#ধূসর_রঙে_আকাশ
#পর্ব_৩৬
লিখা: Sidratul Muntaz
( রোজাদার ব্যাক্তিরা এই পর্ব ইফতারের পর পড়বেন।)
শিউলি তোহার রুম থেকে বেরিয়ে ড্রয়িংরুমে গিয়ে বসলো। তার খুব কান্না পাচ্ছে৷ তোহাকে সে যা কিছু বলেছে তার মধ্যে সব সত্যি ছিল না। আংশিক সত্যি তো আংশিক মিথ্যা। কিছুদিন আগের কথা, শিউলি কাপড় রোদ দিতে ছাদে গিয়েছিল। এই একটা উদ্দেশ্যে সে প্রায়ই ছাদে যায়। আর রিম্মির সাথে দেখা হয়। মাত্র কয়েকদিনে ভালোই সম্পর্ক হয়েছে দু’জনের। শিউলির কাছে অবাক লাগে যখন রিম্মি ওর সাথে মস্তিষ্কের মাধ্যমে কথোপকথন চালায়। এটা নাকি ওর ম্যাজিক। আরও অনেক বিস্ময়কর কান্ড রিম্মি দেখিয়েছে শিউলিকে। যেমন ছাদের রেলিংএ উঠে স্বাচ্ছন্দ্যে হাঁটা, মাঝে মাঝে দৌড়ানো। কাপড়ের রসিতে বসে থাকা। আবার রসির উপর দিয়েও হাঁটা। দেয়ালে টিকটিকির মতো ঝুলে থাকা। এসব দেখে শিউলি অভিভূত। তার মনে হয়, একদিন হঠাৎ করে শুনবে রিম্মি মৃত ব্যাক্তি। এতোদিন সে একটা মৃত মানুষের সঙ্গে গল্প করতো। ব্যাপারটা খুব মজার হবে। একথা একা বসে চিন্তা করলে শিউলির গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায়। কিন্তু রিম্মির সামনে গেলে তার একটুও ভয় লাগে না। অথচ একা বসে যখন রিম্মির কথা সে চিন্তা করে তখনি ভয় লাগে। কারণটা সে নিজেও জানেনা। একদিন রিম্মি শিউলিকে ডেকে বললো,
” সত্যি কথা বলো শিউলি। তুমি প্র্যাগনেন্ট না?”
শিউলি বাকরুদ্ধ। রিম্মি প্রশ্ন করে ভয়ংকরভাবে হাসছে। শিউলি বললো,
” আপনি কেমনে জানলেন?”
” আমি সবজান্তা। সব বুঝি। তোমার মাথায় এখন কি চলছে সেটাও বুঝি। তুমি এখন ভাবছো, আমি তোমার প্র্যাগনেন্ট হওয়ার কাহিনি জানি কিনা৷ হ্যা সেটাও জানি। কিন্তু খবরদার, এই কথা ভুল করেও কাউকে বলবে না। তুমি যে প্র্যাগনেন্ট এটা যদি তোহা জানতে পারে তাহলে কিন্তু বাসা থেকে বের করে দিবে।”
” বাইর কইরা দিবো ক্যান?”
” ও তোমাকে বাসায় কেনো রেখেছে জানো? অবশ্যই কাজ করানোর জন্য। এখন যদি জানে তুমি অসুস্থ, তাহলে কি তোমাকে কাজে রাখতে চাইবে? তার চেয়েও বড় কথা ঝামেলা কেউই পছন্দ করেনা। প্র্যাগনেন্সির কথা জানলে তোমাকে খারাপ মেয়ে ভাববে। একটা অবিবাহিত মেয়ে প্র্যাগনেন্ট হওয়া মানে অনেক বড় ব্যাপার। ও জানলে তোমাকে অবশ্যই বের করে দিবে।”
” আমি এখন কি করমু আপা? বাইর কইরা দিলে যামু কই? আর এই খবর কি লুকায় রাখন যায়? একদিন না একদিন তো জানবোই।”
” এখনো তোমাকে দেখে কিছু বোঝা যায় না। যতদিন তোমার পেট বড় না হচ্ছে, তুমি তোহার কাছেই থাকো। শুধু কাউকে কিছু বুঝতে দিবে না, তাহলেই হবে। আর তুমি কি তোহার সাথে এক রুমে ঘুমাও?”
” হো আপা।”
” সর্বনাশ করেছে। এখনি রুম চেঞ্জ করো। ওর সাথে থাকবে না। তাহলে অতি শীঘ্রই ধরা পড়ে যাবে। এতো সহজে ধরা পড়লে কিন্তু চলবে না। তোমাকে কমপক্ষে একমাস ওই বাসায় থাকতে হবে। আর যখন একেবারেই লুকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না, তখন আমি তোমাকে আমার কাছে নিয়ে আসবো। ”
শিউলির মুখে উজ্জ্বল হাসি ফুটলো। সে ঘাড় নাড়িয়ে বললো,
” আচ্ছা আপু, আপনি অনেক ভালো। ”
রিম্মি মধুর মতো বললো,
” কিন্তু সেজন্য তোমাকে আমার একটা ইম্পোর্ট্যান্ট কাজ করে দিতে হবে আপু।”
” আইচ্ছা কইরা দিমু। অসুবিধা নাই।”
” কি কাজ সেটা শুনবে না?”
” যত কঠিন কাজই হোক আমি করমু। কন, কি কাজ?”
রিম্মি তখন শিউলিকে বলেছে তোহার কাছে বাচ্চা নিয়ে ধরা খেলে দোষ আমীরের ঘাড়ে চাপাতে হবে৷ এই শর্তেই রিম্মি ওকে নিজের বাসায় তুলবে। নাহলে না। শিউলি তার কথা রাখতে গিয়েও শেষ পর্যন্ত রাখতে পারলো না। ডাক্তারের কাছে গিয়ে ধরা খেয়ে গেল। সে এখানে পনেরো-বিশদিনের মতো আছে। অথচ তার পেটের বাচ্চার বয়স তিনমাস। কিভাবে অস্বীকার করবে? তার উপর তোহাকে সে এখন ভীষণ পায়। সব মিলিয়ে সত্যি স্বীকার করে ফেলেছে। এখন কি রিম্মি তাকে আশ্রয় দিবে? তোহা তাকে বাসা থেকে বের করে দিবে এ বিষয়ে শিউলি নিশ্চিত। কিন্তু রিম্মিও যদি আশ্রয় না দেয় তাহলে শিউলি যাবে কই?
তোহা আমীরের সামনে যাওয়ার সাহস আর করেনি। কাঁদতে কাঁদতে রাতে জ্বর চলে এসেছিল। এই জ্বর নিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে। সকালে যখন তার ঘুম ভাঙে সে দেখলো আমীরের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে। আমীর বিছানার একপাশে দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে বসে বসে ঘুমাচ্ছে৷ তোহার মাথাটা ওর কোলে নিয়ে রেখেছে। আমীরের একহাত তোহার চুলের ভাজে। ওর চোখে ভাঙা চশমাটা। এই নিদারুণ দৃশ্য দেখে তোহার কেন জানি ভীষণরকম কান্না পেল। শোয়া থেকে উঠে দূরে গিয়ে বসলো। হাটু জড়িয়ে ধরে কুকিয়ে কাঁদতে লাগলো। আমীর কান্নার আওয়াজে জেগে উঠে। ঘুম জড়ানো গলায় প্রশ্ন করলো,
” কাঁদছো কেনো তোহা?”
তোহা বার কয়েক হিঁচকি তুললো। ভারী দুঃখজনক গলায় বললো,
” আমাকে মাফ করে দিন প্লিজ। আপনার গায়ে হাত তুলে আমি অনেক বড় অপরাধ করেছি।”
আমীর ঠান্ডা গলায় বললো,” আচ্ছা।”
তোহা অবাক বিস্ময়ে বললো,” মাফ করেছেন!”
” হ্যা।”
আবারও কান্না শুরু করলো তোহা। আমীর বললো,
” এখন কি হলো?”
তোহা কান্না বজায় রেখে বললো,” আপনি কত ভালো। কি সহজে এতোবড় অন্যায় ক্ষমা করে দিলেন। আমার সাথে কেউ এমন করলে আমি কখনো এতো সহজে ক্ষমা করতাম না।”
” তাহলে কি করতে?”
” কঠিন শাস্তি দিতাম।”
” কি সেই শাস্তি?”
” কমপক্ষে এক সপ্তাহ তার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ রাখতাম।”
” তাহলে কি আমার উচিৎ এক সপ্তাহ তোমার সাথে কথা বলা বন্ধ রাখা?”
তোহা আঁৎকে উঠে বললো,” না একদমই না। তাহলে তো আমি মরেই যাবো। আপনি একঘণ্টা আমার সাথে না বললেই আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। মরে যেতে ইচ্ছে করে।”
আমীরের একটু মনখারাপ হয়ে গেল। যখন সে তোহাকে ছেড়ে সারাজীবনের জন্য চলে যাবে তখন কি করবে মেয়েটা? আমীর একঘণ্টা কথা না বললেই নাকি ওর দমবন্ধ হয়ে আসে। অথচ এমন সময় আসবে যে বছরের পর বছরও কথা হবেনা। তোহা হয়তো আমীরের কণ্ঠস্বরটাও ভুলে যাবে! তোহা বললো,
” শুনুন, আমি ঠিক করেছি শিউলিকে আর বাসায় রাখবো না। আস্তো একটা ফাজিল মেয়ে। ওকে আমি কোনো আশ্রমে পাঠিয়ে দিবো। মাসে মাসে থাকা-খাওয়ার খরচটা দিয়ে দিবো। কিন্তু আমাদের সাথে রাখবো না।”
” আচ্ছা, রেখো না।”
তোহা আমীরের কপালের ব্যান্ডেজে হাত রেখে আহ্লাদী গলায় বললো, ” আপনার খুব ব্যাথা লেগেছে তাইনা?”
” হ্যা, একটু।”
” খুব কষ্ট পেয়েছেন?”
” না। কষ্ট পাবো কেনো? তুমি তো রাগের মাথায় আউট অফ কন্ট্রোল ছিলে।”
” আপনিও কি রাগের মাথায় আউট অফ কন্ট্রোল হলে আমাকে মারবেন?”
” না।”
” আমি খুব খারাপ। আপনি রাগ উঠলেও আমাকে মারতেন না। কিন্তু আমি কত্ত খারাপ আচরণ করেছি আপনার সাথে। আসলেই আমি খারাপ। মারুন আমাকে।”
” মারবো কেন?”
” প্লিজ মারুন। নাহলে আমার শান্তি লাগবে না।”
আমীর হেসে ফেললো তোহার অদ্ভুত পাগলামী দেখে। ইশশ, কি সুন্দর সেই হাসি! সাদা ব্যান্ডেজ কপালে মানুষটার হাসি কত মোহনীয় দেখাচ্ছে। চোখ দুটো ফুলে ছোট হয়ে আছে। আরও ভালো লাগছে। আমীরকে দেখলেই শুধু তোহার মনে হয় আল্লাহর সৃষ্টি কত মাধুর্যময় হতে পারে। কত মহিমান্বিত হতে পারে। আল্লাহ কতটা যত্ন করে এই মানুষটিকে বানিয়েছেন। তাইতো সে এতো সুন্দর। অন্তত তোহার চোখে আমীর পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সুদর্শন পুরুষ। তোহা একটা ছেলেমানুষী কান্ড করে বসলো। নিষ্পলক দৃষ্টিতে আমীরের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে আনমনেই আমীরের দুই গালে হাত রেখে ঠোঁট চুমু দিল। আমীর কেঁপে উঠলো। এই অনুভূতি তার জন্য একদম প্রথম, সম্পূর্ণ নতুন! তোহা আমীরের ঠোঁটের স্পর্শ ছাড়লো না। অবিরত গভীর থেকে গভীর পরশ দিতেই থাকলো। আমীরের এখন উচিৎ তোহাকে ধাক্কা মেরে দূরে সরানো। অথবা এমন কিছু করা যেন তোহা জীবনে কখনো এই সাহস না করে। অথচ আমীর অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো, সে কিছুই করতে পারছে না। তার শরীর তার কথা শুনছে না। তোহার উষ্ণতায় ক্রমাগত ঘায়েল হতে ইচ্ছে করছে। ডুবতে ইচ্ছে করছে। তার হাত দুটো নিয়ন্ত্রণের বাহিরে গিয়ে কখন জানি তোহার পিঠ জড়িয়ে ধরেছে। ঠোঁট দুটোও কথা শুনছে না। প্রবল উৎসাহে তোহার কোমল ঠোঁটে লেপ্টে আছে। যেন ওরা কত বছরের তৃষ্ণার্ত। এ অবস্থায় মরে গেলেও কোনো দুঃখ থাকবে না। আমীরের হঠাৎ করেই মনে হলো তার এখন মরে যেতে ইচ্ছে করছে। সত্যিই ইচ্ছে করছে। কারণ বেঁচে থাকলে তাদের বিচ্ছেদ অবধারিত।সেই বিচ্ছেদের ব্যথা সহ্য করার চেয়ে মরে যাওয়াই অনেক সহজ। তোহার যখন হুঁশ ফিরলো এবং বুঝলো সে যা করছে তা ঠিক নয়, তখনি ছেড়ে দিল। কিন্তু আমীরের ঘোর কাটেনি তখনো, তৃষ্ণা মেটেনি তখনো। এবার সে নিজ উদ্যোগেই তোহার মুখটা দুইহাতে নিয়ে ঠোঁটে রুক্ষভাবে চুমু দিতে শুরু করলো। তোহার মনে হচ্ছে ওর ঠোঁট ছিন্নবিন্ন হয়ে যাচ্ছে। আমীর ওকে পেছন থেকে খুব শক্ত করে ধরে ওর গায়ের উপরেই হেলে পড়লো। তোহার শ্বাস-প্রশ্বাস সব আটকে গেছে। পৃথিবী অন্ধকার লাগছে। কারণ আমীর তাকে পুরোপুরি আবৃত করে ফেলেছে। ওকে আটকানোর সাধ্য বা ইচ্ছে কোনোটাই তোহার নেই৷ তার শুধু মনে হচ্ছে এতোদিনের অপেক্ষার সুদীর্ঘ ফল সে পেতে চলেছে। তোহা চোখ বন্ধ করে অদ্ভুত যন্ত্রণাময় সেই প্রশান্তি উপভোগ করতে লাগলো। এতো আনন্দ হচ্ছে কেন তার? এমন সুখ পৃথিবীর আর কোথাও কি আছে? আমীরের মনে হতে লাগলো সে তার ভেতরকার দুই সত্তার সাথে তুমুল যুদ্ধে মেতে উঠেছে। একসত্তা কঠোরভাবে আমীরকে বাধা প্রদান করছে। অন্যসত্তা বিপরীতভাবে সমর্থন করছে। সব মিলিয়ে মাথাটায় অসহ্য সন্তাপ বেধে গেল। আমীর একটা চিৎকার দিয়ে উঠে বসলো। তারপর কেমন ছটফট করতে লাগলো। যেন প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে ওর। তোহা শোয়া থেকে উঠে আমীরের গালে,গলায় হাত রেখে বললো,
” কি হলো আপনার?”
আমীর ঝারি মেরে তোহার হাত সরালো৷ তোহা অবাক নয়নে তাকালো। আমীর চেহারা শক্ত করে হঠাৎ তোহার গাল একহাতে চেপে ধরলো। তোহা ব্যথায় চোখমুখ খিচে নিল। আমীর পূর্ণ মেজাজী কণ্ঠে বললো,
” খবরদার আমার সামনে আসবে না। এর পরিণাম ভয়ংকর হবে।”
আমীর ঝারি মেরে তোহার গাল ছাড়লো। তারপর জায়গা ত্যাগ করলো। তোহা হতবাক হয়ে বসে আছে। খেয়াল করলো অবিরত তার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। গালের দুই সাইডে এতোই ব্যথা যে মুখ বন্ধ পর্যন্ত করা যাচ্ছে না। আমীর এমন কেন?
চলবে