ধূসর_রঙে_আকাশ #পর্ব_৪৫

0
1050

#ধূসর_রঙে_আকাশ
#পর্ব_৪৫
লিখা: Sidratul Muntaz

তোহা শিউলিকে অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার কথাটা বলেই ঘরে এসে থম মেরে বসে থাকে। সে কালকেই অস্ট্রেলিয়া যাবে কিন্তু কিভাবে যাবে সে জানেনা। শুধু জানে তাকে যেতেই হবে। না যেতে পারলে মন-মস্তিষ্কের এই দ্বন্দ্ব-বিরোধ কিছুতেই থামবে না। তোহা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। হাপুস নয়নে আকাশের দিকে তাকিয়ে অনেক জোরে শ্বাস ছাড়লো। এইযে বুকভরা এতো চাপ, এতো কষ্ট, বিষাদময় যন্ত্রণা, এ থেকে পরিত্রাণের উপায় কি? পাশের বারান্দাতেই নীলাভ্র একটা ডায়েরী হাতে আকাশের দিকে চেয়ে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন বুনছে। ওর চোখেমুখে বিশাল উচ্ছাস, কাল ওর জীবনটা আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে। এতোদিনের অপেক্ষা, সীমাহীন ধৈর্য্য, কিচ্ছু বিফলে যায়নি। ভালোবাসার অগ্নিপরীক্ষায় সে পূর্ণ সফলতা পেয়েছে।
তোহা ডানপাশের বারান্দা থেকে নীলাভ্রকে দেখে। বেশকিছু দিন নীলাভ্রর সাথে কথা হয়না৷ আমীরের মৃত্যুর পর থেকে যখন তোহা অস্বাভাবিক হয়ে গেছিল তখন নীলাভ্র রোজ আসতো ওর কাছে। তোহার সাথে বসে অনেক গল্প করতো। তোহাকে খুব যত্নে আগলে রাখতে চাইতো। ওর সামনে বসে দুইহাত ধরে চোখের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে বলতো,
” বন্ধু ভেবে মনের সব কষ্ট ঢেলে দে। তোর কষ্টের অন্তত একাংশ ভাগীদার আমি হতে চাই। কিসের এতো কষ্ট তোর? পিচ্চি মেয়েটার এতো কষ্ট কেনো থাকবে? এতো কষ্ট তোকে একলা সইতে দিবো না। আমারও ভাগ নেওয়ার অধিকার আছে। রক্তের সম্পর্কের অধিকার না হলেও আত্মিক সম্পর্কের অধিকার আছে। এই আত্মার টান মিথ্যে নয়। আমি তোর আত্মার ভাই, তুই আমার আত্মার বোন। ছোটবেলা থেকে তুই অনেক আদরের একমাত্র ছোটবোন। ”
তোহা কোনো জবাব দিতো না। নীলাভ্রর চোখের দিকেও হয়তো তাকাতো না। কেমন যেন মরা মরা হয়ে থাকতো। মনে হতো সত্যিই জ্যান্ত লাশ বসে আছে। নীলাভ্র হতাশ হয়ে নিজে নিজেই বিরবির করে চলে যেতো। তোহাকে অনেক কথা বলতো। তোহা সুযোগ পেয়েও মনের জমানো ব্যথাগুলো নীলাভ্রতে ঢেলে নিজেকে হালকা করতে পারতো না। কিন্তু নীলাভ্র পারতো, ওর জীবনের সব বেদনাদায়ক গল্প তোহার মধ্যে ঢেলে দিতে। এইটাও মনে হয় একটা ক্ষমতা। নিজেকে ভালো রাখার কৌশল। যা হয়তো সবার থাকে না। হয়তো নীলাভ্র তোহার কাছে এসেই বেঁচে থাকার শক্তি পেতো। তাইতো বারবার ছুটে আসতো। তোহার কাছে আসার আগে নীলাভ্রর মনে জমে থাকতো একরাশ পাহাড়ের মতো শক্ত, ভারী, তিক্ত যন্ত্রণাবোধ। কিন্তু তোহার কাছে এসে যখন সব বলতো, মনে হতো পাহাড় গলে পানি হয়ে গেছে। মন বিষাদের সাগরে কখন যেন ধুয়ে মুছে মিলিয়ে যেতো কষ্টগুলো। কখনো জোয়ার কখনো ভাটা। ভীষণ চাপের মধ্যে থেকেও নীলাভ্র হাসতে পারতো। তার জীবনটা প্রায় দূর্বিষহ হয়ে পড়েছিল তবুও, সুইসাইড করাই তার জন্য জীবনের শেষ উদ্দেশ্য হতে যাচ্ছিল তবুও, সেই সম্ভাবনা রোধ করে, ডিপ্রেশন কমিয়ে, তোহার অন্ধকার ঘরে বসে মিনমিনে গলায় আপনখেয়ালে সকল কষ্টের কথা একনাগাড়ে বলে বিসর্জন দিয়ে ফেলতো। মনটা তখন ম্যাজিকের মতো শান্ত হয়ে যেতো। তোহা মেঝেতে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে শুধু শুনতো আর শুনতো। কোনো জবাব কখনো দিতো না। নীলাভ্রর মাঝে মাঝে ধারণা হতো তোহা কিচ্ছু শুনছে না। তাও সে জোর করে মনকে বুঝ দিতো, তোহা শুনছে। তার কষ্টে কষ্টও পাচ্ছে। ওইতো কাঁদছে। কেউ একজন অন্তত আছে, যে তার কষ্টগুলোর ভাগীদার হচ্ছে। তোহা নিজের চিন্তাজগতে ডুবে থেকেও নীলাভ্রকে ঠিকই শুনতে পাচ্ছে। কেউ একজন তার জমানো ব্যথার ভার একইভাবে উপলব্ধি করছে এমন অনুভূতিতেও একটা অপরিমিত সুখমিশ্রিত। নীলাভ্র এভাবেই মনঃকষ্টের ভার কমিয়ে স্বাভাবিক হয়ে যায়। একদম অক্ষরে অক্ষরে সব বলতো তোহাকে সে। নাহলে মনের জমানো ভারী কষ্টের পাহাড়টা টলাবে কিভাবে?

তোহা মনে করার চেষ্টা করছে। নীলাভ্র যেন কি বলতো? নিবরাস ভাইয়ের মৃত্যুর পর মাথার উপর থেকে যেন বটগাছের মতো ছায়াটা সরে গেছে। প্রখর রোদের কঠিন উত্তাপ কতটা অসহনীয় ছিল এবার সেটা উপলব্ধি হয়। বাবাহীন অনাথ ছেলেটি তার বড়ভাইকে বাবার আসনে বসিয়ে ভালোবেসেছে আজীবন। এখন সেই বাবার মতো বড়ভাই আর নেই। মাথার উপর শক্তিশালী হাতটা নেই। নিজেকে বড় অসহায় মনে হয়। মায়ের মতো যত্ন করতো যে ভাবী, সেও কেমন উদাসীনি হয়ে গেছে। তার নিজের জীবনের উৎসটাই যেন খুঁইয়ে গেছে। ছেলেহারা মা, সারাক্ষণ শুধু কাঁদে। ওই কান্না দেখলে পৃথিবীর কোনো সুখকেই আর সুখ মনে হয়না। সব বিষাদময় হয়ে যায়। জীবন হয়ে পড়ে ছন্দহীন, শুকিয়ে যাওয়া নদীর মতো। কি অদ্ভুত! একমাত্র রিম্মির সংস্পর্শে আসলে একটু প্রশান্তি মিলতো। রিম্মি যখন নীরবে, নিভৃতে নীলাভ্রর মাথায় বিলি কেটে বলতো,
” ধৈর্য্য ধরো, সময় সবকিছু পাল্টে দেয়। আঁধারের পরেই আলো আসে। সুখ পেতে গেলে আগে কষ্টকে বরণ করতে হয়।”
নীলাভ্রর তখন ভালো লাগতো রিম্মির মস্তিষ্কের বার্তা শুনতে। রিম্মি শব্দহীন ছিল। তার হয়তো নিজস্ব কণ্ঠ ছিল না। কিন্তু রিম্মি যখন বার্তা পাঠাতো নীলাভ্র নিজের মনেই রিম্মির কণ্ঠের ছন্দে হারিয়ে যেতো। মনে হতো এর চেয়ে মোহনীয় সুর পৃথিবীর আর কোনো জায়গায় নেই। পৃথিবীর সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ সুর হলো নীলাভ্রর কল্পনায় রিম্মির কণ্ঠস্বর! এই মেয়েটা নীলাভ্রর জীবনের সুখের অবলম্বন। নীলাভ্র রিম্মির জীবনে শান্তির উৎস। একজন- আরেকজনের পরিপূরক! অথচ এই বন্ধনও ছিন্ন হয় নিয়তির চক্রান্তে। বাস্তবের নির্মম পরিহাসে পিষ্ট হয় ভালোবাসার স্বর্গীয় অনুভূতি। নীলাভ্রর মা হঠাৎ করেই জেদ ধরে বসেছিলেন তিলোত্তমার সাথে নীলাভ্রর বিয়ে দিতে। উদ্দেশ্য হলো নিবরাসের রেখে যাওয়া সম্পত্তি রক্ষা। উনি বড় ছেলের তিল তিল করে গড়া কষ্টের অর্জন অন্যকারো হাতে সঁপে দিতে নারাজ। কিন্তু মৃত ছেলের ঘাম ঝড়ানো পরিশ্রমের সুফল রক্ষা করতে গিয়ে জীবিত ছেলেটার জীবনের সব সুখ মাটিচাপা দিয়ে দিচ্ছেন। এই নির্মম সত্যিটা উনাকে বোঝায় কে?
রিম্মির জীবনটা ছোটবেলা থেকেই সুখহীন। জীবনে কত কষ্ট যে পেয়েছে মেয়েটা! এই দুঃখী মেয়েকে বাকি জীবন সুখী রাখার দায়িত্ব নিজের ঘাড়ে তুলে নিতে চেয়েছিল নীলাভ্র। অথচ ভাগ্য তার সহায় হলো না৷ এতো নির্দয় পরিণতি কেন হলো তাদের ভালোবাসার? সারাক্ষণ মায়ের সাথে এসব নিয়ে ঝগড়া হতো নীলাভ্রর। ডিপেশনের লাস্ট স্টেজে ডুবে যাচ্ছিল সে। রিম্মি অনেক বেশি পাগলামী করতো। নীলাভ্রকে সে পাগলের মতোই ভালোবাসতো। একবার রিম্মির একটা কথা নীলাভ্রর মনে খুব দাগ কেটেছিল। এই কথায় বাচ্চা ছেলের মতো কেঁদে ফেলেছিল নীলাভ্র।
‘ তিলু ভাবীকে বিয়ে করো। সমস্যা নেই। কিন্তু তোমাদের সংসারের কোনো ছোট্ট কোণায় আমাকেও কি একটু জায়গা করে দেওয়া যায়? আন্টিকে বলে দেখো, রাজি হয় কিনা।”
কতটা অসহায় পর্যায়ে গেলে একটা মেয়ে নিজের ভালোবাসার মানুষকে ভাগ করতেও রাজি হয়ে যেতে পারে। রিম্মিকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে সে কষ্ট পাচ্ছে। কিন্তু তার মনের নিস্তব্ধ অভিব্যক্তিগুলো শুনলে স্বাভাবিক থাকা যায়না। নীলাভ্র বড্ড এলোমেলো হয়ে পড়ে। তখন সত্যিই মনে হয় রিম্মিকে কষ্ট দেওয়ার চেয়ে মৃত্যুবরণ শ্রেয়। তাদের জীবনের এই অবাধ ঝড়ের তান্ডব থেমে যায় তিলোত্তমার আগমনে। সে হঠাৎ করেই নিবরাসের ব্যাংকে জমানো টাকা, বাড়ি, আরও যাবতীয় সম্পত্তি সব একটা উকিলের মাধ্যমে নীলাভ্রর নামে করে দেয়। এর বিনিময়ে শর্ত হলো, তার গর্ভে যে বাচ্চাটা আছে তার দায়িত্ব রিম্মি নীলাভ্রকে নিতে হবে। তিলোত্তমা নিবরাসের কোনো চিহ্ন নিজের কাছে রাখতে চায়না। সে হয়তো জীবনের নতুন ঠিকানা খুঁজে পেয়েছে। নীলাভ্রর অনেক মনখারাপ হয়। তার ধারণা ছিল তিলোত্তমা ভাবী ভাইয়াকে অনেক ভালোবাসে! অথচ ভাইয়ার মৃত্যুর মাত্র কয়েকমাস পরই ভাইয়ার সমস্ত স্মৃতি বোঝা মনে করছে। এখন সবকিছু থেকে সে মুক্তি চায়! সত্যিই দুঃখজনক। তার তো উচিৎ ছিল নিবরাসের একমাত্র অবলম্বন, তার গর্ভের সন্তানকে আঁকড়ে ধরে বাঁচা। যেমন বাচ্চা মেয়ে তোহা বেঁচে আছে। তার সাথে তো আমীরের বিয়েও হয়নি। আমীর নাকি কখনো তাকে স্ত্রী হিসেবে মর্যাদাও দেয়নি। তাও মেয়েটা কাল্পনিক স্বামীকে এতোই ভালোবাসে যে তার ভাঙা চশমাটা পর্যন্ত যত্নে রেখে দিয়েছে। তার বাঁচার একমাত্র অবলম্বনই আমীরের লিখে যাওয়া শেষ চিঠি। আর অন্যদিকে নিবরাস তো তিলোত্তমাকে কম ভালোবাসেনি! বউ তার কাছে এতোই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে কষ্টের সব সম্পত্তি বউয়ের নামে রেখে গেছে। তার নিজের বলে কিচ্ছু নেই। নীলাভ্র আর মারুফা ইয়াসমিনের নামেও নিবরাস একটা ফিক্স ডিপোজিট করতো। সেটা ওর মৃত্যুর পরে জানা যায়। নীলাভ্র কখনো বড় কোনো বিপদে পড়লে ওই টাকার মাধ্যমে ও আর্থিকভাবে অনেক সাপোর্ট পাবে। সেখানে ভালো পরিমাণ টাকাই আছে। মায়ের শেষ বয়সের শখ-আহ্লাদ পূরণের জন্যও যথেষ্ট। কি অদ্ভুত! মানুষটা যেন জানতো সে মরে যাবে। তাই সবকিছু এতো সুন্দরভাবে গুছিয়ে দিয়ে গেছে। নিঃস্বার্থভাবে পরিবারের জন্য গাঁধার মতো খেটেছে। নিজের জন্য তো কোনোদিন কিচ্ছু করেনি। একেই হয়তো বলে পরিবারের বড় ছেলে। গাঁধার মতো বড় ছেলে! অথচ তিলু ভাবী এইটা কি করলো? মানুষটাকে এতো সহজে ভুলে যেতে পারলো?
যাইহোক, রিম্মির কথামতো সত্যিই আঁধারের পর আলোর আগমন ঘটেছে। কালকেই রিম্মি-নীলাভ্রর পারিবারিকভাবে আকদ হয়ে যাবে। তারপর থেকে দুজনের নতুন জীবন শুরু। আজকেই হয়তো নীলাভ্রর ব্যাচেলর লাইফের শেষরাত। কাল থেকে সে হবে বিবাহিত পুরুষ! ভাবতেই অদ্ভুত আনন্দ লাগছে। ডায়েরী হাতে নিয়ে রিম্মির প্রিয় জিনিসগুলো কিনে ফেলার একটা লিস্ট বানাচ্ছিল নীলাভ্র। তখনি তোহা পাশের বারান্দা থেকে স্থির গলায় ডাকে,
” নীল ভাইয়া।”
নীলাভ্র হঠাৎ তোহার কণ্ঠ শুনে চমকে যায়। মুখ দিয়ে অদ্ভুত শব্দ বের করে বুকে থুতু দিয়ে ধমকের মতো বললো,
” ভয় পাইয়ে দিয়েছিলি। এইভাবে কেউ ডাকে? আচ্ছা কি হয়েছিল রে তোর? একটু আগেই ষাঁড়ের মতো চিল্লাচল্লি করছিলি। আবার ভূত দেখেছিস নাকি?তোর সাইন্টিস্ট ভূত জামাই কি তোর উপর নতুন এক্সপেরিমেন্ট করতে এসেছিল?”
তোহা মনখারাপ করে তাকিয়ে থাকে৷ প্রশ্নের উত্তর দেয় না। নীলাভ্রর মনে হয়, এইভাবে মজা করা ঠিক হয়নি৷ তোহাকে আমীরের কথা মনে করালেই তো কষ্ট পায়। আচ্ছা মনে করানোর কি আছে?সে কি এক মুহুর্তের জন্যও আমীরকে ভুলতে পারে? যদি পারতো, তাহলে অন্তত এক মুহুর্তের জন্য হলেও মানসিক চাপ থেকে নিস্তার পেতো।
তোহা মনে করার চেষ্টা করলো সে যেন নীলাভ্রকে কেন ডেকেছে? ও হ্যা, রিম্মি-নীলাভ্রর বিয়ের খবর জানতে ডেকেছে। তোহা শুধু এতটুকু জানে মারুফা আন্টি নীলাভ্র-রিম্মির বিয়েতে মত দিয়েছে। কিন্তু বিয়ে কবে ঠিক হয়েছে সেটা তো জানে না। তাই জিজ্ঞেস করলো,
” তোমার বিয়ের কি খবর ভাইয়া?”
” আমার খবর তো ভালোই রে পাগলী। আগামীকাল রিম্মির সাথে আকদ হয়ে যাবে। ”
তোহা মলিনমুখে একটু হাসি আনার চেষ্টা করলো,” সত্যি?”
” আমার চেহারার দিকে ভালো করে তাকালেই বুঝবি সত্যি না মিথ্যা। লুকটা দেখ, একদম নতুন জামাই লাগছি না?”
কষ্টের মধ্যেও তোহা নীলাভ্রর মজার কথায় হাসি দিল। নীলাভ্র বললো,
” তোর খবর কি?”
” আজকে তার সাথে দেখা হয়েছিল।”
” স্বপ্নে?”
” না, বাস্তবে।”
নীলাভ্র ডায়েরিটা স্লো মোশনে বারান্দার ভাঙা টেবিলে রেখে চেয়ারে বসে বললো,
” আইসসা.. এজন্যই কি আন্টি-আঙ্কেল তোকে ওই পাগলের ডাক্তার থুক্কু সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাতে নিয়ে গেছিল?”
তোহা বারান্দার গ্রিল শক্ত করে চেপে ধরে বললো,” আমি মজা করছি না ভাইয়া।”
নীলাভ্র স্ট্যাচুর মতো হতভম্ব গলায় বললো,” ও আচ্ছা, আসলেই দেখেছিস? বেটা সাইন্টিস্ট কি তাহলে মরেনি?”
তোহা ছলছল চোখে বিকৃত মুখে বললো,” ও মরলে তুমি খুশি হবে?”
নীলাভ্র একটু চমকে উঠলো। না তো, আমীর মরলে সে খুশি হবে কেন? রিম্মির বিষাদময় জীবনের গল্প শোনার পর থেকে আমীরের প্রতি তার মনে একটা তীব্র ক্ষোভ চেপে গিয়েছিল ঠিকই। কিন্তু এখন তো রিম্মি আমীরের কবল থেকে পুরোপুরি মুক্ত! তবে রিম্মি শুধু আমীরের মৃত্যুর জন্য ওর হাত থেকে মুক্তি পায়নি। আসলে আমীর সুইসাইড করার আগেই রিম্মিকে মুক্ত করে দিয়েছিল। এখন রিম্মিকে সারাজীবনের জন্য আপন করে নীলাভ্র পেতে যাচ্ছে। তাই মৃত আমীরের প্রতি বেহুদা ক্ষোভ চেপে রাখার কোনো কারণ নেই। তবুও একজন মৃত মানুষ একবার মরে গিয়ে আবার ফিরে আসে কিভাবে? আচ্ছা, নিবরাস ভাইও কি ফিরে আসতে পারে?
তোহা বললো,
” আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি ভাইয়া।”
” কি সিদ্ধান্ত নিয়েছিস?”
” কালকেই অস্ট্রেলিয়া যাবো। আমীরের কবর নিজচোখে দেখে আসবো। জানিনা কেন, কিন্তু এখানে আমার মন টিকছে না। মনে হচ্ছে ওখানে বিরাট কিছু ঘটে যাচ্ছে। আমি অস্ট্রেলিয়া যাবোই।”
নীলাভ্র চিন্তিত গলায় বললো,” কি বলছিস এসব?”
তারপর হঠাৎ করে বললো,” ওহ, তোর ভাবীই তো কালকে অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছে। তুই চাইলে ওর সাথে যেতে পারিস। যাবি নাকি?”
” তিলু ভাবী অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছে?”
নীলাভ্র অসন্তুষ্ট হয়ে বললো,
” তিলু ভাবী কেন? তোর কি শুধু একটাই ভাবী? আর ভাবী নেই?”
” আরেকটা ভাবী আবার কে?”
” রিম্মির কথা বলছি।”
” রিম্মিআপু অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছে? কেনো?”
” ওর নাকি মোস্ট ইম্পোর্ট্যান্ট কাজ আছে। বিয়ের আগেই কাজ শেষ করতে হবে।”
নীলাভ্র কথাটা বলে ঠোঁট উল্টালো। অর্থ এর বেশি সে কিছু জানেনা। তোহা প্রশ্ন করলো,
” তোমাদের না কালকে আকদ? তাহলে ও কাল অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছে কিভাবে?”
” সকাল সকাল যাবে, সন্ধ্যার মধ্যে ফিরে আসবে। আকদের আয়োজন তো সন্ধ্যায়।”
” সকাল সকাল গিয়ে সন্ধ্যার মধ্যে কিভাবে ফিরবে?”
” ও হচ্ছে আমার অপশরী। ও সব পারে।”
তোহার হঠাৎ মনে হলো, রিম্মির সাহায্য ওর বিশেষভাবে দরকার। তোহা বারান্দা থেকে এক দৌড়ে চলে গেল। নীলাভ্র তাড়াহুড়ো করে বললো,
” আরে, কই যাচ্ছিস?”
তোহা যে অবস্থায় ছিল সেই অবস্থাতেই ঘর থেকে বের হয়ে যায়। এলোমেলো শাড়ি মেঝতে ছুঁয়ে যাচ্ছে। তোহার এলোমেলো চুলগুলো প্রবল বেগে উড়ছে। দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে লাভলী আর জাবিদ সাহেব ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। পূরবী আর শিউলি ড্রয়িংরুমেই বসেছিল। তোহা যখন বের হচ্ছিল, ওদের মনে হয় খুব জোরে একটা সাইক্লোন চোখের দৃষ্টি ফসকে তুমুল বেগে ধেঁয়ে গেল। সবাই হতবাক হয়ে চেয়ে থাকে। তোহাকে আটকাতেও পারেনা। রিম্মিদের বাসায় গিয়ে তোহা কম্পনরত আঙুল দিয়ে কলিংবেল চাপলো। রিম্মি সাথে সাথে দরজা খুললো। তোহার বেহাল অবস্থা দেখে চুপচাপ চেয়ে রইল। তোহা হাঁপাতে হাঁপাতে খুব অস্থির গলায় বললো,
” ভাইয়া বললো তুমি নাকি কাল অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছো?আমাকেও নিয়ে যাবে তোমার সাথে? প্লিজ।”
তোহা অসহায়ের মতো হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে আছে রিম্মির সামনে। ক্লান্তিতে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে ও। আর চোখ দিয়ে শুধু অশ্রুপাত হচ্ছে। রিম্মি কঠিন মুখভঙ্গি করে তোহার মস্তিষ্কে সচল বার্তা দিল,” না।”
একথা বলে দরজাটা খোলা রেখেই রিম্মি ভেতরে চলে গেল। যেন সে চাইছে তোহাও ভেতরে যাক। তোহা দ্রুত পা থেকে স্যান্ডেলগুলি খুলে ভিতরে ঢুকলো। শাড়ির সাথে পা পেচিয়ে উষ্টা খেতে নিচ্ছিল। তারপরও নিজেকে সামলে নিল। সে দিশেহারা হয়ে পড়েছে। অস্ট্রেলিয়া তাকে যেতেই হবে!
রিম্মি ঘরে ঢুকে শান্ত হয়ে বসে আছে। সে চিন্তা করছে অনেককিছু। তোহার অবস্থা দেখে রিম্মির প্রতিনিয়ত মায়া লাগে। কিন্তু আমীর তোহার ভালোবাসাটা বুঝলোই না। রিম্মির হঠাৎ করেই মনে হয় পৃথিবীতে এমনকিছু মানুষ আছে যাদের কখনো পিছুটান তৈরী করতে নেই। কারণ তাদের জীবনটা তাদের নিজের জন্য না। শুধুই মানবকল্যাণে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার জন্য তাদের জন্ম হয়েছে। আমীর হয়তো সেরকমই একজন মানুষ। তার অসীম সাহস! নাহলে কি সাধেই এমন সর্বনাশের খেলায় মেতে উঠেছে?

চলবে

( এই গল্পে আলোচনা করবো আমার সবচেয়ে প্রিয় থিউরি নিয়ে। যেটা আমীর অনেক আগেই রিম্মিকে বুঝিয়েছিল। আপনারা যদি স্টাডি রিলেটেড পার্টগুলো বুঝে পড়তেন, তাহলে মনে হয় এতোক্ষণে অনেক কিছু বুঝে ফেলতেন। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত কেউই সাইন্টিফিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করছে না। সবাই খালি আমীর-তোহার মিল হওয়া নিয়ে বসে আছে।😐

আর কিছু না বুঝলেও প্রবলেম নেই। রহস্যগুলো ইঞ্জয় করতে থাকুন। কাহিনি অনেক মজার। আশা করি, আপনাদেরও মজা লাগবে।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here