। ওর একটা ফ্রেন্ড খুব অসুস্থ। এক্সিডেন্ট করেছে, হসপিটালে ভর্তি।”
আমীর একবাক্যে উচ্চারণ করল,” তোহা কোথাও যাবে না। ও নিজেও অসুস্থ। তুমি যাও।”
আমীর হাত বাড়িয়ে দরজায় ইশারা করলো।পূরবী আর কথা বাড়াতে পারলো না। তোহার দিকে একবার তাকিয়ে কি যেন একটা ভাবতে ভাবতে বেরিয়ে গেল। আমীর তোহাকে কোলে নিয়ে বিছানায় শোয়ায়। একটু পর তোহার জ্ঞান ফিরে আসলে সে দেখে আমীর তার পাশেই টেবিলে বসে অণুবীক্ষণ যন্ত্রে কিছু একটা দেখার চেষ্টা করছে। তোহা এখন যে ঘরে, সেটা আমীরের লঙ্গরখানা। নিয়াজের কথা মনে পড়তেই বুকের ভিতর দামামা বাজতে শুরু হয়। তোহা ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে বলল,
” পূরবী কোথায়?”
আমীর তোহার দিকে একবারো তাকায় না। নিজের কাজে মনোযোগী হয়েই বলল,
” চলে গেছে।”
ওর কণ্ঠ একদম স্বাভাবিক। যেন কিছুই হয়নি। তোহা কঠিন মুখে প্রশ্ন করল। অনেকটা জেরা করার মতো,
” আপনি নিয়াজের সাথে কি করেছেন? একদম সত্যি কথা বলবেন। আমি কিন্তু সব জানি। নিয়াজ এক্সিডেন্ট করেনি। আপনিই ওকে কিছু করেছেন। তাইনা?”
আমীর জবাব দিল না। তোহা হাটু ভাজ করে বসে মাথার চুল খামচে ধরল। কাঁদতে কাঁদতে বলল,
” কেন করলেন এসব আপনি? ছেলেটা একদম নির্দোষ বিশ্বাস করুন। ও আমার সাথে কখনো কিছু করেনি। কালকে তো আমি ওইসব আপনাকে বানিয়ে বানিয়ে বলেছিলাম। মিথ্যে বলেছিলাম।”
আমীর দায়সারাভাবে বলল,” জানি।”
বিস্ময়ে তোহার কান্না বন্ধ হয়ে যায়। সে চমকিত গলায় প্রশ্ন করল,” মানে?”
আমীর উঠে তোহার কাছে আসল। সোজামতো দাড়িয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল,
” আমি শুধু একটা ডেমো দেখালাম। তোমার গায়ে হাত দেওয়া তো দূরে থাক, কেউ যদি তোমার দিকে তাকানোর চেষ্টাও করে তাহলে তার অবস্থা কতটা ভয়ানক হবে।”
তোহা অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলতে লাগলো। এই প্রথম আমীরকে দেখে তার খুব ভয় লাগছে। আমীর কথা শেষ করে বামহাতে তোহার বামগাল স্পর্শ করল। তারপর ডানগালে একটা চুমু দিয়ে বলল,
” তুমি খুব সুন্দর তোহা। তোমাকে আমার প্রয়োজন।”
আমীর একথা বলেই জায়গা ত্যাগ করল। তোহা তখনো পাথরের মতো বসে আছে। আমীরের বলা শেষ বাক্যটি কানে বাজছে। ‘তোমাকে আমার প্রয়োজন?’ আমীর প্রয়োজনের কথাটাই কেন বললো? ভালোবাসার কথা তো বললো না!
চলবে