ধূসর রঙে আকাশ পর্ব- ২৭

0
951

#ধূসর_রঙে_আকাশ
#পর্ব_২৭
লিখা: Sidratul Muntaz

রিম্মি আর আমীর এখন হাটছে ইয়ারা ভেলির ল্যাভেন্ডার ফার্মে। এ জায়গায় আগে কখনো আসা হয়নি রিম্মির। অথচ আমীর নাকি প্রায়ই আসে৷ রিম্মির ঘুরাঘুরির অনেক শখ থাকলেও সৎমায়ের অতিরিক্ত শাসনের চাপে কখনো কোথাও ঘুরতে যেতে পারেনি সে। তাকে ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার মতো কেউ নেইও। আজকে আমীর ওকে এ জায়গায় নিয়ে এসেছে বলেই সে আসতে পেরেছে। নাহলে জীবনেও আসা হতোনা। দেশটা যে এতো সুন্দর এই ল্যাভেন্ডার ফার্মে এসে উপলব্ধি হচ্ছে রিম্মির। আমীর বলেছে এর চেয়েও হাজারগুণ সুন্দর জায়গা আছে। রিম্মি খুব এক্সাইটেড। আজকে পুরোটা জায়গা ঘুরবে সে। আমীর তার ল্যাম্বোরগিণি নিয়ে এসেছে। প্রায় আধঘণ্টা রিম্মি আমীরকে সাইকেলে ঘুরিয়েছিল। বিনিময়ে আমীর তাকে সারাদিন ল্যাম্বোরগিণি করে ইয়ারা ভ্যালি ঘুরাবে। কত্ত মজা!
ল্যাভেন্ডারের সুভাষ অনেক সুন্দর। ইচ্ছে করে সারাক্ষণ নাকে লাগিয়ে রাখতে। রিম্মি ফুলগুলো ধরে ঘ্রাণ নিচ্ছিল। আমীর তাড়া দিয়ে বললো,
” সারাদিন কি এখানেই পার করবে রিম্মি? চলো তোমাকে আরেকটা সুন্দর জায়গায় নিয়ে যাই।”
রিম্মি বললো,” আসছি।”
মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আমীর রিম্মিকে ‘তুমি’ বলতে শুরু করেছে৷ রিম্মির কাছে ব্যাপারটা অস্বাভাবিক লাগছে না। বরং শুনতে বেশ ভালোই লাগছে। সে কয়টা ল্যাভেন্ডার ফুল ছিড়ে ব্যাগে ভরে নিল। বাসায় গিয়ে মুনকে দিবে। অন্তরা আজকে খুব ভালো ব্যবহার করেছে রিম্মির সাথে। তাই অন্তরাকেও দিবে। রিম্মি আমীরের গাড়িতে উঠলো। ল্যাভেন্ডারের ঘ্রাণ শুকতে শুকতে বললো,
” আচ্ছা, আপনি সারাখন চশমা পড়ে থাকেন কেন?”
আমীর পাল্টা প্রশ্ন করলো,” কেন? চশমায় কি প্রবলেম?”
” চশমা পড়ে রাগী মানুষরা। আপনি কি রাগী?”
” একটু একটু।”
রিম্মি আমীরের দিকে ঘুরে উৎসুক গলায় বললো,” তাই? একটু রাগ দেখান তো।”
আমীর ভ্রু বাঁকিয়ে কটমট চোখে তাকালো। রিম্মি হাতে তালি বাজিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠলো। আমীর শব্দ ছাড়া মিটিমিটি হাসলো। রিম্মি বললো,” আচ্ছা এবার চশমাটা খুলে ফেলুন।”
” কেন?”
” দেখবো, চশমা ছাড়া আপনাকে কেমন দেখায়।”
” ভালো না। বোকা বোকা দেখায়।”
” তবুও দেখি, প্লিজ প্লিজ।”
আমীর চশমা খুললো। রিম্মি মুখ হা করে বললো,
” হায় আল্লাহ, পুরা ইনোসেন্টের ডিব্বা। আপনাকে তো চশমা ছাড়াই কিউট লাগে। আর চশমা পড়লে রাগী রাগী লাগে। গোমরামুখো টাইপ। আচ্ছা একটু চশমাটা দিন তো আমি পড়বো। আমাকে কেমন লাগে দেখি।”
” না না। তোমার পড়তে হবে না। এইটার অনেক পাওয়ার। সহ্য করতে পারবে না। ”
” কি যে বলেন! আমার আব্বুর চশমার পাওয়ার ছিল মাইনাস সিক্সটি ফাইভ। সেই চশমাই আমি দেড় মিনিট অনায়াসে পড়ে বসে থাকতে পারতাম। আপনারটার পাওয়ার আর কত হবে?”
রিম্মি একথা বলতে বলতে চশমাটা নিয়ে চোখে দিয়ে ফেললো। সাথে সাথেই যেন দুনিয়ায় অন্ধকার নেমে আসে। এক ন্যানোসেকেন্ডের মধ্যে রিম্মি একটা চিৎকার দিয়ে চশমাটা চোখ থেকে খুললো। মাথাটা তুমুল গতিতে ঘুরছে। আমীর ব্রেক কষলো। রিম্মির মাথা হেলে পড়েছে আমীরের কাধে। আমীর ওর হাত থেকে চশমাটা নিয়ে আত্মবাদী কণ্ঠে বললো,
” আগেই বলেছিলাম। সহ্য করতে পারবে না। অনেক পাওয়ার।”
রিম্মি ক্ষীণ কণ্ঠে বললো,” এটা কি চশমা? মনে হচ্ছে কয়েক সেকেন্ডের জন্য ব্ল্যাকহোলে চলে গেছিলাম। আপনি এই চশমা কিভাবে পড়েন?”
” এটা কোনো চশমা না। বলতে পারো মিনি এক্সরে মেশিন অথবা স্ক্যানার।”
রিম্মি আমীরের কাধ থেকে মাথা উঠিয়ে ঘাবড়ানো গলায় বললো,” মানে?”
” এই চশমাটা আমার কাছে অনেক স্পেশাল। আমার প্রাণ ভোমরা। এর মাধ্যমে আমি যেকোনো মানুষের শারীরিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে পারি। দারুণ না?”
রিম্মি নির্বোধের মতো ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। আমীর একটু বিস্তারিত বললো,
” যেমন তোমার শরীরের ভেতর কোথায় কি হচ্ছে, কিভাবে হচ্ছে, সব কিন্তু আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। তোমার ব্লাড প্রেশার এখন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। রিডিং হচ্ছে ১৪০/৯০। একটু পরেই শরীর থেকে ঘাম বের হবে। দেখো, অলরেডি ঘামতে শুরু করেছো।”
আমীর রিম্মির কপাল থেকে একফোঁটা ঘাম আঙুলের ডগায় নিয়ে দেখালো। রিম্মি হতভম্ব গলায় বললো,
” আপনি এই চশমা পরে শরীরের ভেতর দেখতে পারেন?”
” হুম।”
” সব দেখতে পারেন?”
” হ্যা।”
রিম্মি নিজেকে গুটিয়ে নিতে লাগলো। আমীর হেসে বললো,” বিশ্বাস হচ্ছে না? ভয়ের কিছু নেই। আমি বলছি শোনো, তোমার বামপায়ের উরুতে একটা গভীর ক্ষত চিহ্ন আছে। চিহ্নটা চার বছর তিনমাস পুরনো। আর হাটুর নিচে বামসাইডে একটা কাটা দাগ আছে। তিনদিন আগের। মনে হয় সাইকেল থেকে পড়ে ব্যথা পেয়েছিলে। ঠিক না?”
রিম্মি সাথে সাথে বিপরীত দিকে ঘুরে বসলো। আতঙ্কে অস্থির হয়ে বললো,” একদম আমার দিকে তাকাবেন না। এতো নোংরা জিনিস চোখে লাগিয়ে ঘুরছেন? আপনার নামে তো মামলা করা উচিৎ। ”
” নোংরা কেন? এটা তো ক্লিনই আছে। ও বুঝেছি, রিম্মি আমি কিন্তু শরীরের ভেতরে বলতে স্কিনের ভেতর বুঝিয়েছি। কাপড়ের ভেতর না।”
” যে চশমা দিয়ে স্কিনের ভিতর দেখা যায় সেটা দিয়ে কাপড়ের ভিতর দেখা যায় না?”
” না যায়না। এমন সস্তা কাজে আমি এতো দামী জিনিস ইউজ করতে যাবো কেন?”
” আমি আর আপনার সামনেই থাকবো না ধূর!”
রিম্মি দরজা খুলে বেরিয়ে যেতে নিচ্ছিলো। আমীর বললো,
” আচ্ছা চশমা খুলে ফেলছি। তুমি বসো প্লিজ। যেওনা।”
রিম্মি আঙুল উঠিয়ে বললো,” এই চশমা আর কখনো আমার সামনে পরবেন না আপনি। বাজে চশমা।”
” আচ্ছা, পরবো না। কিন্তু এটা বাজে চশমা না।”
” এটা বাজে চশমাই।”
সন্ধ্যায় ওদের ঘুরাঘুরি শেষ হয়। আমীর রিম্মিকে তার বাসায় যাওয়ার প্রস্তাব দিল। রিম্মি এক চুটকিতে রাজি হয়ে গেল। সারাদিন একসাথে থাকার পর আমীরের প্রতি অচিরেই গাঢ় বিশ্বাস তৈরী হয়ে গেছিল তার মনে। তাছাড়া আমীরকে দেখার পর তার বাসা দেখার খুব আগ্রহ হচ্ছে রিম্মির। যে মানুষের চশমাই এতো বিস্ময়কর তার বাড়িটা না জানি আরও কত বিস্ময়কর হবে। নিশ্চয়ই বিস্ময়ের কারখানা থাকবে সেখানে। তার ধারণা মিথ্যে হলো না। বাড়িটা ট্রিপ্লেক্স। পুরো বিল্ডিং সাদা। মেইন গেইটে দুইজন পালোয়ানের মতো মানুষ রিভলবার হাতে দাঁড়ানো। ওদের গায়ে কালো কোর্ট। মনে হচ্ছে আমেরিকা থেকে জাসুস এসেছে। আমীর ফিংগারপ্রিন্ট দিয়ে গেইট খুললো। রিম্মিকে দরজার সামনে একটা গোল জায়গায় এসে দশসেকেন্ড দাড়িয়ে থাকতে হয়। একটা চিকন গোলাকার সাদা বর্ণের রশ্মি ওর শরীর বেয়ে প্রবাহিত হয়। এটা নাকি স্ক্যানার। রিম্মির সাথে কোনো ঝুঁকিপূর্ণ অস্ত্র আছে কিনা সেটা ডিটেক্ট করার জন্য এই ব্যবস্থা। রিম্মি প্রশ্ন করলো,
” আচ্ছা, আপনার চোখের চশমাটা তো সব স্ক্যানারের বাপ। তাহলে আবার আলাদা করে আমাকে স্ক্যান করা হলো কেন?”
আমীর মৃদু হেসে বললো,” এ বাসায় যারা আসে সবাইকে তো আমি চশমা দিয়ে ইনডিভিজুয়ালি স্ক্যান করতে পারবো না। তাই এই ব্যবস্থা।”
” ও আচ্ছা।কিন্তু আমাকে তো অনেক আগেই স্ক্যান করেছেন। তাহলে আবার কেন?”
” এটা নিয়ম তাই।”
” ও।”
রিম্মি বাসায় ঢুকে ছোট একটা ধাক্কা খেল। কি বিশাল বাড়ি! বাহিরে থেকে দেখলে বোঝাই যায়না। সব দেয়ালের রঙ ঘন কালো। মেঝেতে রেড কার্পেট। ড্রয়িংরুমের দুইপাশে বিশাল আকৃতির স্টিল সিড়ি। মাঝখানে গোল ফিশ পন্ড। মাছগুলো অদ্ভুতরকম দেখতে। এরকম মাছ রিম্মি আগে দেখেনি। বিলাসী সোফায় একটা রোবটের মতো ছেলে বসে বই পড়ছে। গায়ের রঙ কালো। চুলগুলো ঘাসের মতো সোজা,দাঁড়ানো। গায়ে কালো শার্ট। মনে হচ্ছে খুব গম্ভীর ধরণের মানুষ। আর বেশ মনোযোগ দিয়ে সে বইটা পড়ছে। দু’জন মানুষ ওর সামনে দিয়েই ঘরে ঢুকে যাচ্ছে তাও সে একবারের জন্য তাকাচ্ছে না। ওর চোখেও চশমা। এই চশমা দিয়েও কি সব স্ক্যান করা যায়? রিম্মি নিজেকে আড়াল করার জন্য আমীরের পেছনে লুকিয়ে পড়লো। আমীর ছেলেটিকে উদ্দেশ্য করে বললো,
” সানভী।”
ছেলেটা বইয়ে দৃষ্টি রেখেই উচ্চারণ করলো,” হুম?”
” আওয়ানের ফাইলটা চেক করতে বলেছিলাম। করেছিস?”
” কমপ্লিট। তোর ডেস্কে সব রাখা আছে।”
” ওকে।”
আমীর সিড়ি বেয়ে উঠতে লাগলো। রিম্মি ওর পেছনে যেতে যেতে বললো,
” আপনার ভাই?”
” কি মনে হয়?”
” একদমই আপনার ভাইয়ের মতো মনে হচ্ছে না। দুজনের চেহারায় বিস্তর ফারাক।”
” ও আমার ক্লোজ ফ্রেন্ড। এখানেই আমার সাথে থাকে। আমরা ছয়বন্ধু মিলে থাকি।”
” ও, তাহলে বাড়িটা কার?”
” আগে ছিল শুধু আমার বাবার। এখন আমাদের সবার।”
” আচ্ছা, উনার চোখেও তো চশমা। ওই চশমা দিয়েও কি সব স্ক্যান করা যায়?”
আমীর ফিক করে হেসে বললো,” না। ওইটা আলাদা চশমা।”
রিম্মি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। তবুও তাকে খুব সাবধানে থাকতে হবে। আমীর রিম্মিকে নিয়ে তিনতলায় গেল। পুরো তিনতলা জুড়ে শুধু একটা রুম। এটাই আমীরের রুম। এই রুমটা ঠিক কতবড় সেটা পরিমাপ করা সম্ভব না। পুরো বাড়িটার ক্ষেত্রফল আর এই রুমের ক্ষেত্রফল সমান। তবে আয়তনে পার্থক্য আছে। কারণ উচ্চতা এক নয়। পুরোবাড়ির তিন ভাগের একভাগ উচ্চতা এই রুমের। ওরা রুমটায় ঢোকার সময় অটোমেটিক দরজা খুলে গেছিল। এবার অটোমেটিক দরজা বন্ধও হয়ে যাচ্ছে৷ রিম্মি বললো,
” এই রুমের দরজায় পাসওয়ার্ড নেই?”
” আছে। পাসওয়ার্ড আমার আইলক।”
” তারমানে আপনি তাকালেই খুলে যায়?”
” হুম।”
” অনেকটা মোবাইল লকের মতো তাইনা?”
” হুম।”
রিম্মি রুমটায় ঢুকে কয়েক সেকেন্ডের জন্য থমকে যায়। পুরো রুম জুড়ে একটা মিষ্টি সুভাষ। আর অজস্র গাদাগাদি যন্ত্রপাতিতে ঠাসা। তবে রুমের দৈর্ঘ্য বিশাল হওয়ায় দেখতে খারাপ লাগছে না। রিম্মির মনে হচ্ছে সে কোনো অফিসে চলে এসেছে। অবশ্য যন্ত্রপাতির সাথে এই স্মেলটা খুব মানাচ্ছে। চোখ বন্ধ করে শুধু নিঃশ্বাস নিতে ইচ্ছে করছে। চারপাশে নিলাভ কাচের বেষ্টনী দেওয়া। কোনো দেয়াল নেই। নীলাভ কাচের জন্য সাদা মেঝেটাও হালকা নীলাভ লাগছে। আবার জায়গায় জায়গায় কাচের পিলার। শপিংমলের লিফটের মতো। এগুলো লিফট কিনা বোঝা যাচ্ছে না। রিম্মি বললো,
” আপনি এই ঘরে থাকেন কিভাবে? বাহিরের মানুষ তো আপনাকে দেখে ফেলে। পর্দা লাগান নি কেন?”
” পর্দা লাগেনা। এই গ্লাস দিয়ে ভিতরে দেখা যায় না। শুধু বাহিরে দেখা যায়।”
” ও, ইন্টারেস্টিং। আচ্ছা এগুলো কি লিফট? নাকি শুধুই পিলার?”
” আলমিরা।”
” আলমিরা? তাহলে ফাঁকা কেন?”
” ফাঁকা না। এখানে অনেক মূল্যবান জিনিস আছে। তুমি খালি চোখে দেখবে না।”
” খালি চোখে দেখবো না মানে? ব্যাকটেরিয়া আটকে রেখেছেন? অণুবীক্ষণ যন্ত্র লাগবে নাকি?”
” না।”
” তাহলে? আপনার ওই চশমা পড়লে দেখতে পারবো?”
” আবার তিনশো ষাট ডিগ্রী অ্যাঙ্গেলে মাথা ঘুরানোর ইচ্ছে হচ্ছে?”
” না বাবা থাক। কিন্তু আমি জানতে চাইছি খালি চোখে দেখবো না কেনো?”
” কারণ আগেই বলেছি। এসব কাচে বাহিরে থেকে দেখা যায়না। ভিতর থেকে দেখা যায়।”
আমীরের সামনে অনেকবড় একটা সাদা ল্যাব ডেস্ক। ডেস্কটা লম্বাতে বড়। লম্বায় বলতে উচ্চতায় না, প্রস্থে। তবে দৈর্ঘ্য খুব বেশি না। এই ডেস্কের উপর অনেক জিনিস। কিন্তু সাজানো, গুছানো। দেখতে সুন্দর লাগছে। আমীর ডেস্ক থেকে একটা দূরবীনের মতো যন্ত্র নিয়ে বললো,
” এইটা দিয়ে দেখতে পারবে।”
” তাই? তাহলে দিন তো।”
আমীর যন্ত্রটা জায়গামতো রেখে বললো,” অসম্ভব। এসব দেখলে ভয় পাবে। এক চিৎকারে হার্ট অ্যাটাক। তারপর তোমার জায়গাও ওইখানে হবে।”
রিম্মি ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে হাতের ব্যাগ খামচে ধরে বললো,” মানে আপনার রুমে এসে যারা হার্ট অ্যাটাক করে ওদেরকে আপনি এই আলমিরাগুলোতে বন্ধী করে রাখেন?”
আমীর হেসে দিল,” আরে না, এ কথা তো আমি মজা করে বলেছি। রিম্মি বসো।”
একটা রকিং চেয়ার চলে আসলো। রিম্মি চেয়ারটায় বসতেই নিচে থেকে একটা স্ট্যান্ড বেরিয়ে আসলো। রিম্মি সেখানে পা রাখলো। ওর মাথাটা পেছনদিকে হেলে পড়লো। ঠান্ডা ঠান্ডা অনুভব হচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ মাথায় ম্যাসাজ করে দিচ্ছে। কি আরাম! রিম্মি ঘুমিয়ে পড়লো। আমীর জিজ্ঞেস করলো,
” কি খাবে বলো?”
একথা বলে রিম্মির দিকে ফিরতেই দেখলো মেয়েটা ঘুমাচ্ছে। আমীর মুচকি হেসে নিজের কাজে মনোযোগ দিল।
বেশ কয়েকঘন্টা পর রিম্মি ঘুম ভাঙে। সে নিভু নিভু চোখে তাকিয়ে চারপাশটা দেখে প্রথমে খুব ঘাবড়ে যায়। তারপর মনে পড়ে সে আমীরের বাসায় এসেছিল। আমীর ঠিক ওর বামসাইডের অনেকটা দূরে সাদা ডেস্কটায় বসে কি যেন লিখছে। আর মনে মনে বিড়বিড় করছে। রিম্মি হাই তুলতে তুলতে বললো,
” কয়টা বাজে?”
” সাতটা চল্লিশ।”
রিম্মি মাথায় হাত রেখে বললো,” হায় আল্লাহ, আমাকে আটটার মধ্যে বাসায় যেতে হবে। নাহলে মা ভেজে খাবে। ”
” চিন্তা কোরো না। আটটার মধ্যেই যেতে পারবে।”
” কিভাবে? বিশমিনিটে যাওয়া সম্ভব?”
” দশমিনিটেও সম্ভব। আওয়ানকে বলে দিবো। ও তোমাকে নিয়ে যাবে।”
” আওয়ান কি সুপারম্যান? যে দশমিনিটে আমাকে বাসায় পৌছে দিবে?”
আমীর হেসে বললো,” হ্যা সুপারম্যান।”
” আচ্ছা আপনি কি করছেন?”
” গ্রহ-নক্ষতের গতিবিধি মাপছি।”
” আপনার টেলিস্কোপ আছে?”
” আছে।”
” আমার না খুব শখ, টেলিস্কোপে নক্ষত্র দেখবো। দেখা যাবে?”
” নিশ্চয়ই যাবে। তুমি কি অ্যাস্ট্রোনোমি লাভার?”
” অনেক। কিন্তু আমি কমার্সের স্টুডেন্ট।”
” কমার্সের? সায়েন্স নিলে না কেন?”
” সায়েন্সে খরচ অনেক। ফিন্যান্সিয়াল প্রবলেম তার উপর মা নিতে দেয়নি। আমার ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার খুব ইচ্ছা ছিল। কিন্তু সেটা সম্ভব না।”
” কে বলেছে সম্ভব না? তুমি চাইলে আমার কাছে সায়েন্স পড়তে পারো। পড়বে?”
রিম্মি ফ্যাকাশে মুখে বললো,
” মা দিবে না।”
” মাকে জানানোরই দরকার কি?”
” মা না জানলে আপনার ফিস কে দিবে?”
” আমি কখন বললাম আমার ফিস লাগবে? কোনো ফিস টিস লাগবে না। আমি এমনিই পড়ানোর কথা বলছি।”
রিম্মি মুখ উজ্জ্বল করে বললো,” আমার নিজেকে খুব লাকি মনে হচ্ছে।”
” আসো আগে তোমাকে টেলিস্কোপে নতুন কিছু নক্ষত্রের সাথে পরিচয় করাই।”
” ওকে।”
আমীর রিম্মিকে নিয়ে একটা কোণায় দাড়ালো। যেখান থেকে আকাশ পরিষ্কারভাবে দেখা যায়। রিম্মি আগ্রহ নিয়ে টেলিস্কোপে চোখ রাখলো। দুইটা টেলিস্কোপ। একটা আমীর নিয়েছে অন্যটা রিম্মি। রিম্মি গর্জন করে বললো,
” ওয়াও, কি সুন্দর! ”
” তুমি যেটা এই মুহুর্তে দেখছো সেটার নাম কি জানো?”
” কি?”
” সাইরাস এ।”
” বেশ বড় লাগছে। এটা কি আসলেই এতো বড়?”
” সূর্যের থেকেও বড়?”
” সূর্যের থেকেও বড়? কিন্তু এতোবড় তো মনে হচ্ছে না।”
” দূরত্ব অনেক যে তাই। প্রায় ৮.৬১১ আলোকবর্ষ দূরে।”
” আচ্ছা, আলোকবর্ষ মানে কত সময়? আমি না ঠিক বুঝিনা।”
আমীর হেসে বললো,” আলোকবর্ষ মোটেও কোনো সময় না। এটা একটা দূরত্বের একক। মহাকাশে তো সবকিছুর দূরত্বই অনেক বেশি। তাই সেখানে কিলোমিটার বা মাইলে হিসাব করা সম্ভব না। তাহলে অঙ্কের পাশে শূন্য বসাতে বসাতেই দিন-রাত পার হয়ে যাবে। এজন্য প্রচলিত এককের চেয়ে অনেক বড় একটা একক জ্যাতির্বিদ্যায় ধরা হয়। যার নাম আলোকবর্ষ। কিন্তু এর নাম আলোকবর্ষ কেন হলো জানো?”
রিম্মি আগ্রহ নিয়ে বললো,” না। কেন?”
” শূন্যস্থানে আলো কোনো বাধা না পেয়ে এক বছরে যে দূরত্ব অতিক্রম করে সেটাই আলোকবর্ষ। আলো থেকে আলো আর বছর থেকে বর্ষ। আলোর বেগ প্রতি সেকেন্ডে ২,৯৯,৭৯২ কিলোমিটার। অর্থাৎ বুঝতেই পারছো এই আলোকবর্ষ আসলে কতবড় একটা পরিমাপ। এক আলোকবর্ষ প্রায় ৬ ট্রিলিয়ন মাইলের সমান। কিলোমিটারে হিসাব করলে প্রায় দশ ট্রিলিয়ন কিলোমিটার। মহাকাশের হিসাব নিকাশের জন্য কিন্তু আলোকবর্ষ মানে লাইট ইয়ারই ব্যবহার করা হয়না। আরও বড় হিসাব করতে গেলে কিলো লাইট লাগে। আরও বড় হলে মেগালাইট। সুপারগ্যালাক্টিক বিষয়াষের দূরত্ব মাপার জন্য তো মেগালাইটও হার মানে। তখন ব্যবহার হয় গিগালাইট। এছাড়াও একটা বহুল প্রচলিত একক হচ্ছে পারসেক। এটি মহাজাগতিক দূরত্বের একক। ১ পারসেক= ৩.২৬ আলোকবর্ষ। ”
” বাহ, আপনি কত কিছু জানেন। আমি তো এর আগে এসবের নামও শুনিনি।”
” এসো তোমাকে পারসেক বুঝাই।”
আমীর ওর ডেস্কে গিয়ে চেয়ারে বসলো। রিম্মি পেছন পেছন গিয়ে সামনে দাড়ালো। আমীর কলম ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বললো,
” পারসেক হচ্ছে প্যারাল্যাকটিক সেকেন্ড। এটা বুঝার জন্য একটা উদাহরণ দেওয়া যায়। তুমি এই কলমটা ধরো।”
রিম্মি কলম ধরলো। আমীর বললো,
” এবার ডানচোখ বন্ধ করে শুধু বামচোখ দিয়ে দেখো।”
রিম্মি দেখলো। আমীর বললো,” এবার ঠিক উল্টো কাজ করো। বামচোখ বন্ধ করে ডানচোখ দিয়ে দেখো।”
রিম্মি তাই করলো। আমীর হেসে বললো,
” কলমের অবস্থান পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না?”
রিম্মি দ্রুত মাথা নাড়লো। আমীর বললো,
” কলমটা কিন্তু স্থির ছিল। তবুও কেন এমন মনে হয়েছে? এটাই আসলে প্যারালাক্স বা দৃষ্টি বিভ্রম। যে দূরত্বের কোনো বস্তু এক আর্ক সেকেন্ডে কৌণিক দূরত্বের প্যারালাক্স তৈরী করে সেই দূরত্বকে এক পারসেক বলে। এবার বুঝেছো পারসেক কি?”
রিম্মি মাথা নাড়লো। আমীর বললো,
” এখনো বুঝিনি। আসো আরেকটু ডিটেইলস বলি।”
আমীর ড্রয়ার থেকে একটা চিত্র বের করে বললো,
” রিম্মি এই ছবিটার দিকে লক্ষ্য করো। চিত্রে দেখানো এই নক্ষত্রটার কথা ভাবি। ধরি এই নক্ষত্রটি সূর্যের কেন্দ্র থেকে পৃথিবীর কেন্দ্রে যে প্যারালক্স তৈরী করে তার কৌণিক দূরত্বের মান এক আর্ক সেকেন্ড। তাহলে সূর্য থেকে ওই নক্ষত্রের দূরত্বই হবে এক পারসেক। আর এক পারসেকের মান কিভাবে ৩.২৬ হয় তা ত্রিকোণমিতি থেকে বের করা যায়। এই দেখো,
ধরি সূর্য থেকে ওই নক্ষত্রের দূরত্ব d,
তাহলে ১ আর্ক সেকেন্ড, ১”= ১/৩৬০০ ডিগ্রী
tan(১/৩৬০০)= ১ জ্যাতির্বিদ্যা একক/d
=> tan(১/৩৬০০)= ১৫০০০০০০০/d
=>d=৩.২৬. ”

আমীর খাতায় অঙ্কটা করেছে। রিম্মির অঙ্ক দেখে খুব ঘুম আসছে। সাথে মাথাও ঘুরাচ্ছে। সে বললো,
” অনেককিছু শিখেছি আজকে। আর না হ্যা? বাসায় যেতে হবে৷ নাহলে মা বকবে। আওয়ান কোথায়? ওকে একটু ডাকুন। ও না আমাকে দিয়ে আসবে?”
” আওয়ান লাগবে না। আমিই তোমাকে দিয়ে আসবো।”
” ও, আচ্ছা। তাহলে চলুন।”
রিম্মি দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমীর ওর হাত ধরে বললো,
” দাঁড়াও রিম্মি। যে কারণে তোমাকে এখানে এনেছি সেই কাজটাই তো শেষ হয়নি।”
রিম্মি অবাক হয়ে জানতে চাইলো,” কি কাজ?”
” এদিকে এসো।”
আমীর রিম্মিকে হাতে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। রিম্মি খেয়াল করলো আমীর ওকে বিছানার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আমীরের বিছানাটা খুব বেশি বড় না। তবে একজনের জন্য পারফেক্ট। একটাই বালিশ। বিছানায় কালো চাদর। পাশে সোনালী রঙের ল্যাম্প টেবিল। আমীর ওকে ল্যাম্পটেবিলের সামনে দাঁড় করিয়ে বললো,
” এখানে দাঁড়াও।”
রিম্মি চুপচাপ দাড়ালো। আমীর বললো,
” একদম ভয় পাবেনা কিন্তু।”
রিম্মি বুকে সূক্ষ্ম চাপ অনুভব করলো। মাথা নেড়ে বললো সে ভয় পাবেনা। কিন্তু তার ভীষণ ভয় লাগছে। বুক দুরুদুরু করছে।

চলবে

( বেশি না, এমন বিশাল বিশাল আর দুই পর্ব হবে। তারপরেই অতীত শেষ। আবার বর্তমান শুরু।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here