#ধূসর_রঙে_আকাশ
#পর্ব_২৬
লিখা: Sidratul Muntaz
বাহিরের কথোপকথন শুনে রিম্মি দরজার ফাঁক দিয়ে দেখার চেষ্টা করলো। সে বুঝলো কোনো পুরুষ মানুষ এসেছে। আর তার সামনে সাহিল রীতিমতো ভয়ে কাঁপছে। আচ্ছা, তার কাছে গিয়ে কি সাহায্য চাওয়া উচিৎ? না থাক,সাহায্য চাওয়ার দরকার নেই। সাহিল এখন ওই মানুষটিকে নিয়ে ব্যস্ত। রিম্মি এই সুযোগে বেরিয়ে যেতে পারে। আর জীবনে সাহিলের সঙ্গে যোগাযোগ করবে না। আমীর চশমার ফাঁক দিয়ে রিম্মিকে দেখলো। সাথে সাথেই আঙুলের ইশারায় ডাকলো,
” এদিকে এসো।”
রিম্মি থতমত খেয়ে যায়। দরজা সম্পূর্ণ খুলে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। এদিকে সাহিলের কলিজা শুকিয়ে অর্ধেক। রিম্মি ছেঁড়া শার্ট নিয়ে বাহিরে আসতে সংকোচবোধ করছে। আমীর ভ্রু কুচকে আবার ডাকলো,
” কি হলো? এসো?”
রিম্মি মাথা নিচু করে খানিকটা এগিয়ে এলো। আমীর বললো,
” সাহিল, কে ও?”
সাহিল ইতস্ততবোধ নিয়ে বললো,” ফ্রেন্ড। আমার ফ্রেন্ড।”
আমীর চোখ ছোট করে রিম্মিকে আপাদমস্তক একবার দেখলো। গোয়েন্দার মতো প্রশ্ন করলো,
” লুকিয়ে কথা শুনছিলে কেন?”
রিম্মি অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। আমতা-আমতা করে কি বলবে ভেবে পাচ্ছিলো না। সাহিলের ছোট আত্মা শুকিয়ে কাহিল। এর আগে রিম্মি কিছু বলে দেয় তাই সে নিজেই বললো,
” ও একটা ছোট্ট কাজে এসেছিল ভাই৷ এখনি চলে যাবে৷ ওর স্কুল আছে। দোস্ত তুই বরং চলে যা। এখন আমি ব্যস্ত। আমরা অন্য আরেকদিন দেখা করবো।”
রিম্মি চোয়াল শক্ত করে ঠোঁট গুটিয়ে মনে মনে উচ্চারণ করলো,” তোর কি মনে হয়? আর জীবনে তোর এই চেহারা দেখবো আমি?”
রিম্মি মুখে কিছু বললো না। তার চলে যাওয়াই শ্রেয়। এখান থেকে বেঁচে কোনোমতে বাসায় ফিরতে পারলেই হয়েছে। সাহিলকে পরে দেখে নিবে। কিন্তু সোফায় বসে থাকা মানুষটিকে খুব চেনা লাগছে। কোথাও কি দেখেছে? মনে পড়ছে না। রিম্মি একথা ভাবতে ভাবতে দরজার কোণার সাথে বারি খেলো৷ চোখের উপরে হালকা ব্যথা পেয়ে বললো,
” আউ।”
তারপর আবার ঘুরে সাহিল আর আমীরের দিকে তাকালো। আমীর ওর দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে। রিম্মি শার্টের ছেঁড়া অংশটা হাত দিয়ে খুব সাবধানে ঢেকে রেখেছে। আমীরের চোখ ঘুরে-ফিরে সেদিকেই আটকে যাচ্ছে। রিম্মি দরজা দিয়ে বের হওয়ার সময় সাহিল কাপা কাপা কণ্ঠে বললো,
” তোর ব্যাগটা কে নিবে ইডিয়েট?”
তারপর হাসার চেষ্টা করে বললো,” ব্যাগ নিয়ে যা।”
রিম্মি থামলো। সাহিল ব্যাগটা নেওয়ার জন্য খুড়িয়ে খুড়িয়ে সোফার কাছে আসলো। রিম্মি ততক্ষণে আমীরকে আরও ভালোমতো দেখার সুযোগ পেল। উফফ, মানুষটাকে সে কোথায় যেন দেখেছে, একটুও মনে পড়ছে না। বিরক্ত লাগছে। কেন মনে পড়ছে না? আমীর জিজ্ঞেস করলো,
” পায়ে কি হয়েছে সাহিল?”
সাহিল ব্যাগটা তুলে বললো,” এক্সিডেন্ট করেছি ভাই। মেইন রোডে হাটছিলাম। হঠাৎ একটা মিনি ট্রাক এসে লাগিয়ে দিল। ছিটকে গিয়েছিলাম তাই শুধু ব্যথা পেয়েছি। ট্রাকের নিচে চলে যাইনি। নাহলে এতোক্ষণে ভোগে থাকতাম।”
আমীর বললো,” সাবধানে চলা-ফেরা করা উচিৎ। তাছাড়া আজ-কাল ড্রাইভারদেরও বিশ্বাস নেই। হুট-হাট এসে লাগিয়ে দেয়। বুঝি না ব্রেক কন্ট্রোল করতে জানেনা এরা গাড়ি নিয়ে বের হয় কোন সাহসে?”
রিম্মির এতোক্ষণে মনে পড়লো। সাথে সাথেই ভেতরের জমে থাকা রাগটা ফোঁস করে জ্বলে উঠলো। চোখ-মুখ শক্ত হয়ে আসলো। রিম্মি রাশভারী কণ্ঠে বললো,
” আমারও একই প্রশ্ন। মানুষ ব্রেকই কন্ট্রোল করতে জানেনা। অথচ ভাব দেখিয়ে ল্যাম্বোরগিণি নিয়ে বের হয়। সেই ভাবের ঠেলায় ছোট-খাটো চামচিকার মতো সাইকেল তাদের চোখে পড়ে না। এক-দু’টা সাইকেল ভেঙে গুড়িয়ে গেলেও কিচ্ছু যায় আসেনা। বরং বেচারী সাইকেলচারীকেই ধমক শুনতে হয়।”
রিম্মি ব্যঙ্গ করে আমীরের কণ্ঠ নকল করে বললো, ” হাউ ডেয়ার ইউ টেইক সাচ আ চিপ বাইক ডাউন দ্যা রোড? স্টুপিড গার্ল! কি সুন্দর বিচার তাইনা? তার ল্যাম্বোরগিণির দাম আছে। আর আমার সাইকেল চিপ? আরে সেই-ই তো বিশাল ল্যাম্বোরগিণিটা নিয়ে আমার ছোট্ট সাইকেল ধাক্কা মেরেছে। এখন আমার সাইকেলটা যে ভাঙলো সেই দাম কে দিবে? আর দাম দেওয়া তো দূরে থাক, অন্তত একটা ছোট্ট সরি ও কি বলা যেতো না? সরি তো পেলামই না উল্টা আমাকেই ধমক শুনতে হলো। ব্যথা পেলাম আমি,ক্ষতি হলো আমার আর বকাও শুনলাম আমি। স্টুপিডও হলাম আমি। অবশ্য আমি তো আসলেই স্টুপিড। নাহলে কোন ব্রিটিশের ব্রিটিশ,নবাবের নবাব, এদের থেকে আবার কার্টেসী এক্সপেক্ট করি? এরা তো ভাবের ঠেলায় কথাই বলতে জানেনা। মানুষকে মানুষ মনে করেনা। আমি স্টুপিড বলেই এদের থেকে ভালো বিহেভিয়ার আশা করেছিলাম। এই নবাবদের জন্যই এদেশে থাকতে মন চায়না। যত্তসব হিপোক্রিটের দল!”
রিম্মি ছো মেরে স্কুল ব্যাগটা সাহিলের হাত থেকে নিল। আমীরের দিকে একবার অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে হনহনিয়ে বের হয়ে গেল। আমীর শান্ত দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। সাহিল ঠোঁট উল্টে বললো,
” ভাই, ও কি বললো আপনি বুঝেছেন?”
আমীর জবাব দিল না। সে একধ্যানে রিম্মির চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। সাহিল বললো,
” আমি নিজেও বুঝিনাই আপনি আর কি বুঝবেন? আসলে ওর শরীরটা ভালো নাই। তাই হয়তো মাথার স্ক্রু ঢিলা হয়ে গেছে। মাথায় সমস্যা দেখা দিচ্ছে। আপনি কিছু মনে করবেন না ভাই।”
আমীর ভাবলেশহীন মুখে বললো,
” আমাকে এক গ্লাস পানি দেবে সাহিল?”
” এখনি দিচ্ছি ভাই।”
সাহিল ফিল্টার থেকে পানি আনার জন্য বেডরুমে গেল। ফিরে এসে দেখলো আমীর আর নেই। চলে গেছে। অদ্ভুত!
রিম্মি ব্যাগটা কাধে নিয়ে রাস্তায় হাঁটছে। মনে মনে আমীরকে বকছে সাথে সাহিলকেও। তবে আমীরের জন্য আজ অনেক বড় বিপদের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে সে। আমীর যেমন তার বড় ক্ষতি করেছে তেমনি বড় উপকারও করেছে। ক্ষতি-উপকারে কাটাকাটি করে নেওয়া যায়। তবুও রাগটা কমছে না। কারণ আমীর ওকে স্টুপিড গার্ল বলেছে। ওর প্রিয় সাইকেলকে চিপ বলেছে। এতো অপমান ভুলবে কি করে? রিম্মি আরও কিছুটা সামনেই যেতেই দেখলো তার মতো ড্রেস পড়া তিনটি মেয়ে একসাথে হাটছে। মনে হয় রিম্মির স্কুলের। সে দৌড়ে ওদের কাছে গেল। এরা তো রিম্মিরই ফ্রেন্ড। শেহেরজান, ঊষা আর পিংকি। সবাই বাঙালী। বাঙালী বলেই রিম্মির সাথে ওদের ঘনিষ্টতা বেশি। শেহেরজান সবার আগে রিম্মিকে দেখলো। তারপর পিংকি আর ঊষাকেও দেখালো। তিনজনই থেমে দাড়ালো। রিম্মি ওদের কাছে গিয়ে কোমড়ে হাত রেখে বললো,
” তোরা এদিকে কি করছিস? ক্লাস নেই?”
তিনজনই একসাথে প্রশ্ন করলো,” তার আগে বল তুই এখানে কি করছিস?”
” আমি ঘুরতে এসেছি।”
শেহেরজান বললো,” আমরা ট্রিট নিতে এসেছি।”
” কিসের ট্রিট?”
ঊষা চোখ মেরে বললো,” আজকে পিংকির বার্থডে। তাই ও আমাদের ট্রিট দিতে নিয়ে এসেছে।”
রিম্মি বললো,” সত্যি পিংকি?”
পিংকি হেসে হ্যাসূচক মাথা নাড়লো। রিম্মি বললো,
” তোরা কি এজন্য ক্লাস মিস দিয়েছিস?”
শেহেরজান বললো,” হ্যা। ফ্রেন্ডের বার্থডে বলে কথা। দু-একটা ক্লাস তো মিস দেওয়াই যায়।”
রিম্মি তালি বাজিয়ে বলল,” বাহ! তাহলে আমি কেনো বাদ যাবো? আমারো তো সমান অধিকার আছে ট্রিট পাওয়ার। তাইনা?”
পিংকি বললো,” থাম,থাম। তোর আমার জন্মদিনের কথা মনে ছিল?”
রিম্মি জীভ কেটে বললো,” উহুম।”
” যে আমার জন্মদিনই মনে রাখেনা তাকে ট্রিট কেন দিবো?”
শেহেরজান আর ঊষা তাল মিলিয়ে বললো,” হ্যা তাইতো। যা যা, তুই বাদ।”
রিম্মি হাত ভাজ করে বললো,” ঠিকাছে, লাগবে না তোদের ট্রিট। তোরাই ইনজয় কর।”
রিম্মি চলে যেতে নিচ্ছিল। পিংকি একহাত ধরে ওকে থামালো,
“আরে দাঁড়া,দাঁড়া। তোর শার্ট ছিঁড়লো কিভাবে?”
পিংকির কথায় বাকি দুজনও বিষয়টা খেয়াল করলো। ওরাও জিজ্ঞেস করলো,
” আসলেই তো। শার্ট কিভাবে ছিঁড়লো?”
রিম্মি সাহিলের বিষয়টা ওদের বলতে চাইলো না। পরে ওরা রিম্মি সম্পর্কেই নেগেটিভ ভাবতে শুরু করবে। রিম্মি বললো,
” সিড়ি থেকে পড়ে গেছিলাম। তারপর দ্রুত উঠতে গিয়ে টান লেগে ছিঁড়ে গেছে।”
শেহেরজান বললো,” ওহহো! খারাপ দেখা যাচ্ছে। তুই আমার জ্যাকেট পড়ে ফেল।”
শেহেরজান কোমরে বাধা জ্যাকেট খুলে রিম্মিকে দিল। রিম্মি ওইটা গায়ে জড়িয়ে বললো,” থ্যাঙ্কিউ। ”
এবার চারজন একসাথে হাটতে লাগলো।শেহেরজান একহাতে রিম্মির গলা জড়িয়ে বললো,
” এখন বলতো, কাল স্কুলে আসিস নি কেন?”
রিম্মি বললো,” আরে কাহিনি কি হয়েছে জানিস? আমার সাইকেলটা তো শেষ। ”
তিনজন একসঙ্গে উচ্চারণ করলো,” কি?”
ওরা সবাই জানে রিম্মির কাছে সাইকেলটা কত বেশি প্রিয়। তাই সবার এমন সিরিয়াস প্রতিক্রিয়া। রিম্মি সাইকেল ভাঙনের ঘটনা খুলে বললো। ঊষা গালে হাত রেখে বললো,
” আহারে! ল্যাম্বোরগিণিওয়ালাটা তো আস্তো একটা শয়তান।”
রিম্মি বললো,” চাড়াল, চাড়াল। নাম্বার ওয়ান চাড়াল। আজকে পেয়েছিলাম তো ব্যাটাকে। ইচ্ছেমতো ধুয়ে দিয়েছি। শালা ল্যাম্বোরগিণি চালিয়ে নিজেকে বিল গেটস মনে করে। আমার সাইকেল ভেঙে আমাকেই বলে স্টুপিড গার্ল। ইচ্ছে করছিল বলতে ব্যাটা তুই স্টুপিড, তোর বাপ স্টুপিড, তোর চৌদ্দ গুষ্টি স্টুপিড। শুধু ভদ্রতার খাতিরে কিছু বলিনি..”
রিম্মির কথার মাঝখানেই চশমা পরিহিত একটা ছেলে বিনয়ী কণ্ঠে বললো,
” একটু শুনবেন?”
রিম্মি তাকিয়ে দেখল আমীর। সাথে সাথেই চোখ বড় হয়ে গেল। হৃৎপিন্ডে জোরেসোরে চাপ অনুভব হলো।আমীরের চোখ দুটো ছোট হয়ে আছে। মুখে হালকা হাসির ছাপ। ছেলেটাকে দেখতে মারাত্মক সুন্দর লাগছে। শেহেরজান, ঊষা, পিংকি তব্দা লেগে তাকিয়ে আছে। রিম্মি আচমকা দৌড় দিল। একটু আগে সে যেসব কথা বলেছে তার জন্য ছেলেটা আবার তাকে ধুয়ে না দেয়। শেহেরজান, পিংকি আর ঊষা পড়ে গেল অস্বস্তিতে। রিম্মির দৌড় দেওয়া দেখে তারা কি করবে বুঝতে পারছে না। আমীর সরলগলায় প্রশ্ন করলো,
” উনি চলে গেলেন কেন? ”
মেয়েগুলো কি বলবে বুঝতে না পেরে হাসলো৷ আমীর বলল, “আপনারা কি কাইন্ডলি একটু ডেকে আনবেন উনাকে?”
তিনজন চোখাচোখি করলো। তারপর হাসার চেষ্টা করে ঘাড় নাড়িয়ে ওরাও দৌড় দিল রিম্মির পেছনে। রিম্মি অনেকটা দূর গিয়ে থামলো। হাটুতে ভর দিয়ে হাঁপাতা হাঁপাতে চিন্তা করতে লাগলো, ছেলেটা কি ওইসময় হাসছিল? নাকি রেগে ছিল? ছেলেটার চোখ দুটো ছোট হয়েছিল। ঠোঁট হালকা প্রসারিত ছিল। মনে তো হচ্ছে একটু হাসছিল৷ কিন্তু হাসবে কেন? রিম্মি যেসব কথা বলেছে তাতে তো হাসার কথা নয়। উল্টা রেগে যাওয়ার কথা। হাসার চান্স যদি সত্তর পারসেন্ট হয় তাহলে রেগে যাওয়ার চান্স ত্রিশ পারসেন্ট। ঊষা, শেহেরজান আর পিংকি রিম্মিকে এসে বললো ছেলেটা ওকে ধরে নিয়ে যেতে বলেছে। রিম্মি ভয়ে আরেক দফা পালাতে চাইলো। তারপর ভাবলো, সে কেন পালাচ্ছে? অন্যায় তো সে করেনি। ওই ছেলেটাই করেছে৷ তাহলে তার পালানোর প্রশ্ন আসেনা। রিম্মি ওদের সাথে গেল। কিন্তু পরে আমীরকে আর পাওয়া গেল না।
আসল ঘটনা ঘটলো এরপরদিন। সেদিন ছিল উইকেন্ড। রিম্মির স্কুল ছুটি। স্বভাবতই ছুটির দিন সবাই একটু দেরিতে ঘুম থেকে উঠে। কিন্তু বাসায় এতো হৈচৈ হচ্ছিল যে রিম্মির ঘুম আর দীর্ঘায়িত হলোনা। সবাই এমনভাবে চেচামেচী করছিল যেন বাসায় ভূমিকম্প হয়েছে। রিমি ঘুমো ঘুমো চোখে বাথরুমে গেল। টুথব্রাশে পেষ্ট লাগিয়ে বারান্দায় এসে দাড়াতেই দেখলো তার বাসার নিচে প্রায় ত্রিশটার মতো বাইসাইকেল। সবকয়টা সাইকেলই আগের সেই ভাঙা সাইকেলটার মতো। সাথে একটা বিশাল ল্যাম্বোরগিণি। ল্যাম্বোরগিণির সাথে ঠেস দিয়ে দাড়িয়ে আছে সেই আশ্চর্য সুন্দর ছেলেটা। বিস্ময়ে রিম্মির হাত থেকে টুথব্রাশ পড়ে গেল। তনিমা মুনকে কোলে নিয়ে দৌড়ে রিম্মির কাছে এসে চঞ্চল গলায় বললেন,
” রিম্মি দ্যাখ দ্যাখ, কি কান্ড ঘটেছে দ্যাখ।একটা ধনী যুবক এত্তোগুলো সাইকেল এনে তোর নাম করে খুঁজছে। এগুলো নাকি তোর উপহার। কি অবস্থা বল দেখি? মহল্লার সবাই দৌড়ে চলে এসেছে দেখতে। তুই নিচে আয় মা, জলদি নিচে আয়।”
রিম্মি অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। এর আগে কখনো তনিমা তাকে ‘মা’ বলে সম্বোধন করেনি। আজ করেছেন। এই শব্দটা রিম্মির কানে প্রতিধ্বনির মতো বাজছে৷ তনিমা তাড়া দিয়ে বললেন,
” কিরে আসবি না? ছেলেটা তো বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে। কতবার যে ভিতরে আসতে বললাম। কিন্তু এলো না৷ বললো তোকেই নিচে নামতে হবে। আচ্ছা ছেলেটা কি তোর বন্ধু? কেমন বন্ধুরে? নিশ্চয়ই খুব ক্লোজ ফ্রেন্ড তাইনা? বোঝাই যাচ্ছে। নাহলে কি একটা সাইকেল ভাঙায় একসাথে একদম সাইকেলের দোকান তুলে আনে? আয়, আয় জলদি নিচে আয়।”
রিম্মি হুড়মুড়িয়ে সিড়ি দিয়ে নেমে দ্রুত গতিতে নিচে গেল। আমীর শান্তভাবে দাঁড়িয়ে আছে। ভরাট পরিবেশ। চারপাশে মানুষ জড়ো হয়েছে। রিম্মির নিজেকে ভিআইপি মনে হচ্ছে। সবাই যেন তার আগমনের অপেক্ষাতেই ছিল। অন্তরা রিম্মির থুতনি ছুয়ে বললো,
” কিরে পাকনি! কি কাহিনি ঘটিয়েছিস বলতো? ডুবে ডুবে জল খাওয়া হচ্ছিল বুঝি? তোর যে এমন রাজপুত্রের মতো দেখতে ফ্রেন্ড আছে আগে কখনো বলিস নি তো? দ্যাখ তোর জন্য কত্তগুলি সাইকেল এনেছে। এসব দিয়ে একটা সাইকেলের ফ্যাক্টরি খোলা যায়। কি বলিস?”
অন্তরা খিলখিলিয়ে হাসছে। রিম্মি আজকে সবার আচরণ দেখে শুধু অবাকই হচ্ছে। অন্তরা এর আগে কখনো রিম্মির সাথে ভালো করে কথা বলেনি। কাজের মেয়ের মতো ব্যবহার করতো। অথচ আজ কি সুন্দর করেই না কথা বলছে। মনে হচ্ছে অন্তরা সত্যি তার বড়বোন। রিম্মি এগিয়ে গেল আমীরের দিকে। আমীর মুচকি হেসে বলল,
” হায়, কেমন আছেন?”
” আপনি? হঠাৎ এতো সাইকেল নিয়ে আমার বাসায়? আমি না কিছু বুঝতে পারছি না।”
আমীর মাথা নিচু করে একটু হাসলো। চশমা ঠিক করে বললো,
” আমিও কিছু বুঝতে পারছি না। হঠাৎ ইচ্ছে করলো আপনাকে সরি বলতে। কোন উপায়ে সরি বললে ব্রিটিশ, নবাব, ভাবওয়ালা পদবীগুলো নামের পাশ থেকে সরবে মাথায় আসছিল না। তারপর ভাবলাম একটা সাইকেল ভাঙার কারণেই তো আমার নামের পাশে ব্রিটিশ,নবাব,অহংকারীর মতো পদবীগুলো যুক্ত হয়েছে। তাহলে সেই একটা সাইকেলের বদলে দশটা সাইকেল নিয়ে এলে কেমন হয়? তারপর ভাবলাম দশটা না, তিনগুণ। কারণ পদবী তো তিনটা। আমাকে তিনটা কলুষিত চরিত্র থেকে নিজেকে মুক্ত করতে হবে তাইনা? এজন্য ত্রিশটা।”
রিম্মি গোল গোল চোখ করে মুখ হাত দিয়ে বললো,
” তাই বলে ত্রিশটা? এতো সাইকেল? আপনি কি পাগল?”
” এ পৃথিবীতে সবাই পাগল। শুধু পাগলামির ধরণ আলাদা। একেক জনের পাগলামির ধরণ একেক রকম।”
” আচ্ছা আপনি আমার বাসার ঠিকানা পেলেন কোথায়?”
” সাহিলের থেকে নিয়েছি।”
” আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। এতো সাইকেল দিয়ে আমি কি করবো?”
” আপনার যা ইচ্ছা তাই করবেন। চাইলে আমার ল্যাম্বোরগিণিটা ভেঙে ফেলতে পারেন।”
রিম্মি চমকিত গলায় বললো,” কি?”
” এটা দিয়েই তো আপনার সাইকেল ভেঙেছিলাম। মনে নেই? আপনি বরং রিভেঞ্জ নিয়ে নিন।”
রিম্মি ভীতগলায় বললো,
” না বাবা, দরকার নেই। একটা ল্যাম্বোরগিণি ভেঙে ত্রিশটা ল্যাম্বোরগিণি এনে দেওয়ার সাধ্য আমার নেই।”
আমীর একথা শুনে হু হা শব্দে হেসে উঠলো। রিম্মির চারপাশ ঝলমল করতে লাগলো। এতো আনন্দ আগে কখনো লাগেনি। আমীর হাসি থামিয়ে বললো,
” ত্রিশটা ল্যাম্বোরগিণি লাগবে না। এই ত্রিশটা সাইকেলের মধ্যে যেকোনো একটায় আমাকে চড়ান। তাহলেই হবে।”
” আপনি আমার সাথে সাইকেলে চড়বেন?”
” হুম। কেন? আমাকে সাইকেলের পেছনে বসাতে আপনার কি অসুবিধা আছে?”
” না না, অসুবিধা কেন থাকবে?”
” তাহলে চড়াবেন?”
রিম্মি লজ্জিত মুখে নতমাথা উপর-নিচ করলো। আমীর বললো,
” ভেরি গুড। তাহলে চলুন। আজকে আপনাদের এলাকা ঘুরবো।”
” সত্যি বলছেন?”
” আমি এক্সট্রিম ইমার্জেন্সী ছাড়া মিথ্যা বলি না।”
” কোন সাইকেলটা নিবো?”
” সব তো একই। আপনার যেটা ইচ্ছা হয় নিন।”
রিম্মি প্রথমে একটা সাইকেল ধরে বললো,” এইটা?”
আমীর বললো,” ওকে।”
রিম্মি বললো,” আচ্ছা না না, এটা?”
” ঠিকাছে।”
” এক মিনিট, এইটা নেই। এটা সবচেয়ে ভালো। ”
রিম্মির আনন্দে প্রায় দিশেহারা অবস্থা। আমীর হাসতে হাসতে বললো,” বললাম তো, সব একই। যেটা ইচ্ছা নিন।”
রিম্মি লজ্জারাঙা মুখে হেসে বললো,” ঠিকাছে তাহলে এটাই।”
” আচ্ছা।”
রিম্মি সাইকেলে চড়ে বসলো। আমীর বসলো বিপরীত দিকে ঘুরে ওর পেছনে। দুজনের পিঠের সাথে পিঠ লেগে রইলো। রিম্মির শরীরে তীক্ষ্ণ শীহরণ বয়ে যায়। সাইকেল চলতে শুরু করে। রিম্মির লালচে লম্বা চুলগুলো আমীরের ফরসা মুখে লেপ্টে যেতে থাকে।
চলবে
( আগামী কয়েক পর্বে শুধু রিম্মির পাগলামি থাকবে। এরপর আসবে তোহার ভয়ংকর পাগলামি। যেটার জন্য আমি সবচেয়ে বেশি এক্সাইটেড। 😬)