#ধূসর_রঙে_আকাশ
#পর্ব_২৩
লিখা: Sidratul Muntaz
তোহা যখন মোবাইলে আমীরের সাথে তার বিশেষ মুহুর্তের দৃশ্যগুলো দেখছিল রিম্মি তখন তোহার পাশে বসে শান্ত কণ্ঠে বলে উঠে,
” তুমি যা দেখছো তা সঠিক নয়। তোমার দৃষ্টিভ্রম হচ্ছে। সেটা কি বুঝতে পারছো না?”
তোহা ভয় পেয়ে উঠল। বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
” মানে?”
” তুমি কি ভাবছো? এই ভিডিওতে যা দেখানো হচ্ছে সব সত্যি? না তোহা, এইসব তোমার দূর্বল মস্তিষ্কের কল্পনা। আসলে তোমার ব্রেইন চায় এমনটা হোক। তাই তুমি ভিডিওতে এমন দেখছো৷ এ ধরণের চিত্রকে বলা হয়, ভিশন অফ উইশেস।”
তোহা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। কিছু বুঝতে পারে না। রিম্মি বলল,
” সত্যিটা কি জানো? ফোনের স্ক্রিনে কিচ্ছু নেই। না আছো তুমি না আছে আমীর। শুধু আছে একটা ধূসর রঙ। এই রঙটা আমরা চোখ বন্ধ করলেও দেখি। এটা এমনি এক রঙ যে এর দিকে তাকিয়ে তুমি যা কল্পনা করবে তাই দেখবে। অথবা যা তোমাকে কল্পনা করানো হবে। আমার ধারণা, তুমি কি কল্পনা করবে সেটাও তোমার নিজের নিয়ন্ত্রণে নেই। তুমি অন্য কারো দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছো।”
তোহার মাথাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগে। হঠাৎ করে বুঝে উঠতে পারল না কি বলা উচিৎ। রিম্মির কথার সত্যতা যাচাইয়ের উদ্দেশ্যে সয়ংক্রিয়ভাবে তোহার দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় ফোনের স্ক্রিনে। না, ধূসর কোনো রঙ তো চোখে পড়ছে না।তোহা যা দেখছে তা হলো, চারদিকে সবুজ ঘাস৷ ঘাসে ঘেরা মাঠ। মাঠের চারদিকে সাদা পেন্ডেলের মতো। যেন হলি উৎসব শুরু হবে একটু পর। আমীর সেই মাঠেরই একটা সাদা সোফায় আধশোয়া অবস্থায় আছে। তোহা ওর চুল ঘেটে দেয়। আমীর পেছনে ঘুরে তোহাকে দেখল। তারপর নজরকাঁড়া একটা হাসি দিল। তোহা যে ফোন দিয়ে ভিডিও করছিল সেটা কোথাও সেট করে আমীরের কোলে এসে শুয়ে পড়ে। আমীর ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। তারপর একটা গান বেজে উঠে। তোহা চোখে অবিশ্বাস নিয়ে রিম্মির দিকে তাকালো। তার কপালে সূক্ষ্ম চিন্তার ভাজ। দৃষ্টিতে কৌতুহল। রিম্মি মুচকি হাসল,
” দেখলে, আমি বলার পরেও তুমি সেই নির্দিষ্ট জিনিস ছাড়া অন্যকিছু কল্পনা করতে পারলে না। পারবেও না। যতক্ষণ না সে চাইবে।”
তোহা শুকনো গলায় বলল,” কে সে?”
” সে তোমার নিয়ন্ত্রক। তোমাকে নিজের মতো নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে প্রতিনিয়ত। তুমি বুঝতেও পারছো না। এখন তুমি একটা যন্ত্রের মতো। যেভাবে ইচ্ছা তোমাকে পরিচালনা করা যায়। কিন্তু একবার চিন্তা করো তোহা, সবকিছুর উর্ধ্বে গিয়ে তুমি একজন মানুষ। তোমার নিজস্ব একটা ক্ষমতা আছে। মন আছে। সেই মনের উদ্দীপনায় সাড়া দাও। আমি জানি তোমার মন আমাকে বিশ্বাস করতে চাইছে। কিন্তু মনের সেই ডাক তুমি শুনতে পাচ্ছো না। তোমার মন আর মস্তিষ্ক এখন একে-অপরের বিরোধিতা করে চলেছে অবিরাম। নিয়ন্ত্রিত মস্তিষ্ক মনের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ করছে৷ তুমি কি বুঝতে পারছো না? সাড়া দাও তোহা, মনের ডাক শোনার চেষ্টা করো। আমি জানি তুমি পারবে। প্লিজ তোহা সাড়া দাও!”
তোহার মাথায় বোমা বিস্ফোরণের মতো বিকট শব্দ হলো। সে কল্পনাশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। কিছু ভাবতে গেলেই মাথা ঝিম মেরে আসে। অসহ্য যন্ত্রণা লাগছে। তোহা কাতরাচ্ছে। কিচ্ছু বলতে পারে না। শুধু হাসফাস করে। তোহার হঠাৎ মনে পড়ল, রিম্মি তো কথাই বলতে পারে না৷ তাহলে ওর সাথে কিভাবে কথা বলছে? তোহা অবাক বিস্ময়ে তাকায় রিম্মির দিকে। রিম্মি ভাবমূর্তির মতো বসে আছে। তার মুখে কোনো কথা নেই। ঠোঁটও নড়ছে না। সব স্বাভাবিক। তাও তোহা রিম্মির কথা শুনতে পাচ্ছে,
” সাড়া দাও তোহা।”
তোহা আরও চমকায় যখন বুঝতে পারে তার কানে কোনো শব্দ আসছে না। সে যা শুনছে সবই তার কল্পনা। না কল্পনা নয়, সব তার মস্তিষ্কের আলোড়ন। রিম্মি যেন পাশে বসে তোহার মস্তিষ্কে সিগন্যাল পাঠাচ্ছে। ওদের দুজনের মস্তিষ্কেই কি অদৃশ্য সংযোগ আছে? যে রিম্মি যা কল্পনা করছে তোহা তাই শুনতে পাচ্ছে! বুঝতে পারছে!
পরক্ষণেই তোহার মনে পড়ল নীলাভ্র বলেছিল রিম্মির ঐশ্বরিক ক্ষমতা আছে মানুষের সাথে মনে মনে কথা বলার। আচ্ছা রিম্মি কি একজন অতিমানবী? তার ক্ষমতা দেখে তো তাই মনে হয়। তোহার একহাত শক্ত করে চেপে ধরল রিম্মি। আবেশী গলায় বলতে থাকল,
” চোখ বন্ধ করো তোহা। কল্পনা করার চেষ্টা করো। অনেককিছু মনে করতে হবে তোমায়। অতীত নিয়ে ভাবো। অতীতে কি হয়েছিল আর কি হয়নি? সব স্বচ্ছ কাচের মতো পরিষ্কারভাবে ধরা দিবে তোমার মস্তিষ্কে। বেশি না, মাত্র গত তিনমাস আগের ফ্ল্যাশব্যাকে যাও। তারপর চিন্তা করো। গভীর মনোযোগে চিন্তা করো। আমি জানি তুমি পারবে।”
তোহার মনে হচ্ছে একহাজারটা বিশ পিপড়া তার মাথায় কিলবিল করছে। কপাল বরাবর কেউ তারকাটা ঢুকিয়ে দিচ্ছে। এতো যন্ত্রণা! তোহা কিভাবে সহ্য করবে? ছটফট করতে লাগল সে। দম আটকে আসার মতো অবস্থা হয়েছে৷ রিম্মি তোহাকে শান্ত করার চেষ্টা করলো। তোহা যেন টের না পায় তাই খুব সন্তর্পণে তার পায়েলটা পা থেকে খুলে নিতে চাইলো। তখনি আমীর চলে আসে। কাঠখোট্টা গলায় প্রশ্ন করল,
” তুমি এখানে কেন?”
আমীরকে দেখে তোহার হাতটা ছেড়ে দিয়ে উঠে দাড়ালো রিম্মি। আমীর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মাথা থেকে পা পর্যন্ত একবার রিম্মিকে দেখলো। রিম্মি নিঃশব্দে বলল,
” তোহার শরীর ভালো নেই। কেমন জানি করছে। তাই দেখতে এসেছিলাম। তুমি তো বাসায় ছিলে না।”
আমীর উত্তরে বলল,” এখন আমি চলে এসেছি। তাই তোমাকে দরকার নেই। যেতে পারো।”
রিম্মি ঘর থেকে বের হয়ে গেল। আমীর তোহার সামনে বসতেই তোহা জোরে জোরে কান্না শুরু করল। আমীরকে উদ্দেশ্য করে বলল,
” ও কি মনে করতে বলছে আমায়? আমার তো কিচ্ছু মনে আসছে না। আমি কেন কিছু চিন্তা করতে পারছি না? সব অসহ্য লাগছে আমার। সারা শরীরে যন্ত্রণা হচ্ছে। মস্তিষ্ক ছিড়ে যাচ্ছে। আমি এই যন্ত্রণা নিয়ে বাঁচতে চাইনা। মরে যেতে চাই।”
আমীর তোহাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল,” এই কথা বলে না৷ সব মনে পড়বে তোমার। আস্তে আস্তে মনে পড়বে।”
আমীর তোহার চোখের পানি মুছে দিল। তোহা আবার কেঁদে ভাসাতে ভাসাতে অসহায়ের মতো বলল,
” কবে মনে পড়বে বলোনা?”
আমীর তোহার কপালে একটা চুমু দিয়ে আদুরে গলায় বলল,
” খুব শীঘ্রই মনে পড়বে।”
তোহা আমীরকে জাপটে ধরে ওর বুকে মাথা রাখলো। তাও যদি একটু শান্তি পাওয়া যায়৷ কিন্তু শান্তি আসছে না। রিম্মি যেন ওর সারাদেহে অশান্তির আগুন দাউদাউ করে জ্বলতে দিয়ে গেছে। আমীর তোহাকে বালিশে শুয়িয়ে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
” ঘুমানোর চেষ্টা করো তোহা। সব দুশ্চিন্তা দূর হয়ে যাবে।”
তোহার চোখ বন্ধ করতে ভয় লাগছে। কারণ চোখ বন্ধ করলে আবার তার মাথায় যন্ত্রণা হবে। আমীর ওর মাথায় হাত বুলানোর সময় খেয়াল করল তোহার খয়েরী রঙের শাড়ি সরে গিয়ে ফরসা ত্বকের পেট উন্মুক্ত হয়ে আছে। কোমড়ের আরেকটু নিচের জায়গাটায় কি বিছরি একটা দাগ! গোলাপি আভার মতো সুন্দর ত্বকে এই দাগটা ভীষণ বেমানান লাগছে৷ খুব দৃষ্টিকটু। আমীর এই জায়গায় চিমটি দিয়েছিল৷ কিন্তু সামান্য চিমটিতে এতো গাঢ় দাগ বসে যাবে সে ভাবেনি। আহারে, তোহা নিশ্চয়ই খুব ব্যথা পেয়েছিল। আমীর কি মনে করে যেন তোহার পেটের ওই জায়গায় একটা গভীর চুমু দিল। তোহা সাথে সাথে কেপে উঠল৷ সমস্ত শরীরে যেন কেউ বরফ ঢেলে দিচ্ছে। আমীর আরেকটা চুমু দিল। এভাবে দিতেই থাকল। তোহা ভারী নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে চোখ বন্ধ করে নেয়। রিম্মি পুরো ঘটনা দেখল। তখনো সে বাসা থেকে বের হয়নি। এবার বেরিয়ে গেল। সোজা পাশের বিল্ডিংএ নীলাভ্রর বাসায় গিয়ে উঠল। নীলাভ্রর ঘরে ঢুকে রিম্মি দরজা বন্ধ করে দিল।
নীলাভ্র দুপুরের লাঞ্চ শেষ করে মাত্র ভাতঘুম দেওয়ার উদ্দেশ্যে বিছানায় শুয়েছিল। রিম্মিকে দেখে ব্যাঙের মতো লাফিয়ে উঠল। চমকিত গলায় বলল,
” রিম্মি তুমি?”
রিম্মি নীলাভ্রর দিকে অগ্রসর হয়ে বলল,” কেন আসতে পারিনা?”
” অবশ্যই আসতে পারো। কিন্তু হঠাৎ এইসময়? আম্মা তোমাকে দেখেনি?”
” নিশ্চয়ই দেখেছে। মা দেখেছে, ভাবী দেখেছে, ভাইয়াও দেখেছে।”
নীলাভ্র শুকনো ঢোক গিলে বলল,” কেউ কিছু বলেনি?”
” উহুম! কি বলবে? আমি তো কথাই বলতে পারিনা। আমার ইশারার ভাষাও কেউ বোঝে না। একমাত্র তুমি ছাড়া।”
রিম্মির গাল লাল হয়ে আসল। এর অর্থ রিম্মি মিথ্যে বলছে। কিন্তু মিথ্যেটা কি? নীলাভ্র জানেনা। সে ভীত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
” দরজা কেন বন্ধ করেছো রিম্মি? বাসার সবাই কি ভাববে?”
” কেউ কিছু ভাববে না। তুমি এখন আমাকে ভালোবাসবে।”
রিম্মি এই কথা বলেই গায়ের ওরনাটা ফেললো। তারপর জামার পেছনের চেইন খুলতে শুরু করল। নীলাভ্র আতঙ্কিত হয়ে উঠে এসে রিম্মিকে থামিয়ে বলল,
” এসব কি করছো? মাথাখারাপ হয়ে গেছে?”
রিম্মি চুপচাপ বিছানায় বসলো। জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগল। নীলাভ্র হাটু গেড়ে রিম্মির সামনে বসে বলল,
” কি হয়েছে তোমার ?”
” আচ্ছা একটা সত্যি কথা বলোতো?”
” তোমার সাথে কি মিথ্যা বলা যায়? তুমি তো আমার মনের কথা সবই জানো।”
” তবুও মুখে বলো। কে বেশি সুন্দর? আমি নাকি তোহা?”
নীলাভ্র ঘোর বিস্ময় নিয়ে বলল,” এইটা কেমন প্রশ্ন রিম্মি?”
” উত্তরটা আগে দাও।”
” তোহা আমার কাছে এখনো একটা বাচ্চা মেয়ের মতো। ওর সাথে তোমার কম্পারিজম কি করে হয়? তোহাকে তো আমি ছোটবোনের মতো দেখি।”
” আমার কথার সহজ উত্তর দাও। কে বেশি সুন্দর? ”
এই প্রথম নীলাভ্রর মনে হচ্ছে রিম্মি হিংসার আগুনে জ্বলছে। কিন্তু কেন? রিম্মির মতো কোমলমতি মেয়ে কাউকে হিংসাও করতে পারে? আশ্চর্য! নীলাভ্র বলল,
” তুমি বেশি সুন্দর। অন্তত আমার কাছে তুমি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দরী।”
রিম্মি বিজয়ীর হাসি দিয়ে নীলাভ্রর ঠোঁট দুটো আঁকড়ে ধরল, নিজের ঠোঁটের সাথে। নীলাভ্র ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়। পরমুহূর্তেই আবেশ তাকে গ্রাস করে। অটোমেটিক নীলাভ্রর হাত চলে যায় রিম্মির উন্মুক্ত পিঠে। রিম্মি নীলাভ্রর কলার ধরে হেচকা টানে বিছানায় নিয়ে এলো। নীলাভ্র শুয়ে পড়লো রিম্মির গায়ের উপর। আর রিম্মি তার নিচে। কিছুমুহূর্তের জন্য দুজনই ডুব দিল নিত্য কোনো আদিম সুখের সন্ধানে।
চলবে
( বেশি না। আর মাত্র কয়েক পর্ব। তারপরই ফ্ল্যাশব্যাক। বুদ্ধিমানেরা হয়তো এই পর্বেই অনেককিছু আন্দাজ করে ফেলবে।🤐)